#বিধ্বস্ত_অনুভূতি
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্ব-১০
গাইনী বিভাগের সামনে বসে অনবরত দুলছে নীলিমা। মনে মনে শুধু আল্লাহ্ কে ডাকছে।
অবচেতন মন বার বার বলছে
“অনির বলেছে তন্দ্রা মেনে নিলে তাকে সম্মান দিবে, বিয়ে করবে যদি তন্দ্রা মেনে না নেয়?সম্মতি না দেয়?
তাহলে কে তার সন্তানকে পরিচয় দিবে?বাবার আদর পাবে?তার সন্তানের বাবার আদর ভাগ হয়ে যাবে।
অনিরকে ইচ্ছে হলেই কাছে পাবে না তার সন্তান।”
গভীর চিন্তায় মগ্ন নীলিমা এখন বুঝতে পারছে তন্দ্রার পরিস্থিতি।নিজেকে আজ তন্দ্রার জায়গায় পেয়ে তার উপলব্ধি হচ্ছে তন্দ্রা বিগত কয়েকটা মাস কতটা যন্ত্রণা সহ্য করেছে।
“আপু আপনি তো শিক্ষিত, চাকরি করেন। আপনাদের বিয়েও হয়নি।কিন্তু আমার সন্তানের কথা চিন্তা করে অন্তত আমার স্বামীকে আমায় দিয়ে দিন।”
সেদিনের তন্দ্রার আকুতিভরা টলটলে দৃষ্টি বার বার ভেসে উঠছে নীলিমার মানসপটে।
অনির কখন এসেছে সেদিকে কোনো খেয়াল ছিল না নীলিমার।
সিরিয়ালের ডাক পড়তেই উঠে দাঁড়ায় সে। পাশে অনিরকে দেখেও তার কোনো ভাবান্তর হলো না।
স্ত্রী বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট দেখে জানালেন রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। কথাটা শুনে নীলিমা যেন প্রাণ ফিরে পেলো।
ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায় নীলিমা।পুরোটা সময় অনিরের সাথে কোনো কথা বলেনি।রিক্সা ডেকে রিক্সায় উঠে বসে নীলিমা।
রিক্সা ওয়ালাকে বলল কিছুক্ষণ দাঁড়াতে। অনির তার থেকে কিছুটা দূরে ছিল।কাছাকাছি আসতেই নীলিমা বলল,
“আপনি আমার জীবনে সেই সুখের মুহূর্ত যা আমি ভুলে যেতে চাইলেও পারবো না।তবে আমাকে ভুলতে হবে।কারণ অনির নামক বিষাক্ত অনুভূতি থেকে আমার মুক্তি চাই।অন্তত আর কোনো মেয়ের সাথে এমন করবেন না।তন্দ্রা ভালো মেয়ে। তাকে ভালোবাসতে শিখুন।আমাদের গন্তব্য এক হতে পারে না।তাই আমাকে মাফ করবেন।”
আমাদের জীবন বড়ই অদ্ভুদ। আমরা যখন যা পাই তা চাই না।অথচ আমাদের আপন পাওয়াতেই সন্তুষ্ট থাকা প্রয়োজন। আজ অনির নীলিমাকে আটকে রাখেনি।কারণ তার মনে এখন শুধুই তন্দ্রাকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে।
একটা ভয়,নিরাশা ঘিরে ধরেছে তাকে। সে ভেবেছিল আর যাই হোক তন্দ্রা তাকে ছাড়বে না কিন্তু সে ভুল প্রমাণিত হলো।
নিজের সকল সম্পত্তির অধিকার তন্দ্রাকে দেওয়ার পরেও সে ফিরেনি।তন্দ্রা এসব কিছুই চায় না।সে তার ভাইয়ের কাছে আছে। তন্দ্রার আট মাস চলছে৷
তন্দ্রা আরেকটু কঠিন হৃদয়ের অধিকারী সেদিন হলো যেদিন সে জানতে পারে সে কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে।
অনিরের মা এসে তন্দ্রার সাথে কথা বলেছে। তন্দ্রা তার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি তবুও ফিরে যাবে কী না এই বিষয়েও কিছু বলেনি।
স্বামীর সংসারে ফিরবে না বলে নবনীতাকে কম কথা শোনায়নি তন্দ্রার মা।তার ধারণা নবনীতা তাকে কানপড়া দিয়েছে এসব করার জন্য।
তন্দ্রা সব সময় মন মরা হয়ে থাকতো তাই তার ভাই তার জন্য কাঁদা মাটি এনে দিতো কারণ তন্দ্রার ছোট বেলায় অভ্যেস ছিল মাটি দিয়ে জিনিসপত্র বানানোর।
একদিন বিকেলে নবনীতা বাসায় ছিল না, ভাই তখন বাহিরে। বাসার কাজের মহিলার বাচ্চা মেয়ের জন্য দুটো ছোট্ট চায়ের কাপ বানিয়েছিল তন্দ্রা।
নবনীতা ফিরে সেই মাটির কাপ জোড়া দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল সে।
পর দিন প্রয়োজনীয় বাকী জিনিসপত্র কিনে আনে নবনীতা। তার সর্বক্ষণের সঙ্গী কাজের মহিলার সাত বছরের ছেলেটা।
তন্দ্রার সকল কাজে সাহায্য করে দুই দিনের মধ্যে তারা তৈরী করে ফেলে এক সেট মাটির চায়ের কাপ।
পুরো ৪৫০ টাকা দিয়ে সেই চায়ের কাপের সেট কিনে নেয় নবনীতা। এবং উপহার দেয় তার এক কলিগকে। মাত্র কয়েক দিনের মাঝেই বেশ কয়েকটি অর্ডার পায় সে।
শখের বশে করা কাজ আজ তার পরিচয় হতে চলেছে কিন্তু ভারী পেট নিয়ে সমস্যা হয় তার। কষ্ট লাগে, ক্লান্ত লাগে। তবুও সে প্রকাশ করে না। নবনীতা বুঝে, সে যত্নের কমতি রাখছে না তবুও তন্দ্রার একাকীত্ব যে একান্ত ব্যক্তিগত।
তার ভাই পুরো সকাল তন্দ্রার কাজে সাহায্য করে। আর পুরো বিকেল তন্দ্রার নিয়ম করে বিশ্রাম, হাটতে যাওয়া রুটিন।
রাস্তায় নেমেই সে অনিরকে।খোঁজে। অবচেতন মন বার বার চায় সে আসুক। বার বার আসুক। এসে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ করুক আমায়। অথচ অনিরের দেখা পায় না।
অনির থাকে তার আশেপাশে থাকে। কখনো তার ভাইয়ের বাসার গেটের সামনে কখনো বা পার্কের চন্দ্রপ্রভা গাছের আড়ালে।
দেখতে দেখতে দিন ঘনিয়ে এলো।তন্দ্রা জন্ম দিলো এক কন্যা সন্তান।
সেদিন হাসপাতালে কেউ ছিল না তন্দ্রার পরিবারের। কারণ যে মেয়ে স্বামী মাফ চাওয়ার পর তার সাথে থাকবে না, বেল্লাপনা করবে তার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখা যায় না। তবে তন্দ্রার ননদ জামাই,শাশুড়ি, নবনীতা এবং তার ভাই ছিল।
অনিরের কোলে তার সদ্য জন্মানো কন্যা।সে দুচোখ ভরে তাকে দেখছে। অনিরের চোখ থেকে তখন টুপ টুপ পানি ঝরছে।
তন্দ্রার এক মন বলছে মাফ করে দে অনির কে। সে তো ভুল বুঝতে পেরেছে কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে সেই বস্তির ঘরের নীলিমার সাথে তাকে দেখার সেই দৃশ্য।
সে জানে না তার নিয়তিতে কি আছে, তার কি করা উচিৎ। তবে সে সম্মানের সাথে বাঁচতে চায়। তার মেয়েকে সকল সুখ দিতে চায়,কিন্তু নিজের আত্নসম্মানের বিনিময়ে নয়। তন্দ্রা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,
আর একচুল ছাড় নয়। মানুষের মতোন বাঁঁচবো। মেয়েকে মাইয়্যা মানুষ নয়,মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো।
সমাপ্ত।