বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-৮+৯

0
118

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৮]
প্রভা আফরিন
_
“অবিশ্বাসের পরিণাম স্বরূপ আমি তোমায় উপহার দিলাম এক জনম আফসোস।”

মেহেরুন বানু আচমকা ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন। নিশ্বাস ঊর্ধ্বগতিতে, ঘাড়, গলা ঘেমে গেছে। ঘুটঘুটে আধারে চোখ মেলে তিনি দিশেহারা হয়ে গেলেন। আশপাশ হাতড়ে নিজের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করেন। ঘোর ভেঙে ধাতস্থ হতে সময় লাগলো কিছুটা। এক সময় দেহের অস্থিরতা কমে গেল। কিন্তু মনের অস্থিরতা ডানা ঝাপটানো পাখির মতো অটল রইল। মেহেরুন বানু আধারেই খাট ছেড়ে নামলেন। ধীরপায়ে পথ ঠাহর করে চলে গেলেন জানালার ধারে। খুট করে কাঠের ভারী জানালাটির কপাট মেলে দিতেই শেষ রাতের নির্মল, আদরমাখা হাওয়া সন্তর্পণে সম্পূর্ণ ঘরে আধিপত্য বিস্তারে নিয়োজিত হলো। মেহেরুন বানুর কম্পিত দৃষ্টি জানালার মোটা লোহার শিক গলে দূরের আধারে নিক্ষেপিত হয়। এই থমথমে আধার ওনার খুব পরিচিত। যতটা পরিচিত নিজের প্রতিটি শ্বাস, ততটাই। রাতের কালিমা লেপা, ছায়াঘেরা আবহ দীর্ঘ জীবনে ওনার উত্তম সঙ্গী হিসেবে সঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই তা ঘোর অচেনা রূপে হা’না দেয়। তখন মনে হয় প্রকৃতির এই কালো রূপ ওনাকে গিলতে আসছে। এই যেমনটা একটু আগে মনে হচ্ছিল। কিন্তু মেহেরুন বানু জানে এই আধারে আরো একটা জিনিস ভেসে বেড়ায়। ওই যে পূর্বাকাশের নিসঙ্গ, নির্বিকার, জ্বলজ্বলে শুকতারাটি, সেও জানে। ভেসে বেড়ানো জিনিসটা হলো অনুতাপ, আফসোস, এক যন্ত্রণাময় অনুভূতির যা’তাকল। যাতে প্রতিনিয়ত জ্ব’লছেন মেহেরুন বানুর ক্ষয়ে আসা দেহের পক্ক হৃদয় আর নিরন্তর জ্বলে আসছে বহুদূরের শুকতারাটি।
বয়স হলেও মেহেরুন বানুর দৃষ্টি পরিষ্কার, ইন্দ্রিয় সজাগ। তিনি মিটমিটিয়ে আলো ছড়ানো নক্ষত্র সজ্জিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনেকটা সময়। একসময় অনুজ্জ্বল মেঘের গায়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে তিনি খেয়াল করেন সেখানে তার মেয়ের মুখাবয়ব ফুটে উঠছে। বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে ওঠে। একি দৃষ্টিভ্রম! নাকি মনের লুকানো প্রতিচ্ছবি! প্রকৃতি কি তবে আধারের মাঝে ওনাকে খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলতে পারছে! মেহেরুন বানু কাঁদেন না। ভেঙে পড়েন না। শুধু নিশ্চল হয়ে শেষ রাতের বিদায়ী আধার ফুঁড়ে, নরম গতিতে আলোর বিচ্ছুরণ হতে দেখেন। ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানায় তাকান। পালি হাত পা গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওনার আধার ঘেরা হৃদয়েও কি তবে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে?

‘কুব কুব কুব’ করে কুবো পাখিটি ছয়-সাত বার ডেকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল কদম গাছের ডাল থেকে। পালির ঘুম হালকা হলো ধীরগতিতে। ভোরের প্রকৃতি সদ্য জন্মানো বাচ্চার মতো কোমল ও স্পর্শকাতর। এই সময় জোরে আওয়াজ করলে ভোরের নিরবতা নামক অঙ্গটি ব্যথা পায়। সকলেই তা অঘোষিতভাবে অবগত। তাইতো খুব ধীরে সুরেরা জেগে ওঠে। শব্দগুলো ছন্দের মতো শোনায়। পালির কাছে শব্দগুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগে। আধোঘুমের আলস্য এঁটে থাকা দুইচোখ যেন শব্দ শুনে বাস্তব রূপ আঁকে। ঘরের মেঝেতে কারো ধীরপায়ে হাটা কিংবা ব্যস্ত পায়ে হাটার গতি বোঝা যায়। বাইরের রান্নাঘর থেকে বাসন-কোসনের ঝনঝন শব্দ, ছাই দিয়ে পাতিল মাজার ছিকছিক শব্দ সবই স্পষ্ট শোনা যায়। অবশ্য এই ঘরের জানালা খোলা বলেই বাইরের শব্দগুলো প্রকট হয়ে আসছে। বন্ধ ঘরে তা বড্ড আবছা শোনাতো। পালির ইচ্ছে হয় বন্ধ জানালা গলে শব্দগুলো কেমন শোনায় জানতে। কিন্তু বিছানা ছেড়ে জানালা বন্ধ করে ফেরত আসতে বোধহয় সেই আধোঘুমের আদুরে আরামটুকু টিকবে না।

মেহেরুন বানুর ডাকে পালি চোখ মেলে তাকালো। কোচকানো, মলিন চামড়ার এই মহিলাটি তার নানি হয়। যার সম্পর্কে সে এযাবতকাল শুনেই এসেছে। দেখলো সপ্তাহ দুই আগে, মামাবাড়িতে পা রেখে।
মেহেরুন বানু মশারির কোণা খুলে দিলে পালি মাথা বের করল। তার রুগ্ন দেহটি দেখে মেহেরুন বানু মেয়ের জীবনের অভাবটুকু যেন কল্পনা করতে পারেন। শালুগঞ্জ এসে প্রথম কয়েকদিন পালি কারো সঙ্গেই কথা বলেনি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। মেহেরুন বানু ভেবেছিলেন মা ম’রা মেয়েটাকে সামলানো খুব কষ্টের হবে। কিন্তু কয়েকদিনের মাঝেই ছোট মেয়েটা নিজেকে একা একাই সামলে নিয়েছে। অথবা শালুগঞ্জে এসে সে এতটাই ভিন্ন পরিবেশে পড়েছে যে নতুন সম্পর্কগুলো তাকে পুরোনো স্মৃতিতে বিচরণ করতে দিচ্ছে না। মেহেরুন বানু বললেন,
“যা, হাত-মুখ ধুইয়া ওজু কইরা আয়। আইজ থাইকা আরবি শিখবি।”

পালি মাথা কাত করে বিছানা ছাড়ে। সে নানিকে একটু ভয় পায়। কেননা নানি-দাদি সুলভ রসিকতা ওনার স্বভাবে নেই। অবশ্য পালি সবাইকেই ভয় পায়। খন্দকার বাড়ির প্রতিটি মানুষকে তার অদ্ভুত লাগে। প্রথম যেদিন সে এই বাড়িতে এল, নানি তাকে নিজের থেকে সরালোই না। কথাও বলল না। শুধু জড়িয়ে ধরে রইল। পালি কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। তার কাছে সবটাই অপ্রত্যাশিত। এখানকার জীবনযাত্রাও চরবাসীর মতো নয়। ফলে পালির কাছে সবটাই প্রবল কৌতুহলের। সে বা হাতের তালুতে নিমপাতার ছাই নিয়ে ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে দাত মাজতে মাজতে যাচ্ছিলো পুকুরের দিকে। চিত্রা কোথা থেকে ছুটে এসে তাকে দুইহাতে জাপটে উঁচু করে ঘুরতে শুরু করে। ভড়কে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে পালির ঠোঁটে হাসি ফুটলো।

“চিত্রা বুবু, মাথা ঘোরে। নামাও আমারে।”
চিত্রা আরো একটা পাক দিয়ে পালিকে নামিয়ে দিল। পালির হাতের ছাই ততক্ষণে উড়ে দুজনের জামায় লেগেছে। চিত্রা জামা ঝেরে বলল,
“এত সকালে উঠলি কেন?”
“নানি আরবি পড়তে ডাকলো।”
“তুই আসায় একটা ভালো কাজ হয়েছে বুঝলি, আমার পেছনে দাদির খবরদারিটা একটু কমেছে। এখন তোকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।”
পালি সে কথা বুঝলো না। চিত্রার অনেক কথাই সে বোঝে না। কিন্তু মানুষটাকে তার খুবই ভালো লাগে। এত এত গোমড়ামুখের মাঝে এই সুন্দর মুখটাই সবসময় হাসিখুশি থাকে। পালি মুগ্ধ গলায় বলল,
“চিত্রা বুবু, তোমার হাসিটা অনেক সুন্দর।”
চিত্রা হাসিতে নুইয়ে পড়ে। বলে,
“কতটা সুন্দর?”
“অনেক।”
“কেউ পাগল হবে?”
পালি ঠোঁট উল্টে বলল,
“হাসি দেখে কেউ পাগল হয় নাকি?”
“বুঝবি না। এবার বলতো মুচকি হাসলে বেশি সুন্দর লাগে না কি দাত বের করে? জোরে হাসলে কেমন লাগে?”
চিত্রা নানান ভঙ্গিতে হেসে দেখালো। পালি ফিচ করে মুখের জমানো থুতু ফেলে বলল,
“এতকিছু জানি না। তোমার হাসিটা আমার মায়ের হাসির মতো সুন্দর।”

চিত্রার মন খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়েটা তার সবকিছুতে মায়ের সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ায়। একই বংশের মেয়ে হওয়ায় করবী ও চিত্রার মাঝে কিছু সাধারণ মিল আছে। এই সাধারণ মিলও পালির কাছে অসাধারণ লাগে। অবশ্য পালি তার জলে আবদ্ধ ছোট জীবনে দুইজন সুন্দর মানুষ কাছ থেকে দেখেছে বলেই হয়তো অবচেতন ভাবনায় চিত্রার সঙ্গে মাকে মিলিয়ে বসে। চিত্রা প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,
“হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যা। দেরি হলে দাদি আমাকেও বকবে।”
________

হিমাদ বাড়িতে এলো বেলা গড়ানোর পর। সে বাড়ি ফিরেছে প্রায় মাসখানিক পর। পড়াশোনা না থাকায় আত্মীয়দের বাড়িতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো এতদিন। কিন্তু মায়ের মনে হঠাৎ ছেলের চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই এনাম তাকে সঙ্গে করে ধরে এনেছে। যা নিয়ে সে যারপরনাই বিরক্ত। জুলেখা ছেলেকে অনেকদিন পর দেখতে পেয়ে আপ্লুত। সেই সঙ্গে ওজন কমা ও রোদে পুড়ে গায়ের রঙ তামাটে হওয়ায় খানিক উদ্বিগ্নও। জুলেখা বলল,
“তরে বারে বারে মানা করি মাইনষের বাড়িত গিয়া এতদিন থাকবি না। আমার মতোন কেউ যত্ন নিতে পারবো আমার পোলাপাইনের? সোনার বরন পোলাডা রইদে পুইড়া, হুকাইয়া তামা হইয়া গেছেগা।”
এনাম দাতকপাটি বের করে বলল,
“তাইলে ভাবী এইডা নকল সোনা। আসল সোনা তো পুইড়া গেলেও সোনাই থাকে। তামা হয় না।”
হিমাদের মেজাজ আবার খারাপ হলো। জুলেখা খেকিয়ে বলল,
“তরে কইছি আমগো মাঝে বাম হাত ঢুকাইতি? যা, ডাব কাইট্যা আন।”

এনাম হাসতে হাসতেই ডাব নিয়ে এলো। দা’য়ের একাধিক কৌশলে খুব সহজেই ডাব কে’টে ফেলল সে। হিমাদ সবটাই চোখা নজরে দেখে। এই সদাহাস্যজ্জ্বল লোকটিকে দেখতে একজন ভোলাভালা ভৃত্য মনে হলেও খন্দকারদের জন্য সে চরম পর্যায়ে যেতে পারে। যে হাতে এখন ডাব কাটছে সে হাতে অনায়াসে শত্রুর মাথাটাও আলাদা করতে পারে। শুধু দরকার রবিউল খন্দকারের একটা দরাজ স্বরের হুকুম। অথচ রাগ, তেজ, গম্ভীরতা কোনোটাই তার স্বভাবে নেই। শুধু আছে বশ্যতা। হিমাদ ডাব হাতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। নিজের ঘরে ঢোকার আগে নানির ঘরে চোখ যেতেই দেখলো একজোড়া ভীতু চোখ দরজার আড়াল থেকে তাকে দেখে লুকিয়ে পড়েছে। হিমাদ ভ্রু কুচকে বলল,
“এই কে তুই? বেরিয়ে আয়।”

পালি আবারো মাথা বের করে। হিমাদ হাতে ইশারা করে কাছে ডাকলে মাথা নুইয়ে দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। হিমাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে মেয়েটাকে। বাড়ি ফেরার পথে এনাম তাকে এতদিনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা জোর করে শুনিয়েছে। করবী ফুপির মৃত্যু সংবাদ শুনে সে মনে মনে খানিক ব্যথিত হয়েছে। ছোটবেলায় ফুপি তার খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিল। তার শৈশবকে আনন্দে মাতিয়ে রাখা মানুষটা ছিল ফুপি। এরপর একদিন কোথায় যে চলে গেল, আর খুঁজেই পেল না। ফুপির শোকে হিমাদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অনেকদিন পর আব্বা এসে বলল তাকে নিয়ে ফুপিকে আনতে যাবে। হিমাদ সেদিন কি যে খুশি! কিন্তু ফুপি তাদের সঙ্গে এলো না। হিমাদ আঁচল ধরে কেঁদেকেটে কাহিল হয়ে গেলেও ফুপির মায়া হলো না। হিমাদ সেদিন তাকে নিষ্ঠুর আখ্যা দিয়ে ফিরে এসেছিল আব্বার সাথে। তারপর বছরের পর বছর গিয়েছে। হিমাদও ফুপিকে স্মৃতির মলাটে আবদ্ধ করে ফেলেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুচকে মেয়েটা যে ফুপির মেয়ে হিমাদের তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। হিমাদ থমথমে গলায় বলল,
“নাম কী তোর?”
“পালি।”
“শুধু পালি?” হিমাদ ভ্রু কুচকায়।
“আম্রপালি।”
হিমাদ ডাবের পানিতে চুমুক দিয়ে বলল,
“নামে আম কিন্তু চোখদুটি ডাবের মতো।”
পালি মাথা নিচু করে আছে। এ বাড়িতে আর কতগুলো নতুন মানুষ আছে কে জানে? হিমাদ আধখাওয়া ডাবের পানিটুকু পালির হাতে দিয়ে বলল,
“যা ভাগ।”

পালিকে যেতে হলো না। হিমাদ নিজেই চলে গেল। জুলেখা উঠানে দাঁড়িয়ে পালির হাতে ডাব দেখেই ছুটে এলো। ছো মেরে ওর হাত থেকে ডাবটা নিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
“খাওন দেখলেই চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে শুরু করে। জীবনে খাস নাই? ছেড়াডা বাড়িত আইতে না আইতেই হের খাওনে ভাগ বহাইতে আইছে। খালি আদেখলামি।”

জুলেখা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল। পালির খুব কান্না পেল। মামী তাকে দেখতে পারে না কেন?

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৯]
প্রভা আফরিন [কপি নিষেধ]
_
শ্রাবণের মেঘলা আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা লালিমা বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। রঙ মিলান্তির ধূসর সন্ধ্যায় ধীরে ধীরে বিশ্রামে যাচ্ছে প্রকৃতির উচ্ছল প্রাণেরা। রবিউল খন্দকার বাড়ি ফিরলেন কাচকি মাছ নিয়ে। বললেন রাতের বেলা কাচকি মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খাবেন। তা শুনেই জুলেখার মেজাজ গরম হলো। এই সন্ধ্যায় ছোট মাছের ঝামেলা তার কাছে আপদ ছাড়া কিছুই মনে হলো না। জুলেখা গজগজ মাছগুলো নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। চামেলিকে বলল কুটে-বেছে ধুয়ে নিতে। চামেলি খন্দকার বাড়িতে কাজ করে করবীর গ্রাম ছাড়ারও আগে থেকে। বাড়ির কাজের লোক হওয়ার পাশাপাশি করবীর খুব ভালো বান্ধবীও ছিল সে। জুলেখা মাছ রেখে রান্নাঘর ছেড়ে বের হতেই সে মুখ ভেংচি দিলো।

রবিউল খন্দকার পুকুর থেকে হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখলেন পালি বাইরের ঘরে চুপচাপ বসে আছে। তিনি পালিকে কাছে ডাকলেন। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতেই বললেন,
“কীরে মামা? মন ম’রা ক্যান? কেউ কিছু কইছে?”

পালি ডানে-বামে মাথা নাড়লো। রবিউল খন্দকার আবার বললেন,
“তাইলে?”

পালি কোনো উত্তর দিলো না। এক দৃষ্টিতে পায়ের দিকে তাকিয়ে নখ খুটতে লাগল। রবিউল খন্দকার ধীরে ধীরে বললেন,
“এহন থাইকা কিন্তু এইডা তরও বাড়ি। চিত্রা যেমন এই বাড়ির মাইয়া তুইও এই বাড়ির মাইয়া। কিছু কইতে শরম পাইলে হইবো? হইবো না। নিজের সুবিধা-অসুবিধা মুখ খুইল্লা কবি। আমারে না কইলে মামীরে, নানিরে কিংবা বুবুরে কবি। চুপ থাইক্যা নিজেরে ঠকাবি না। আমার বোন আমার বাড়িতে যেমন আছিলো তুইও তেমনই থাকবি।”

কথাটা শেষ হতেই পালি হঠাৎ দুইহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। তার ফোঁপানোর শব্দ ফুরিয়ে আসা ম্লান আলোর সঙ্গে মিশে বেদনার ছন্দ তৈরি করল। রবিউল খন্দকারের বুকের ভেতরটা গুমরে ওঠে। পালির না বলা কথাটা যেন তিনি বুঝে নিলেন। চিত্রা ছুটে এসে পালিকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“আব্বা, ওরে স্কুলে ভর্তি করে দেন। নাহলে বেশি দেরি করলে পরের বছর ভর্তি করাতে হবে। বাড়িতে একা থেকে ফাঁপড় হয়ে গেছে মেয়েটা।”

রবিউল খন্দকার মাথা নেড়ে বললেন,
“তা তো দেওয়াই লাগবো। করবীর আমানত তার মনের মতো কইরাই গড়তে হইবো।”

পরদিন সকালেই রবিউল খন্দকার পালিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বাড়ি থেকে স্কুল অনেকটা দূরে হওয়ায় প্রতিদিনের যাতায়াতের জন্য সেদিনই গঞ্জে থেকে একটা সাইকেলও কিনে দিলেন। এটা অবশ্য মেহেরুন বানুর পছন্দ হলো না। মেয়েমানুষ সাইকেল চালিয়ে বাজারের মানুষগুলোর সামনে দিয়ে স্কুলে যাবে তা ওনার একদমই ভালো লাগলো না। পালির জন্ম আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে। সেই হিসেবে এবার সে দশ বছরে পড়েছে। যদিও রোগা শরীরের জন্য তাকে আরো কম বয়সী লাগে। কিন্তু সামনের বছর ঘুরতেই মেয়ে বড় হয়ে যাবে। লোকের চোখে বাজবে। বিষয়টা পছন্দ হলো না জুলেখারও। সে মুখ বেকিয়ে বলল,
“মায়েরে আহ্লাদ দিয়া ছি*না*ল বানাইছিলো। এইবার মাইয়াও তাই হইবো।”

মায়ের নামে বাজে কথা শুনে পালির চোখে পানি চলে এলো। মেহেরুন বানুও কথাটা শুনতে পেয়েছেন। তিনি রাগে হুংকার দিলেন,
“জুলেখা!”

জুলেখা ভড়কে গেল। সে জানতো না শ্বাশুড়ি আশেপাশেই আছে। কাচুমাচু করে সে তড়িৎ প্রস্থান করল। মেহেরুন বানুর রাগ পড়লো না। ছেলে এলে আজ একটা বিহিত করবেনই মনে মনে ঠিক করলেন। পালিকে ধমকে বললেন,

“কথায় কথায় কান্দন লাগবো ক্যান তর? চোক্ষের পানি এত সরস ক্যান? চোখ মুইচ্ছা ঘরে ঢোক।”
পালি কেঁপে উঠে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢোকে।

পালিকে সাইকেল চালানো শেখানোর দায়িত্বটা পড়েছে হিমাদের ওপর। সে দায়িত্ব হিমাদ খুব ভালো করেই পালন করছে। সামনেই তার ম্যাট্রিকের ফলাফল। সেসব নিয়ে হিমাদের চিন্তা নেই। সে ভেবে রেখেছে আর পড়বেই না। সেই তো আব্বার কাজগুলোই করবে ভবিষ্যতে। তাহলে এত পড়াশোনার কী দরকার? এই সিদ্ধান্ত অবশ্য সে কাউকেই জানায়নি। মা এবং দাদি এই সিদ্ধান্ত শুনলে বরং খুশি হবেন এই ভেবে যে ছেলে অল্প বয়সেই নিজের কাধে দায়িত্ব তুলে নিতে চাইছে। আব্বা মানলেই হলো।

পালি তিন দিনেই সাইকেল চালানো অনেকটা রপ্ত করে ফেলেছে। শিখতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ে হাটু ছি’লে গেছে। কিন্তু আগ্রহ তারও কম না। হিমাদ পালিকে মাঠে রেখে কোথাও একটা চলে গেছে। কিছু বলেও যায়নি। পালি আপন মনে সাইকেল চালাতে চালাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে সহজ রাস্তা ধরলো। সড়কের এবড়োখেবড়ো পথের চেয়ে বাশঝাড়ে ঘেরা সরু, মসৃণ পথটা দিয়ে গেলে তার সুবিধা। কিন্তু পথিমধ্যে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সে ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গেল ঝোপের ভেতর। হিমাদ দৌড়ে এসে ওকে টেনে তুলল। পালি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“হিমাদ ভাই, তুমি সিগারেট খাও?”
হিমাদ ভড়কালো। পালির মুখ চেপে ধরল সজোরে। ফিসফিসিয়ে বলল,
“যা দেখলি এইখানেই ভুলে যাবি। কাকপক্ষীও যেন না জানে। মনে থাকবে?”
পালি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে একদিকে মাথা কাত করে।
__________

রবিউল খন্দকারের রাইস মিল হাটে অবস্থিত। আশেপাশের গ্রামগুলো যেহেতু কৃষিভিত্তিক তাই
গ্রামে বিদ্যুতায়ন হতেই লাভজনক ব্যবসাটি চালু করেন তিনি। কাঁচামাল, উৎপাদিত পন্য আনা-নেওয়ার সুবিধার জন্য নদীর তীর ঘেঁষে অনেকটা জায়গা জুড়ে মিলখানা বানানো হয়েছে। রাইস মিলের পেছনে আবার সারি করে টিনের ঘর বানানো। যাতে কাঁচামাল অর্থাৎ ধান মজুত রাখা হয়। সেই ঘরগুলোর একটা বর্তমানে রনির থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাইস মিলটা হাটের শেষপ্রান্তে হওয়ায় পেছনের ধান মজুদের জায়গাটি তুলনামূলক নিরিবিলি। এদিকটা ঘিরে গাছ-পালার পরিমান বেশি হওয়ায় জায়গাটুকু ছায়াঘেরা। তার সামনেই আবার বিশাল বিল। রনির একলা জীবন, ভোরে একবার রান্না করে সারাদিন তাই খায়। ভাত-তরকারি আলাদা আলাদা রান্না করতে ঝামেলা লাগে বলে বেশিরভাগ সময় চালে-ডালে মিশিয়ে পাতলা খিচুড়ি রাঁধে। আজও তাই করেছিল। কিন্তু এবারের চালের ভাত বিকেল গড়াতেই ঘেমে গন্ধ ছুটে যায়। ফলে আজ এক থালা খিচুড়ি গন্ধ উঠে নষ্ট গেছে। পুনরায় রান্না করার আলসেমিতে না খেয়ে রাত কাটাবে কিনা ভাবতে ভাবতে জানতে পারলো মসজিদে আজ শিন্নি দেবে। তা দিয়ে রাত পার করা যাবে ভেবে মনে মনে খানিক উৎফুল্লতা বোধ করল সে। তবে সেই উৎফুল্লতা উৎকন্ঠায় রূপ নিলো চিত্রার আগমনে।

চিত্রার স্কুল ছুটি হয় দুপুরের পর। হেলেদুলে বাড়ি ফিরতে বিকেল গড়ায়। তবে আজ সে বাড়ি না গিয়ে হাটের দিকে আসছিলো। কাছাকাছি আসতেই বিলের কাছে রনিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোণে কাঙ্ক্ষিত হাসিটি ফুঁটে উঠলো। সে এগিয়ে এসে পাশাপাশি দাঁড়াতেই রনি ভড়কে গেল। কয়েক কদম পিছিয়ে আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো কেউ দেখছে কিনা। চিত্রা বিরক্ত হয়ে বিরস মুখে বলল,

“আপনার ভেতরে কী তেলাপোকার কলিজা? আমাকে এত ভয় পান কেন? আমি তো আপনার মতোই মানুষ। নাকি অন্যকিছু ভাবেন?”

চিত্রা ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো। রনির হাঁসফাঁ’স লাগে। এই মেয়েটি কাছে এলেই এমন হয়। মনে হয় এই বুঝি গর্দান যাবে। তার ভয়ার্ত চোখ বারবার মিলের দিকে যায়। যে কোনো সময় কোনো কর্মচারী বেরিয়ে এসে তাদের দেখে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে। যেটা সে মোটেও চাইছে না। মেয়েটার হাবভাব বুঝবে না এমন বোকা নয় সে। তাই মাসখানেক সে অজুহাত দেখিয়ে কোনো কাজেই খন্দকার বাড়িতে যায়নি। তবুও রক্ষা নেই। মেয়ে নিজেই চলে এসেছে। রনি নিজের পায়ের দিকে চোখ রেখে বলল,

“আপনে এইখানে ক্যান?”

“ক্যান মানে? আমাদের জায়গায় আমি আসছি। আব্বার কাছে আসছি।”

“চাচারে এইহানে পাইবেন না। একটু আগেই চইলা গেছে।”

চিত্রা বিলের পাড়ের সতেজ ঘাসের ওপর বসে পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“এতদিন যাননি কেন বাড়িতে? আমাকে ভয় হয়?”

“ডরামু ক্যান?”

“যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসি।”

রনি কোনো উত্তর দিলো না। চিত্রা মিটমিটিয়ে হাসছে। সামনের বিস্তৃত, স্বচ্ছ জলরাশিতে বিকেলের তেজক্ষয়ী রোদেরা আলতো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। এই বিল সারা বছরই খা খা করে। শুধু বর্ষা ঋতুতে বৃষ্টি ও নদীর দান করা পানিতে প্রাণ ফিরে পায়। চিত্রা বাতাসে লম্বা শ্বাস টেনে জলের গন্ধ নেয়। তার মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে রনি বলল,

“বাড়ি ফিরা যান।”

চিত্রা আনমোনা হয়ে বলল,
“যদি না ফিরি?”

“পাগলামি করতাছেন।”

“আপনিও একটু করেন।”

“আমার জানের মায়া আছে।”

চিত্রা রনির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। রনি মাথা নিচু করে ফেলে। চিত্রা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ময়লা ঝেরে বলল,
“কাল টিভিতে একটা সুন্দর সিনেমা দেখেছি জানেন। নায়িকা বিশাল বড়লোক। আর নায়ক হলো তার বাড়ির চাকর। দুজনের প্রেম ভালোবাসা হয়। একসময় পরিবার জেনে গেলে অনেক অশান্তি হয়। কিন্তু অনেক ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে অবশেষে মিলন হয়।”

“কিন্তু বাস্তবে অশান্তি ছাড়া কিছুই হয় না। সিনেমা দেইক্ষা আপনের মাথা আউলায় গেছে। এইবার দয়া কইরা ফিরা যান। এইহানে এত সময় দেখলে মাইনষে খারাপ কইবো।”

চিত্রার মন খারাপ হয়। এসব যে সে বোঝে না তা নয়। তবুও অবাদ্ধ অনুভূতিরা হামলা করে। ইচ্ছে করে বেপরোয়া হতে, সকল বাধা এড়িয়ে নিজের ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিতে। তার জীবনে প্রণয়ের ভ্রমর হয়ে আসা মানুষটাকে সে কেন পাবে না? মানুষ নিশ্চিত জীবনের আশায় কতকিছু করে। কিন্তু জীবন আসলে এক অনিশ্চিত পথ চলা। সামনের বাঁকে জীবন কোনদিকে মোড় নেবে কেউই জানে না। তাহলে এই অনিশ্চিত জীবনে এত জটিলতা কেন? সে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর মুখ তুলে আবার হাসলো। সেই হাসি রনির কাছে সুবিধার মনে হলো না। তার ভীতু চোখ বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। চিত্রা বলল,

“কাল ছুটির পর যেন আপনাকে স্কুলের কাছের নদীর পাড়ে পাই। নয়তো পরের দিন বিলের ধারে নয়, একদম আপনার ঘরে ঢুকে যাব।”

রনি কথাটা হজম করার আগেই মেয়েটা ফড়িংয়ের মতো উড়ে চলে গেল।

চলবে…