বিবাহিতার সাতকাহন পর্ব-০৪

0
238

#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪

শ্বাশুড়ি মা খালা শ্বাশুড়িকে গলাটা জোরালো করে বলছেন

“রেবাকে বিয়ে করালে আজকে এ দিন দেখতে হত না রে বোন। রেবার মা কত করে আমার ছেলেটাকে চাইল। নুহাশ যদি এ মেয়েকে পছন্দ না করত তাহলে তো রেবাকেই বিয়ে করিয়ে আনতাম। রেবার বাবার ঢাকায় ৪,টা বাড়ি। দুই ছেলেমেয়ে। রেবাতো অর্ধেক পেত। আমার ছেলের জন্য ঐসব মেয়েরাই যোগ্য। কিন্তু কপাল খারাপ বলে ফকিন্নি জুটেছে। সবি কপাল। ”

আমি কথাগুলো শুধু হজম করে যাচ্ছিলাম। বুঝার মতো কেউ হয়তো এ বাড়িতে আমার জন্য নেই। টাকা কী সুখ দিতে পারে? কেন মেয়ের পরিবার কেবল ছেলের টাকা দেখে। কেন মনে করা হয় আর্থিক ভাবে স্বচ্ছলতায় সকল সুখের চাবিকাঠি।

আমি খাবার টেবিল থেকে উঠে রুমে গেলাম। অনেক কাঁদতে ইচ্ছা করলেও কাঁদতে পারছিলাম না। হয়তো এতে কেউ সন্দেহ করে সত্যি সত্যিই আমার উপর কথা তুলে দিবে৷ বলে উঠবে আমার হয়তো কোনো সম্পর্ক ছিল তাই সে ছেলের জন্য কাঁদতেছি। ইতোমধ্যে নুহাশ তো বলেই ফেলেছে। তাই নিজেকে কিছুটা সামলে কষ্টটা মানিয়ে নেওয়ার তুমুল চেষ্টা করলাম।

অরুন ভাই যাওয়ার সময় আমার সাথে আর দেখা করে যায়নি। আমাকে না বলেই বাড়ি চলে গেছে৷ হয়তো আমাকে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। এত শখ করে ধুমধাম করে বোনের বিয়ে দিয়ে এত বড়ো প্রতিদান পাওয়ার পর তো তার কোনো মন্তব্য থাকতে পারে না। তাই আমার সম্মুখে আসার দুঃসাহসিকতা না দেখিয়ে আড়ালেই চলে গেল।

দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে গেল। আজকে নুহাশ আসার কথা কারণ কাল রিসিপশন। বাড়িটা রাস্তার পাশে হওয়ায় ড্র-ইং রুম থেকে রাস্তা দেখা যায়। নুহাশ আসলে তো এ রাস্তা দিয়েই আসবে। এখানেই নামবে প্রথম। তারপর নাহয় বাড়িতে ঢুকবে। আমি ড্র-ইং রুমে বসে চাতক পাখির মতো বাইরে তাকিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছি। কখন সে আসবে আর আমার নয়ন জুড়াব তাকে দেখে। বিয়ের কবুল বলার পর এ অপরিচিত ব্যক্তিটার প্রতি একটা নৈসর্গিক টান চলে এসেছে যা চাইলেও দুর্নিবার করা সম্ভব না। কখনও ডাহুকের ন্যায় গলা উঁচিয়ে আবার কখনও চাতক পাখির মতো অসহায় চিত্তে রাস্তা বরাবর তাকিয়ে আছি।

এরমধ্যে কতবার শ্বাশুড়ি মা এসে এটা সেটা বললেন। কিন্তু কোনো কথায় যেন আমার মাথায় ঢুকছে না। সবকিছুতে শুধু নুহাশ আসার আনন্দটায় বিরাজ করছে। আমার মন পড়ে আছে নুহাশের কাছে৷ শুনেছি অনেক আগে রওনা দিয়েছে। এতক্ষণে তো আসার কথা। মা এসে পাশের সোফায় বসতেই বলে উঠলাম

“নুহাশের আর কতক্ষণ লাগবে আসতে?”

মা কিছুটা বিরক্ত গলায় জবাব দিল

“এমন তো না নুহাশের সাথে কথা বলো না। ফোনে তো কথা হয়েই। তুমি জিজ্ঞেস করে নাও। আমাকে বলে শুধু শুধু নাটক করার দরকার নেই। বুঝানোর দরকার নেই যে, তুমি সব খবরাখবর আমার কাছ থেকেই নাও।”

উনার কথা শুনে মাথাটা নুইয়ে ফেললাম। তবুও বেহায়া চোখ দুটো শুধু জানালার কাঁচ ভেদ করে রাস্তার দিকে চলে যায়।

বিকেল তিনটে। রাস্তায় নীল গাড়িটা দাঁড়িয়েছে৷ বুঝতে আর বাকি রইল না নুহাশ এসেছে। শ্বশুড় শ্বাশুড়ি দুজনেই ড্র- ইং রুমে বসা। নুহাশ আসলে তার সাথে আমার প্রথম চোখাচোখি উনাদের সামনে হলে বেশ লজ্জায় পড়ে যাব। তাই নিজের অসীম আবেগের ছন্দমালা আর লজ্জাবতী লাল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকে বেঁচে উঠার জন্য সোফা ছেড়ে সরাসরি নিজের রুমে চলে আসতে নিলাম। মা পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করল

“কোথায় যাচ্ছ? এতক্ষণ যে নুহাশ,নুহাশ করে মাথা খাচ্ছিলে এখন তো নুহাশ এসেছে। একটু পরেই রুমে ঢুকবে। তুমি এখন উঠে কোথায় যাচ্ছ?”

আমি মাথা নুইয়ে লজ্জায় লাল হয়ে উত্তর দিলাম

“মা ভীষণ লজ্জা করছে।”

বলেই রুমে চলে আসলাম। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের ফ্যাকাশে চেহারাটাকে একটু রঙিন করতে লেগে গেলাম। হালকা লিপস্টিক, আইলাইনার,কাজল আর ছোটো ছোটো চুল গুলো আঁচড়ে নিলাম। আমি এমনিতেও অনেক সাজগোজ পছন্দ করি৷ পড়াশোনার বাকিটা সময় আমার পার হত সাজগোজ করেই। আর এখন স্বামী আসবে রুমে, আমি সাজব না… তা তো হয় না। হাতে চুড়িগুলো পরে নিলাম। চটপট শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে নিলাম। শূন্য কপালটায় লাল বিন্দু দিয়ে পূর্ণ করলাম।

দরজা খোলার আওয়াজ শুনে বুকটা আচমকা কেঁপে উঠল। বাইরে আড়ি পেতে শুনতে লাগলাম। নুহাশের কণ্ঠস্বর কানে আসলো। সবাইকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে নুহাশ মাকে বলল

“মা মুমু কোথায়? ওকে দেখছি না যে?”

উত্তরে মা বললেন

“এতক্ষণ এখানে বসে ছিল। তুই এসেছিস শুনে রুমে চলে গেছে। ”

আমি বুঝতে পারলাম, মা যেভাবে নুহাশকে কথাটা বলেছে সেটা তার কাছে স্বাভাবিক লাগবে না। কারণ আমি মাকে ইতিবাচক ভাবে বলেছিলাম আর মা বিষয়টাকে নেতিবাচক করে উপস্থাপন করেছে। সব মিলিয়ে মুখটা মলিন হয়ে গেল আমার। ড্রেসিং টেবিলের সামনেই বসে আছি আমি। ব্যকুল মনটা এখনও নুহাশকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য ছটফট করছে।

এসব ভেবে আয়নায় তাকাতেই নুহাশের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। মনটা উথাল পাতাল করতেছে। হয়তো নুহাশ বলবে মুমু তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে৷ কিন্তু না আমার সকল আশায় জল ঢেলে নুহাশ বলে উঠল

“মুমু বিয়ের পর থেকেই দেখছি আমার ব্যাপারে তুমি উদাসীন৷ মা বলল আমি এসেছি শুনে তুমি রুমে চলে এসেছো যাতে করে আমাকে দেখতে নাহয়। আর এমনিতেও সবাই বলে যাচ্ছে আসার পর থেকেই তুমি প্যাচ প্যাচ করে কান্না করছো। এখন তো আমারও মনে হয় তোমার হয়তো এ বিয়েতে মত ছিল না৷ মুমু আমার কিন্তু কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমি তোমাকে পছন্দ করেই বিয়ে করেছি। তোমার যদি এর আগে সম্পর্ক থেকেও থাকে দয়াকরে আমাদের সংসারের জন্য সব ভুলে যাও। এসব আর নিতে পারছি না। বিয়ে করেছিলাম একটু শান্তির জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছে বিয়ের পর আরও অশান্তিতে পড়ে গিয়েছি।”

আমি চুপ করে নুহাশের দিকে তাকিয়ে আছি। তার কী আমার সাজসজ্জা চোখে পড়ে নি৷ একবারও কী মনে হয়নি, যে এভাবে সেজেগুজে আমার জন্য বসে আছে তার অন্য কোথাও সম্পর্ক থাকতে পারে না। সেদিন নুহাশের মনে আমার প্রতি একটা সন্দেহের বীজ বপন হয়েছিল যা কালেক্রমে আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করে।

কথা যা শুনার শুনে নিলাম। রাত হলো। নুহাশ আমার পাশে শুয়ে আছে। বিবাহ তো সে এমনি এমনি করেনি। আমাকে পাবার আকাঙ্খা তো তার আছেই। তবে সে পাবারও কিছু স্বাভাবিক দিক থাকা দরকার। শারিরীক চাহিদা কেবল একটা ছেলেরেই হয় না মেয়েরও থাকে। বিষয় গুলো স্বামী স্ত্রী মিলে সুন্দর করে বুঝাপড়া করে করা যায়। কিন্তু পুরুষরা যখন এক তরফা নিজের দিকটা দেখে যায় তখন সে সুন্দর মুহূর্ত টাও ফ্যাকাশে বেরঙিন হয়ে যায়।

সকালে উঠে নুহাশকে একটু জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইলাম। নুহাশ আমাকে একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল

“মুমু আমাকে এভাবে ধরো না আমার অনেক সুরসুরি লাগে।”

এর মধ্যেই দরজায় কড়া নড়ার শব্দ। কেউ একজন ডেকে বলল

“ভাবী উঠেন। পার্লারের লোক এসেছে সাজানোর জন্য।”

আমি দ্রূত উঠে দরজা খুললাম। তারপর পাশের রুমে চলে গেলাম সাজার জন্য।

আমাকে সাজাতে সাজাতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগল। এখন দুজন মিলে স্টেজে গিয়ে বসার পালা। কিন্তু নুহাশকে নিয়ে তৈরী হলো নতুন গন্ডগোল। আর গন্ডগোলের রসাতলে পড়ে মনে হচ্ছে আমি চিৎকার করে কেঁদে এখান থেকে চলে যেতে পারলে বেঁচে যেতাম।

কপি করা নিষেধ