বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-০৩

0
201

#বিবর্ণ_বসন্ত
৩য়_পর্ব
~মিহি

‘ভর্তা কি বরফ দিয়ে বানিয়েছো? একে তো ঠাণ্ডা তারপর পানসে। রান্নাবান্নাও পারোনা, মেয়ে হয়ে তবে পারোটা কী? শুধু খাওয়া?’ সোহরাবের কথায় অনামিকার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। খাওয়ার খোটা না দিলে সে হয়তো ক্ষমা চাইতো কিন্তু এ মুহূর্তে তার ক্ষমা চাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই। সোহরাব উঠে গটগট করে চলে গেল।

-‘অনু মা, সোহরাবের অপমানের জবাব দিলি না কেন? তোর সাথে এভাবে কথা বলার অধিকার ওর নেই। সবসময় যে আমিই তোর হয়ে কথা বলবো এমনটা ভাবিস না। তোকে শক্ত হতে হবে। নিজের জায়গা নিজেকে গড়তে হবে।’

-‘লোকটা আমার জন্য ঠিকমতো খেতে পারলো না মা।’

-‘আর তোকে কত কী শুনিয়ে গেল তার বেলা? অত সতী হতে যেও না মেয়ে।’

অনামিকা কিছু বললো না। চুপচাপ ঘরে গেল। সাজিয়া খাওয়ার জন্য সাধলেন কিন্তু অনামিকা না খেয়েই ঘরে চলে গেল। রাহেলা বানু বেশ খুশিই হলেন। সে তো এমনটাই চেয়েছিল।

দুপুরবেলা অযথা রাগ করে বের হয়ে আসলেই ভুল করে ফেলেছে সোহরাব। গা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে অনামিকাকে বললো এক মগ পানি আনতে। ঘর্মাক্ত গায়ে বাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না তার। অনামিকা কিছুক্ষণ বাদে মগে পানি আনলো। সে পানিতে হাত ডুবাতেই চেঁচিয়ে উঠলো সোহরাব। গরমে এমনিতেই অবস্থা খারাপ তার উপর গরম পানিতে হাত ডুবিয়ে মনে হচ্ছে হাতদুটো চুলোয় ঢুকিয়ে ফেলেছে।

-‘বুদ্ধিসুদ্ধি কিচ্ছু নেই তোমার? এত গরম আপনি এনেছো কেন?’

-‘আপনি তো আবার ঠাণ্ডা পছন্দ করেন না, তাই গরম পানি!’

অনামিকার কথায় চুপসে গেল সোহরাব তবে হাল ছাড়লে চলবে না।

-‘গরমের দিনে এত গরম পানি কে দেয়? আক্কেল নাই?’

-‘সকালবেলার ভর্তাও স্বাভাবিক দিছিলাম, আপনার ঠাণ্ডা লাগলো তাই ভাবলাম আপনার শরীর বোধহয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরমেই অভ্যস্ত।’

-‘হইছে। যাও এক গ্লাস ঠাণ্ডা শরবত করে আনো তো।’

অনামিকা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। সোহরাব রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে ঢুকলো। অনামিকা ঠোঁট টিপে হাসলো। সাজিয়া শেখ পেছন থেকে সবটাই দেখলেন। অনামিকার কাণ্ডে তিনি বেশ মজা পেয়েছেন তবে দেখে মনে হচ্ছে অনামিকা এত সহজেই বিষয়টা ছেড়ে দেবে না, আরো কিছু করবে।

অনামিকা রান্নাঘরে এসে শরবত বানাতে লাগল। এক গ্লাস পানিতে চার চামচ গুড়ো মরিচ, দুই চামচ হলুদ, হাফ চামচ চিনি আর দেড় কাপ লবণ দিল। মনে মনে হেসে বললো, ‘এবার বুঝবে মজা! রান্না নিয়ে তো ভালোই ভাষণ দিলো, এখন দেখাবো।’ সাজিয়া আড়াল থেকে সবটাই দেখলেন। কোনোরকমে হাসি চেপে রাখলেন তিনি। রান্নাঘর থেকে বেরোনোর আগে অনামিকা আরেকটা কাজ করলো। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে মিষ্টিগুলোকে লবণ গোলা পানিতে বেশরকম করে মাখিয়ে প্লেটে ঢেকে রাখলো। এ কাজের কারণ তখনো বুঝে উঠেননি সাজিয়া। তিনি অনামিকার পিছু পিছু গেলেন।

-‘এই নিন আপনার শরবত।’ অনামিকা শরবতের গ্লাসটা সোহরাবের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

শরবত একটু মুখে দিতেই সোহরাবের চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসলো। ঝাল, নোনতা সবরকম স্বাদ জিহ্বায় একসাথে বিশ্রিভাবে হামলা করেছে। শরবতটুকু মুখ থেকে ফেলে হাঁসফাঁস করতে লাগল সোহরাব।

-‘কী বানিয়েছো এটা?’

-‘না মানে রান্নাবান্না পারিনা তো তাই আর কী! খুব খারাপ হয়েছে?’

সোহরাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সকালের কথার খোঁটা দিচ্ছে অনামিকা। অবশ্য দোষ তো সোহরাবেরই। সকালে ভর্তা ততটাও খারাপ ছিলনা তবুও অযথা পে অনামিকাকে কথা শুনিয়েছে। বাবা তাকে সবসময় শেখাতো বউকে দাবিয়ে রাখতে হবে কিন্তু অনামিকাকে যে দাবানো যাবে না তা হাড়ে হাড়ে টের পেল সোহরাব। মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইল।

-‘আমি দুঃখিত অনামিকা। সকালে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি।’

-‘ভুল যখন বুঝতে পেরেছেন তখন মিষ্টিমুখ করুন দাঁড়ান।’

অনামিকা রান্নাঘর থেকে প্লেটে ঢাকা মিষ্টিগুলো এনে সোহরাবের দিকে বাড়িয়ে দিল। সোহরাব সরল মনে একটা মিষ্টি মুখে পুরতেই মস্তিষ্ক ছ’নম্বর বিপদ সংকেত দিল। চটজলদি মিষ্টিটুকুও ফেললো। অনামিকা তখন হাসতে লাগল।

-‘এটা ছিল খাওয়ার খোঁটা দেওয়ার জন্য। এরপর থেকে বুঝে শুনে কথা বলবেন।’

-‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।’

অনামিকা হাসলো। সোহরাব তবে নিজের ভুল বুঝেছে। অবশেষে তার একটা সুখের সংসার হতে চললো। সোহরাবের জন্য নতুন করে শরবত বানিয়ে আনলো অনামিকা। শরবত খেয়ে প্রশংসা করলো সোহরাব। সাজিয়া শেখ শান্তি পেলেন। অবশেষে তার সংসারের জন্য যোগ্য মেয়ে বাছতে পেরেছেন তিনি। এ মেয়েই পারবে সংসারটা বেঁধে রাখতে।

বিকেলবেলা সুমি এলো। সুমিকে পেয়ে অনামিকার ভালো লাগলো। তন্বীও খুশি। দুজন মিলে অনামিকার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। পাশের এলাকায় মেলা বসেছে। তারা দুজন যাওয়ার জেদ করছে কিন্তু সোহরাব রাজি হচ্ছে না। মেলায় ভীড় বেশি, ওদের নিয়ে মেলায় যাওয়ার মতো রিস্ক সে নেবে না। তাই দুজন অনামিকাকে বলছে সোহরাবকে ম্যানেজ করতে। এদিকে রাহেলা বানুও সোহরাবকে বলছে,’ বাচ্চা মানুষ, নিয়ে যা।’ শেষমেশ অনামিকাও বলাতে সোহরাব রাজি হলো। সোহরাব অনামিকাকেও বললো রেডি হতে। এতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন রাহেলা।

-‘বাড়ির বউ কেন মেলায় যাবে? কিসের এত রঙঢঙ বাপু! পরপুরুষরে রূপ দেখাইতে যেতে হবে?’

-‘তন্বী আর সুমিও যাচ্ছে ফুফু। অযথা আমার বউকে দোষারোপ করবে না। তাছাড়া অনামিকাও বয়সে খুব বড় নয়, ওরও শখ থাকতেই পারে। বিয়ের পর তো ঠিকমতো ঘোরাই হয়নি ওর।’

এই প্রথম সোহরাব অনামিকার পক্ষে কথা বললো। তাতেই রাহেলা বানু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সাজিয়া অনামিকার কানে কানে বললো,’সকালের ডোজটা ভালোই কাজে দিয়েছে রে মা।’ অনামিকা লজ্জা পেয়ে হাসলো। অতঃপর রেডি হতে গেল।

মেলার প্রবেশমুখে ভীড় দেখে গা গুলিয়ে আসলো অনামিকার। এত ভীড়ের মধ্যে অযথা আসলো সে। ফুফু ঠিকই বলেছিল, এ মেলায় তার আসা উচিত হয়নি। তবে সোহরাব তাদের তিনজনকে অন্য একটা গেইট দিয়ে ঢোকানোর ব্যবস্থা করলো যেখানে ভীড় নেই। মেলায় হরেক রকম দোকানপাট বসেছে। আশেপাশের তিন-চার এলাকার মধ্যে এটা সবচেয়ে বড় মেলা। মানুষজনে গিজগিজ করছে জায়গাটা। সুমি আর তন্বী নাগরদোলায় উঠার বায়না করছে। সোহরাব অনামিকাকেও উঠতে বললো। তাতেই চমকে উঠলো অনামিকা। নাগরদোলা সে মারাত্মক ভয় পায়। ছোটবেলায় একবার নাগরদোলায় উঠতে গিয়েই পড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে নাগরদোলাভীতি তার মনে বিদ্যমান। তবুও তন্বী আর সুমির জোরাজুরিতে চারজন উঠলো নাগরদোলায়। উঠা অবধি ঠিক ছিল, যখনি নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করলো অনামিকা সোহরাবের হাত চেপে ধরে বিড়বিড় করতে লাগলো।

-‘এই তুমি নাগরদোলা ভয় পাও? হায় ফায়! বাচ্চারাও তো এত ভীতু হয়না।’

-‘আরেকবার শরবত না খেতে চাইলে চুপ করুন।’

সোহরাব চুপ করে। অনামিকার হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে নেয়। কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার শোনা যাচ্ছে বাচ্চাদের। এক পর্যায়ে অনামিকারা যেখানে বসেছিল সেটা উপরে গিয়ে থেমে গেল। সুমি আর তন্বী আশপাশটা দেখছে। সবকিছু ছোট দেখাচ্ছে। অনামিকার নিচে তাকাতেই পা কাঁপছে, আশেপাশে দেখতে গেলে সে নির্ঘাত মারা পড়বে। নাগরদোলা ভীতি তো আছেই, উচ্চতা ভীতিও এখন চেপে ধরেছে। সোহরাব অনামিকার অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসছে। আচমকা তন্বী নিচের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,’রাইসা আপু…!’
অনামিকার সমস্ত ভয়-ভীতি যেন অদৃশ্য হয়ে গেল নামটা শুনে। রাইসা! সোহরাব তো একেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। অথচ সে পাগলের মতো ভেবে বসেছিল এবার বুঝি তার সংসার পূর্ণতা পেল। রাইসার নাম শুনে সোহরাবের চোখেমুখেও বিস্ময় খেলা করছে তবে অনামিকার মুখভঙ্গি সোহরাব বুঝে উঠতে পারছে না। আচমকা নিচে কয়েকজন ছেলে এসে গোলমাল শুরু করলো। অনামিকারা নাগরদোলা থেকে নামতে নামতেই গোলমাল বড়সড় আকার ধারণ করলো। ছেলেগুলো দা-ছুরি নিয়ে মারামারি করতে লেগে পড়েছে। সাধারণ মানুষজন জায়গা ছেড়ে পালাচ্ছে। এরই মধ্যে অনামিকা, সুমি আর তন্বীকে নিয়ে সামনে এগোতে গিয়ে ধাক্কা খায় সোহরাব। অনামিকা আশঙ্কায় আঁতকে উঠে।

চলবে…