বিবাহিতার সাতকাহন পর্ব-০৫

0
253

#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫

নুহাশের স্যুট নুহাশ সময় করে কিনতে পারেনি। নুহাশ ভেবেছিল স্যুট আমাদের দিক থেকে কেনা হয়ে গেছে। আর শ্বশুড় বাবা অরুন ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিলেও সেটা তিনি ব্যস্ততায় পাঠাতে ভুলে গেছেন। এখন নুহাশ বিষয়টা বুঝতে পেরে সামাল দিতে গিয়ে নিজের পুরাতন একটা স্যুট পরে নিল যাতে করে বিষয় টা নিয়ে কোনো ঝামেলা নাহয়। বিষয়টা সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমার শ্বাশুড়ির চোখ ফাঁকি দিতে পারে নি। তিনি আমার পাশে নুহাশকে পুরাতন স্যুট পরে দাঁড়াতে দেখে সবার সামনে কর্কশ ধ্বনিতে বলে উঠলেন

“আমার ছেলেকে এত বড়ো করেছি পুরাতন স্যুট পরে বিয়ে করার জন্য। আমার ছেলের কপাল এত খারাপ যে একটা স্যুটও জুটল না। মুমুর শাড়িটার দামেই তো ২৫ হাজার টাকা। শাড়ি, গহনা কোনো কিছুতে তো আমরা কার্পণ্য করিনি৷ তাহলে আমার ছেলের বেলায় এত অবিচার কেন? রিতীনিতী কী মুমুর পরিবার শিখেনি? এমন অলক্ষুণে কান্ড দেখব আশা করিনি। আমার ছেলে পুরাতন স্যুট পরে বিয়ের রিসিপশন করবে। এমনিতে কী ফকিন্নির জাত বলি।”

নতুন বউ মুখ ফুটে বলতেও পারছি না যে- আপনি কেন আমাকে ফকিন্নি বলছেন? আমার পরিবারের অবস্থা তো এত খারাপ না। বিয়ের সময় ৫ লাখ টাকার ফার্নিচার দিয়েছে। স্যুটের টাকা পাঠিয়েছে তাহলে এমন মন্তব্য কেন করছেন? এর দোষ কী আমাদের? আপনার ছেলে জানতই না স্যুটের টাকা পাঠিয়েছে। বাবা তো স্যুটের টাকা নিয়ে তাকে পাঠায়নি। তাহলে দোষটা কার আমাদের নাকি উনার। কথাগুলো মনে মনে বলতে পারলেও মুখ ফুটে আর বলতে পারলাম না। উপস্থিত সব আত্মীয় স্বজন নুহাশের দিকে তাকাতে লাগল আড় চোখে। বাবা পাশ থেকে মাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন

“নুহাশের মা থামো। স্যুটের টাকা আমি পঠাতে ভুলে গিয়েছিলাম। বিষয়টাতে আমাদের দোষ আছে। মুমুর পরিবারের দোষ নেই। ”

মায়ের আহাজারি তাতেও যেন কমছে না। এরপর ও একই কথা বলতে লাগল, ফকিন্নির জাত আমি৷ আমি আশা করেছিলাম নুহাশ বিষয়টা ঠিক করবে৷ মাকে অন্তত কিছু বলবে। কিন্তু নুহাশ একদম নীরব দর্শকের মতো ছিল। মনে হচ্ছিল এখানে তার কিছু বলার নেই৷ আমি শুধু নাটক গুলো দেখে যাচ্ছিলাম। খারাপ লাগলেও সেটা আর বলতে পারছিলাম না। আসার পর থেকেই একটা করে নাটক সামনে আসছে এতে বলারেই বা কী থাকে।

যাইহোক বিষয়টা কোনোরকম মিটমাট হলো। রিসিপশনের অনুষ্ঠানটাও ভালোভাবেই শেষ হলো৷ আজকে বাড়ির সবাই আমাকে সাথে করে নিতে চেয়েছিল। তবে শ্বাশুড়ি মা বললেন কাল নুহাশ নিয়ে যাবে সাথে তারাও যাবে। আমার পরিবার এতে কোনো আপত্তি করেনি৷ সবাই আমার কাছে এসে একে একে কথা বলতে লাগল। কেউ এসে বলল মুমু সত্যিই একটা সোনার ঘর পেয়েছিস তুই। কিন্তু সবাই তো জানে না আমি কেমন আগুনে পুড়তেছি। তাদের জবাবে শুধু হেসে যাচ্ছি। আস্তে আস্তে সবাই বিদায় নিল।

রক্তিম আকাশটা কালো হয়ে রাতের সমাবেশ ঘটল। সাজগোজ ধুয়ে, শাড়ি খুলে সালোয়ার কামিজ পরে বসে আছি রুমে। নতুন করে সাজগোজের কোনো ইচ্ছা জাগছে না। নুহাশের থেকে একটু প্রশংসা আশা করি। তবে নুহাশের চোখে এ সাজটা ধরায় পড়বে না যে সাজগোজ করব। যার জন্য সাজগোজ করব সে যদি না দেখে তাহলে সে সাজগোজের আর কোনো মূল্যই থাকে না। ভেতরটা ভীষণ পুড়ছে। কেউ যেন এ বাসায় আমাকে বুঝছে না। সবাই যেন আমাকে ভুল বুঝে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে অশান্ত মনটা কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছি না।

রাত ১১ টা বাজে। নুহাশ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেছে। আমি যে সেই ৭ টা থেকে অপেক্ষা করছি সেটা তো সে বুঝতেও পারছে না। এত কাছে থেকেও সে যেন কাছে নেই। হতাশা ঘিরে ধরছে তবুও বসে আছি এক অজানা সুখের একটু আশায়।

সাড়ে এগারটায় ননদ এসে হালকা গলায় বলল

“মা বলেছে গয়না গুলো খুলে মাকে দিয়ে দিতে। আবার যখন আপনি বাপের বাড়ি যাবেন তখন বের করে দিবেন। আপনার কাছে থাকলে হারিয়ে যাবে তাই মাকে দিয়ে দিত বলল এগুলো। এখনই খুলে দিন। ”

আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি তার দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সকল গহনা গুলো খুলে তাকে দিয়ে দিলাম।

রাত বাজে সাড়ে বারোটা। নুহাশ এসেছে রুমে। হালকা কথা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। নুহাশ পাশে থাকলে যেন একটু শান্তি লাগে। তবে স্বামী স্ত্রী এর স্বাভাবিক চাহিদা গুলো নুহাশের কিছু আচরণের জন্য আমি উপভোগ না করে ভুগতে থাকি ভীষণ। তখন অনেক বেশিই কষ্ট হয়।

পরদিন সকালে সবাই তৈরী হয়ে নিলাম আমাদের বাসায় যাওয়ার জন্য। আমিও শাড়ি পরে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। গলায় কানে কোনো গহনা না থাকায় মাকে সবার সামনেই বললাম

“মা বাড়ি যাচ্ছি গলা, হাত খালি করে গেলে একেকজন একেক কথা বলবে। আমাকে যদি গহনা গুলো দিতেন পরে যেতে পারতাম।”

মা আমার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল

“ওহ হো রে মা। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। রাতে সোনালি তোমার কাছ থেকে গহনা এনে আমাকে দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম তার ব্যাগে আপাতত রাখতে। আজকে সকালে ওর শ্বশুর অসুস্থ হওয়ায় দ্রূত চলে যায়। গহনা গুলো ওর ব্যাগে৷ এখন তো ওর থেকে আজকে গহনা আনতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তুমি নাহয় এভাবেই যাও। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলো গহনা ভারী লাগে তাই পরো নি।”

আমি মাথা নীচু করে আচ্ছা বললাম। চোখ বেয়ে পানি আসতে নিলেও সেটা আটকে দিলাম। নিজের গহনা নিজের ইচ্ছামতো পরারও কোনো সুযোগ পেলাম না। একেই বলে রাণী কপাল। সবাই তো বলেই আমার কপাল কত ভালো। এত ধনী আর বিসিএস ক্যাডার সুদর্শন জামাই পেয়েছি। কেবল আমি জানি আমার কপালের অবস্থা।

কথা না বাড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর সবাই মিলে আমাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম। অসম্ভব এক শান্তি লাগছে বাড়ি যাচ্ছি তাই। রাস্তা যতই এগুচ্ছে ততই যেন বুকটা বেশ প্রশান্ত লাগছে। শীতলতা ঘিরে ধরছে। মনে হচ্ছে আজকে আমার ইদ। এত ভালো লাগা কাজ করতেছে মুখে বর্ণণা করা দুষ্কর।

আস্তে আস্তে গন্তব্য সন্নিকটে আসলো। আর আমরা সবাই আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম দুপুর ২ টা ৩৩ মিনিটে। মা আর বোনরা মিলে সকল আয়োজন করেছে। আমরা যেতেই শ্বশুড় বাড়ির লোকদের নাস্তা দেওয়া হলো। সত্যিই বিষয়টা অন্য রকম এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। আমি আর নুহাশ দুজনেই বিয়ে করেছি। দুজনই সদ্য বিবাহিত। তবুও দুজনের গন্তব্য কত ভিন্ন। নুহাশের জন্য আমার বাড়িতে কত আয়োজন করা হলো আর তাদের বাড়ি যখন আমি সব প্রিয় মানুষ ছেড়ে গেলাম তখনও এত আদর পাই নি। এ আদরটা দরকার ছিল আমার।

দুপুরে সবাই মিলে একসাথে খেলাম। ইলিশ মাছ ভাজা,রুই মাছের ঝোল,মুরগীর রোস্ট,গরুর মাংস, কাবাব, ডাল, পাচ রকমের ভাজি, খাসির মাথা দিয়ে বুটের ডাল,পায়েস,পিঠা, সব ধরণের মিষ্টি। যতটুকু পেরেছে আয়োজন করেছে। যাতে করে শ্বশুড় বাড়ির কেউ বদনাম করতে না পারে।

খাওয়া শেষে সবাই তাড়া দিতেছে আজকেই আমাকে নিয়ে চলে যাবে। আমার বাড়ির সবাই ভেবেছিল কাল যাবে। তাই সবার জন্য আজকে কাপড় কিনে নি। ভেবেছিল কাল বিকেলে আমরা যাব আর সকাল বেলা সবাইকে কাপড় কিনে দিবে। এখন সবাই এত তাড়া লাগিয়েছে যে আমাদের পরিবার পরে গেল এক মহা বিপত্তিতে। এর মধ্যেই শ্বাশুড়ি মায়ের ধারালো কণ্ঠস্বর সবাইকে যেন আঘাত করল প্রবলভাবে। কারণ

কপি করা নিষেধ।