বিরোধীদলীয় প্রেম পর্ব-০৫

0
135

বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ৫
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]

বিয়ের এক সপ্তাহ পরেও স্বামীকে মানতে নারাজ মাহা। যেখানে সে এই সম্পর্কটাই মানে না সেখানে মানিয়ে নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। মিমির সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে ভার্সিটির প্রায় অর্ধেক ছেলেপেলে জেনে গেছে তার আর সা’দের বিয়ের ব্যাপারটা। যেই বিষয়টা মাহা সবার আড়লে রাখতে চেয়েছিল তা আজ সবার সামনে। এর পেছনে একজনই আছে আর সে হচ্ছে সা’দ। অন্যদিকে বাবার বাড়ি থেকে লাগাতার উপদেশ শুনতে হচ্ছে। অনেক ভালো পরিবার। সবার মন জুগিয়ে চলতে হবে। সবাইকে ভালোবাসতে হবে। বিশেষ করে স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে হবে। এই ধরনের কথা শুনতে শুনতে কানে পচন ধরে গেছে মাহার। বিয়ের ঝামেলায় পড়াশোনার চরম ক্ষতি হচ্ছে। বৌভাতের অনুষ্ঠান দুই দিন পরে হবার কথা থাকলেও তারিখ পিছিয়ে দেয় মাহার শ্বশুর। বড় ছেলে, বড় বউ, নাতি-নাতনি সবাই ইন্ডিয়া থাকায় কেউই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেনি। ছোটো ছেলের যন্ত্রণায় অতি দ্রুতই বিয়ের জন্য হ্যাঁ করেছিলেন তিনি। এতে অবশ্য বড় ছেলের মনে কোনো ক্ষোভ নেই। সে অনুমতি দিয়েছে বলেই বিয়েটা হয়েছে। ব্যবসায়ের কাজে তাকে ইন্ডিয়া যেতে হয়েছিল। অন্যদিকে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকায় স্ত্রী, বাচ্চাদের নিয়েই ইন্ডিয়া যায় সে। এখন বড় ছেলে আর বড় বউয়ের আসার অপেক্ষা। তাদের আসার দিন ক্ষণ জেনে বৌভাতের অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করা হয়েছে।
ঘড়িতে এগারোটা বাজে। মাহা নিচে নামে। এইভাবে হাত কোলে করে ঘরে বসে থাকতেও লজ্জা লাগছে তার। যদিও শাশুড়ি কোনো কিছুই করতে দেন না তাকে। বাড়িতে খালা শাশুড়ি, মামি শাশুড়ি, ফুফু শাশুড়ি সেই সাথে খালাতো, মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো ননদ, দেবরদেরও অভাব নেই। সব মিলিয়ে এই পরিবারের জনসংখ্যা বিশাল আকৃতির। অনুষ্ঠান কিছুদিন পরে করবেন বলে সবাইকে নিজের কাছে রেখে দেন জাফর সাহেব। জাফর ইসলাম বড় ভালো মনের মানুষ। আনন্দে থাকতে ভালোবাসেন। তার স্ত্রী রাহেলাও ভালো মনের অধিকারী। বড় বউয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে তর্কে গেলেও দিন শেষে সবাইকে নিয়ে সুখেই আছেন তিনি। মাহাকে নিচে নামতে দেখে রাহেলা এগিয়ে আসেন। হাত ধরে নতুন বউকে সোফায় নিজের কাছে বসান। হাসিমুখে বলেন, ‘তোমাকে ডাকব ভাবতেছিলাম, কিন্তু পরে ভাবলাম যদি ঘুমাও। তাই আর ডাকি নাই। কী খাবা? কিছু দিতে বলি?’
মাহা নিচু স্বরে জবাব দেয়, ‘নাস্তা করলাম কিছুক্ষণ আগে। এখন আর কিছু খাব না আন্টি।’
ছেলের বউয়ের মুখে আন্টি ডাক শুনে আশ্চর্য হন রাহেলা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখেন তার ভাইয়ের বউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনিও আশেপাশে তাকিয়ে মাহার কাছে এসে বসলেন। বললেন, ‘উনি তোমার শাশুড়ি। আন্টি না মা ডাকবা। ভুলেও কারো সামনে আর আন্টি ডাকবা না। ঠিকাছে?’
মাহা বুঝতে পারছে যে সে ভুল করেছে। এই ভুলটা সে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই করেছে। তাই তৎক্ষনাৎ নিজের ভুলটা শুধরে নেয়। বলে, ‘আসলে আমি বুঝে পারিনি। আমার ভুল হয়ে গেছে মা।’
রাহেলা হাসিমুখে মাহাকে বুকে টেনে নেন। হাত ধরে ছোটো ছেলের বউকে রান্নাঘরে নিয়ে যান। এটা সেটা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মাহাও বোঝার চেষ্টা করছে আর ভাবছে অনেকটা অসহায় অবস্থায় সে না চাইতেও সা’দের জীবনে এসে পড়েছে। তাদের দাম্পত্য জীবনটা ওতটা সুখকর হবে না যতটা অন্য আর পাঁচটা বিবাহিত দম্পতির জীবনে হয়ে থাকে। তবে এখন পর্যন্ত এই বাড়ির দু’জন মানুষকে তার ভালো লেগেছে। এমন শ্বশুর শাশুড়ি অনেক কম মেয়েই পায়। কিন্তু এমন স্বামী বোধ হয় কোনো মেয়েরই পাওয়া উচিত না।
রাহেলা ছেলের বউকে উপরে পাঠিয়ে দিলেন। মাহাও উপরের ঘরে চলে আসে। সা’দ সেই সকালে বের হয়েছে। আর এখন ঘড়িতে একটা বাজে। কোথায় গেছে কেউই জানে না। অন্যদিকে, সা’দের কাজিনরা সবাই মিলে মাহাকে লেগ পুল করতে ব্যস্ত। কেউ কেউ তো বলছে সা’দকে যেন ফোন করে। আর বলে সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসতে। কিন্তু মাহা তো সবাইকে বলতে পারছে না, সে সা’দের সঙ্গে কোনো রকম কথাই বলতে চায় না।

★★

ভার্সিটির গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সা’দ। অনেকক্ষণ হলো বাড়ি থেকে বের হয়েছে সে। ভেবেছিল, মাহা তাকে ফোন করবে। কিন্তু নাহ, মাহা তাকে ফোন করেনি। বাইক স্টার্ট দিবে এমন সময় কেউ একজন এসে বাইকের সামনে দাঁড়ায়। সা’দ চোখ তুলে তাকালে দেখতে পায় তার মেইন ওপোনেন্ট ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে। ফিরোজকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে সা’দ বলে, ‘আমার রাস্তায় বাধা হয়ে আর কত দাঁড়াবি, বল তো?’
ফিরোজও জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ‘শুনলাম বিয়ে করছিস। তাও আবার এই ভার্সিটিরই জুনিয়রকে। দাওয়াত দিলি না একবারের জন্যেও?’
‘তুই ভাবলি কীভাবে, আমার বিয়েতে তোকে দাওয়াত করব। তুই এখনও আমার কাছ থেকে এতটা ভদ্রতা আশা করিস?’
‘করতেই পারি। যাই হোক, তোর বউয়ের সৌন্দর্যের বেশ প্রশংসা শুনলাম। আমি অবশ্য দেখিনি এখনও। তবে দেখতে হবে। তোর পছন্দ আছে বলতে হয়। ভার্সিটির গুডি গুডি মেয়ে তোর বউ হবে, এটা আশা করতে পারিনি। মেয়ে মানুষ এত গুডি গুডি হলে চলে না। তোর বউকে পরখ কর‍তে হবে। নেক্সট টাইম করব। একা তুই কেন মজা নিবি, আমাদেরও নেওয়ার সুযোগ করে দিবি।’
ফিরোজের বলা নোংরা নোংরা কথাগুলো সা’দের কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে। দিকবিক ভুলে গিয়ে বাইক থেকে নেমে একটা ঘুষি সোজা ফিরোজের নাক বরাবর বসিয়ে দেয় সা’দ। এরপর আরেক, তারপর আরও একটা।
দাঁত মুখ খিচে গালি দেয় সা’দ, ‘মাদার……. আর একটা শব্দ উচ্চারণ করবি, তো তোর জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব। পুরুষ মানুষ আছিস পুরুষ মানুষের মতো থাক। ঝামেলা চলে তোর আর আমার মধ্যে। আমি কখনও তোর মা বোনের দিকে যাইনি। খবরদার, আমার ঘরের দিকে নজর দিবি না। খুন করে ফেলব।’
অপমানটা ফিরোজ নিতে পারেনি। সে-ও পাল্টা আক্রমণ করে। তার আঘাতে সা’দের ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হতে শুরু করে। ঘটনা আরও গুরুতর হওয়ার আগেই সা’দের সাথের ছেলেগুলো ছুটে চলে আসে। অপরদিকে ফিরোজের সাথের দুই একজন হাজির হয়। উভয়পক্ষের ছেলেরা সা’দ আর ফিরোজকে ছাড়িয়ে দেয়। এতক্ষণ পর সা’দ তার ঠোঁটে ব্যথা অনুভব করতে পারে। রক্তাক্ত ফিরোজ সা’দকে হুমকি দেয়। সা’দ আরও বাজেভাবে গালাগাল শুরু করে। পরিস্থিতি খারাপ হবার আগেই সা’দকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
রাফি সা’দের ঠোঁটে লেগে থাকা রক্ত কটন দিয়ে মুছতে মুছতে বলে, ‘কোন আক্কেলে তুই ফিরোজের সাথে লাগতে গেলি। তোর কি বুদ্ধি হবে না কখনও?’
‘বাজে বকিস না রাফি। আমি ওকে কিছুই বলিনি। মাহাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলা শুরু করছে। যেই মাহাকে ও এখনও দেখেইনি, তাকে নিয়ে এত নোংরা কথা ওর মুখ থেকে বের হবে কেন? মাদার**রে আজকে মেরেই ফেলতাম।’
‘গাধা, এটা ব্রেনে আসে নাই যে ও তোকে প্রোভোক করছিল। ও যেহেতু মাহাকে দেখেইনি তাহলে এইসব বলা মানে তোকে প্রোভোক করা। যাতে তুই রাগের বসে কিছু করে বসিস। আর সেটাই হয়েছে।’
‘ছাড়। কিছু করা লাগবে না।’
‘বউ ঘরে রেখে বাইরে কী করিস তুই? যা, বাড়ি যা।’

★★

সা’দের হাতে ব্যান্ডেজ আর ঠোঁটের কোণ ফাটা দেখেই রাহেলার হাসিমাখা মুখটা কালো হয়ে যায়। সা’দের প্রতি তার ভালোবাসার শেষ নেই। এই ছেলের প্রতি তার ভীষণ দুর্বলতা।
‘এইসব কী করে হলো? কার সাথে মারামারি করে এসেছিস তুই?’
‘মা, চেঁচামেচি করো না তো। প্লিজ। ভালো লাগছে না।’
‘যা। ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি। তুই আসতে দেরি করলি, তাই নতুন বউও কিছু খায় নাই।’
মায়ের কথা শুনে ঘড়ি দেখে সা’দ। প্রায় আড়াইটা বাজে। মাহা এখনও খায়নি। ব্যাপার কী, হঠাৎ এত আন্তরিকতা কেন? সা’দ কনফিউজড। এই মেয়ের মনে কখন যে কী চলে কে জানে। গত রাতে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার সঙ্গে সা’দের বিয়েটা নাকি নিতান্তই লোক দেখানো। সা’দ যেমন তাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছে তেমনি বন্ধ ঘরে তার আর সা’দের মধ্যে থাকবে বিস্তর ফারাক। অন্যথায় সে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে সা’দকে। সা’দ বরাবরই একরোখা। সে যা চেয়েছে তা সে পেয়েছে। তবে কখনও অন্যায় ভাবে কিছু চায়নি কিংবা অন্যের জিনিস দখল করেনি। মাহাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসেছে সে। আর সেই ভালোবাসা থেকেই এত অধিকার বোধ এবং এতটা বাড়াবাড়ি।
এঁটে থাকা দরজাটা হালকা ধাক্কায় অনেকটা ফাঁক হয়। সা’দ ভেতরে প্রবেশ করে। মাহা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দরজা লাগানোর শব্দে তার কলিজাটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার বুঝতে বাকি নেই ঘরে সা’দের পা পড়েছে। সব বুঝেই সে আর ঘরে যায়নি। সা’দ বারান্দায় আসে, মাহার পাশে দাঁড়ায়।
‘মা বলল, তুমি নাকি খাওনি। কেন?’
কড়া কিছু কথা শোনাবে ভেবেই সা’দের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে যায় মাহা। সা’দের ফাটা ঠোঁট আর হাতের ব্যান্ডেজ অচিরেই তার চোখে পড়ে। ভ্রু জোড়া হালকা কুঁচকে যায় তার। মনে মনে ভাবে, গেল ভালো আসল ব্যথা নিয়ে। ব্যাপার কী? মাহা কিছুই বলেনি এমনকি সা’দের কথার জবাবও দেয়নি। মাহার এমন আচরণই সা’দকে রাগান্বিত করে। তার কথানুযায়ী, সে তো মাহার সব কথাই মেনে নিয়েছে। মাহা তার জীবনে চলে এসেছে। তার ঘরে তারই চোখের সামনে ২৪ ঘন্টা থাকবে এর বেশি আর দরকার নেই তার। বাকি রইল স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা। সেটাও একদিন না একদিন পূরণ হবে। কিন্তু সব মেনে নেওয়ার পরেও কেন মাহা এমন আচরণ করবে, এটা নিয়েই তার সমস্যা। সা’দ মাহার পথ আঁটকে ধরে।
‘কী হলো? কিছু জিজ্ঞেস করছি তো আমি। খাওনি কেন এখনও?’
মাহা রেগে যায়। চোখ জোড়া রাঙিয়ে তাকায় সা’দের দিকে।
‘আমার ইচ্ছে করেনি, আমি খাইনি। এর জন্য তোমাকে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।’
‘আলবাত বাধ্য তুমি। এই বাড়িতে যতদিন থাকবে আমার প্রত্যেকটা কথার জবাব দিতে বাধ্য থাকবে তুমি।’
‘ওহ রিয়েলি! তাহলে এই বাড়িতে থাকা আমার দ্বারা মঞ্জুরকৃত নয়। একটা গুন্ডার সাথে একই ঘরে একই ছাদের নিচে আমি থাকব না। মারামারি করা যার পেশা তেমন বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের সঙ্গে আমি থাকতে রাজি নই।’
মাহার কথাগুলো সা’দ নিতে পারেনি। মাহার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে তার হাত উঠে যেত। কিন্তু সে মাহার গায়ে হাত তো দূরে থাক একটা ফুলের আচরও লাগতে দেয়নি এতদিনে। কিন্তু নিজের জেদের কাছে তাকে সব সময় হার মানতে হয়। মাহার দিকে উঠে যাওয়া হাতটা সোজা দেওয়ালে গিয়ে পড়ে। তৎক্ষনাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটতে দেখে মাহার মুখ থেকে অজান্তেই চিৎকার বের হয়ে আসে। দরজা বন্ধ থাকায় মাহার চিৎকার ঘরের বাইরে পর্যন্ত যেতে পারেনি। সা’দের রক্তাক্ত চোখ আর হাত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়া দেখে মাহা সেখানেই অচেতন হয়। মাহার অচেতন শরীর দেখে সা’দ নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে। এই মুহুর্তে নিজের রক্ত মাখা হাতের চিন্তা ভুলে গিয়ে তাকিয়ে থাকে মাহার দিকে।

চলমান………………