বিবাহিতার সাতকাহন পর্ব-০৮

0
217

#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮

নুহাশ আসার সাথে সাথেই শ্বাশুড়ি মা নুহাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল

“কী রে তুই আবার ফিরে এসেছিস বাবা? তোর রাগ পড়েছে এতেই খুশি আমি। মুমুর জন্য বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিস এটা ভেবেই আমার বুকটা কেঁপে উঠতেছিল বারবার।”

মায়ের কথা শুনে নুহাশ বেশ সাবলীল কণ্ঠে জবাব দিল

“মা মুমু কল করেছে বলেই এসেছি। নাহয় এ রাগ কমত না। তুমি আর মুমু ঝগড়া করো না আর। দুজনের এই সাপে নেউলে সম্পর্ক মানতে পারছি না। আর স্বাভাবিক ভাবে নিতেও পারছি না।”

নুহাশের কথা শুনে মা বেশ রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে চিৎকার গলায় উত্তর দিলেন

“দুদিন হয়নি বিয়ে হয়েছে এখনই বউয়ের কথায় উঠছিস বসছিস। আমার জন্য তো আসিস নি। এসেছিস বউয়ের জন্য। বউ এই তো এখন সব। মানুষ সত্যিই বলে বিয়ের পর ছেলে আর ছেলে থাকে না। পর হয়ে যায়। আর আমি মুমুর সাথে ঝগড়া করি? এত বড়ো কথা বলার আগে তোর বুক কাঁপল না? মুমুর পরিবার থেকে আমাকে অপমান করেছে আর সে অপমান পাবার পর আমি কিছু বললেই সেটা ঝগড়া হয়ে গেল। তুই তো তোর বউয়ের আঁচল ধরে এখনই ঘুরছিস। ”

আমি মায়ের কথা গুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নুহাশ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথায় সে বলছে না। আর এখানে বলার মতো কিছু থাকেও না। সে যা বলছে তাতেই যেন মা দোষ ধরে বেড়াচ্ছে। দিনশেষে এটাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে এ বাসায় সকল নষ্টের শিকর আমি।

সেদিনের মতো ঝগড়া মিটমাট হয়ে সবটা ঠিক হলো।।তবে দুঃখ যেন আমার পিছু ছাড়ছে না। নুহাশ চলে যাওয়ার পর থেকে আমার কেমন জানি শূন্য লাগতে শুরু করল। আমার শ্বাশুড়ি কারও সাথে আমাকে কথা বলতে দিত না। আমার রুমের জানালাটাও নেট দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে যাতে করে বাহিরের কারও সাথে কথা বলতে না পারি। দম বন্ধ পাখির মতো বাসায় বসে থাকতাম সারাদিন। নুহাশ ব্যস্ত থাকায় খুব একটা ফোন দিয়ে খুঁজ নিতে পারত না। আর এদিকে আমি কতক্ষণ পরপর নুহাশের ফোন দিয়েছে কি’না তা দেখে মোবাইল চেক করতাম। নুহাশ বলেছিল আমাকে তার সাথে নিয়ে যেতে। তবে শ্বাশুড়ি মায়ের কড়া নির্দেশ এখনই একসাথে থাকা যাবে না। এক বছর অন্তত এ বাড়িতে থেকে তারপর আলাদা থাকার চিন্তা করতে হবে। নুহাশ সেটা মেনেও নিয়েছে আর আমিও সেটা মেনে নিয়েছি। শ্বশুড় শ্বাশুড়ির আদর যত্ন করেই চলতে চেয়েছিলাম। তবে সে আশায় যেন ভাটা পড়ে গেল আমার। উঠতে বসতে কথা শুনতে হত। আর কারও সাথে মন খুলে কথা না বলতে পারায় আমি হুট করেই ডিপ্রশনে গিয়ে একদম চুপ হয়ে পড়ি। কারও সাথেই কথা বলতাম না। হ্যাঁ, না ছাড়া কোনো উত্তর দিতাম না। খেতেও পারতাম না। শরীর দুর্বল হতে লাগল। চোখ যেন গর্তে চলে গেল। সবকিছুতেই একটা বিতৃষ্ণা কাজ করতে লাগল। মনে হচ্ছিল আমি যদি মরে যেতাম সবচেয়ে ভালো হত। চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া যেন আমার কোনো কাজ ছিল না। মানসিক যন্ত্রণা দিনকে দিন বাড়তে লাগল৷ আমাকে প্রবলভাবে গ্রাস করতে লাগল।

কিছুদিনের মধ্যে আমি খুব অসুস্থ হয়ে গেলাম। তবুও আমাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হচ্ছে না। দুই, তিনদিন টানা জ্বরে ভুগলাম। নুহাশ জানতে পেরে শ্বাশুড়ি মাকে বলল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। অবশেষে নুহাশের কথায় তিনি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার আমার শরীরের অবস্থা দেখে মাকে জিজ্ঞেস করলেন

“উনার স্বামী কোথায়?”

মা অকোপটে উত্তর দিলেন

“অন্য জায়গায় থাকে চাকুরির সুবাদে।”

ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল

“কতদিন পর পর আসে?”

মা হালকা গলায় জবাব দিল

“১৫ বা ১ মাস পর পর”

ডাক্তার মায়ের কথা শুনে উত্তর দিলেন

“দেখুন আমি রোগীকে দেখেছি। রোগীর এ সমস্যাগুলো মানসিক সমস্যা থেকে হচ্ছে। এভাবে মানসিক সমস্যার বিস্তার ঘটতে থাকলে রোগীর সমস্যা বাড়বে। এরচেয়ে বরং রোগীকে তার হাসবেন্ডের সাথে থাকার ব্যবস্থা করুন।”

মা শুধু ডাক্তারের কথা গুলো শুনে গেলেন। প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার কিছু ঔষধ লিখে দিল সেগুলো নিয়ে তিনি বাসায় ফিরলেন। বাসায় ফেরার পর বাবা, মাকে জিজ্ঞেস করলেন

” মুমুকে ডাক্তার দেখে কী বলল?”

মা একটা ব্যাঙ্গাত্নক হাসি দিয়ে উত্তর দিল

“তেমন কিছু হয়নি। জামাই রোগে ধরেছে। আর শরীর দুর্বল। ”

বাবা কিছুটা বিস্মিত হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন

“জামাই রোগ মানে?”

“এতশত তোমার বুঝতে হবে না। এর কিছু হয়নি। ভান ধরছে যাতে জামাইয়ের কাছে যেতে পারে। আমাদের থেকে আলাদা থাকতে পারে। ডাক্তার কোনো রোগ খু্ঁজে পায়নি। ইচ্ছা করে না খেয়ে এমন রোগ বানাচ্ছে। সবই বুঝি আমি।”

বাবা আর কোনো কথা বাড়ালেন না। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। ইদানিং কিছুই ভালো লাগে না। নিজেকে বেশ অসহায় ছন্নছাড়া লাগে। নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার প্রয়াস যেন চলে গেছে। নিজের ভেতরের শান্তি যেন মাটি হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে দম বন্ধকর অবস্থা পার করছি। আগে মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম নুহাশের কলের জন্য। আজকাল তাও ভালো লাগে না। চাতক পাখির তিতিক্ষার শেষ প্রহর যেন বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

রাত বারোটা। টিকটিকি টিক টিক করে ডাকছে। আমার চোখ দুটো সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। অতৃপ্ত মনটা জানান দিচ্ছে আমি মোটেও ভালো না। এ দুনিয়া আমার জন্য না। মনে হচ্ছে মানুষ পঁচা গন্ধ নাকে ধেয়ে আসছে। এ দুনিয়া এবার বিদায় নেওয়ার পালা। অশান্ত মনটা পরপারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিলিং ফ্যানে নিজেকে ঝুলন্ত অবস্থায় কল্পনা করতে বেশ শান্তি লাগছে। এ যন্ত্রণা আমাকে গ্রাস করছে। আমার ভেতরটা পুড়িয়ে নিচ্ছে। আমার শরীরটা কম্পন দিয়ে উঠছে বারবার। নুহাশকে খুব মনে পড়ছে। ওকে যদি একটু কাছে পেতাম কত ভালো লাগত। পনের টা দিন ওর সাথে আমার ভালোভাবে কথাও হয় না।

দীর্ঘ দীর্ঘ দম নিচ্ছি। মনে মনে হাসছি। জামাই রোগ ধরেছে আমাকে এ কথা গুলো বিড় বিড় করে বলে হাসছি। বাবা থাকলে হয়তো কষ্ট আরও কম হত। বাবা মারা যাওয়ায় আরও শূন্য লাগছে। নিজের দুঃখ বলার মতো কাউকে পাচ্ছি না।

মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। ঘুমের ঔষধগুলো হাতে নিলাম। একবারে ২১ টা ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম। একটু শান্তির ঘুম দরকার। সুখ ভেবে যে আগুনে ঝাপ দিয়েছিলাম সে আগুন নেভাতে হবে। চোখ দুটো ভার হয়ে আসছে। কপালটা কুচকে যাচ্ছে। শরীর ভার হয়ে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। বুঝতে পারছিলাম আমার শান্তির ঘুমটা চলে এসেছে।

কপি করা নিষেধ