বিরোধীদলীয় প্রেম পর্ব-০৮

0
135

বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ৮ (প্রথম অংশ)
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]

অফ হোয়াইট লেহেঙ্গা পরে মাহাকে রাজকন্যার মতো লাগছিল। গলায় কুন্দনের নেকলেস, কানে দুল। খোঁপায় সাদা গোলাপ। সব মিলিয়ে যাকে বলা চলে অন্যরকম সুন্দর। মাহার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নওমি তাকে আর সা’দকে নিয়ে শপিংয়ে যায়। খুঁজে খুঁজে সব পছন্দ করে কেনাকাটা করা হয়। মাহার চারপাশে আনন্দের কমতি নেই। শুধু আনন্দ নেই তার মনে। আয়নায় নিজেকে দেখছে আর ভাবছে, কতটা অসুখী আমি! আমার চারপাশে সুখের অভাব নেই, কিন্তু আমার মনে সুখ নাই। এর চেয়ে কষ্টকর অনুভূতি নিশ্চয়ই আর হয় না। হঠাৎ আয়নায় অবয়ব দেখা গেল একজনের। কালো স্যুট পরা একজনের ছায়া দেখতে পায় মাহা। সা’দকে আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। ঘরে ঢুকে মাহাকে এইভাবে দেখে সা’দ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এতটা সুন্দর মাহাকে বিয়ের দিনেও লাগেনি। আজকে যতটা সুন্দর লাগছে।
গুটি গুটি পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় সা’দ। মাহার তখন মুখ বন্ধ। সে ইচ্ছে করেই কথা বলেনি। সা’দ নিজ থেকেই বলল, ‘নিচে সবাই অপেক্ষা করছে। চলো।’
অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন সা’দদের বাড়িতেই করা হয়েছে। গার্ডেন এরিয়াতে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। সা’দের কথাকে অগ্রাহ্য করে মাহা একাই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিলে তাকে আঁটকায় সা’দ।
‘আমার সাথে নিচে যাবে তুমি।’
চাপা স্বরে মাহার জবাব, ‘আমি তোমার সাথে যাব না।’
‘তুমি আমার সাথেই যাবে।’
‘কখনোই না। তোমার এই আলোকসজ্জায় নিজেকে পুতুল সাজিয়েছি এটাই ঢেড়। এতটুকু ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দাও যে তুমি মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেছ।’
সা’দ দাঁত কড়মড় করে বলল, ‘কিপ ইউর মাউথ সাট।’
এই বলে মাহার হাতটা শক্ত করে ধরল। অতিরিক্ত চাপ দিয়ে ধরার মাহা ব্যথা পায়। হাত ধরে টান দিতেই সেখানে নওমি এসে উপস্থিত হয়। সা’দের করা ব্যবহার তার দৃষ্টির আড়ালে যায়নি। নওমি কাঠিন্য স্বরে বলে, ‘সা’দ, তুমি নিভে যাও। তোমার বন্ধুরা আসছে। আমি মাহাকে নিয়ে নিচে আসছি।’
সা’দের রাগান্বিত চাহনি যেন চিৎকার করে বলছে এখনই সব লন্ডভন্ড করে দিবে। সা’দকে নওমি কখনও দেবর ভাবেনি। অত্যন্ত ভালো বন্ধু এবং ভাইয়ের মতোই দেখেছে। সা’দ নওমিকে ভাবী ডাকে না। এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর এখন পর্যন্ত সা’দকে দিয়ে কেউ ভাবী ডাকাতে পারেনি। সে সব সময় নওমিকে চড়ুই বলে ডাকে। প্রথম প্রথম জিনিসটা সবার দৃষ্টিকটু লাগলেও পরে সবাই এই ব্যাপারটার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। সা’দের পাগলামি একমাত্র নওমি-ই থামাতে পারে। একজন বড়ো বোন আর একজন ভালো বন্ধু দুটো চরিত্রই নওমি দারুণভাবে মেইনটেইন করে আসছে এতটা বছর। আবার সা’দের যত রাগ সব নওমির উপর দিয়েই যায়।
‘কী ব্যাপার সা’দ, নিচে যেতে বললাম তো।’
‘ওকে বলে দাও, যা যা আগে করেছে তার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটায়।’
‘তুমিও কম বেয়াদব নও। এইরকম সিচুয়েশনে তুমি ওর হাত ধরে টানাটানি করতেছ। ওযে ব্যথা পাচ্ছে সেটাও তোমার বোধগম্য হচ্ছে না।’
‘চড়ুই, না বুঝে কথা বলতেছ কেন?’
‘আস্তে, সব জায়গায় মেজাজ দেখাতে হয় না। যাও নিচে যাও৷’
সা’দ ঘর থেকে বের হয়ে গেলে মাহা বিছানায় বসে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। নওমি চাপা নিঃশ্বাস ফেলে মাহার পাশে বসে।
‘তুমি কাঁদছ কেন মাহা! আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমাদের দু’জনকে দেখে। তোমাদের রিসিপশনের অনুষ্ঠান আজকে। আজকের দিনেও তোমাদের ঝগড়া করতে হবে। কেন বলো তো? তুমি সা’দকে কেন মানতে পারছ না? ঘৃণার চোখে না তাকিয়ে একবার সহজ ভাবে তাকাবা, দেখবা সা’দকে ভালো না বাসলেও ঘৃণা করতে পারবা না।’
‘ও আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছে ভাবী। আপনি জানেন, ও আমাকে আড়াইটা বছর বিরক্ত করে গেছে। আমি ওর জন্য ভালোবাসা নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত নিতে পারতাম না ভার্সিটিতে।’
‘আর সেইজন্য বুঝি বিয়ের প্রস্তাব আসার পর রাজি হয়ে গিয়েছিলে।’
‘হ্যাঁ। ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেলে অন্তত এই জঞ্জাল আমার জীবন থেকে বিদায় নেবে।’
‘ও তোমাকে এত দ্রুত বিয়ে করত না মাহা যদি না তুমি ওকে ভার্সিটিতে সবার সামনে চড় মারতে।’
‘আপনি জানেন না ভাবী, ও আমার এক ক্লাসমেটকে মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছে।’
‘হ্যাঁ, এটা ওর দোষ। কিন্তু ভার্সিটিতে ওর একটা রেপুটেশন আছে। সেটা তুমিও জানো এবং মানোও। সেই হিসাবে ওর সঙ্গে এই বিহেভ করাটা মোটেও উচিত হয়নি। যার শোধ ও এইভাবে তুলেছে।’
‘ওকে কখনও ক্ষমা করব না।’
‘এটা ভুল বললে। এমনও হতে পারে তুমিই ওকে ভালোবেসে ফেললে।’
‘এর আগে যেন আমার মৃত্যু হয়।’
‘ভালোবেসে কিন্তু অনেকেই মরেছে। তুমি মরলে আপত্তি কোথায়?’
‘ভাবী!’
নওমি হাসে।
‘চলো। নিচে সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। সব থেকে বেশি অপেক্ষা করছে সা’দ। তাছাড়া তোমার বাড়ির লোকজনরাও আসবে। চলো।’
মাহা নওমির সাথে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

চলমান……………….

বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ৮ (শেষ অংশ)
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]

অনুষ্ঠান শেষে মাহা আর সা’দকে সারপ্রাইজ হিসেবে আলাদা ঘরে পাঠানো হয়। সা’দের বন্ধুদের তরফ থেকে এটা সা’দের জন্য সারপ্রাইজ ছিল। অন্যদিকে মাহার বাবার বাড়িতেও যেতে হবে। কথা হয়েছিল বউভাতের পরেই মাহা আর সা’দ ও বাড়ি যাবে। রাত বেশি হওয়ায় রাহেলা বেগম আবদার করেন আগামীকাল সকালে যাবে। মাহার বাবা কাকারাও রাজি হন।
মাহা ঘরে ঢুকে বেশ অবাক হয়। পুরো ঘরটা ফুলে আবৃত। এমনকি বিছানাতেও ফুলের সমাহার। ব্যাপারটা সা’দের কাছেও অস্বস্তিকর ছিল।
বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে তাই কিছু বলতেও পারছে না সা’দ। ব্লেজারটা খুলে বারান্দায় যায় সে। লাইটার দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরায়। মূলত সে মাহার সামনে থেকে সরে আসার জন্যই বারান্দায় আসে। এদিকে সব কিছু ভেঙে চুড়ে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে মাহার। ফুলগুলো দেখে ফুলের সুবাসের পরিবর্তে ফুলের কাঁটা দেখছে সে। চোখে পানি ভর করছে ধীরে ধীরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লেহেঙ্গার পিনগুলো এক এক করে খুলছে সে। তারপর এক এক করে গয়নাগুলোও খুলে ফেলে। শরীর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে পাশেই রাখে। ফ্রেশ হবে বলে হলুদ শাড়ি আর তোয়ালে হাতে নিয়ে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ায়। এই পুরো দৃশ্য বারান্দা থেকে সা’দ খেয়াল করে। চারপাশে রাতের নিস্তব্ধতা। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চোখের সামনে এমন ফুটন্ত গোলাপের মতো বউকে দেখে নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে সা’দের। দুই একবার নিজেকে কন্ট্রোলও করেছে সে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। নিজেকে কাবু করতে পারছে না কিছুতেই। বার কয়েক মাথাও ঝাকিয়েছে যাতে এইসব ভাবনা মাথা থেকে দূর হয়। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মাহাকে ছুঁয়ে দেখার লোভ তাকে পেয়ে বসেছে। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বারান্দার দরজার পর্দা টেনে দিয়ে সোজা এসে মাহার সামনে দাঁড়ায় সে। এই মুহুর্তে সা’দকে সে তার সামনে আশা করেনি। বুকে কাপড় নেই। শরীরে কোনো গয়না নেই। মাথার চুলগুলোও এলোমেলো। সা’দকেও স্বাভাবিক লাগছে না। মাহা ভয় পেয়ে যায়। সা’দকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই সা’দ মাহার হাত ধরে। নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাহাকে পা থেকে চুল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে সা’দ। মাহা ঢোক গিলে। কণ্ঠনালীতে কথাগুলো আঁটকে গেছে। অনেক কষ্টে কথা বলল মাহা।
‘আমি ফ্রেশ হবো। হাত ছাড়ো।’
সা’দ পেছন থেকেই মাহাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। মাহার পিঠ যখন সা’দের বুকের সঙ্গে মিশে যায়, মাহার নিঃশ্বাস তখন দ্রুত গতিতে ওঠানামা করা শুরু করে। সা’দ মাহার ঘাড়ে মুখ ডোবায়। কম্পিত কণ্ঠে আকুতি জানায়, ‘আরেকটু পরে যাও মাহা। প্লিজ আরেকটু পরে যাও।’
কোনোক্রমেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে মাহা। সা’দ ততক্ষণে নিজের এক হাত দিয়ে মাহার গলার নিচের অংশ আবদ্ধ করে মাহার কাঁধ স্পর্শ করে। আরেক হাত দিয়ে মাহার পেটের অংশ আবদ্ধ করে। বার বার আকুতি জানাচ্ছে, ‘একটু সময় দাও আমায়। প্লিজ মাহা, একটু সময় দাও আমায়। এখনি ছেড়ে দিও না।’
মাহার অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়। সে দাঁত মুখ খিঁচে চাপাস্বরে বলে, ‘আমার ব্যথা লাগতেছে সা’দ। ছাড়ো।’
নেশাকাতুরে সা’দের জবাব তখন, ‘উহু। ছাড়তে পারছি না তোমায়। অন্তত আজকের রাতটা আমাকে উপহার দাও মাহা। প্লিজ।’
কথাটা মাহা নিতে পারেনি। কথাটা তার কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বলপ্রয়োগ করে পেছন থেকেই সা’দকে ধাক্কা দেয়। মাহাকে প্রথমে টাইট করে ধরলেও পরবর্তীতে আলগা করে দেয় সা’দ। আর ধাক্কার টাল সামলাতে না পেয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়ে সে। মেঝেতে পড়ার পরেই সা’দের সম্বিত ফিরে আসে। লজ্জায় ঘেন্নায় তার চোখে পানি জমে। সা’দের এইভাবে পড়ে যাওয়াটা মাহাও মানতে পারেনি। সা’দ পড়ে যাক এটাও সে চায়নি। সে শুধু সা’দকে সরাতে চেয়েছিল৷ কিন্তু সা’দ যে এইভাবে ছিটকে পড়বে এটা কল্পনাতেও ভাবেনি মাহা। দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে মাহা। চোখে পানি টলমল করছে তার। সা’দ মাথা নিচু করেই বসে আছে। মাথা নিচু হওয়ায় চোখের পানিগুলো পায়ের উপর টপ টপ করে পড়ছে। এতটা অপমান সে পাওনা ছিল না। খোলা আকাশের নিচে তার ভয়ে চারপাশটা কাঁপে। আর বন্ধ ঘরে নিজের বিয়ে করা বউয়ের কাছ থেকে এতটা ঘৃণিত ভাবে অপমানিত হবে এটা সে ভাবনাতেও আনেনি। মাহার জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে শুইয়ে জবাই করে দেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবত না সা’দ।
মাহা এগিয়েও যায় সা’দকে ধরতে। কিন্তু সা’দ তাকে থামিয়ে দেয়। মাহা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে, ‘আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করিনি। আসলে..’ বাকি কথা শেষ করার আগেই সা’দ ধাক্কা দিয়ে মাহাকে ফেলে দেয়। হাঁটু গেড়ে মাহাও পড়ে সা’দের সামনে। চোখের পানি মুছে সা’দ বলে, ‘আজকের পর থেকে এই আমাকে যদি তুমি তোমার আশেপাশেও দেখ তাহলে আমি আমার আমিকেই শেষ করে দিব।’
সা’দ মাহার উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ায়। পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করে সে। ঘরে থাকা প্রত্যেকটা কাঁচের জিনিস ভাঙতে শুরু করে। মাহা মূর্তির মতো এক কোণে দাঁড়িয়ে সা’দের পাগলামি দেখতে থাকে। সা’দের হাত কেটে রক্ত পড়ছে। সেদিকে খেয়াল নেই সা’দের৷ সব কিছু ভেঙে চুড়ে সা’দ দরজা খুলে বের হয়ে যায় সে। মাহা দৌড়ে ওয়াসরুমে যায়। ঝরণা ছেড়ে মুখ চেপে চাপা আর্তনাদ করছে। তার জীবন কী থেকে কী হয়ে গেল? তবে আজ নিজের করা অপরাধে নিজেকেই দুষছে সে। সে বার বার নিজ মনে বিড়বিড় করে, আমি এমনটা চাইনি। আমি চাইনি সা’দ পড়ে যাক। সবটা এলোমেলো হয়ে গেল।

চলমান………………