বিপরীতে হিত পর্ব-১২

0
215

#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-১২

আজ একসপ্তাহের বেশি হয়ে গেলো আদি ভার্সিটিতে আসে না। প্রথম কয়েকদিন সুমনা বিশেষ পাত্তা দেয়নি বিষয়েটা। দু’তিন হলো কেমন যেন শুন্য শুন্য লাগে চারপাশটা। কেউ একজন কারণে অকারণে তাকে ফলো করতো, খোঁচাত, পিছু লেগে থাকতো। ভীষণ রকম বদমায়েশি করে ওকে ভয় দেখাতো! আজ এক সপ্তাহ ধরে সে নেই, সুমনার মনে হয় কি যেন একটা নেই ওর। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, ভেতরটা খা খা করে। মনের অজান্তেই সুমনা দিনের ভেতর দশবার নিজের আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজে ফেরে আদিকে। মাঝে মাঝে ভাবে এই বুঝি আদি এসে ওর গায়ে তেলাপোকা ছেড়ে দিলো কিংবা মাথায় কিছু দিয়ে দিলো। হঠাৎ মনে হলেই পিছু ফিরে দেখে, আশা করে আদিকে দেখতে পাবে।
অথচ, কেউ যদি কথাটা ওকে বলে তাহলে ও বেমালুম অস্বীকার করবে কথাটা। বলবে, নাহ! আমি কেন ঐই বদকে খুঁজবো? আমার বয়েই গেছে ওকে খুঁজতে?

আজ ভার্সিটিকে আশার সময় খুব করে প্রার্থনা করছিলো, আজ যেন আদি আসে? ওকে যেন দেখতে পায় একনজর? ভার্সিটিতে এসেও আদিকে খুঁজতে খুঁজতেই ক্লাসের দিকে আসছিলো। কোথাও দেখা পেলো না আদির। নিজের ক্লাস রুমে ব্যাগ রেখে কি মনে করে আবার ফেরত আসছিলো আদির ক্লাসের দিকে। দৌড়ে উঠতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলো। সুমনা সরি বলতে যাবে তার আগেই পরিচিত কন্ঠে সরি শুনে চোখ তুলে তাকাতেই আদিকে দেখতে পেলো। ওকে সরি বলে মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। মাথাটার সামনে রুমাল দিয়ে বাঁধা, তারউপর আবার ক্যাপ পড়েছে। সুমনা ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলো। আচ্ছা, আদি কি ওকে দেখেনি? নাকি দেখেও না দেখার ভান করলো? সুমনা ভাবলো একবার ডাকবে আদিকে। পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করে দিলো। থাক, এখন না। ক্লাস শেষে দেখা যাবে ব্যাপারটা।

ক্লাস শেষে আদি বেরিয়ে যাচ্ছিলো। এতোদিন পর ভার্সিটিতে এসে পড়েছে মহা বিপদে। ক্লাসের বন্ধুদের চুল কেটে ফেলার রহস্য বলতে বলতে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর সুমনা উপর রাগ বাড়ছে। বন্ধুরা ওর অবস্থা দেখে আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসছে পাছে মুখের উপর হাসলে আদি মাইন্ড করে? এসব দেখে আদির মেজাজের পারদ আরো চড়ে যায়। এই বুড়ো বয়সে এসে যদি মাথা টাক করতে হয় তবে কার না মেজাজ খারাপ হবে? তার উপর আদির চুলগুলো ছিলো ওর নিজের খুব ফেবারিট। কি সুন্দর করে চুলগুলো ছেটে ছিলো। আদির পুরো মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল ছিলো যেটা ম্যানলি স্টাইলে কাটা। সুমনার বাচ্চা কিনা সেই চুলে হাত দিলো? ন্যাড়া মাথা বানিয়ে দিলো ওকে? আদি রাগে দুঃখে ক্লাস শেষ হতেই বেড়িয়ে যেতে চায়। ওর আর কারো হাসির খোরাক হওয়ার ইচ্ছা নাই আবার সুমনার সামনেও পড়তে চায় না। সুমনা সামনে পড়লেই আদির মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছে। আদি ইচ্ছা করলেই সুমনাকে পাল্টা কিছু করতে পারে। কিন্তু করবে না। এখন তো বড় হয়ে গেছে, বাচ্চাদের মতো এসব টম এন্ড জেরি খেলা কি মানায়? আর তাছাড়া,
আর কতোদিনই বা চলবে এসব? এক না এক সময় তো ক্ষান্ত দিতে হবে নাকি? সুমনার হিসেবে, এই টাক হওয়া নাকি ওর পাওনা ছিল? ওর কারনে সুমনার চুল কাটতে হয়েছিলো এখন সুমনার কারনে ওর চুল কাটতে হলো। সুমনার ভাষ্যমতে হিসাব বরাবর হলো তবে? আদি তাই আর সুমনাকে ঘাঁটাচ্ছে না। নতুন করে আর হিসাব নিকাশ না হোক এটাই ভালো হবে।
এজন্যই সকালে সুমনাকে দেখেও না দেখার ভান করে কেটে পড়েছিলো।
“এই আদি, আদি, এই আদি!”
দৌড়ে এসে কেউ একজন পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। কন্ঠ শুনে আদি চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলো কিন্তু সুমনার সাথে দৌড়ে পারলো না। আদির সামনে দাঁড়ায়ে ভ্রু কুঁচকে আদির দিকে তাকালো-
“কি সমস্যা তোর? আমাকে এভোয়েড করছিস কেন? সকালে আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে এমন ভাবে চলে গেলি যেন আমাকে চিনতে পারিস নি?”
“খেয়াল করি নি!”
অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো আদি।
“মিথ্যে কথা বলছিস কেন? আর আমার দিকে তাকাচ্ছিস না কেন?”
“কই তোর দিকে তাকাচ্ছি না?”
আদি একবার সুমনার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ঘুড়িয়ে নেয়।
“এই যে তাকাচ্ছিস নাই তো?”
“দেখ সুমনা, যেতে দে আমাকে। জরুরি কাজ আছে আমার!”
“বাব্বাহ এতো রাগ? তুই তো তাও ছেলেমানুষ, তাই চুল কেটে এতো রাগ দেখাচ্ছিস? তাহলে বোঝ, আমার কেমন লেগেছিল? আমার অতো সুন্দর লম্বা চুল!”
আদির চোখের সামনেও যেন সুমনার মাথা ভর্তি চুল ভেসে উঠলো। আসলেও মেয়েটার চুলগুলো সুন্দর ছিলো।
“তোর দুঃখ বুঝলাম, এবার তুই খুশিতো? আমি গেলাম?”
আদি আগাতেই সুমনা হাত দিয়ে আটকালো।
“আবার কি হলো?”
আদির কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।
“তুই আমাকে এভোয়েড করছিস?”
“দেখ সুমনা, আমি আর তোর সাথে ঝগড়া করতে চাইছি না। না এনার্জি আছে আর না মুড!”
“আশ্চর্য! আমি কি তোর সাথে ঝগড়া করছি নাকি? কথা বলতে চাইছি শুধু? ”
“কেন কথা বলতে চাইছিস? অন্য সময় যখন আমি তোর পিছন পিছন ঘুরি তুই তো একটুও পাত্তা দিতে চাস না। আর আজ আমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তুই ফোর্স করছিস!”
“এখনো রেগে আছিস?”
“এবং সেই রাগটা আমি আর তোর উপর দেখাতে চাইছি না। তোকে দেখলে মেজাজ খারাপ হচ্ছে তাই তোকে এভোয়েড করতে চাইছি। কিন্তু তুই তো নাছোড়বান্দা!”
“এভাবে কেন কথা বলছিস?”
“তো কিভাবে বলবো? দেখ সুমনা, আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আগের সেই বাচ্চামো এখন করলে মানাবে, বল? এসব এখন ছেড়ে দেওয়া উচিত। আজ আমি করবো কাল তুই করবি, এভাবে কি অনন্তকাল চলবে? তাই বলছি, এসব বাদ দেই।”
শান্ত কন্ঠে আদি উত্তর দেয়। কথাগুলো শুনে সুমনার মনে কেমন যেন হতাশা তৈরি হলো। মনেহলো, কেউ যেন জীবনের সব আনন্দ কেড়ে নিলো ওর কাছ থেকে। আদিকে কে বোঝাবে যে, আদির এসব দুষ্টুমি সুমনা এনজয় করতে শুরু করেছে আর নিজেও আদিকে জ্বালিয়ে মজা পাচ্ছে ভীষণ। সুমনা অনেক কষ্টে ঠোঁটে হাসি এনে আদির দিকে তাকিয়ে বললো-
“বেশ ভালোই তো, তোর মাঝে ম্যাচুরিটি এসেছে দেখে ভালো লাগলো। বেশ আজ থেকে তবে শান্তিচুক্তি হলো, নাকি?”
“কোনো চুক্তি ফুক্তি আদি করে না। ব্যাস, আদির আর ঝগড়া করার মুড নাই।”
কথাটা শুনেই সুমনার ভেতরটা জ্বলে উঠলো। মনে মনে ভেংচি কাটলো আদিকে। মুখে বললো-
“ওকে। যা তাহলে!”
আদি কিছু না বলে চলে গেলো। সুমনা পেছন থেকে আদিকে দেখছিলো আর মুখ বাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভেবে যাচ্ছে, এই মুডি আদিকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়? কি কথা? আদির আর ঝগড়া করার মুড নাই! হুহ। তোর মুডের এ্যায়সি কি ত্যায়সি। ভেবেছিলাম তোকে ছেড়ে দেবো। কিন্তু মুড দেখিয়ে ভুল করে ফেললি। এই সুমনাকে মুড দেখিয়ে তুই পার পাবিনা। নিজ থেকে তোর সাথে কথা বলেছি বলে তোর ভাব বেড়ে গেছে, তাই না? দাড়া, কালই তোর এই ভাব কমিয়ে দিচ্ছি। দেখি কাল তুই কিভাবে এতো ভাব নিয়ে চুপচাপ বসে থাকিস? সুমনা মুখে মৃদু হাসি দিয়ে আনমনে ওর গালে হাত বুলায়। সেই ছয় বছর আগের আলতো ছোঁয়া আজও যেন ওর মনে নতুন করে শিহরণ জাগিয়ে গেলো। কেউ জানে না, ওই স্পর্শ কতোটা প্রিসিয়াস ছিলো ওর কাছে। না বুঝে শুনে আদির হঠাৎ গালে দেওয়া স্পর্শ সুমনার ভেতরটা তো সেদিনই নাড়িয়ে দিয়েছিলো। সুমনা আজ আবার যেন সেই স্পর্শটা নিজের ভেতর অনুভব করতে চাইলো। কিছু না বুঝেই মনের অজান্তেই চোখ দুটো বন্ধ করে গালটা আবার স্পর্শ করলো সুমনা।

চলবে—–
©Farhana_Yesmin