বিবাহিতার সাতকাহন পর্ব-০৯

0
216

#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৯

আধো আধো আলো কেবিনের জানালা দিয়ে মুখে পড়ছে। কিছুটা উষ্ণতা শরীরকে ঘিরে ধরেছে। আসরের আযান পড়ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম নুহাশ আমার পাশে বসা। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই সে বলে উঠল

“মুমু এত রাগ কার উপর ছিল যে এমন একটা কাজ করেছো?”

আমি ক্লান্ত গলায় উত্তর দিলাম

“রাগটা ছিল নিজের উপর। আর আমি চেয়েছিলাম একটু ঘুমাতে। সব মিলিয়ে কী হলো বুঝতে পারলাম না। আমার কেন জানিনা দম বন্ধ লাগতেছে। কিছু ভালো লাগছে না। তুমি থাকো না পাশে। আর একা একা খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার শান্তি যেন উড়ে গেছে। পড়াশোনাও করতে পারছি না। কী করব আমি৷ কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছি না।”

নুহাশ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“কিছুই করতে হবে না। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে আমার কাছে নিয়ে রাখতে। আমি তাই করব ভেবেছি।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঝেড়ে বললাম

“মা তো দিবে না।”

“মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।”

হাসপাতালে ৩ দিন ছিলাম। আপাতত একটু সুস্থ। আমাকে বাসায় আনা হলো। নুহাশ আমার বেশ যত্ন নিচ্ছে। আমাকে রুমে রেখে দরজার সামনে গিয়ে মাকে বলে উঠল

“মা মুমুকে আমার সাথে নিয়ে যেতে হবে৷”

মা বেশ রাগী গলায় উত্তর দিলেন

“দুদিন হলো না বিয়ে হয়েছে এখনই সাথে নেওয়ার কী দরকার? আর মুমুর তো এগুলো শুধু শুধু নাটক। ওর কিছুই হয়নি। নাটক করে তোর সাথে যেতে চাচ্ছে কেবল।”

নুহাশ প্রতি উত্তরে বলল

“মা, নাটক হোক আর যাই হোক ওকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। আমার চাকুরি নিয়েও টান দিতে পারে।”

বিস্ময় প্রকাশ করে মা জবাব দিল

“এতে চাকুরি নিয়ে টান কেন দিবে?”

নুহাশের কৌশলদীপ্ত উত্তর ছিল

“মা দেখো মুমু যদি নাটক করেও এসব করে। আর সে তথ্য যদি ওর পরিবার আমার অফিসে দেয় তাহলে সরকারি চাকুরী নিয়ে টান দিবে। কোনোভাবে যদি এ অভিযোগ আসে যে আমি বা আমার পরিবার মুমুর উপর অত্যাচার করছি তাহলে আর চাকুরি থাকবে না। মা আমি চাচ্ছি না আমার চাকুরিতে কোনো সমস্যা হোক। আজকে মুমু কিছু সমস্যা করছে না কালকে করবে না তার কী গ্যারান্টি।”

মা বেশ রাগ গলায় উত্তর দিলেন

“এমন বউ রাখার কী দরকার ছেড়ে দে।”

মায়ের কথাটা কানে আসতেই বুকটা যেন কেঁপে উঠল। একজন মা উনি, একজন মেয়ে আছে উনার আর সর্বোপরি উনি নিজেও একজন মেয়ে। একজন মেয়ে হয়ে কী করে আরেকটা মেয়ের সংসার নষ্ট করে দিতে বলল। উনার মেয়ের বেলায় কী সেটা পারত?

এর মধ্যেই নুহাশের উত্তর কানে আসলো। নুহাশ বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল

“মা ভুলেও এ কাজ করা যাবে না। এমন কাজ করলে আমাকে আর চাকুরি করতে হবে না। এসব ঝামেলায় চাকুরি চলে যায় বারবার বলতেছি। তুমি অবুঝের মতো কথা বলতেছো৷ তাহলে আমি তোমাদের কথা শুনে চাকুরি ছেড়ে বাসায় চলে আসি। বাকিটা তুমি চিন্তা করো কী করব। আমি আর এসব নিতে পারছি না। আমি নিজেই পাগল হয়ে যাচ্ছি এসব কারণে৷ কাজে মন বসছে না। আমার এমনিতেও আর চাকুরি থাকবে না। ”

আমি নুহাশের কথা শুনে চুপ করে রইলাম। কেন জানি না একটু অপরাধবোধ কাজ করছে। কারণ আমার এ বোকামির জন্য তার একটু হলেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে। টানা ৪ দিন অফিস থেকে ছুটি নেওয়া। এখানে এসে আমার পাশে বসে থাকা। তার উপর নিজের জন্মদাত্রী মায়ের কথা শুনা। সব মিলিয়ে সে ও মানসিক অশান্তিতে আছে৷ নিজের মধ্যেই বেশ খারাপ লাগা কাজ করতে লাগল। খারাপ লাগাটায় ভাটা পড়ল মায়ের কথায়। তিনি নুহাশ কে বলে উঠলেন

“এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে এতদূর এসেছিস। আমরা তো চাইব না এ সামান্য ব্যাপারে তোর কোনো ক্ষতি হোক৷ তুই তোর সুবিধামতো মুমুকে সাথে নিয়ে যাস। ”

কথাটা বলেই উনি কেঁদে দিলেন৷ তারপর কাঁদতে কাঁদতে বাকি কথা বললেন

“তবে বাবা বউকে পেয়ে মাকে ভুলে যাস না। মাকে পর করে দিস না। বিয়ের পর সব ছেলেরায় পর হয়ে যায়।”

“আরে মা কী বাজে বকতেছো। তুমি আমার মা তোমাকে কেন পর করে দিব। তোমার জায়গা সবার উপরে। এসব বলে প্লিজ আমাকে কষ্ট দিও না।”

“আমি তো আর স্বাদে বলি না। মন তো আর মানে না রে বাপ।”

কথাগুলো ঝপতে ঝপতে তিনি প্রস্থান নিলেন। মা চলে যাওয়ার পর নুহাশ আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“তুমি আমার স্ত্রী তোমাকেও আমি ভালোবাসি আর মাকেও। কারণ মা আমাকে জন্ম দিছে। তুমি কখনও মাকে ছোটো করবে না। আমি তোমাকে আমার সাথে করেই নিয়ে যাব। একা হাতে সব সামলাতে হবে। সব কাজ করতে হবে৷ পারবে তো?”

আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম

“সব পারব। কিন্তু কোথায় উঠব?”

নুহাশ মাথায় হাত বুলিয়ে পুনরায় উত্তর দিল

“পুলিশদের কোয়ার্টারে। তোমার থাকতে অসুবিধা হবে না সেখানে আরও অনেক মানুষ আছে। সবাই খুব মিশুক৷”

আমি শুধু হালকা হাসলাম। তার সাথে থাকতে পারব এটা ভেবেই বেশ আনন্দ লাগছে। দুদিন পর সব কিছু গুছিয়ে প্রস্তুত হলাম নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। নুহাশের মা বেশ কান্নাকাটি করে বিদায় দিলেন আমাদের। উনার হাবভাব এমন ছিল যে আমি উনার ছেলেকে উনার থেকে কেড়ে নিচ্ছি। ছেলের সাথে কথা বললেও আমার সাথে কোনো কথা বলে নি। যা বলার তিনি ছেলেকে বলেছেন। নুহাশের বাবা শুধু আমার মাথায় হাত রেখে বললেন

“সবটা গুছিয়ে চলেফেরা করো। আর আমরা তো আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকব।”

আমার নম্র উত্তর আসলো

“আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। দোয়া করবেন।”

“সেটা তো সবসময় করি।”

নুহাশের মা আমার সাথে কথা না বললেও আমি বিনয়ের সহিত উনাকে বললাম

“মা আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমার উপর কোনো কষ্ট রাখবেন না। দিনশেষে আপনি আমার মা আমি আপনার মেয়ের মতো। ”

মা কোনো জবাব না দিয়েই স্থান পরিত্যাগ করলেন।

গাড়িতে উঠলাম। নুহাশের কাঁধে মাথা রেখে নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভেবেছিলাম আমার জীবনের সব দুঃখ ঘুচে গেছে। তবে যে সুখের সন্ধানে গিয়েছিলাম সেটা যে বিলীন হয়ে নতুন দুঃখের সূচণা হবে সেটা কে জানত।

কপি করা নিষেধ