বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-০১

0
633

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [১]
প্রভা আফরিন [কপি করা কঠোরভাবে নিষেধ]

ঋতুতে এখন গ্রীষ্ম। পরিবেশে তীব্র গরম বিরাজ করছে কিছুদিন যাবত। যাকে বলে ফল পাকানো গরম। বৃষ্টি নেই, বাতাস নেই, প্রাণীকুলে শান্তিও নেই। পরিবেশ গুমোট হয়ে আছে। এই প্রখর দাবদাহে অবসরযাপনও পরিশ্রমের কাজ। এমনই এক গরমের রাতে শালুগঞ্জে ঘটে গেল বিরল এক ঘটনা। মাঝি নবুর বাড়িতে সিঁধেল চোর হানা দিয়েছিল গতরাতে। সিঁধ কে’টে ঘরে চুরি করে চলে গেছে। সাধারণত বর্ষাকালে সিঁধেল চোরের উৎপাত বেশি দেখা যায়। সে সময় টিনের চালে সারারাত ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে। শরীরে শীত শীত অনুভূতি জেঁকে বসে। ফলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আরামের একটা ঘুম হয়। দিন দুনিয়ার কোনো খেয়াল থাকে না।

গৃহস্থের এই ঘুমটাই চোরের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। বৃষ্টির অবিরত কানে তালা লাগানো ঝমঝম শব্দে মাটি খোঁড়ার শব্দ আলাদা করা যায় না। এইরকম দিনে গৃহস্থের ঘুম হয় গভীর, সহজে ভাঙে না। ফলে চোর খুব অনায়াসে, আরাম করে তার কার্য সম্পাদন করতে পারে। কিন্তু এমন থমথমে গরমের রাতে নবুদের বাড়িতে সিঁধ কেটে চুরি হলো অথচ নবু বা তার পরিবার কোনো কিছু টের পেল না! সিকান্দারের কাছে এটা বিরল ঘটনাই বটে। নবুর মতো ঘোরেল লোকের বাড়িতে সিঁধ কেটে চুরি করা চারটেখানি কথা নয়। এসব ভেবে ভেবে জৈষ্ঠ্যের নিরাক পড়া দুপুরে নদীর পাড় ঘেঁষে হাটছিলো সিকান্দার। হাতে একটা আধ কিলোগ্রাম মুড়ির পোটলা। একটু আগেই বাজার থেকে কিনে এনেছে। মাথার ওপর একটা গামছা দিয়ে রোদ থেকে বাঁচার বৃথা চেষ্টা করছে সে। চোখের ওপর এক হাত দিয়ে সরু দৃষ্টিতে দূরের সড়কে কাউকে হেটে যেতে দেখে সে হাক ছাড়লো,
“ওই ব্যাটা? খাড়া, খাড়া!”

সিকান্দার নদীর পাড় ছেড়ে সরু আইল ধরে ছুটে এলো সড়কে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“তুই খন্দকারের কামের ব্যাটা না? ব্যাগ লইয়া কী খন্দকার বাড়িত যাস?”
ছিপছিপে গড়নের যুবা ছেলেটির নাম রনি। রনির কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। দুইহাতে ভারী ওজনের দুটি পাটের ব্যাগ। এমন কাঠফাটা রোদে দাঁড় করানোয় দৌড়ে আসা লোকটির ওপর সে যারপরনাই বিরক্ত। বাহুতে কপালের ঘাম মুছে বলল,
“হ, কিছু কইবেন?”
সিকান্দার বলল,
“আইজ তো শুক্রবার। খন্দকার বাড়িতে সিনেমা দেখাইবো। একলা যাইতে ভাল্লাগে না। তর লগেই যাই, চল।”

দুজনে পা চালালো একসাথে। সিকান্দার যেতে যেতে উৎফুল্ল মনে চোরের কথাটা পাড়লো,
“কাইল রাইতের কাহিনি হুনছোস?”
“কিসের কাহিনি?”
“আমি আরেক গেরাম থেইকা আইয়া হুনলাম। পুরা গেরামে হুলুস্থুল লাগছে আর তুই কছ কিসের কাহিনি? নবুর বাড়ির চুরির কাহিনির কথা কই।”

শালুগঞ্জে চোরের উপদ্রব তেমন নেই। এতদিন পর হুট করে এক বাড়িতে চুরি হলে পুরো গ্রামে চোরের আত’ঙ্ক ছড়াবে, হুলুস্থুল লাগবে, গৃহস্থরা চোরের ভয়ে রাত জেগে বাড়ি, গবাদি পশু পাহারা দেবে, এ আর নতুন কী? সে ছোট করে বলল,
“ওহহ!”

রনির মাঝে বিশেষ আগ্রহ দেখা গেল না। সিকান্দার তবুও উৎসাহ নিয়ে বলল,
“ঘামাচি মারা গরমে কুয়ার মতোন বুইড়া একখান সিঁধ কাইট্যা চোর ঢুকলো। নবু, নবুর বউ-পোলাপাইন টেরই পাইলো না! এ কোনো সাধারণ চোর নারে। এই চোর অসম্ভব কাজ করতে পারে। ব্যাটার হাতে জাদু আছে।”
সিকান্দারের ভাবখানা এমন, ভ্যাপসা গরমের রাতে সিঁধ কেটে চুরি করা সাধারণ কর্ম নয়। সে চোরের ওপর রীতিমতো মুগ্ধ।

“অসম্ভবের কিছু দেখি না। হয়তো চোর খুব সাবধানি লোক। আগেই নবু চাচার বাড়ির সব খবরাখবর জানতো। তাই সুবিধা করতে পারছে। তয় মাঝির বাড়িত চুরি করা কোনো মহত্ম হইলো? ব্যবসায়ীর বাড়িতে চুরি হইলে একটা ব্যাপার আছিলো।”
রনির বিরস প্রতিক্রিয়ায় সিকান্দার কথা জমানোর সুযোগ পেল না। রোদ মাথায় নিয়ে বাকিটা পথ দুজনে চুপচাপ হাটলো।

খন্দকার বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করে সিকান্দার একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসলো। লুঙ্গির ঢিলে হয়ে আসা গিটটা শক্ত করে বেঁধে, রনির হাত থেকে ভারী ব্যাগ দুটি কেঁড়ে নিয়ে ওর হাতে মুড়ির পোটলা ধরিয়ে দিল। এরপর ভারী ব্যাগদুটো উঠিয়ে ছুটে গেল ফটক ঠেলে। হতভম্ব রনি কোমড়ে হাত দিয়ে সিকান্দারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

চিত্রা বাড়ির সম্মুখের বাঁধানো দাওয়ায় বসে আছে। এত গরমেও সে খোলা চুলে রোদে বসেছে। শুভ্র মুখটা রোদের তাপে লাল হয়ে গেছে। সে গুনগুন করে আপনমনেই সুর বাধছে আর হাতে নেইলপলিশ লাগাচ্ছে। টকটকে লাল রঙের নেইলপলিশ। এমন সময় সিকান্দার ব্যাগ হাতে লোহার ফটক ঠেলে ছুটে এলো। বলল,
” ও চিত্রা, তুমগো সদাই আনছি। কই রাখমু?”

চিত্রা নেইলপলিশে ফু দিতে দিতে বলল,
“রান্নাঘরে চামেলি খালাকে পাবেন। ওনাকে দিয়ে আসেন।”

সিকান্দার বাধ্যের মতো মাথা নেড়ে ব্যাগদুটি নিয়ে উত্তরের দেয়াল লাগোয়া ঘরটার দিকে অগ্রসর হলো। এই বাড়ির রান্নাঘর বাইরের দিকে হওয়ায় তাকে আর ময়লা পায়ে ভেতরে যেতে হলো না। রবিউল খন্দকার সবে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে উঠলেন। রনিকে মুড়ির পোটলা হাতে ঢিমেতালে আসতে দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,
“তোমার কাম সিকান্দার করে ক্যান?”

সিকান্দার বিদ্যুতের বেগে ছুটে এলো। আগেভাগে বলে উঠল,
“ওয় ছুডু মানুষ খন্দকার সাব। দুইডা ব্যাগ কষ্ট কইরা আনতে দেইখা মায়া হইলো। তাই হাত লাগাইলাম। পোলাডারে বইকেন না। আপনের জিনিস বইতে আমার ভালোই লাগে।”

রনি স্বভাবতই একটু লাজুক প্রকৃতির ছেলে। সে সিকান্দারের রাখ-ঢাক করে বলা মিথ্যার বিপরীতে কিছু বলার সুযোগ পেল না। দ্বিধান্বিত চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। রবিউল খন্দকার ঘর্মাক্ত রনির দিকে খানিকক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মাস চারেক আগে হাটের চায়ের দোকানওয়ালা আগর মিয়া একটা ছিপছিপে গড়নের ছেলেকে নিয়ে এসে বলেছিল,
“এই এতিম পোলাডারে একটা কামের বন্দোবস্ত কইরা দেন খন্দকার সাব। বাপ-মা কেউ নাই দুনিয়াত।”

এতিম ছেলে-মেয়ের কথা শুনলেই রবিউল খন্দকার নরম হয়ে পড়েন। তিনি নিজেও এই বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন। তারপর বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি ও সম্মান উভয়ের হাল ধরেছিলেন একা। এতবছর পর এসেও সেই সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখেছেন তিনি। সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে ওনার মায়া হয়েছিল। হাড় জিরজিরে শরীরে মলিন একটা ঢিলেঢালা শার্ট গায়ে। শুকনো মুখে মায়া ছিল ঢেড়। ছেলেটার অভাবের কথা ভেবে লোক না লাগা সত্ত্বেও রেখে দেন তাকে। চারমাসে স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আগে শুকনো দেহে রনিকে কিশোর মনে হতো। এখন যুবক যুবক ভাব এসেছে গায়ে। রনি পা দিয়ে মাটি খুটছিল। তিনি বললেন,
“রনি, টিভির এন্টেনাডা একটু ঠিক করে দিতে পারবা? একটু পরে সিনেমা আরম্ভ হইবো। এহন টিভিডা ঝিরঝির করতাছে।”

রনি একদিকে মাথা কাত করে এন্টেনার কাছে চলে গেল। রবিউল খন্দকার সিকান্দারকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কবে ফিরলা মিয়া? মাঝে মাঝেই নিরুদ্দেশ হইয়া যাও। আবার ফিরা আহো।”
“আইজ সকালেই ফিরলাম।”
“কই আছিলা এতদিন?”
“নিবাসপুর আছিলাম। কয়দিন বদলি খাটছি। হেরপর মাছ ধরার নৌকায় আছিলাম কয়দিন। দুইডা টেকা হাতে হইতে এহন আবার গেরামের লইগ্যা মন টানলো।”
“সৎ পথে কামের পিছে ছুটতাছো হুইনা খুশি হইলাম। তয় টেকা-পয়সা আইবো যাইবো। তার লইগ্যা কি সংসার ধর্ম ফালাইয়া ছুটবা? এইবার একটু থিতু হও। গেরামেই কিছু করার চেষ্টা করো।”

সিকান্দার কান চুলকে হাসলো একটু। চিত্রা নুন-চিনি গুলানো শবরতের দুটি গ্লাস হাতে নিয়ে এলো। বলল,
“খেয়ে নিন। আমি নিজে বানিয়েছি।”

সিকান্দার গদগদ হয়ে চিত্রার হাত থেকে একটা গ্লাস নেয়। অপরটা রনির জন্য দাওয়ায় নামিয়ে রাখে সে। রবিউল খন্দকার মেয়েকে দেখে বলেন,
“তর মায় কই?”
“মা ঘুমায়।”
“এই গরমে চুল খুইল্যা রাখছোস ক্যান? বেনি কইরা থো। চোখমুখ লাল হইয়া গেছে। বাতাসে ব গিয়া।”

চিত্রা একদিকে মাথা কাত করতেই তিনি টিভির ঘরের দিকে চলে গেলেন। তবে চিত্রা গেল না। সে খোলা চুলে বারকয়েক আঙুল চালিয়ে দরজার সামনে বসে পড়লো।

রবিউল খন্দকারের বাড়ির বিশাল উঠানের একপাশে বেশ কিছু মহিলা গাছের ছায়ায় পাটি বিছিয়ে বসেছে। গ্রামে বিদ্যুৎ আসার পর খন্দকার বাড়িতে প্রথম টেলিভিশন এসেছে। প্রতি শুক্রবার তাতে সিনেমা দেখায়। বাক্সের ভেতর ছেলে-মেয়েরা নাচগান করে। প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষগুলো তা অবাক চোখে চেয়ে দেখে। আনন্দ পায়। তাই এই দিনটায় খন্দকার বাড়িতে পাড়ার ছোট-বড় মানুষগুলো উঁকিঝুকি দেয়। রবিউল খন্দকার ভালো মানুষ বিধায় ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে তাদের সিনেমা দেখতে দেন। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে অবশ্য সে সুযোগ থাকে না। খন্দকার গিন্নি জুলেখা বড়োই কঞ্জুস মহিলা। বাইরের মানুষ দেখলেই টিভি, ফ্যান সব বন্ধ করে রাখে। শুক্রবার দুপুরের পর রবিউল খন্দকার বাড়িতে থাকেন বিধায় এই দিনটায় তা পারে না।

তবে আজ তাছলিমাও সিনেমা দেখতে উপস্থিত। বাড়িতে এতবড়ো একটা চুরি হয়ে যাওয়ার পরেও সে সিনেমা দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। ছুটে এসেছে খন্দকার বাড়িতে। কিন্তু এখানে এসেও সেই চোরের আলাপ। নবুর স্ত্রী তাছলিমার মতে চোর তার দুই ভরি সোনার গহনা চুরি করেছে। দিন আনা দিন খাওয়া নবুর বউয়ের এই কথা শুনে সবার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার জোগাড়। কেউ কেউ বলছে,
”সইত্য কইরা কও দেহি তাছলিমা। দুই ভরি আছিলো নাকি দুই আনি?”

তাছলিমা তার কান্নায় ফুলে ওঠা লাল চোখদুটো বড় বড় করে বলে,
“আরে এই বিপদের সময়ে তোমরা আমারে মিছাখোর ভাবতাছো? আমার দুই ভরি স্বর্ণ গো, দাদার আমলের পাওয়া দুই ভরি স্বর্ণ।”

“তইলে এতদিন কই আছিলো এই স্বর্ণ। জীবনেও শইল্যে ছোঁয়াইতে দেহি নাই।”

“গেরামের মাইনষের বুঝি নজর ভালা? আমার কাছে এত দামের স্বর্ণ আছে জানলে কবেই বাড়িত ডাকাইত পড়তো। মাইয়ার বিয়ার লইগ্যা থুইয়া দিছিলাম।”

“ডাকাইতের হাত থাইকা বাঁচতে গিয়া তো চোরের খপ্পরে পড়লা। তে স্বর্ণের শোক এত জলদি ভুইলা টিপি দেখতে আইয়া পড়লা?”

“সবই কপালরে বুবু। এডি মনে করলে কান্দন আহে। চিন্তায় মনে অয় ইস্টোক কইরা মরমু। হের লইগ্যা তুমগো ধারে আইছি।” তাছলিমার যেন নিজের ওপর বড্ড মায়া হলো।

সিকান্দার মুড়ি কিনে এনেছে সিনেমা দেখতে দেখতে খাওয়ার জন্য। ইচ্ছে আছে এই বাড়ি থেকে একটু সরিষার তেল ও পেয়াজ-মরিচ চেয়ে মাখিয়ে খাবে। কিন্তু সে মহিলাদের কর্কশ গলার আলাপ শুনতে শুনতে উঠানে বসে এখনই পোটলা খুলে খাওয়া ধরেছে। চোরের আলাপে তার বিশেষ আগ্রহ আছে। কিন্তু তাছলিমার দুই ভরি স্বর্ণের কথা শোনা মাত্রই সে তেতে উঠল। চিত্রার দিকে ফিরে বলল,
“হুনছো চিত্রা? হুনছো বেডির কথা? পান্তা খাইয়া দুইবেলা কাটে, হের নাকি আবার স্বর্ণ আছিলো দুই ভরি। মিছাখোর!”

“থাকতে পারে না বুঝি?”

“কেমনে থাকবো? হেগো বাপ-দাদারা তো পান্তাও জুটাইতে পারে নাই। লাউ-টাউ, শাক-টাক সিদ্ধ কইরা খাইয়া বাঁচতো। হেগো আবার থাকবো দুই ভরি স্বর্ণ? ফুটানি!”

“সেটা আমরা কি করে বলব চাচা? বলতে তো পারবে চোরে, যে ওদের ঘরে চুরি করতে গিয়েছে। আপনি কিছু জানেন নাকি?”

চিত্রা ঠোঁট কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে, সরু চোখে সিকান্দারের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন মজার কিছু দেখছে। সিকান্দারের গলায় মুড়ি আটকে গেল। সে পানি খাওয়ার নাম করে উঠে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে ষোড়শী চিত্রা ছন্দ তুলে হাসে। কাউকে ভড়কে দেওয়ার মাঝে অদ্ভুত এক মজা আছে।

রনি ফিরে এল কিছুক্ষণের মধ্যে। দাওয়ায় তখন চিত্রা একা বসে আছে। তার ঘর্মাক্ত ফর্সা মুখে সূর্যের আলো ঝিলমিল করছে। রনি নিচের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমি যাই। চাচারে কইয়েন।”
চিত্রা বলল,
“আপনার জন্য আমি নিজের হাতে নুন-চিনির শরবত করে এনেছি। আব্বা বলেছে খেয়ে যেতে।”

রনি ইতস্তত করে শরবতের গ্লাসটা মুখে তুলেছিল সবে। তবে দুই ঢোকের বেশি পান করতে পারলো না। শরবতে অতি মাত্রায় নুন থাকলেও চিনির একটি দানাও নেই সে নিশ্চিত। মেয়েটা ওর সাথে মজা করেছে কিনা সে বুঝলো না। আধখাওয়া গ্লাস নামিয়ে সে দ্রুত পায়ে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে চিত্রা আরেকদফা হেসে ফেলল। এরপর আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে সকলের অগোচরে গ্লাসটা তুলে আধ খাওয়া নুনের শরবতটুকু ঢকঢক খেয়ে ফেলল।
__________________

খিলানচর

জৈষ্ঠ্য মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। নদীর পানি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর আষাঢ়ের শেষে কিংবা শ্রাবনের শুরুতে খিলানচরে বন্যা হয়। এ যেন প্রকৃতির বাধাধরা নিয়ম। ঘোলাপানি কখনো হাটু আবার কখনো কোমড় অবধি এসে এই চরের জনজীবন স্থবির করে দেয়। একসময় আবার চলেও যায়। তবে এবার জৈষ্ঠ্যমাসেই নদীর পানি ঘাটের হিজল গাছের গুড়ি ছুয়ে ফেলেছে। সেই গুড়িতে ছোট ছোট ঢেউ এসে ধাক্কা লেগে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘাটে বাধা ছোট একটা ডিঙি নৌকার গলুইয়ে পা ঝুলিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে পালি। মাথার ওপর চড়া রোদ। সেই রোদে তীরের বালি চিকচিক করছে। চোখ রাখা দায়। ঘামে পালির গলার কাছটায় ভিজে উঠেছে। তার মাথায় চলছে মাছ ধরার চিন্তা। তাদের ঘরে মাছ আসে না আজ অনেকদিন। চালকুমড়া, আলু, শাকপাতা খেতে খেতে পালির মুখের স্বাদ নষ্ট হওয়ার জোগাড়। তাই আজ সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে মাছ সে ধরেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু মাছ ধরার জন্য কোনো বড়শি বা জাল তার নেই। একটা মাঝারি আকার প্লাস্টিকের জালি নিয়ে এসেছে সাথে করে। এই সময় নদীর পানি বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিতে পুকুরের পানিও বাড়ে। তখন পুকুর পাড়ের ডুবন্ত সবুজ ঘাসে কুচো চিংড়ি আর ছোট পুটিমাছ হাত দিয়ে ধরা যায় সহজেই। কোনো পথ না পেলে তাই করবে আজ।

“ও পালি! গালে হাত দিয়া বইয়া আছোস ক্যান? জানোস না গালে হাত দিয়া থাকলে জামাই ম’রে।”

শফিকের বাবা সোলেমানের কথা কর্ণগোচর হতেই গাল ছেড়ে তড়াক করে নৌকার গলুই থেকে নেমে পড়লো পালি। সোলেমান পান খাওয়া দাত বের করে হাসলো। কাধের জালখানা নৌকায় রেখে তারপর বলল,
“এইহানে কি শফিকের লইগ্যা বইয়া আছোস? শফিকরে নিয়া টালিপাড়ার হাটে যামু। এহন খেলন যাইবো না।”

পালির মন খারাপ হয়ে গেল। শফিক আর ও আজ একসাথে মাছ ধরার কথা। শফিক থাকলে অন্তত বড় মাছ ধরার সুযোগ ছিল তার বড়শি দিয়ে।

“তোর মায়ে এহন কেমন আছে?”

সোলেমানের কথায় পালি ছোট করে ভালো বলল। লোকটাকে তার কেন যেন ভালো লাগে না। যখন কথা বলে তখন সোলেমানের নজর পালির মুখে না থেকে সাড়া গায়ে ঘুরতে থাকে। নয় বছরের পালির কাছে ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। সারাদিন টইটই করে শফিকের সাথে খেলে বেড়ায় সে। কই? শফিকের নজর তো এমন অস্বস্তি লাগে না! তাহলে সোলেমান চাচাকে এমন কেন লাগে তার স্পষ্ট ধারনা পালির নেই। তার মা পইপই করে বলে দিয়েছে পুরুষদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলতে। কেউ কোলে বসাতে চাইলে, বুকে, পিঠে ধরতে চাইলে যেন দূরে থাকে।

সোলেমান নদীর পাড়ে বালিতে পানের পিক ফেলল। ক্ষণেই সে পানের পিক নদীর পানিতে ধুয়ে গেল। সোলেমান বলল,
“এদিকে আয় তর লগে কথা কই। হাট থাইকা আওনের সময় শফিকের লগে তর লইগ্যাও রস গজা কিনা দিমুনে।”

কথাটা শেষ করে সে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলো পালিকে ধরতে। তার আগেই দূরের টিলা থেকে করবীর ডাক ভেসে এলো। পালিকে ধমকে ডাকলো,
“পালি? এই মুহূর্তে বাড়িতে ঢুকবি তুই?”

মায়ের ধমকে পালির শরীর কেঁপে উঠল। মা তার ওপর রেগে গেছে। অগত্যা মাছ ধরার আশা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরলো সে। উঠানে পা দিতেই করবী মেয়ের পিঠে কিল বসালো। দাত চেপে বলল,
“তোরে কইছি না সোলেমানের কাছ থেকে দূরে থাকবি? শফিকের সাথে আর খেলবি না। তাও কেন গেছিলি, হ্যাঁ? আমাকে না জ্বালিয়ে তোদের শান্তি হয় না?”

পালি কুকড়ে গেল। ঠোঁট ভেঙে জল এলো চোখে। মিনমিন করে বলল,
“আমি তো মাছ ধরতে চাইছিলাম।”

করবী স্ফিত পেট নিয়ে তেড়ে আসে। বলে,
“যার বাপ খোঁজ নেয় না তার এত খাই খাই স্বভাব থাকবে কেন? আমি কী তোরে অভুক্ত রাখি?”

পালি ফুঁপিয়ে ওঠে। মাছ তো সে মায়ের জন্যই ধরতে চেয়েছিল। চরের বয়োজ্যেষ্ঠ খুদিবু বলেছেন গর্ভাবস্থায় ভালোমন্দ খাবার খেতে। অথচ তাদের বাড়িতে আমিষ আসে না কতদিন। কতদিন ভালোমন্দ খাওয়া হয় না। সে অভিমান করে বলল,
“আব্বা জলদি আসবে। আসলে তোমার নামে বিচার দিমু। খালি আমারে মা’রো।”

পালি ছুটে ঘরে চলে যায়। করবী উঠানে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে।

চলবে…

(পাঠকরা সাড়া দেবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)