বিরোধীদলীয় প্রেম পর্ব-০২

0
165

বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ২
আফরোজা আক্তার

মিমি, ইতু পাশাপাশি বসে আছে। অপরপ্রান্তে মাহা। গালে হাত দিয়ে এক মনে কি যেন ভাবছে। মিমি বলল, ‘কাজটা কি তুই ঠিক করলি মাহা? এইভাবে সবার সামনে সা’দ ভাইকে চড় মারলি। সে তো এখন এর শোধ তুলবেই। ওপেনলি বলল সে কথাটা। অন্যভাবেও হ্যান্ডেল করতে পারতি।’
মাহা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে, ‘অন্যভাবে! কীভাবে বল তো আমাকে? আর কীভাবে হ্যান্ডেল করা যায়। ও কি মানুষ? আমার কাছে তো ওকে মানুষ রুপে জানোয়ার মনে হয়।’
মিমি চোখ রাঙায়। বলে, ‘আহ মাহা! এনাফ ইয়ার, রাগের মাথায় কখন কি যে বলস, তুই নিজেও জানস না। এইসব ভুলেও সা’দ ভাইয়ের সামনে উচ্চারণও করিস না। নয়তো তোকে মাটিতে পুতে ফেলবে।’
‘ফেলুক। আমিও তাই চাই। ওর জন্য বিগত আড়াই বছর আমি মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। না পাচ্ছি ঘরে শান্তি না পাচ্ছি বাইরে। ঘরে আসলে ওর ফোনের যন্ত্রণা। ভার্সিটি গেলে স্বয়ং ওর যন্ত্রণা। ভুল একটাই হয়েছে আমার। প্রথমেই আব্বুকে বলে দিতাম।’
‘সা’দ ভাইকে তুই চিনস না? যার সঙ্গে কথা বলেছিস বলে তাকে মেরে হাসপাতালে পাঠাইছে। আর সে তোর বাপকে ছাড়বে ভাবছিস। হি রিয়েলি লাভস ইউ।’
‘আর আমি ওকে ঘেন্না করি। সত্যিই ঘেন্না করি ওকে আমি।’
ইতু এতক্ষণ ওদের দু’জনের কথা শুনল। সে এখনও কনফিউজড। কে এই সা’দ। তাকে বেশি অবাক করেছে মাহার থাপ্পড় মারাটা। একেবারে সবার সামনে গিয়ে থাপ্পড় মেরেছে। ইতু বলল, ‘সবার সামনে চড় মারায় ডেফিনেটলি ছেলেটার মেল ইগো হার্ট হয়েছে। এত সহজে ছেড়ে দিবে না সে মাহাকে। আচ্ছা আমাকে কি বলবি, কী হয়েছে? আর এই সা’দ-ই বা কে?’
মাহা একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার জীবনের কালো অধ্যায়।’
মিমি গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করল, ‘সা’দ আমাদের ভার্সিটির বড় ভাই। সিনিয়র আর কি। যদিও পড়াশোনা কমপ্লিট। ভার্সিটি ভর্তি হবার পর থেকেই অনেকের মুখে শুনেছি উনার নামটা। প্রচন্ড রাগী একজন মানুষ। আবার অনেকে সুনামও করেছে। তো আড়াই বছর আগে, সেদিন ভার্সিটিতে বসন্ত উৎসব উপলক্ষে বেশ বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর সেই অনুষ্ঠানেই মাহাকে নিজের চোখে পার্মানেন্টভাবে বসিয়ে নেয় সা’দ ভাই।’
ইতু এখনও বুঝতে পারছে না। আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘কীভাবে বসালো?’
ইতুর প্রশ্ন শুনে মিমি হেসে উঠল আর মাহার আরও রাগ হলো। মিমি বলল, ‘তুই বল আমাকে, কোন গাধা বসন্ত উৎসবের দিন বাসন্তী শাড়ির বদলে সাদা শাড়ি পরে।’
ইতু কৌতূহল নিয়ে বলল, ‘বসন্তের দিন সাদা শাড়ি! সিরিয়াসলি!’
মাহা বিরক্ত নিয়ে বলল, ‘আর সেই সাদা শাড়িই আমার গলায় কাফনের কাপড় হয়ে পেঁচিয়েছে।’
মিমি আবারও বলা শুরু করল, ‘প্রোগ্রামের দিন মাহা ভার্সিটিতে ঢুকতেই সবার নজর মাহার দিকে যায়। ছেলে মেয়ে উভয়ই হা করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। আমাদের মাহা রানী তো এমনিতেই মাশা-আল্লাহ। তার উপর পরনে সাদা শাড়ি। এক কথায় সোনেপে সোহাগা। সাদা রঙে সেদিন ওকে এত উজ্জ্বল লাগছিল! আনকমন থাকতে গিয়ে নিজেই ভেজালে জড়িয়েছে। সেখানে সবার চোখের আড়ালে এক জোড়া চোখ ঠিকই মাহাকে দেখেছে। মাহার রূপের উজ্জ্বলতা তাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছে যে নিজের ভালো লাগার কথা জানাতে সে এক মিনিটও অপেক্ষা করেনি। অন্যদিকে সা’দ ভাইকে যে সবাই অপছন্দ করে তা কিন্তু না। পলিটিক্সে ভালো নাম ডাক তার। দেখতে শুনতেও সুদর্শন। এক শ্রেণির মেয়ে আছে যারা সা’দ বলতে অজ্ঞান। আরেক শ্রেণির মেয়ে আছে যারা সা’দকে দেখলে দশ হাত দূরে অবস্থান করে। এক শ্রেণির ছেলে আছে যারা সা’দ ভাই করতে করতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে। আর এক শ্রেণির ছেলে আছে যারা সা’দকে পছন্দ করে না।’
ইতু চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল, ‘সবই বুঝলাম। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখলাম, এতে তো বোঝা যায় ভালোবাসার থেকে ঘৃণা-ই বেশি।’
মিমি পানি খেতে খেতে বলল, ‘মাহার পছন্দ না। আর তাছাড়া সা’দ ভাই মাহার চারপাশটায় একটা গন্ডী টেনে দিয়েছে। যার সবটাতেই সে থাকতে চায়। মাহার সঙ্গে কোনো ছেলে কথা বলতে পারে না। ইভেন মেয়েরাও ওর সঙ্গে কথা বলতে ভয় পায়। দেখলি না রাকিব বেচারার কি হাল করেছে। গতকাল মাহা নিজে গিয়েই রাকিবকে কিছু সাজেশনের কথা বলল। আর আজ বেচারা হাসপাতালের বেডে।’
ইতু দেখল মাহা ততক্ষণে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ। ইতু উঠে গিয়ে মাহার পাশে দাঁড়ায়। বলে, ‘থাপ্পড়টা এইভাবে মারা উচিত হয় নাই। সাপ যখন শান্ত থাকে তখন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু সেই সাপকেই যদি খোঁচা মারা হয় তখন সে তার বিষদাঁত দিয়ে আক্রমণ করে।’
মাহা মাথা নাড়ায়। বলে, ‘নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে। আমার জন্য একটা নির্দোষ ছেলে এইভাবে মা’র খেল। ছিঃ’
পুরো ঘর জুড়ে নীরবতা বিরাজ করছে। একই সাথে দু’জনের দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। কেবল মাহার দীর্ঘশ্বাসটা ভেতরে চাপা পড়ে আছে।

★★★

দু’দিন পর বাবা মায়ের এইভাবে চলে আসাটা স্বাভাবিক লাগছিল না মাহার কাছে। তাই সে জানতে চায়, ‘কী ব্যাপার, তোমাদের তো আরও কয়েকদিন থাকার কথা ছিল। চলে আসলা যে?’
মাহার বাবা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু মাহার মা আমিনা তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে, ‘কাজ শেষ হয়ে গেছে। তাই চলে আসলাম।’
মাহা চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যায়। মোশাররফ সাহেব স্ত্রীকে বললেন, ‘আমাকে বাধা দিলা কেন? ওকে বলতে হবে না? ও জানবে না?’
‘হ্যাঁ, জানবে৷ তবে পরে। এখন না।’
‘এখন না, কখন?’
‘তুমি এখন বাইরে যাও। আমার মাথা খেও না।’
বিকেলের পরে মা’কে রান্না ঘরে ব্যস্ত দেখে মাহা জিজ্ঞেস করে, ‘কেউ আসবে নাকি মা? এত নাস্তা বানাচ্ছো!’
মেয়ের কথায় আমিনা বলল, ‘হ্যাঁ, সন্ধ্যার পর মেহমান আসবে। তার জন্যই এই আয়োজন।’
‘কোন মেহমান আসবে মা?’
আমিনা ভাবল তার বলা উচিত। এইভাবে হুটহাট করে তো কিছু হয় না। তাই মেয়েকে আগে থেকেই বলে রাখা উচিত। আমিনা বলল, ‘মাহা, সত্যি করে বল তো, মা’কে তোকে কতটা ভালোবাসি?’
মাহা মায়ের প্রশ্নে অবাক হয়। বলে, ‘অনেকটাই ভালোবাসো মা। হঠাৎ এই প্রশ্নটা কেন করলা?’
‘মা যদি এখন তোকে কিছু বলি, তাহলে মায়ের কথা রাখবি তুই?’
‘কী কথা মা, বলো।’
‘তোর জন্য একটা প্রস্তাব আসছে। অনেকদিন ধরেই ঘুরতেছিল। আমরা এতটা গুরুত্ব দিই নাই। ভাবলাম তুই পড়ছিস। তোকে এখন এইসব বলা হবে না। কিন্তু গতকাল জানতে পারলাম তারা একবার তোকে দেখতে চায়। তাই আমি আর না করি নাই।’
মাহা অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল, ‘আজকে আসবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘বিয়ের প্রস্তাব এইটা কে এনেছে?’
‘সামনের বিল্ডিংয়ের রুহুল ভাই আছে না, উনিই এনেছেন। তোকে তো দেখে মাঝে মাঝে। উনার হাতে প্রস্তাব এইটা ছিল, তাই উনি তোর বাবাকে আলাপ দিল।’
‘ছেলে কী করে?’
‘ছেলেদের নাকি ব্যবসা আছে। ছেলের বাবার গার্মেন্ট আছে। ওইটাতেই বসে।’
‘পড়াশোনা?’
‘এম বি এ কমপ্লিট। বাকিটা তারা আসলে জিজ্ঞেস করবে তোর বাবা। যদি তাদের তোকে ভালো লাগে, তাহলে আমরাও গেলাম দেখতে। তোর মেজ মামাকে আসতে বলছি।’
‘ওহ।’
‘তুই আর অমত করিস না।’
‘অমত কই করলাম। আমারও উচিত এখন বিয়েটা করে নেওয়া মা। সমস্যা নাই। আমি তাহলে আস্তে আস্তে রেডি হই।’
আমিনা মেয়ের কথা শুনে খুশি হয়ে গেল। বলল, যা যা। রেডি হয়ে নে।’
‘কী পরব মা?’
‘যা তোর ভালো লাগে।’
নিজের ঘরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাহা। মনে মনে ভাবল, ভালোই হয়েছে। সা’দ নামক অভিশাপ থেকে বাঁচার উপায় পেয়ে গেছে সে। এবার বিয়ে করার পালা। একবার বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর আর এই হেডেক থাকবে না। মিমি আর ইতুকে ফোন করে সবটা জানায় মাহা। ইতু খুশি হলেও মিমি হয়নি। মিমি খুব ভালো করেই জানে এবার বেশ বড়সড় ধামাকা হবে। মাহার বিয়ের খবর সা’দের কান অবধি পৌঁছাতে বেশি দেরি হবে না। আর সে কখনোই মাহার বিয়ে হতে দিবে না।

চলমান…………….