বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-৪+৫

0
319

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪
জাওয়াদ জামী

ড্রেসিং টেবিলের আয়না ঝাপসা দেখাচ্ছে কেন! একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল! কিন্তু হঠাৎই আয়না ঝাপসা হওয়ার কারন খুঁজতে যেয়ে লক্ষ্য করল ও কাঁদছে। চোখে পানি থাকায় আয়না ঝাপসা লাগছে। কিছুক্ষণ নিরবে কাঁদে কুহু। চোখের পানিদের ঝরতে দেয় তাদের ইচ্ছেমত। একপর্যায়ে যখন নিজেকে হালকা লাগে তখন চোখ মুছে আলমারি ভেতরের ড্রয়ার থেকে এ্যালবাম বের করে। উল্টাতে থাকে একের পর এক পাতা। এ্যালবামের অধিকাংশ পাতাজুড়ে মায়ের ছবি। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে কুহুর জন্মের পরেরও ছবি ঠাঁই পেয়েছে সেখানে। এমনকি মা’র বিয়ের আগের ছবিও আছে। কুহু ওর মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷
” কই আমার মা কালো! আমার মা’তো পরমাসুন্দরী। পৃথিবীর যে কারও মায়ের থেকে আমার মা সুন্দরী ছিলেন। ” ছবিগুলো সামনে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে কুহু।
ছোটবেলা থেকেই ঘাত-প্রতিঘাতে বড় হওয়া কুহুর মাথায় এটা আসেনি মায়েদের আলাদা কোন রূপ হয়না। আলাদা কোন জাত হয়না। মায়েদের রূপ মমতাময়ীতেই বেশি প্রকাশ পায়। পৃথিবীর সকল সন্তানদের কাছেই তাদের মা সুন্দরী, অতুলনীয়। এমনকি শিউলি আক্তারও তার ছেলেমেয়ের কাছে মমতাময়ী হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। স্থান-কাল, পাত্রভেদে পার্থক্য হয় শুধু ভালোবাসার। সে তার সন্তানদের মনে নিজের প্রতি বীজ বুনেছে ভালোবাসা দিয়ে। যেখানে স্থান,কাল,পাত্রের কোন বিভেদ নেই কভু।
শুধু বিভেদ কুহুর ক্ষেত্রে। সেখানে স্থান, কাল, পাত্রের কোন স্থানই নেই যেখানে স্থান পেয়েছে শুধু ঘৃণা।
” এই যে নবাবজাদী, আর কতক্ষণ ঘরের কোনায় মুখ গুঁইজা থাকবি। ঘরের কাম কি তর বাপে করব? তা ফুপুর রাজমহলে থাইকা আসলি, ফুপু জামাকাপড় কিন্না দেয়নি? ফুপুরা এক্কেরে ভালোবাসার ঝুড়ি নিয়া বসে তাগোর ভাইঝির জন্য। দেখলেই শরিল আ’গু’নে জ্ব’ই’লা যায়। ” শিউলি আক্তারের গলার ঝাঁঝ শুনে কুহু চুপসে যায়।
” দিছেতো ছোটমা। ফুপু চারটা ড্রেস দিছে, দিদুন তিনটা আর আন্টি তিনটা দিছে। ”
” বাব্বাহ্ তর তো দেখতাছি ঈদ লাইগা গেছে। হেই বুড়িও তরে জামা দিছে! তর কপাল। কারও মা মরলে যে কপাল খুলে তরেই দেখলাম। এদিকে তর ফুপু খালি মুখেই আমার পোলা মাইয়ারে ভালোবাসা দেখায়। কই কিছুতো পাঠাইলনা তাগোর জন্য? না কি তুই মানা করছস? আমার পোলা মাইয়ারে এত হিং’সা করস তুই? দুধকলা দিয়া কা’ল’না’গি’নী পুষতাছি আমি। ” কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আর্তনাদ করছে শিউলি আক্তার।
” ছোটমা ফুপু শিহাব, দৃষ্টি সবার জন্যই কাপড় পাঠাইছে। কাল শিহাবকে বলেছি ওরগুলো নিতে। কিন্তু ও পরে নিবে বলল। তারপর আমি ভুলে গেছি। আর ছোটমা দিদুন খুব ভালো মানুষ তাকে ঐভাবে বলোনা। ” ভয়ে ভয়ে কুহু শিহাব, দৃষ্টির পোশাক শিউলি আক্তারের হাতে দিতে দিতে।
” তর কাছ থাইকা আমার আদব শিখন লাগব রে হা’রা’ম’জা’দি? তরে দিছে দশটা জামা আর আমার পোলা মাইয়ার জন্য একটা কইরা পাঠাইছে! কত ভালোবাসে আমার শিহাব, দৃষ্টিকে তা বুঝা শেষ আমার। খালি আমার পোলা মাইয়ারে ভালোবাসি ভালোবাসি কইরা মুখে ফেনা তুলে। তাগোর সব ভালোবাসা এখন দেখতাছি এই কালীর জন্য। ” মনের যত রা’গ উগরে দেয়ার চেষ্টায় আছে শিউলি আক্তার।
ছোটমার মুখে ‘ কালী ‘সম্মোধন শুনে আবারো কান্না এসে ধাক্কা দিচ্ছে বুকের দরজায়। এভাবে যে আরও কতদিন কাটবে তা কুহুর জানা নেই। জানা নেই কবে ছোটমার মনে ওর জন্য একটু ভালোবাসার জন্ম নিবে। ওকে অনেকটা ভালোবাসার দরকার নেই শুধু এক চিলতে ভালোবাসা পেলেই চলবে।
নিজের ছেলে-মেয়ের পোশাক নিয়ে কুহুর ঘর থেকে বেরিয়ে যায় শিউলি আক্তার। সে বেরিয়ে যেতেই কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ছোটমার মুখে কালী ডাক শুনলেই ওর ভিষণ কষ্ট হয়। এভাবেও কেউ কাউকে বলতে পারে! কালো’রা কি মানুষ নয়! দুই দিনের দুনিয়ায় এত রুপের বড়াই কেন করে মানুষ! ভেতরের রক্ত, মাংস, অস্থিমজ্জা সবই এক তবুও কেন উপরের রং নিয়ে এত অহংকার!
বাহিরে শিউলি আক্তার চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কুহু ঝটপট পোশাকগুলো আলমারিতে তুলে রেখে বাহিরে আসে। ফুপু তার ছেলে-মেয়েকে একটা করে পোশাক দিয়েছে এই রা’গে সে জিনিসপত্র আছড়াচ্ছে। কুহু বেশ বুঝতে পারছে আজ সারাদিন ওর ওপর দিয়ে ঝড় বইবে।

লাইব্রেরিতে বসে মনযোগ দিয়ে এ্যানাটমির একটা বই পড়ছে তাহমিদ। পড়ার মাঝেই বুঝতে পারে ওর পাশের চেয়ারে কেউ বসেছে। এতে একটু বিরক্ত বোধ করে তাহমিদ। লাইব্রেরিতে আরও চেয়ার থাকতে ওর পাশের চেয়ারে এসেউ বসতে হল! তাহমিদ মুখ গুঁজে রেখেছে বইয়ের মধ্যে।
” হেই, তাহমিদ হোয়াটস আপ? ”
তাহমিদ মুখ তুলে পাশে সিলভি কে বসে থাকতে দেখল। যাকে সে মোটেও পছন্দ করেনা। এরকম গায়ে পরা মানুষকে অপছন্দের তালিকায় রেখেছে সে। বিশেষ করে মেয়েদের। তবুও বিরক্তি নিয়েই মুখ খোলে।
” আমি পড়ছি, আর পড়ার সময় নিজেও কথা বলিনা এবং অন্যরা কথা বলুক এটাও পছন্দ করিনা। ”
সিলভি এমনটা আশা করেনি। অপমানে ওর মুখ কালো হয়ে গেছে। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে ন্যাকা স্বরে বলে, ” ওহ্ তাহমিদ বেবি, তুমি এভাবে বলছ কেন! আমরা একসাথেই পড়ি সে হিসেবে ফ্রেন্ডই বলা চলে। সেই সুবাদে একটুআধটু আড্ডা মারতেই পারি। কিংবা আউটিংয়ে যেতে অথবা তুমি চাইলে কোন রেস্টুরেন্টে বসতে পারি৷ ”
” এই তুমি আমাকে বেবি বলছ কেন! আমি কি কোলের বাচ্চা নাকি ফিডার খাই? নেক্সটে এমন অদ্ভুতভাবে ডাকতে যেন না শুনি। আর একসাথে পড়লেই তাকে ফ্রেন্ড বলেনা, বলে ক্লাসমেট। সে হিসেবে তুমি আমার ক্লাসমেট। আর কোন ক্লাসমেটের সাথে আমি কখনোই আউটিং কিংবা রেস্টুরেন্টে যাইনা, আন্ডারস্ট্যান্ড? সো, তুমি এখন আসতে পার আমি ইমপরটেন্ট একটা বিষয়ে পড়ছি। এখন বিরক্ত না করলেই খুশি হব৷ ” স্পষ্ট ভাষায় সিলভিকে মানা করে দেয় তাহমিদ।
সিলভি এমন অপমানিত কোনদিনই হয়নি। সে তাহমিদকে বেশ পছন্দ করে তাই বারবার ওর কাছে আসে নানান বাহানায়। কিন্তু প্রতিবারই তাহমিদ ওকে এভয়েড করে। তবে আজ একটু রুক্ষভাবেই বলেছে। অবশ্য এতে তাহমিদের আফসোস অথবা অনুশোচনা কোনটাই নেই।
সিলভি ধুপধাপ পা ফেলে লাইব্রেরির বাইরে চলে যায়। তাহমিদ সেদিকে ফিরেও তাকায়না।

বাড়ির পেছনের পুকুরের পাড়ে একটা মাঝারি হিজল গাছ আছে। এই হিজল গাছের তলে কুহু পাশের বাড়ির মজিদ চাচাকে বলে একটা মাচা করে নিয়েছে। তার আগে অবশ্য বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে। এই মাচা কুহুর মন খারাপের সঙ্গী। ওর মন যখনই খারাপ হয় তখনই এখানে এসে বসে থাকে। পুকুরে সারাবছর কমবেশি পানি থাকে। সেখানে মাছেরা কেলে বেড়ায়। কুহু একমনে দেখতে থাকে পুকুরের পানিতে মাছেদের জলকেলি।
আজও তেমনি কুহুর মন খারাপ। ছোটমা সকাল থেকেই যাচ্ছেতাই বলে গালাগাল করছে। বাবা সেই সকালে নাস্তা করে দোকানে বেরিয়ে যায় আসে এশার নামাজের পর। তাই শিউলি আক্তার ওকে মারলে বা বকলেও দেখার কেউ নেই। সারাটা বিকেল পুকুর পাড়ে বসে কাটিয়ে দেয় কুহু। সন্ধ্যার দিকে হাঁস-মুরগিগুলো খোঁয়াড়ে তুলে বাড়িতে ঢুকে। একটু পর শিহাব দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কুহুকে।
” আপা তোমার নাকি ফুপুর বাড়িতে বিয়ে হবেনা! রাতে আব্বু আর আম্মু আলোচনা করল। জানো আপা আমি কত আশা করে ছিলাম তোমার ঢাকায় বিয়ে হলে আমি সেখানে গিয়ে থাকব। ” শিহাবের মুখটা ছোট হয়ে গেছে।
কুহুর মন খারাপ হয়ে যায় সেদিনের কথা মনে হতেই। ওর জন্য ফুপুকে কত অপমান হতে হল।
না চাইতেও কুহুর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে৷
” আপা ও আপা তুমি কাঁদছ কেন? ” শিহাব উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।
কুহু কিছু না বলে মুচকি হেসে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে। কি সুন্দর করে কথা বলে তার ভাইটা। ওর বয়স সবে পাঁচ বছর। অথচ কথা বলে কত স্পষ্ট ও সাবলীলভাবে। অবশ্য দৃষ্টি আর শিহাবকে এভাবে কথা বলতে কুহুই শিখিয়েছে। ওর ছোটমা নিজে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে জানেনা তাই কুহু যখন ওদের শুদ্ধ ভাষায় কথা শিখিয়েছে তখন ছোটমা বারন করেনি।

আজ কুহুর রেজাল্ট দিবে। তাই সকাল থেকেই মনটা বড্ড উচাটন করছে। কিন্তু ছোটমা সেটা বুঝলে তো। কুহুর প্রতিদিনের ন্যায় আজও ঘুম ভেঙেছে ফুপুদের ফোনে। তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই বিছানা ছেড়েছে তারপর নামাজ আদায় করে লেগে পরেছে সাংসারিক কাজকর্মে। ওর রোল নম্বর, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ফুপুদের কাছে আছে। তারা জানিয়েছেন রেজাল্ট পাওয়া মাত্রই কুহুকে জানিয়ে দিবেন। কায়েসও মেয়ের রোল নম্বর, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর নিয়ে দোকানে গেছে। তিনিও রেজাল্ট জেনে নিবেন।
সব কাজকর্ম সেড়ে কুহু নিজের ঘরে বসে আছে। আজ ওর খুব করে মাকে মনে পরছে। মা বেঁচে থাকলে আজকের দিনে অন্তত মেয়েকে এত কাজ করতে দিতনা। নিজ হাতে খাইয়ে দিত। অথচ সকাল থেকে এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছে তা ছোটমা দেখেও দেখেনি। এদিকে প্রচন্ড ক্ষুধাও লেগেছে। কিন্তু টেনশনে খেতে ইচ্ছে করছেনা।
টেনশনে ঘর আর বাহির করছে কুহু। বারবার ফুপুদের কাছে ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছে রেজাল্ট দিয়েছে কিনা। ছোট ফুপুতো একদফা হেসেছে ওর এতবার ফোন করা দেখে।
ওর সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় মেজো ফুপুর ফোন আসে। ধুকপুক বুকে আর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে কুহু।
” কিরে কুহুতান এত দেরি করে রিসিভ করলি কেন? ”
” ও ফুপু তুমি আমার রেজাল্ট জেনেছ? রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে ফুপু? ও ফুপু বলোনা। ”
নাজমা পারভিন বুঝতে পারছে তার ভাতিজী খুব টেনশন করছে।
” এই মেয়ে তুই এত উতলা হচ্ছিস কেন! তোর রেজাল্ট খুব একটা খারাপ হয়নি। ৪.৭৫ এসেছে৷ মাহিন, মাইশা দুজনেই দেখে আমাকে জানিয়েছে। এবার আমাকে মিষ্টি খাওয়া। ”
রেজাল্ট শুনে কুহু হাঁফ ছাড়ে।
” ও ফুপু তুমি না আসলে মিষ্টি খাওয়াব কেমন করে! আচ্ছা ফুপু এই রেজাল্ট কি খুব খারাপ? আমি ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবনা? ” কুহুর মন খারাপ বুঝতে পারে নাজমা পারভিন।
” কুহুতান, কি বলছিস এসব! তুই সংসারের সব কাজ সামলে যতটুকু পড়ার সময় পেয়েছিস তার তুলনায় অনেক ভালো করেছিস। ভালো কলেজে পড়ার সুযোগ তুই অবশ্যই পাবি দেখিস। ”
” ফুপু তোমার সাথে পরে কথা বলছি। বড় ফুপু, ছোট ফুপু ফোন দিচ্ছে। তাদের সাথে কথা বলি। ”
নাজমা পারভিন সায় জানিয়ে ফোন কেটে দেয়।

” আসসালামু আলাইকুম ফুপু। আমার রেজাল্ট শুনেছ তুমি? ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম সোনা মা। অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিস তুই। আমরা অনেক খুশি হয়েছি। এবার বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নে। তোকে এখানে ভর্তি করিয়ে দিব। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবি। আমি কায়েসের সাথে এখনই কথা বলে ওকে রাজি করিয়েছি। ” আফরোজা নাজনীনের উচ্ছ্বসিত গলা শুনে কুহু আর কিছুই বলেনা।
শেষে ফোন আসে ওর ছোট ফুপু শাহনাজ সুলতানার। কুহু ছোট ফুপুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বাইরে আসে।
এদিকে কায়েস রেজাল্ট দেখার সাথে সাথেই শিউলি আক্তারকে ফোন দিয়ে জানায়। কিন্তু শিউলি আক্তারের এতে কোন হেলদোল নেই। কুহু পাস করল কি ফেইল করল তাতে তার কিছুই যায় আসেনা।
কুহু ছোটমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে একটু ভালো কথা, প্রশংসা পাবার আশায়। কিন্তু ওর আশায় জল ঢেলে শিউলি আক্তার খেঁকিয়ে উঠে।
” এই যে নবাবজাদী, কলপাড়ে কাপড় ভিজায় রাখছি সেগুলান কি তর ম’রা মা’য় ধুইব? নাকি মেট্টিক পাশ দিয়াই নিজেকে জজ – ব্যারিষ্টার ভাবতাছস? বেশি উড়িসনা কইলাম। তাইলে কইলাম ডানা কা’ই’টা লু’লা বানায় রাখমু। ”
শিউলি আক্তারের কোন কথায় তেমন কষ্ট হয়নি কিন্তু ওর মৃ’ত মাকে নিয়ে বলা কথা কুহুর সহ্য হয়না।
” ছোটমা তুমি আমাকে যা ইচ্ছে তাই বল। কিন্তু তোমার দুইটা পায়ে ধরি আমার মা’কে নিয়ে কিছু বলোনা। ” কুহু ডুকরে কেঁদে উঠে।
” হা’রা’ম’জা’দি, অ’ল’ক্ষ্মী-অ’প’য়া তুই আমারে জ্ঞান দেস! ছোটবেলায় মায়েরে খাইছস আর এখন আমার সংসারে আ’গু’ন জ্বা’লা’ই’তা’ছ’স। আবার আমার মুখে মুখে কথা কস! ” কথার সাথে সাথে কুহুর দুই গালে কয়েকটা থা’প্প’ড় দিয়েছে শিউলি আক্তার। চুলের মু’টি ধরে টানতে টানতে কলপাড়ে নিয়ে যায় । ছুঁড়ে ফেলে কাপড় ভিজিয়ে রাখা বালতির উপর। ছুঁড়ে ফেলে দেয়ায় কনুইয়ে ব্যথা পায় কুহু। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠেই কাপড় ধুতে শুরু করে। এখন যদি একটুও দেরি হয় তাহলে শিউলি আক্তার ওকে আবারও মা’র’তে দুইবার ভাববেনা।

চলবে…

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৫
জাওয়াদ জামী

কাপড় ধোয়ার মাঝেই কুহু হাতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। ব্যথার চোটে হাত নাড়াতে পারছেনা। কাঁদতে কাঁদতেই কাপড় ধোয়া শেষ করে গোসল সেরে উঠে। ধোয়া কাপড়গুলো রোদে মেলে দিয়েই ঘরে এসে ভেজা চুলেই শুয়ে পরে।
শিউলি আক্তার বেশ কিছুক্ষণ থেকে কুহুকে ডাকছে কিন্তু ওর সাড়া না পেয়ে ঘরে এসে কুহুকে শুয়ে থাকতে দেখেই খেঁকিয়ে উঠে।
” ঐ হা’রা’ম’জা’দি কালী তুই এহন শুইয়া রইছস ক্যা? এমুন কামচোর মাইয়া জীবনেও দেহিনি। আমি কাম করতে করতে ম’র’তা’ছি আর হেয় ম’রা’র ঘুম ঘুমাইতাছে। হায়রে হায়, কি কপাল কইরা এই বাড়িতে যে আইছিলাম। বাপে এক বিয়াত্তা বেডার লগে বিয়া দিয়া আমার কপাল পু’ড়া’ই’ছে গো। কপাল আরও বেশি পু’ড়’ছে যহন দেহি তার একটা ডাইনির লাহান মাইয়া আছে। ” নিজের কপালে জোরে জোরে চাপর দিতে দিতে আহাজারি করছে শিউলি আক্তার।
নিজের খুব কাছে উচ্চস্বরে কথার শব্দ কানে আসতেই ধরফরিয়ে উঠে বসে কুহু। কিন্তু শোয়া থেকে উঠতে গেলেই বেকায়দায় কনুইয়ে লেগে যায়। মৃদু আর্তনাদ করে উঠে ব্যথায়।
” কি হয়েছে ছোটমা! তুমি এমন করছ কেন! ” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে কুহু।
” কি আর হইব বাপ-ফুপুগোরে রাজকইন্যা। আমার কি কিছু হওনের কপাল আছে নাকি! সেই সকাল থাইকা কাজ কাম করতে করতে আমার শরিলডা বিষ-ব্যথায় জইড়া রইছে আর সে এহন জিগায় কি হইছে! আর আমি এত বছর এই মাইয়ারে আদর, যত্ন কইরা পাইলা-পুইষা বড় করছি! শেষে কিনা এই মাইয়াই কাল নাগিনী হইল! ”
কুহু অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় ছোটমার দিকে। সে কবে ওকে আদর,যত্ন করে বড় করেছে! আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও মমতার সহিত ওর মাথায় হাত রাখেনি কিন্তু আজ সে বলছে সে আদর,যত্ন করেছে! সৎ মায়েরা বুঝি এমনই সুযোগসন্ধানী হয়!
কুহু শিউলি আক্তারকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে আসে।

তাহমিদ ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে। সে এতটাই ক্লান্ত যে ফ্রেশ না হয়েই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পরে। তাহমিনা আক্তার ছেলের রুমে এসে দেখেলেন তার ছেলে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তিনি একপা দু পা করে ছেলের মাথার কাছে বসেন। ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। পড়াশোনার বড্ড চাপ যাচ্ছে ছেলেটার ওপর। ঠিকমত নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত করতে পারছেনা। তাহমিদের কপালে চুমু দিয়ে তিনি বেরিয়ে আসেন।
শেষ বিকেলে তাহমিদ ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে আসে। ‘ কুঞ্জছায়া ‘ আজ খাবারের গন্ধে ম ম করছে। তাহমিদ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনা। তারপরই হঠাৎ মনে হয় আজ সিক্ত’র রেজাল্ট দিয়েছে। আশেপাশে তাকাতেই বড়মাকে দেখতে পায় রান্নাঘরে। কয়েক কদমে ও পৌঁছে যায় বড়মার কাছে।
” বড়মা, সিক্তার রেজাল্ট কি? তোমরা কেউই আমাকে জানাওনি ওর রেজাল্ট। ”
” তোর আদরের বোনের রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে বাপ। সে ঢাকা বোর্ডে অষ্টম হয়েছে। তাই তার অনারে আজ তার পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। সেসব কথা বাদ দে, এখন বল দুপুরে এসেই না খেয়ে ঘুমিয়েছিলিস কেন? তোর পরিক্ষার মাত্র সাতদিন বাকি আছে। এখন এরকম অনিয়ম করলে চলবে? তুই বস আমি খাবার নিয়ে আসছি। ”
” বড়মা, আমাদের সিক্তা এত ভালো রেজাল্ট করেছে আর তুমি সেকথা বাদ দিতে বলছ! আমার পরিক্ষা নিয়ে আপাতত চিন্তা করোনা। কাল বাসায় পার্টির আয়োজন করব বুঝছ। বিশাল পার্টি হবে কাল। আমাদের সব ফ্রেন্ড, সব আত্মীয় স্বজনরা সেখানে আসবে। ”
” পার্টি কয়েকদিন পর দে বাপ। কাল আমি ফুলতলা যাব। সেখান থেকে আসলে তোর যা মন চায় করিস। তবে আমার মতে তোর পরিক্ষার পর যা করবি করিস। ”
” বড়মা, আমাকে তোমার বাচ্চা মনে হয়! আমি কি ফাঁকিবাজ যে পার্টির অযুহাত দিয়ে পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করব! তোমার কালকে ফুলতলা যাওয়া হচ্ছেনা। পার্টি কালকেই হবে। ” তাহমিদ একগুঁয়ে ভাবে বলে।
” আমাকে কাল যেতেই হবে বাপ। তুই বাঁধা দিসনা। ”
” বড়মা প্লিজ। তুমি দুইটা দিন পর যাও। ”
” আমাকে এভাবে অনুরোধ করিসনা তুই। তোর অনুরোধ না রাখতে পারলে আমার খারাপ লাগবে তুই বুঝিসনা? ”
” কে চাইছে তোমার খারাপ লাগুক! সেজন্যই তো বলছি দুইদিন পর যাও। ”
” তাহমিদ তুই বড়মাকে এভাবে ফোর্স করছিস কেন? তুই বুঝতে পারছিসনা কেন বড়মার জরুরি কাজ না থাকলে তোর এতবার বলতে হতনা। মাঝেমাঝে এমন অবুঝের মত আচরণ করিস কেন! ” তাহমিনা আক্তার ছেলেকে ধমকে উঠেন।
মা’র ধমক খেয়ে তাহমিদ সুড়সুড় করে সোফায় যেয়ে বসে।
” আহ্, তাহমিনা তুই ওকে এভাবে বলছিস কেন?
ও একটা সামান্য আবদার করেছে মাত্র। আমি কথা বলছিলাম তো ওর সাথে। ” আফরোজা নাজনীন উল্টে ধমক লাগায় তাহমিনাকে।
” বাব্বাহ্ আমি এলাম তোমাকে ওর ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বাঁচাতে আর তুমি কিনা উল্টো আমাকে দোষী করছ! কারও ভালো করতে নেই। ” কিছুক্ষণ বকবক করে নিজের কাজে মন দেয় তাহমিনা।
ততক্ষণে আফরোজা নাজনীন প্লেটে খাবার নিয়ে তাহমিদের কাছে আসে। তাহমিদ হাত ধুয়ে এসে খাবারে মনযোগ দেয়।

সানাউল রাশেদিনরা তিন ভাই। সানাউল রাশেদিন, শফিউল রাশেদিন আর সামিউল রাশেদিন। ওরা বড় দুইভাই একসাথে থাকে। সামিউল রাশেদিন স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে কাতার থাকেন। সেখানে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। দুই-তিন বছর পরপর তিনি দেশে এসে মাসখানেক থেকে যান। তার তিন ছেলেমেয়ে। দুই মেয়ে আর এক ছেলে।
সানাউল রাশেদিনের চার মেয়ে রীতি, দ্যূতি, সুপ্তি সিক্তা। বড় দুইজনের বিয়ে হয়েছে। তারা স্বামী, সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সুপ্তি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ও আর তাহমিদ তিনমাসের ছোটবড়। সিক্তা এ বছর এসএসসি পাশ করল।
শফিউল রাশেদিনের দুই ছেলে। তাওহীদ রাশেদিন সে স্ত্রী আর এক মেয়ে নিয়ে চট্টগ্রাম থাকে। সরকারি কলেজের লেকচারার সে। ছোট ছেলে তাহমিদ মেডিকেলে পড়ছে।
শফিউল রাশেদিন চাকরির সুবাদে রাজশাহী থাকেন। তিনি সিটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তাহমিনা আক্তার স্বামীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন। তবে তাহমিদ মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পরে আর কোথাও যাননি। শ্বশুরালয়েই এখন তার স্থায়ী ঠিকানা।
সানাউল রাশেদিনও একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত। তার কর্মস্থল ঢাকাতেই।

তাহমিদ টিভি দেখছে আর খাচ্ছে। কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই সামনে তাকিয়ে দেখে ওর দাদী আয়েশা সালেহা। তাহমিদ প্লেট রেখে তাকে ধরে এনে সোফায় বসায়।
” দিদুন তুমি কেমন আছো? তোমার বড় ছেলের ছোট মেয়ে কি কান্ড করেছে শুনেছ নিশ্চয়ই। একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই ওর কাছে ফেইল মারলাম দিদুন। ” খেতে খেতে কথা বলছে তাহমিদ। কিন্তু দিদুনের কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। আয়েশা সালেহা এমন ভাব করছেন যেন তিনি নাতির কথা শুনতেই পাননি। তাহমিদের কপাল কুঁচকে আসে দিদুনের এরূপ নির্বিকার আচরণে।
” দিদুন, তুমি কি কোন কারনে আমার ওপর রাগ করেছ? রাগ করলে এখনই বল আমি তোমার রাগ ভাঙ্গানোর আয়োজন করছি। ” মুখে এক লোকমা বিরিয়ানি পুরে আবার কথা বলে তাহমিদ।
” আপনার ওপর রাগ করতে হলে যোগ্যতা থাকতে হবে। হাজার হোক ডাক্তারের সাথে যে কেউ রাগ করতে পারেনা। আর আমিতো অশিক্ষিত একজন বিধবা। আমি কোন যোগ্যতায় আপনার ওপর রাগ করব! ” আয়েশা সালেহার ত্যাড়া উত্তর শুনে তাহমিদের চোখ কপালে উঠে।
যে দিদুন ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সেই দিদুনের আজ এ কেমন কথা! তাহমিদ কষ্ট পাবে না অবাক হবে বুঝে পায়না। শুধু ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে দিদুনের দিকে।
” মা, ছেলেটা সারাদিন পর একটু খেতে বসেছে আর সেই সময় আপনি এসব কি বলছেন! একটু খেতে দিন না ছেলেটাকে। ” শ্বাশুড়িকে অসহায়ভাবে অনুরোধ করেন আফরোজা নাজনীন।
” বড় বউমা, তুমি মহান তাই সহজেই সবকিছু ভুলে যাও। কিন্তু আমি তোমার মত অত মহান নই। তাই পনের দিন আগের ওর সেই ব্যবহার এখনো ভুলিনি। তুমি আজ ওর ওপর মায়া দেখাচ্ছ, সেদিন কি ও তোমার ওপর একটুও মায়া দেখিয়েছে? নাকি ঐ অসহায় মেয়েটার ওপর দেখিয়েছে? না জেনে কোন অন্যায় করলে তার ক্ষমা হয় কিন্তু জেনেবুঝে করা অন্যায়ের কোন ক্ষমা নেই। তাই সব অপরাধিকে ক্ষমা করতে নেই। আর সে হোকনা তোমার সন্তান অথবা আমার সন্তান। ”
না চাইতেও আফরোজা নাজনীনের চোখ ভিজে আসে। এদিকে তাহমিদ খাওয়া ছেড়ে একদৃষ্টিতে দিদুনের দিকে তাকিয়ে আছে। দিদুন আজ ওর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সে অপরাধী। অথচ সেদিনের পর থেকে মা কিংবা বড়মা একবারও এসব কথা মুখে আনেনি। তবে কি বড়মা আজও সেদিনের কষ্ট ভেতরে পুষে রেখেছে! ঠিক তখনই ওর চোখ যায় আফরোজা নাজনীনের দিকে। তিনি মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছছেন। কষ্টে বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তাহমিদের। বড়মার চোখে পানি দেখে ও নিশ্চিত হয়ে যায় বড়মার মনে আজও সেই কষ্ট রয়েই গেছে।
তাহমিনা আক্তার রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শ্বাশুড়ির বলা সব কথা শুনছেন। শ্বাশুড়ির বিপরীতে বলার মত কোন কথাই তার মুখে জোগায়না। সত্যিই যে তার ছেলে সেদিন অন্যায় করেছে।
তাহমিদ হাতের বিরিয়ানিটুকু প্লেটে রেখে উঠে যায়। বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের রুমে পা বাড়ায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকে। কিন্তু কিছুতেই নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারছেনা। বিরক্তি নিয়েই ছাদে আসে। ছাদের এককোণে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বসার জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকে। ছাদে আসার পর থেকেই একটা সুগন্ধ নাকে আসছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনা কিসের গন্ধ পাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের এদিকওদিক দেখতে থাকে। চোখ যায় দক্ষিণ দিকের রেলিংয়ে। সেখানে একটা টবে হাসনাহেনা গাছে ফুলে ভরা। যদিও এই সন্ধ্যায় এখনো ফুলের তীব্র সুবাস ছড়ায়নি কিন্তু যতটুকুই ছড়িয়েছে নেহাৎ মন্দ লাগছেনা। তাহমিদ হঠাৎই লক্ষ্য করল ওর মন ভালো হয়ে গেছে।
” ছোট ভাইয়া আপনি এই সন্ধ্যায় ছাদে বসে আছেন! এদিকে আপনাকে বড়মা খুঁজছে। ” রোজি নামক মেয়েটার গলা পেয়ে পাশ ফিরে তাকায় তাহমিদ। মেয়েটা ওদের বাসায় এক বছরের মত হবে এসেছে।
” রোজি, এই হাসনাহেনা গাছ কবে লাগিয়েছ? ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছটা! ”
” এটাত কুহু আপু এনেছিল। তার নাকি হাসনাহেনা পছন্দের ফুল। ”
এবার তাহমিদের মনে পরে সেদিনের পর থেকে কুহুকে একটাবারও দেখেনি। তবে কি সে চলে গেছে? আর ও তো এবার এসএসসি দিয়েছিল। ওর রেজাল্ট কি? তাহমিদ কিছু না বলেই নিচে আসে।
মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। নিশ্চয়ই বড়মা নিজের রুমেই আছে।
তাহমিদ বড়মার রুমের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল তিনি জায়নামাজেই বসে আছেন। তাহমিদ গুটিগুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। আজ বড়মার কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে।
আফরোজা নাজনীন তসবি পাঠ করছিলেন। তাহমিদ এসে বড়মার কোলে মাথা রেখে মেঝেতেই শুয়ে পরে।
” এসব কি তাহমিদ! এভাবে মেঝেতে শুচ্ছিস কেন বাপ? এখন ঠান্ডা লাগলে পরিক্ষা দিবি কেমন করে! ”
” বাদ দাও তো বড়মা। তুমি ভুলে যাও কেন তোমার ছেলেই ভবিষ্যতের ডাক্তার। তার কোন অসুখ করলে সেই চিকিৎসাও জানা আছে। ”
” হয়েছে আর নিজেই নিজের সুনাম করতে হবেনা। আচ্ছা তুই আজকাল নামাজ বাদ দিয়েছিস? এটা যদি তোর বড় চাচ্চু শুনে তাহলে সে কি করবে জানিস? ”
” নামাজ বাদ দিইনি তো। শুধু মাঝেমধ্যে একটুআধটু গ্যাপ যায় এই আরকি। ” তাহমিদ কেমন যেন উসখুস করছে যা আফরোজা নাজনীনের নজর এড়ায়নি।
” তুই কি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিস বাপ? তাহলে নির্দিধায় বলে ফেল। ”
” বড়মা, কুহুওতো এবার এসএসসি দিয়েছিল ওর রেজাল্ট কি? ”
” হয়েছে মোটামুটি। তুই আর কিছু বলবি? ” আফরোজা নাজনীন এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছেননা।
” বড়মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ। আমি সেদিনের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। ” ছলছল চোখে তাহমিদের অনুনয় বুকে বিঁধে ওর বড়মার।
” আমি তোকে সেদিনই ক্ষমা করেছি বাপধন। যাকে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি তার একটু অপরাধ যদি ক্ষমাই করতে না পারি তবে কিসের মা হলাম আমি! ”
বড়মার মুখে এমন কথা শুনে ফুঁপিয়ে উঠে তাহমিদ। এই মানুষটাকে কষ্ট দিয়েছে ভাবতেই ওর বুক ভারী হয়ে আসছে।
আফরোজা নাজনীন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ এভাবে ঘাপটি মেরে পরে থাকার পর তাহমিদ উঠে বসে।
” বড়মা, এবার যাই তোমার শ্বাশুড়ির রাগ ভাঙ্গিয়ে আসি। আমার হয়েছে যত জ্বালা। একেকজন রাগ করে থাকবে আর আমার দ্বায়িত্ব পরে সেই রাগ ভাঙ্গানোর। ”
তাহমিদের কথা শুনে হেসে দেন আফরোজা নাজনীন।

দিদুনের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল তিনি বিছানায় বসে পান বানাচ্ছেন।
” দিদুন আমাকে একটা ভলো করে পান বানিয়ে দাওতো। পান খেয়েই পেট ভরাই। ”
” আমার হাতের পান খেলে তোর ইগোতে লাগবেনা! ”
” দিদুন প্লিজ এভাবে বলোনা। তুমি না আমার একটামাত্র বিবিজান। জামাইকে কেউ এভাবে বলে নাকি! ”
” তুই চাইলেই বউ আরেকটাও আনতে পারতি৷ কিন্তু তোর তো আবার উচ্চমাপের বউ পছন্দ। যোগ্য, সোসাল, স্মার্ট বউ ছাড়া তোর চলবেনা। আমার ভেতর এসবের কিছুই নেই তবুও বিবি ডাকিস কেন? অপমান করার জন্য? ”
” দিদুন আমার দিকটা একটু ভেবে দেখেছ কখনও! আমার কেন যেন ওকে বিরক্ত লাগে। ইয়াং একটা মেয়ের এতটা ভীতু রুপ আমি মানতে পারিনা কিছুতেই। মেয়েদের হতে হবে স্ট্রং পার্সোনালিটির। এই মেয়েটার তো সবকিছুতেই ভয় মোড়ানো থাকে৷ ”
” সৎ মা যাদের আছে তারাই বোঝে এর যন্ত্রণা। একটা মেয়েকে আটমাস বয়সে রেখে যখন তার মা মারা যায়। তখন সেই মেয়েকে বড় করার, প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়ার কিংবা মুল্যবোধ শেখানের শিক্ষক কিন্তু সেই মায়ের সাথেই বিদায় নেয়। আবার যখন সেই মেয়ের জীবনে যখন সৎমার আগমন ঘটে আর সেই সৎমা যদি হয় বি’ষে’র সমতুল্য তখন সেই মেয়েকে ভয়ে ভয়েই জীবন কাটাতে হয়। তাকে উঠতে-বসতে ভয় তাড়া করে। পেটে ক্ষুধা থাকলেও খেতে চাইতে ভয়, কথা বলতে ভয় এমনকি হাসতেও ভয় যাদের নিত্যসঙ্গী তারা ভীতু হবে এটাই স্বাভাবিক। ”
” দিদুন তুমি যতটা বলছ ততটাই কি আদৌ হয়! যদি সৎমা খারাপই হয় তখন প্রতিবাদ করতে দোষ কোথায়? প্রতিবাদ করে নিজের অধিকার আদায় করতে দোষ কোথায়? ” তাহমিদের একরোখা উত্তর।
” তোর ভাবনার মত যদি জীবন হত তাহলে কোন মা হীনা মেয়ের জীবন কন্টকাকীর্ণ হতনা। যেখানে প্রতিবাদ করলেই মার খেতে হয় সেখানে প্রতিবাদ করে কতদিন টিকে থাকা যায়! একশোজনের মধ্যে দুইজন সৎমা ভালো হয় কিনা আমি এত বছর বয়সেও সে হিসাব মিলাতে পারিনি। যেখানে সেই ভীতু মেয়েটার বেঁচে থাকাটাই দোষের সে আর কি প্রতিবাদ করবে! ”
আয়েশা সালেহার গলা কেঁপে উঠছিল কথা বলার সময়।
” তুমি এতটা নিশ্চিত হয়ে এসব বলছ কিভাবে দিদুন! ”
” আমি যে খুব কাছ থেকে এসব দেখেছি। অবশ্য বলতে পারিস আমি নিজেই ভুক্তভোগী। ” একফোটা পানি চোখ থেকে টুপ করে বিছানায় পরে।
” তুমি কি বলছ এসব দিদুন! প্লিজ এভাবে কেঁদনা। আমাকে খুলে বলনা। ” তাহমিদের বুকটা কেমন ভারী হয়ে আসছে।
” আমাকে আট বছরের রেখে আম্মা মারা যায়। ছোট দুই ভাইয়ের বয়স তখন চার আর ছয়। আম্মা মারা যাওয়ার ছয়মাস না পেরুতেই আব্বা আরেকটা বিয়ে করে। আমার দাদী তখন অসুখে বিছানা নিয়েছে। আমি আম্মা মারা যাওয়ার পর থেকে ছোট ভাইদের দেখাশোনা শুরু করি। যতদিন বাড়িতে সৎমা আসেনি ততদিন ভালোই ছিলাম। কিন্তু যখন সৎমার পা পরল বাড়ির চৌকাঠে সে মুহূর্ত থেকেই আমাদের জীবনের সকল সুখ, হাসি, আনন্দ উধাও হল। ক্ষুধা লাগলে ভাত দিতনা, মাছ-মাংস রান্না করলে শুধু ঝোল দিয়ে খেতে দিত। ভাইদের দেখাশোনার পাশাপাশি বাড়ির সব কাজ আমাকে করতে হত। একটু ভুল হলেই সে কি মা’র। সহ্য করতে না পেরে আব্বাকে বলতাম। আব্বা সেসবের জন্য সৎমার কাছে কৈফিয়ত চাইত। তখন সে মিথ্যা বলত আমাদের নামে। তারপর আব্বা যখন পরদিন বাইরে যেত তখন শুধু হত ব’র্ব’র নি’র্যা’ত’ন। এভাবে চলল পাঁচ বছর। ছোট ভাইরাও অনেকটাই বড় হয়েছে। ওরা আমাকে কাজে সাহায্য করে। সৎমার ততদিনে দুইটা ছেলে-মেয়ে হয়েছে। আর আমাদের উপর নি’র্যা’ত’নও বেড়েছে। আব্বাকে বললে পরে আরও মা’র সহ্য করতে হত তাই একসময় আব্বাকে আর কিছুই বলিনা। আব্বাও ভাবে আমরা ভালো আছি। আসলে মা মারা যাওয়ার পর বাবারা হয়ে যায় আরেকজন নতুন মানুষের হাতের পুতুল। ” এবার আয়েশা সালেহা জোরে কেঁদে উঠলেন। তাহমিদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দিদুনকে। ওর বলার কোন ভাষা আজ অবশিষ্ট নেই। ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করে আয়েশা সালেহা আবার বলতে শুরু করেন,
” তোর দাদুভাই জমিজমার কোস কাজে আমার শ্বশুরের সাথে আমাদের গ্রামে যায়। আমার শ্বশুর সেদিকে জমি অনেক কিনেছিলেন। তখন সে ছাব্বিশ বছরের তাগড়া যুবক। আমি সেই বিকেলে ছোট ভাইকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। তখন রাস্তায় আমাকে দেখে সাথে সাথে তার আব্বাকে জানায়। তারপর অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে আমাদের বিয়ে হয়। বাসর ঘরে তার কাছে অনুরোধ করেছিলাম আমার ভাইদের নিজের কাছে রাখার জন্য। তিনি রাজি হন। এরপর ওদের এখানে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। ওরা পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। ” আয়েশা সালেহা আজ যেন সেই সূদুর অতীতে হারিয়েছেন। আর তাহমিদ দেখছে এক ব্যথাতুর বদন। যার শৈশব,কৈশোর কেটেছে অবর্ননীয় যন্ত্রণায়।
” তাই আমি খুব করে চাইছিলাম কুহুকে একটা পরিচয় দিয়ে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে৷ সেই কয়েক বছর আগে যখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোর ছোটমা কেমন? তখন সে থমকে চেয়েছিল আমার দিকে। তারপর একসময় আমার কথার সাথে পেরে না উঠে বলে দেয় সৎমার নি’র্যা’ত’নে’র বর্ননা। তখন নিজের সেই অতীতের সাথে ওর বড্ড মিল পাই। আর তাই তোকেই ওর উদ্ধারের কারন বানানোর চেষ্টা করি। এবার বল এই ছোট্ট মেয়ের প্রতিবাদ করে মার খাওয়ার চাইতে চুপ করে থাক ভালো কি না? চুপ করে থাকলে একটু হলেও কম মার খেতে হয়। ”
তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে গেছে দিদুনের কথা শুনে। ঐ মেয়েটার ভীতু চেহারার আড়ালে এক করুন কাহিনী শুনে।

চলবে