বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-০৪

0
178

#বিবর্ণ_বসন্ত
৪র্থ_পর্ব
~মিহি

আচমকা তন্বী নিচের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,’রাইসা আপু…!’
অনামিকার সমস্ত ভয়-ভীতি যেন অদৃশ্য হয়ে গেল নামটা শুনে। রাইসা! সোহরাব তো একেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। অথচ সে পাগলের মতো ভেবে বসেছিল এবার বুঝি তার সংসার পূর্ণতা পেল। রাইসার নাম শুনে সোহরাবের চোখেমুখেও বিস্ময় খেলা করছে তবে অনামিকার মুখভঙ্গি সোহরাব বুঝে উঠতে পারছে না। আচমকা নিচে কয়েকজন ছেলে এসে গোলমাল শুরু করলো। অনামিকারা নাগরদোলা থেকে নামতে নামতেই গোলমাল বড়সড় আকার ধারণ করলো। ছেলেগুলো দা-ছুরি নিয়ে মারামারি করতে লেগে পড়েছে। সাধারণ মানুষজন জায়গা ছেড়ে পালাচ্ছে। এরই মধ্যে অনামিকা, সুমি আর তন্বীকে নিয়ে সামনে এগোতে গিয়ে ধাক্কা খায় সোহরাব। অনামিকা আশঙ্কায় আঁতকে উঠে। অনামিকা ধরার আগেই এক রমণী টেনে তুললো সোহরাবকে।

-‘ঠিক আছো সোহরাব?’

-‘হ্যাঁ রাইসা। তুমি কেমন আছো?’

-‘আগে এখান থেকে চলো। পরে বলছি।’

রাইসা তখনো সোহরাবের হাত ধরে রেখেছে। বিরক্ত লাগছে অনামিকার। শেষে সে খানিকটা জোর করেই সোহরাবের হাত ধরে টেনে মেলার বাইরে নিয়ে যেতে থাকলো। পিছু পিছু তন্বী আর সুমিও এলো। মেলা থেকে বের হতেই অনামিকা রাইসাকেও তাদের পাশে দেখতে পেল। মেয়েটা তবে সোহরাবের সাথে আলাপ না করে যাবে না। বেহায়া-বেশরম মেয়ে কোথাকার! সোহরাব খানিকটা হেসে বললো,’রাইসা, বাড়ি চলো। অনেকদিন আড্ডা দেওয়া হয়নি।’ সোহরাবের কথায় অনামিকার রাগ আরো বাড়লো। বিড়বিড় করে বলতে লাগল,’আদিখ্যেতা হচ্ছে? বাড়িতে চলো। বের করবো সব আদিখ্যেতা। পুরান প্রেমিকা পেয়ে দরদ উথলে পড়তেছে!’ অনামিকার ইচ্ছের উপর পা পিষে দিয়ে সোহরাব রাইসাকে নিয়ে বাড়িতে গেল।

বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘণ্টা তিনেক আড্ডা দিয়ে রাইসা যখন যেতে বের হবে তখন প্রায় রাত হয়ে এসেছে। সোহরাব থাকতে বললেও রাইসা কথা শুনলো না। শেষে সোহরাব রাইসাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেল। অনামিকা কিছু বলার সুযোগ পেল না, শুধু মলিন চোখে সবটা দেখলো। সোহরাব বাড়ি ফিরলো রাত দশটার পর। অথচ বেরিয়েছে সেই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। এতক্ষণ লাগে একটা মেয়েকে বাড়িতে রেখে আসতে? অনামিকার মনের সন্দেহ ক্রমশ দানা থেকে চারাগাছ হতে শুরু করেছে। এটাকে এখনি ক্লিয়ার না করলে পরবর্তীতে আরো ঝামেলা জন্মাবে।

-‘সোহরাব, আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’

-‘হ্যাঁ বলো। কথা না শুনলে তো আবার শরবত খাওয়াবা।’

-‘এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি? রাইসা আপুকে রেখে আসতে নিশ্চয়ই এতক্ষণ লাগেনি?’

-‘টিপিক্যাল বউদের মতো জেরা করতেছো কেন? তোমাকে কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে?’

-‘আমার জানার অধিকার আছে। সেদিন ফোনেও আপনি কাকে যেন বলছিলেন রাইসাকে বিয়ে করলে ঝামেলা হতো না। স্ত্রী হিসেবে আপনার থেকে এসব সম্পর্কে জানার অধিকার আমার আছে।’

-‘সকালে? ওহ হো! তুমি ভুল বুঝেছো। সকালে আমার বন্ধু আফিফ কল করেছিল। ও আর রাইসা কলেজ লাইফে প্রেম করতো কিন্তু শেষমেশ আফিফ রাইসাকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে। রাইসা সব জানতে পেরে অনেক ঝামেলা করছিল। রিসেন্টলি রাইসা এ শহরে আফিফকে শিক্ষা দিতেই এসেছে। এখন আফিফ বলছে কোনমতে রাইসাকে ম্যানেজ করতে। তাই বলেছিলাম যে রাইসাকে ও বিয়ে করলে এত ঝামেলা হতো না।’

-‘রাইসা এখানে থাকেনা? তাহলে বললেন যে বাড়িতে রাখতে যাচ্ছেন?’

-‘রাইসার পৈত্রিক বাড়ি এখানে কিন্তু ও ঢাকায় থাকে। আর আমি এতক্ষণ আফিফের বাড়িতে ছিলাম। ওর সাথে গল্প করছিলাম। হয়েছে এবার?’

-‘হুম।’

অনামিকা চুপচাপ শুয়ে পড়লো। রাতের খাবারটাও খায়নি বোধহয়। সোহরাবেরও আর খেতে ইচ্ছে হলো না। সে তো সব সত্যি বলেই দিল তবুও কেন অনামিকা রাগ করে বসে আছে? মনে মনে কিঞ্চিত বিরক্তও হলো সে। অনামিকা কি তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না? এতটাই অবিশ্বাস্য সে?

_____________________

রাহেলা বানুর কোমড়ের ব্যথা সেরেছে। সকালবেলা ধীর পায়ে পায়চারি করছিলেন তিনি। আচমকা বাইরে একটি ছেলেকে দেখতে পেলেন। বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে সাধারণ ঘরের। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক, মুখে উদভ্রান্ত ভাব। রাহেলা এগিয়ে ছেলেটাকে ডাকলেন।

-‘এই যে ছোকরা! কে তুমি? আমাদের বাড়ির দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছো কেন?’

-‘আসসালামু আলাইকুম, খালাম্মা। আমি আসলে অনার প্রতিবেশী মানে অনামিকার। পাড়াতো ভাইও বলতে পারেন। ওর জন্য কিছু বই আর বাকিদের জন্য ফল আর সবজি পাঠিয়েছেন খালা।’

-‘তা ভেতরে এসো। বিয়েশাদির পর বউ বই দিয়ে আর কী করবে বলো।’

-‘অনার তো পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ খুব, ওকে পড়তে দিলে ও অনেকদূর এগোবে।’

রাহেলা ভ্রু কুঁচকালেন। কথা বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। ছেলেটাকে হলে বসিয়ে রেখে তিনি অনামিকাকে ডাকতে গেলেন। পরক্ষণেই মনে হলো ভালো একটা সুযোগ পেয়েছেন সোহরাবকে খেপানোর। দ্রুত পা চালিয়ে গেলেন অনামিকার ঘরে।

-‘অনামিকা দরজা খোলো তো। দেখো তো একটা ছেলে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।’

-‘আসছি ফুফু।’

চটজলদি অনামিকা দরজা খুললো। সোহরাব কেবল শুনলো একটা ছেলে এসেছে দেখা করতে। তৎক্ষণাৎ সেও উঠে হলের দিকে এগোল।

-‘আরে পলাশ ভাই! কেমন আছো তুমি? বান্দরবান থেকে কবে এলে?’

-‘এটুকু সময়ের জন্য বাইরে গেছি। অমনি বিয়ে সেরে ফেললি অনা? একবার বললিও না তো। রাগ করেছি যাহ!’

-‘এমা! তোমার সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না গো। তুমি বসো, আমি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লেবুর শরবত আনছি। তোমার তো লেবুর শরবত পছন্দ।’

অনামিকা চটজলদি রান্নাঘরে যায়। সোহরাব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অনামিকা কি জানে সোহরাবেরও লেবুর শরবত পছন্দ? অথচ এই কোথাকার কোন ছেলে তার পছন্দ ঠিক জানে! রাগ হচ্ছে সোহরাবের। সামনে থাকা মানুষটার বডি ফিটনেস ও পোশাক বলে দিচ্ছে সে আর্মিম্যান। সোহরাব খানিকটা বিরক্তি সত্ত্বেও আলাপ করতে বসলো।

-‘আপনি অনামিকার প্রতিবেশী?’

-‘জ্বী। ছোট থেকেই দেখছি ওকে, বলতে পারেন কোলেপিঠে মানুষ করেছি। অথচ দেখেন আমাকেই ফাঁকি দিয়ে বিয়ে করে ফেললো।’

সোহরাব ভ্রু কুঁচকাল। এ ছেলের কথাবার্তা তার মোটেও ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারলে বাঁচে। অনামিকা শরবত এনে পলাশকে দিল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে চললো তাদের আড্ডা। অনামিকা মায়ের খোঁজ নিল। অনামিকা অবশ্য পলাশকে খেয়ে যেতে বললো কিন্তু তার তাড়া আছে বিধায় আর বসলো না। পলাশ চলে গেলেও সোহরাবের মনের খচখচানি দূর হচ্ছে না। সরাসরি গিয়ে কি একবার অনামিকাকে জিজ্ঞাসা করবে? না থাক! কী না কী ভেবে ফেলবে! সোহরাব ফ্রেশ হয়ে তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য বেড়োলো। তাড়াহুড়োয় নিজের ফোনের জায়গায় ভুলবশত অনামিকার ফোনটা নিয়ে চলে গেল। অনামিকা ঘর গোছাতে এসে দেখলো সোহরাব নিজের ফোন ফেলে গেছে। সোহরাবের খামখেয়ালিপনাকে বিদ্রুপ করে সে কিছুক্ষণ হাসলো। অতঃপর ঘর গোছানোতে মনোনিবেশ করলো। কাজের ফাঁকে তন্বী একবার এলো অনামিকার ঘরে।

-‘ভাবী, তোমার ফোনটা একটু দেও তো। গেম খেলবো।’

-‘আমার ফোনটা তো তোমার ভাইয়া নিয়ে গেছে ভুল করে।’

-‘সর্বনাশ!’ (বিড়বিড় করে)

-‘কী বিড়বিড় করছো?’

-‘না ভাবী কিছুনা। থাকো আসি।’

বলেই তন্বী একদৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনামিকা অবাক চোখে তন্বীর যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। ফোনের শব্দেই ধ্যান ভাঙলো তার। সোহরাবের ফোন বাজছে। জরুরি কল ভেবে ফোনটা রিসিভ করলো সে। স্ক্রিনে ‘আফিফ’ লেখা।

-‘কী রে ভাই? মরছোস? বিয়েশাদী কইরা তো ভুলেই গেছস! তাই বলে চারদিন ধরে ফোন করস না, মেসেজের রিপ্লাই দেস না! এমনে পর করতে পারলি?’

-‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, আমি অনামিকা। আপনার বন্ধু ফোন ফেলে গেছে।’

-‘ওয়ালাইকুম সালাম ভাবী। দুঃখিত! ও আসলে বলবেন আমার সাথে যেন একটু দেখা করে।’

-‘জ্বী আচ্ছা।’

ফোন রেখে দিতেই অনামিকার মাথা ঘুরে উঠলো। সোহরাব আফিফের সাথে ছিল না কাল। তবে কি সোহরাব তাকে মিথ্যে বলে রাইসার সাথে এতক্ষণ সময় কাটিয়েছে?

চলবে…