বিরোধীদলীয় প্রেম পর্ব-০১

0
227

বিরোধীদলীয় প্রেম
সূচনা পর্ব
আফরোজা আক্তার

ডোরবেল বাজতেই সুমি দরজাটা খোলে, দেখে ওয়েস্টার্ন পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুমি প্রশ্ন ছুড়ে দিল তাকে, ‘কে আপনে? কারে চান? কার কাছে আইছেন?’ সুমির প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে মেয়েটা একটু থতমত খেয়ে গেল। একত্রে এতগুলো প্রশ্ন! সে ভাবছে কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবে। এরই মধ্যে সুমি আবারও প্রশ্ন করল, ‘কতাও দেহি কন না। কারে চান?’ মেয়েটা হালকা হেসে বলল, ‘মাহা বাসায় আছে?’
সুমি উত্তর দিল, ‘হ আছে।’
‘আমি মাহার ফ্রেন্ড। ওকে গিয়ে বলো, ইতু এসেছে।’
সুমি কিছু না বলে ভেতরে দৌড় দিল। ইতু এর ফাঁকে পুরো ড্রইংরুমে ঘুরপাক খেল। ড্রইংরুমের ডেকোরেশন দেখে তার বুঝতে বাকি নেই যে, এটা মাহার আইডিয়া। ঘর সাজানোর ব্যাপারে মাহা একদম পারফেক্ট গিন্নি। মিনিট পাঁচেক পর মাহা সেখানে হাজির হয়। মাহার উপস্তিতি টের পেয়ে ইতু পেছন ফিরে তাকায়। বলে, ‘কেমন আছিস?’
মাহা এক নজরে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে। বিদেশে গিয়ে বেশ স্মার্ট হয়েছে ইতু। আগের সেই তেল চিটচিটে চুল নেই এখন। আগের মতো কুর্তা পায়জামাও পরা নেই। বছর চারেক আগে ইতালি চলে যায় ইতু। আর আজ তি বছর পর তার দেশে ফেরা। চার বছর পর প্রিয় বান্ধবীকে দেখে কোথায় ইমোশনাল ডায়ালগ দেবে তা না করে মুখে হালকা হাসি এনে বলল, ‘ভালো আছি। কবে আসলি?’
‘গতকাল।’
‘দাঁড়িয়ে কেন, বোস না।’
‘কী ব্যাপার, তোকে এত টায়ার্ড লাগছে।’
‘শুয়ে ছিলাম। সুমি গিয়ে ডেকে তুলল।’
‘মেয়েটার নাম সুমি, আরে বাপ্রে বাপ, কত যে প্রশ্ন করে!’
‘আসলে আব্বু আম্মু বাসায় নেই তো। আর তাছাড়া ও তো তোকে চেনে না। তাই জিজ্ঞেস করছে।’
‘আন্টি আংকেল কোথায়?’
‘গ্রামের বাড়ি গেছে। বোস তুই, আমি সুমিকে বলি তোর জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে।’
‘সে সব পরে হবে। আগে বল তোকে এমন লাগছে কেন?’
‘কেমন?’
‘আমার কাছে কিছু লুকিয়ে লাভ নাই রে মাহা। সত্যি করে বল তো, তোর মুখ চোখ এমন লাগছে কেন?’
‘চেঞ্জ হইলি না আর তুই।’
‘ও মা আর কত চেঞ্জ হবো! এত চেঞ্জ হয়ে তাহলে কী লাভ হলো আমার।’
‘স্বদেশী মেয়ের বিদেশি জীবন কেমন কেটেছে?’
‘একদম ফার্স্ট ক্লাস। আচ্ছা মাহা, এসব বাদ দে। তুই কি আমাকে কিছুই বলবি না। আমি কিন্তু ইতুর কাছ থেকে কিছুটা শুনেছি।’
‘গত আড়াই বছর ধরে জীবনটা বেশ প্যারায় কাটছে। যেদিকে তাকাই ওইদিকেই ধু ধু মরুভূমির বালি। কোথাও শান্তির বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছি না।’
মাহার জীবনে বেশ বড়সড় একটা সমস্যা চলছে। যার কিছুটা সে মিমির কাছ থেকে শুনেছে। এখন বাকিটা মাহার মুখ থেকেই শোনার পালা। মাহা কেবল মুখ খুলল তখনই ফোন এলো। স্ক্রিনে মিমির নাম দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কোঁচকায়। মিমি প্রশ্ন করে, ‘কে ফোন করেছে?’
মাহা হাতের ইশারা দিয়ে সময় চেয়ে নেয়। ফোন রিসিভ করে কানে নেওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় মাহার চোখে পানি জমে। কোন কথা না বলে মাহা কেবল জিজ্ঞেস করল কোন হাসপাতাল এরপরেই ভেতরে দৌড়ে গেল। হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ইতুকে নিয়ে বের হয়ে গেল। ইতু দেখল মাহার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। একটা সি এন জি নিয়ে সোজা চলে কুরমিটোলা হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে মিমির সঙ্গে দেখা করে। ইতুকে দেখে মিমির প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে অবশ্য তারা দু’জন নিজেদের মধ্যকার সাক্ষাৎকারটা সেরে নেয়। মিমি করুণ স্বরে মাহাকে বলে, ‘অনেক মারছে রে, বেচারার কোনো দোষ ছিল না। তুই তো নিজেই সেধে সেধে কথা বলতে গেলি। আর এখন দেখ, শাস্তি স্বরুপ ওর কি হাল করল।’
মাহার চোখ জোড়া আগুন লাল হয়ে আছে। নিজেকে শান্ত করে রাকিবের কেবিনে যায় সে। বেধড়ক মার খেয়ে বেচারা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। মাহা লজ্জায় মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলল, ‘সরি রাকিব। আমার জন্য তোমার এই অবস্থা হলো।’
রাকিব বলল, ‘তুমি সরি বলতেছ কেন মাহা? আমার কপালটাই খারাপ। তাই তো এইভাবে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিল। কতগুলা ক্লাস মিস হবে আমার। ভার্সিটি কয়দিন মিস যাবে আমি সেটাই ভাবতেছি।’
রাকিব একটু সাদাসিধে মানুষ। এত মা’র খেয়েও বেচারার ক্লাস আর ভার্সিটির চিন্তা। ও-ই পারবে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে। কথাগুলো ভেবেই হাসি পাচ্ছিল মাহার। কিন্তু সে হাসল না। তাকে জরুরী একটা কাজে বের হতে হবে৷ রাকিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইতুকে না নিয়েই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেল সে। মিমি জানে মাহা এখন কোথায় যাবে। ক্লাব ঘরের উদ্দেশ্যে সোজা রওনা দিল তারা। এদিক-সেদিক না তাকিয়ে সোজা ক্লাব ঘরে ঢুকে মাহা। সেখানে উপস্থিত সবাই মাহাকে দেখে চমকে যায়। শুধু চমকায় না সা’দ। মিমিও সেখানে যায়। তবে সে যেতে দেরি করে ফেলে। সাথে ইতু। ও বেচারি সবটা বুঝে উঠতে পারছে না। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছোট বড় সবার সামনে সা’দের গালে ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দেয় মাহা। সা’দ তখন শুধুই মাহার আগুন চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ আগুন যেন সা’দকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে। এতগুলো ছেলেদের সামনে একটা মেয়ের হাতে চড় খাওয়াটা হজম হচ্ছে না সা’দের। সে পারছিল না নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাহাকে আক্রমণ করতে। আর করবেই বা কীভাবে, মাহাকে আক্রমণ করতে গেলে যে নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তবে এই চড়ের শোধ সে তুলবে। তুলবেই। সা’দ গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল, ‘হাউ ডেয়ার ইউ!’
মাহা চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, ‘তোমার মতো অমানুষ এই পৃথিবীতে দুইটা নাই। সা’দ আশরাফ। ঘেন্না করি তোমাকে আমি। তুমি একটা নিরীহ মানুষকে বিনা দোষে এইভাবে মেরেছ যে! তুমি নিশ্চয়ই মানুষ না। মানুষের কাতারেই পড়ো না তুমি। ঘিন লাগে তোমার এই চেহারাটা দেখলে। কোন কুক্ষণে যে তোমার এই বিশ্রী দৃষ্টি আমার উপর পড়ল। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা করে নিজে ফাঁস নেই। আর তোমার মতো অমানুষের কাছ থেকে অনেক অনেক অনেক দূরে চলে যাই। লজ্জা থাকলে এই নোংরা চেহারাটা আমাকে দেখাবা না।’
থাপ্পড় মারার দৃশ্য দেখে মিমি, ইতু দু’জনেই হকচকিয়ে যায়। মিমি বিড়বিড় করে বলে, মাহা নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনল। মাহা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়৷ সা’দ তখন পেছন থেকে মাহার হাতটা মুচড়ে ধরে। এরপর বেশ উচ্চস্বরেই বলে, ‘এই থাপ্পড়টা পাওনা ছিল না। তবুও যখন খেতে হলো তাহলে এর পরিণতির জন্যও রেডি হও। এমন অবস্থা করব তোমার, কেঁদেও কুল কিনারা পাবা না।’
সা’দের হুমকি শুনে মাহা মেঝেতে একদলা থুতু ফেলল। এরপর ওই থুতুকে দেখিয়ে বলল, ‘এইটার যোগ্য তুমি।’
মাহার এই ব্যবহারে সা’দ আরও রেগে যায়। মাহা চলে গেলে সা’দ টেবিলের উপরে থাকা কাঁচের গ্লাসটা এক আছাড় মারে। মেঝেতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাসটা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পাশ থেকে সা’দের বন্ধু বলল, ‘আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া থুতুগুলা নিচে ফালাইছে। আমি ভাবতাছি থুতুগুলা তোর মুখে মারলে কেমন অবস্থা হইত।’ কথাটা বলে দম ফেলার আগেই সা’দ একটা চড় বসিয়ে দেয় তার গালে। উপস্থিত সবাই তখন চুপ ছিল। পুরো ক্লাবঘরটায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সা’দ কোনোক্রমেই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। সবার সামনে এইভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে তাকে। মাহার এই ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না। এর শাস্তি তাকে পেতেই হবে। পেতেই হবে। মোবাইলটা কানে লাগিয়ে হন হন করে বের হয়ে যায় সে।

চলবে।