বিধ্বস্ত অনুভূতি পর্ব-৭+৮+৯

0
4588

#বিধ্বস্ত_অনুভূতি
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্ব-৭+৮+৯

“তোমারে আমি বলতেছি।আমার কথা কিন্তু ফলবো।মিলাইয়া নিও। তুমি যদি আমার পোলার নামে তোমার ভাইয়ের ঠেন কিছু কইছো তাইলে তোমার পেটের বাচ্চা বাচব না। এই আমি কইয়া দিলাম। আমি কিন্তু মা। আমার মুখের কথা বের হওয়ার আগেই আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হইবে।”

কথা শেষ করে অনিরের মা ফোন কেটে দিলেন।অপর পাশে তন্দ্রা ফোন কানে ধরে বসে রইল।
তার শাশুড়ি কল করে সরাসরি অভিশাপ দিচ্ছিলো।সে যদি অনিরের কথা কিছু তার ভাইয়ের কাছে বলে তবে তার পেটের বাচ্চা বাঁচবে না।

তন্দ্রা দুটো ফাকা ঢোক গিলল।এমনিতেই ডক্টর বলেছেন তার বাচ্চাটা দুর্বল।সে নিজের মনকে বার বার বুঝাতে চেষ্টা করছিল ওসব শুধুই কু সংস্কার। কারো কথায় কিছুই হয় না।নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তালা সকল কিছু ভালো করবেন। কিন্তু তার অবচেতন মন বার বার তাকে ইংগিত করছিলো।

“যদি অভিশাপ সত্যি লেগে যায়?”

ভাইয়ের বাসায় তন্দ্রা এসেছে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় হলো। তার মেঝ ভাবী পেশায় একজন ডক্টর। ভাই ব্যবসা করছে।বাসায় এসে তাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল,

“তুই আসিস না কেন রে?তোর ভাই কী শুধু আমার দায়িত্ব? আমি বুঝি তোদের দায়িত্ব নই?”

তন্দ্রা কী বলবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। তার প্রচন্ড গা গুলাচ্ছে। মাথা ঝিম ধরে আছে।
নবনীতা বুঝতে পারে, তন্দ্রার শরীর খারাপ হচ্ছে।
সে ধমকে উঠে তন্দ্রাকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়েছে। নিজে চলেছে রান্না ঘরে।

তার স্বামী কে কল দিয়ে ফ্রেশ দেখে আম নিয়ে আসতে বললো।

কথা বলতে বলতে লেবু শরবত নিয়ে এলো।তন্দ্রা তখন বিছানায় সবে মাত্র গা এলিয়েছে।
তন্দ্রার মুখ দেখে নবনীতা অনেক কিছু বুঝতে পারলো তবুও মুখ ফুটে কিছুই বলল না কারণ এমনিতেই তার শাশুড়ি তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। এ বিষয়ে কথা বললে হয়তো তিনি বলবেন
নবনীতা নিজে কান পড়া দিয়ে তার মেয়ের সংসার ভেঙেছে।

তন্দ্রা ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে উঠে গোসল সেরে বাহিরে বেরিয়ে এলো।বেশ ঝরঝরে লাগছে নিজেকে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। পুরো ঘরজুড়ে তখন পাকা আমের গন্ধে ভরে আছে। রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত নবনীতা। সে তন্দ্রার জন্য নিরামিষ রান্না করছে। সাথে কাচ কলা ভর্তা। ইলিশ মাছের দো পেঁয়াজো এবং সাদা ভাত।

তন্দ্রা রান্না ঘরের পাশে একটা চেয়ারে বসে বলল,

“এত্ত আইটেম, আমাকে ডাক দিলেই পারতে। সাহায্য করতাম।”
“ডাক দিতাম যদি দুজন না হয়ে একজন হতে।”
“এখনো সমস্যা ছিল না আমি পারি।”
“নিজের সংসারে সবাই পারে।”

তন্দ্রা অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,
“সংসার!”

নবনীতা বুঝতে পারে। টিস্যুতে হাত মুছে এসে বলল,

“তুমি চাইলে আমাকে বলতে পারো। চিন্তা করো না সব ঠিক হবে।”

তন্দ্রা কিছু বলল না শুধু শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো নবনীতার হাত।

অনিরের মা বেশ কয়েকবার ফোন করেও ছেলেকে পেলেন না ফোনে। বার বার তার নাম্বার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। এদিকে তার মেয়ের খাই খাই অবস্থা।কিছুক্ষণ পূর্বেই তো ভাত খেলো আবার তার ক্ষুধা লেগেছে।

“কই মা কিছু রেধেছো কী?”
“এখন কী রান্ধনের টাইম?”
“আমি তাহলে কী খাবো?আমার ক্ষুধা লাগছে তো।”
“তন্দ্রার ভাই দেখ মেল্লা ফল ফলান্তি আনছে, মিষ্টি আনছে।”
“দুপুরে তো দই দিয়াই ভাত খাইলাম।এখন ঝাল কিছু বানিয়ে দাও।”
“আমি এহন ঝাল কি বানামু?”
“কাবাব বানাও।না হইলে চটপটি?”
“আমি বাতের বিষে এতক্ষণ খাড়াই থাকবার পারমু?তুই বরঙ নিজে কিছু রাইন্ধ্যা খা।”

মায়ের কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে আফসানা। সামান্য খাবারের জন্য তাকে বসে থাকতে হবে?যদি নিজের রান্না করে খেতেই হয় তো বাপের ঘরে কেন এসেছে সে?রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো সে। এদিকে অনিরের মা দুপুরের ভাত ঘুম কামাই করে ছুটলেন রান্নাঘরে, মেয়ের জন্য খাবার বানাতে। তন্দ্রার অনুপস্থিতি সে হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছেন।

নীলিমা বসে আছে অনিরের মুখোমুখি। চোখ মুখ ফুলে গেছে মেয়েটার। ফর্সা, তির্যক নাক মুখে লালচে আভাস।
তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অনির।

“কেন এমন করলেন?”
“কী করেছি?”
“প্রেমের অভিনয়।”
“অভিনয় তো করিনি।”
“আপনার স্ত্রী আছে,সে সন্তান সম্ভাবনা।”

“জানি।”
“তাহলে আমার সাথে কী?আমাকে আপনার রক্ষীতা হিসেবে রাখতে চাইছেন?”

“এমন কিছুই বলিনি।”
“হেয়ালি বাদ দিবেন?বলবেন আপনি কি চাইছেন?আছে সাহস আমাকে স্বীকৃতি দেওয়ার?”

“কেনো থাকবে না?”
“তবে আপনার স্ত্রী?”
“আমার থেকে স্বীকৃতি পেতে হলে আপনাকে আমার প্রথম স্ত্রীকে মেনে নিতে হবে।”

“আমি রাজি।”

চলবে,

#বিধ্বস্ত_অনুভূতি
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ৮

অনির ফিরেছিল বেশ রাত করে। তখন প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে৷ফেরার সময় বাজার থেকে কিনে এনেছে আম্রপালি আম। তন্দ্রার প্রিয় আম। আজ তাকে নীলিমার কথা বলতে হবে। অবশ্য সে সবটা জেনেছে।তন্দ্রাকে সে ভালোবাসে এবং এটাও সে অস্বীকার করতে পারবে না যে তন্দ্রাকে ছাড়া অসহায়।
নীলিমার প্রতি দুর্বলতা অস্বাভাবিক কিছু নয়, নীলিমা যখন চাইছে তাকে স্ত্রীর পরিচয় দিবে তবে এজন্য যদি তাকে তন্দ্রাকে ছাড়তে হয়?
না সে তন্দ্রাকে ছাড়বে না।

নীলিমা শুধু মাত্র সাময়িক আবেগে ভেসে যাওয়া ক্ষণিকের উল্লাস। তন্দ্রা তার তৃপ্তি।সে ভুল করেছে সে সব সময় বুঝতে পারছে অথচ সময়ের চোরাবালিতে আটকে যাচ্ছে।

বাসায় ফিরে যখন জানতে পারে তন্দ্রা নেই তখন চুপচাপ বসেছিল অনির। ইচ্ছে করছিল নীলিমাকে সব বলে দিতে তার থেকে মুক্তি নিতে কিন্তু সম্ভব নয়। অনেক দেরি হয়েছে।
ছেলের এমন অবস্থা দেখে অনিরের মা তাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?।
অনির ধীরে ধীরে সব’টা বলতে লাগলো।

অনিরের সব কথা শুনে ফ্যাকাসে মুখে বসে রইলেন তার মা।তিনি তন্দ্রাকে পছন্দ করে না এমন নয় তবুও তার ছেলে এতবড় একটা কাজ সে মেনে নিতে পারলেন না।
তার অবচেতন মন প্রার্থনা করতে লাগল,

“তন্দ্রা ভুল করে হলেও যেন তার ভাইকে বলে দেয়ভ,সব’টা বলে দেয়।আর কখনো যেন ফিরে না আসে এই ঘরে। সতীনের সংসারের জ্বালা যে বড় জ্বালা। তন্দ্রা সইতে পারবে না।”

ভাইয়ের সাথে আম খাওয়ার পাল্লা দিয়েছে তন্দ্রা।
একের পর এক আম দুই ভাই বোনে খেয়ে চলেছে। তাদের প্রতিযোগিতার রেফারি হয়েছে নবনীতা।
দেখা যাক কে কত খেতে পারে।
একে একে দশটা আম তন্দ্রা খাওয়ার পর নবনীতা তার স্বামীকে ইশারা করে।
তন্দ্রার ভাই বিষয়টা বুঝতে পেরে বড়সড় ঢেকুর তুলতে তুলতে বলল,

“আর পারছি না।আ’ম ডান।”
“না ভাই এমন বললে হবে না।ছোটো নানুর বাড়িতে আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি আম খেতাম।আর মাত্র ১০ টা আমে?”

“তখন আমরা ছোট ছিলাম।”

“এখন আমাদের খাওয়ার চাহিদা বেড়েছে।”

“আচ্ছা তুই জিতেছিস।বল কী চাই?”

“দিবে তো?”

“হুম দিবো।”

“যা চাই দিতে হবে না করতে পারবে না।”

“তুই যা চাইবি তাই। বল কী চাই।”

“আমি কিছু বলতে চাই, কিন্তু তুমি কোনো রিয়্যাক্ট করবে না। আমার কসম।”

“কী হয়েছে? সব ঠিক আছে?”

নবনীতা ততক্ষণে হাত পরিষ্কার করার জন্য পানি, টিস্যু নিয়ে এসেছে। স্বামীর হাতের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে নিলো সে।কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে তন্দ্রা কী বলতে চাইছে।

তন্দ্রা নিজের মাথায় তার ভাইয়ের হাত রেখে বলল,

“কথা দিচ্ছো?”

“হুম দিচ্ছি। এবার বল।যা বলবি সব বলবি।
এর আগে বল ‘তুই সুখে আছিস তো?”

ভাইয়ের প্রশ্নে তন্দ্রা হাসে। উৎসুক দৃষ্টিতে আশেপাশের পরিবেশ দেখছিল।তার ভাইয়ের এই ফ্ল্যাটে বিলাসবহুল সব পণ্য রয়েছে।
হাত বাড়াতেই সব। তেমন কোনো শারিরীক পরিশ্রম প্রয়োজন নেই। তবে কী সুখ টাকা দিয়ে কেনা যায়?যদি এসবেই সুখ পাওয়া যায় তবে তার ভাইকে বললেই সব সুখ চলে আসবে, আসতে বাধ্য কিন্তু আফসোস। টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। সুখ হচ্ছে আত্নতৃপ্তির বিষয়। তাই সুখ টাকা দিয়ে কেনা যায় না।

তন্দ্রাকে অন্যমনস্ক দেখে তার ভাই তার কাছে বসে জিজ্ঞেস করে,

“এবার চিন্তা হচ্ছে। প্লিজ ঘুম বল কী হয়েছে?”

“ভাই তুমি আমাকে ঘুম ডাকো কেন?”

“সে অনেক কথা।”

“প্রতিবার কাটিয়ে নাও। এবার তো বলো।”

“আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার এক ভয়ের জন্ম হয়। আমি ঘুমাতে পারতাম না। আর ঘুমালে স্বপ্নে দেখতাম পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছি সাপের মুখে।
দিন দিন আমার অসুখ বাড়তে লাগলো।বাবা কবিরাজ, ডাক্তার দেখালেন লাভ হলো না। পরবর্তী মাসেই তোর জন্ম।
তোর জন্মের সাত দিনের দিন মা গেলেন গোসল করতে।
তুই তখন ঘরে একা,মায়ের সাথে নানীও গেছেন।হঠাৎ তুই কান্না শুরু করলি।আমি মিয়াভাই তোকে শান্ত করায় মরিয়া হয়ে উঠি কিন্তু কিছুতেই হচ্ছিলি না। তারপর ক্যান যেন বুকে নিলাম। তুই শান্ত মেয়ের মতোন চুপচাপ ছিলি।তোকে নিয়ে বসে থাকতে থাকতে আমার ঘুম চলে এলো।
এজন্য আমি তোকে ঘুম ডাকি।তোকে বুকে নিয়ে ঘুমালে আমার লাগতো না।তোর মুখ দেখলে ক্লান্তি উবে যায়। আমার জন্য প্রশান্তির অন্য নাম তন্দ্রা। আমার ঘুম বাবু।”

“বাড়ি ফিরবে না?”

“মা তো নব কে মানে না।ওর চাকরি পছন্দ করে না।ও মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় কত কাহিনী করে ওকে পেয়েছি। আমার জন্য ওর ঘর ছুটলো, বাবা মা সবাই পর হলো, আমি কী করে ওর পরিচয়টা কেড়ে নিবো?”

“আমার পরিচয় কী?আমি কী করবো?”

এবার তন্দ্রার ভাই নড়েচড়ে বসে।নবনীতা এসে তন্দ্রার পাশে বসেছে।তন্দ্রা দুই হাতে দুজনের হাত আবদ্ধ করে বলতে লাগলো সব কথা।

পেটের বা পাশে তখন চিনচিনে ব্যথা করছে। তবুও সে বলে চলেছে এক অসহায় জীবনের গল্প।তার গল্প, এই শিক্ষিত সমাজ কে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে বলে চলেছে তার মায়ের অবহেলা,ছোট ভাবীর রান্না তরকারি শাশুড়ি ঘরের বিড়ালের পটি, ননদের কাবাব এবং স্বামীর গল্প।

তন্দ্রার ভাই শুনে রাগে ক্ষোভে বার দুয়েক দেয়ালে আঘাত করলেন।নবনীতা স্বামীকে সামলানোর জন্য এগিয়ে যায়। যখন তন্দ্রার ভাই বেরিয়ে যাচ্ছিলো বাসা থেকে তন্দ্রা ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল,

“ভাই আমার কসম লাগে।তুমি যাবে না।”

নবনীতা দুই ভাই বোনকে নিয়ে যেন মাঝ সমুদ্রে পড়েছে।অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে তার স্বামী, ননদ কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলছে। কতটা অসহায় হলে পুরুষ মানুষ কাঁদে?
কাঁদে যখন তার অতি প্রিয় মুখ কষ্টে থাকে। সে মুখে আষাঢ় মাসের মেঘ জমে।

বাবা-মা কে সব’টা জানালো তন্দ্রার ভাই।তার কথা সে আর ফিরতে দিবে না বোনকে। কিন্তু অপর পাশ থেকে জবাব এলো,

“তালাক দিলে বাচ্চা সহ কেউ ওকে বিয়ে করবে?আর এর পরের জন যে ভালো হবে তার গ্যারান্টি কী?”

চলবে,

#বিধ্বস্ত_অনুভূতি
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্ব-৯

ঘন্টাখানেক সময় হয়েছে অনির কল দিয়ে যাচ্ছে তন্দ্রাকে।তন্দ্রার ফোনে কল তো হচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না তন্দ্রা।
পরপর সতেরোটা সিগারেট খাওয়া শেষ করে ঘরে ফিরে এলো অনির।
রাত জাগার অভ্যেস তার নেই।কাজ করার সুবাদেও সে খুব একটা জাগে না।অনিরের তেষ্টা পেয়েছে। তন্দ্রার তেষ্টা। তাই রাত বারোটার দিকেই বেরিয়ে গেল বাসা থেকে এলো।

রাত তখন বারোটা সাতচল্লিশ। ইমার্জেন্সি কল এসেছিল হাসপাতাল থেকে।
নবনীতাকে নিয়ে তখন তার স্বামী রওনা দেয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
ফিরে এলো তখন প্রায় রাত সাড়ে তিনটে। ফিরে এসে দেখতে পেলো অনির তখন তাদের বাড়ির গেটের সামনে অপেক্ষা করছে৷

অনিরকে দেখে রেগে যায় তন্দ্রার ভাই। এত রাতে বাড়ির সামনে তামাশা হবে তাই নবনীতা তার স্বামীকে নিয়ে জোর করে বাসায় ঢুকে এবং অনিরকে আসতে বলে।

অনির বাসায় ঢুকে নবনীতাকে জিজ্ঞেস করে তন্দ্রা কোথায়।নবনীতা হাত ইশারায় দেখিয়ে দেয় তন্দ্রা সামনের রুমে।

ঘরের বাতি বন্ধ। স্লাইডিং ডোর বন্ধ করে অনির ঘরের বাতি জ্বেলে দিলো।তন্দ্রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে অনির তন্দ্রার পাশে বসতেই তন্দ্রা জেগে গেল। ঘরের বাতি ততক্ষণে বন্ধ হয়েছে।তন্দ্রা উঠে বসতেই অনির গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

“আমাকে না বলে আসার মানে কী?”

তন্দ্রা নিশ্চুপ।ঘুমের কারণে তার কেমন ঘোর লাগছে। মনে হচ্ছে ঘুমোতে পারলেই তার শান্তি।

“কি হলো?কিছু জিজ্ঞেস করেছি?”

তন্দ্রার এখনো মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে আছে। যা হচ্ছে সব স্বপ্ন।পাশের ঘরে তার ভাই রয়েছেন, সে আর যাই হোক অনিরকে এখন এই বাড়িতে আসতে দিবে না।
বিছানা হাতড়ে ফোনের খোঁজ করছে তন্দ্রা। বালিশের নিচে পেয়েও গেলো। ফোনে দেখতে পেলো সময় তখন ভোর চারটা বেজে দুই মিনিট।
সে শুধুই চিন্তা করলো ঘুমের ঘোরে সে জল্পনা কল্পনায় ডুবে যাচ্ছে। তাই আবার বালিশে মাথা রেখে তলিয়ে গেলো ঘুমের সমুদ্রে।

ধীরেধীরে তার অনুভব হতে লাগলো অনিরের শরীরের সেই পরিচিত গন্ধ। যেন অনির জড়িয়ে আছে তার সবটা জুড়ে।

অপরপাশে ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল তন্দ্রার ভাই।
ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুণি অনিরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে কিন্তু নবনীতার জন্য পারছে না।
ফ্রেশ হয়ে নবনীতা তখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ সে রাত-বিরেতে ঘরের মাঝে অশান্তি চায় না।অন্তত তন্দ্রার কথা চিন্তা করে হলেও না।

সকালবেলা তন্দ্রা ঘুম থেকে জেগে অনিরকে নিজের পাশে দেখে কিছুটা অবাক হলেও পরবর্তী কয়েক সেকেন্ড সময়েই বুঝতে পারে রাতে তবে অনির ছিল।
তন্দ্রা জেগে উঠার পরপর অনিরের ঘুম ভেঙেছে। সময় তখন সকাল সাড়ে আট।
বিছানার পাশের সাইড টেবিলের উপর অনবরত বেজে চলেছে।স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে নীলিমার নাম।

তন্দ্রা উঠে অনিরকে ডাক দেয়। হাতে ফোন দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।গতকাল রাতে তার বাসায় ছোটা কাজ করে সেই মেয়ে কল দিয়ে বলেছে অনির নীলিমা কে বিয়ে করবে শীঘ্রই। তন্দ্রা তাই তার ভাইকে সব’টা জানিয়েছে। কারণ তার সংসার থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে কিন্তু তার প্রয়োজন একটা সাহায্যের।তার একাডেমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই যে সে যখন তখন চাকরি পাবে।তাকে জায়গা দেওয়ার মতো, মাথায় একটু ছায়া হওয়ার জন্য পরিবার নেই। তার প্রয়োজন ছিল একটু শান্তির। মনের কথাগুলো কারো কাছে বলে কাঁদতে পারার। সে পেরেছে। তার কাছে এটাই অনেক। এরপর নিয়তি যেখানে নিয়ে যায় সে যাবে।

“আমি তন্দ্রাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”

অনিরের কথায় কটমটে চোখে তাকায় তন্দ্রার ভাই।

“ও যাবে না।”

“আমি আমার স্ত্রীকে নিতে এসেছি।আপনার বাসায় ও আছে।তাই আপনার কাছে বলছি।”

“তন্দ্রাকে আমি দিবো না।খবর পেয়েছি নতুন বিয়ে করছো?”

অনির কোনো জবাব দেয় না। চুপচাপ বসে রইল।রান্নাঘরে নবনীতার প্রেশার কুকার তখন সিটি বাজাচ্ছে। হয়তো সে ডাল চড়িয়েছে।

অনিরের মনোযোগ কয়েক মুহূর্তের জন্য সরে গিয়েছিল। ফিরে এলো তন্দ্রার ভাইয়ের কথায়।

“তাহলে তন্দ্রাকে তোমার তালাক দিতে হবে।”

“আমি তন্দ্রাকে ছাড়তে চাই না।”

“একথা পরকীয়া করার আগে মনে রাখা উচিৎ ছিল।উচিৎ ছিল আমার বোনের গায়ে হাত তোলার আগে।”

“আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা রয়েছেন। আপনি বুঝবেন না আপনার স্ত্রী এবং মায়ের মধ্যেকার রেষারেষি।”

“তুমি যা জানো না, তা নিয়ে কথা বলবে না।”

“আপনার আরো দুই ভাই আছে। আমি মায়ের এক ছেলে। আমার মাকে অন্য কারো ঘাড়ে গোছানোর সুযোগ আমার নেই।
সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে এসে যদি দেখি সামান্য তরকারিতে হলুদ বেশি হওয়ায় আমার স্ত্রীর সাথে মায়ের মনোমালিন্য হচ্ছে এবং আমার মা রাগ করে বাসা থেকে চলে যাবে তখন আপনি রাগ কার উপর দেখাবেন?

দিন শেষে আমরাও মানুষ। মেয়েরা সারাদিন ঘরের কাজ করে আমরা সারাদিন বাহিরে থাকি।আমি বলছি না তাদের কোনো চিন্তা নেই তবে পুরুষ মানুষের শান্তি এই বাড়িতে নিজ নারীতে। অথচ ঘরে ফিরে যদি প্রতিদিন ক্যাচ ক্যাচ লেগেই থাকে এবং বাসার সবার মুখ ভার থাকে তবে কতদিন মেনে নেওয়া যায়?

আমি মানছি রাগ বেশি হলে তন্দ্রাকে আঘাত করি কিন্তু নিজেও শান্তি পাই না। তখন নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখি৷ ঘরে শান্তি না থাকলে বাহিরে খুঁজি।”

অনিরের কথায় তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে তন্দ্রার ভাই।এরপর বলল,

“পরকীয়া তবে শান্তি?”

“নাহ্। এটা আমার ভুল।আমি ভুল করেছি।এটা আমি স্বীকার করছি।”

“আজ এক নারীতে, দুই দিন পর অন্য নারীতে মত্ত হবে।”.

” কথা দিচ্ছি তন্দ্রাকে ফিরিয়ে দিন। আগলে রাখবো। আমার ভুল শুধরে নিবো।”

“ওই মেয়েকে বিয়ে করে নাও৷ আমার বোনকে তালাক দিবে।এটাই শেষ কথা। ”

“আমি তালাক দিবো কেন?তন্দ্রা আমার সাথেই থাকবে।”

“ও যাবে না। এই অবস্থায় কোনো ভাবেই না।”.

” তন্দ্রার সাথে কথা বলবো।”

“সে অধিকার আছে?”

“আছে বলেই চাইছি।বলুন কী করলে তন্দ্রাকে ফিরিয়ে দিবেন?”

“যদি বলি নীলিমাকে ছাড়তে হবে। তোমাকে গ্যারান্টি দিতে হবে আমার বোনকে সুখে রাখবে।”

“যা চাইছেন তাই হবে। আমি তবুও তন্দ্রাকে ছাড়বো না।গ্যারান্টি হিসেবে আমার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পদের অধিকার তন্দ্রার হবে। এবং আমি নীলিমাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিবো।”

অনির কথা শেষ করার পূর্বেই তার ফোনে ম্যাসেজ এলো৷ নীলিমার ফোন থেকে,

“অনির! গত দুইবার আমি পিরিয়ড ডেট মিস করেছি।খুব সম্ভবত আমি মা হতে চলেছি।”

চলবে