বিষাদময় জীবন পর্ব-০৬

0
287

#বিষাদময়_জীবন
#অধরা_ইসলাম
#পর্ব ৬

আমি বাবার কাছে গিয়ে ডাকলাম কয়েকবার ওনাকে। কিন্তু উনি সাড়া দিলেন না কেমন নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। ওনার গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই কিছুক্ষণ পর উনার নিথর শরীরটা পড়ে গেলো বিছানায়! আমি মনের ভয় ক্রমশ বাড়ছে আমি ওনার নাকের কাছ হাত দিয়ে দেখতেই বুঝতে পারলাম উনার শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে! মানুষটা নেই আর পৃথিবীতে। মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। ইশশ যাবার সময়টুকুও আমি উনার পাশে থাকতে পারলাম না এর চেয়ে বড়ো আফসোস বোধহয় আর একটাতেও নেই! সকালবেলাও কি সুন্দর নাস্তা করে ওষুধ দিতেই আমার দিকে তাকিয়ে এক গা’ল হেসে বলেছিলেন বউমা যাও তুমিও বিশ্রাম করো এবার। কে জানতো ওটাই ছিলো ওনার শেষ কথা বলা আমার সঙ্গে! যদি বুঝতাম বাবা আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে তাহলে তো বাবাকে বেঁধে রাখতাম একেবারে কোথাও যেতে দিতাম না। বাবা চলে গেলো আমাকে ফাঁকি দিয়ে! আমার চিৎকারের আওয়াজে কলি, নিরব সবাই এসে উপস্থিত হলো বাবার রুমে।

কলি এসে যেনো থ হয়ে গেছে। সে ভাবেওনি এই তো এক ঘন্টা আগেই তো বাবার রুমে এসেছিলো তখন তো তিনি ঠিকই ছিলেন নিত্যদিন কার মতন কলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গল্প করছিলেন। রান্নার ডাক পড়তেই কলি রান্নাঘরে যায় আর এর মধ্যে তার বাবা তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। কলি কেন এটা তো কারো ভাবনাতেই ছিলো না মানুষটা এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলো যাবে!

—“বাবা ও বাবা? তুমি ওঠো না ওঠো? এক ঘন্টার ভেতর কই চলে গেলে আমাকে ছেড়ে? তুমি না বলতো তোমার মেয়ের বিয়ে না দেখে তুমি যাবে না কোথাও? তাহলে যে চলে গেলে? তোমার মনির বিয়ে দেখবে না বাবা? ও বাবা ওঠো বলছি ওঠো! মা যাবার পর আগলে রেখেছিলে তুমি আর আজকে তুমিও আমাকে এতিম করে দিয়ে চলে গেলে! বাবা ওঠো নইলে নিয়ে যাও আমাকে তোমার সঙ্গে।”

–“কেদোঁ না কলি। নিজেকে সামলাও। মা যেমন নেই আজ থেকে বাবাও নেই আমাদের সঙ্গে! এটা মেনে নিও কান্না করে আর লাভ নেই। আমি বাকি আত্নীয়দের খবর দিতে বলছি নিরবকে। আর ওই মায়া মানে তোমার ভাবী তাকেও কান্না করতে মানা করো তার যে বাচ্চা পেটে ভুলে গেছে? নিজেকে সামলাতে বলো।”

–“আমাকে নিয়ে কোনো ভাবনা অন্ততো তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি চলে যাও এখান থেকে।”

আমার কথা শুনে নয়না চলে গেলো রুম থেকে। একটু পরই বাসা ভর্তি হয়ে গেলো মেহমানে! সবাই একটা শো’কের ভেতর ছিলো এর ভেতর নিরবের দিত্বীয় বিয়ের কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়ছে এরকম অবস্থা! তবুও বাবার জানাযা শেষ করে একে একে প্রায় সবাই চলে গেলো। যদিওবা কিছু আত্নীয় মানে আমার ফুপি শাশুড়ি থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু নয়নার ব্যবহার দেখে আর থাকেননি। চলে গেছে সবাই বাড়ি ছেড়ে। আমার নিজের বাবাও এসেছিলেন উনি যখন জানতে পেরেছিলো নিরব দিত্বীয় বিয়ে করছে তখন বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন আমাকে ওই বাড়িতে গিয়ে থাকবার কথা। কিন্তু নতুন মায়ের চোখ বড়ো করার ইশারাই যথেষ্ট ছিলো আমার বাবার জন্য। ওনারাও চলে যান বাকি মেহমানদের সঙ্গে। যাবার আগে বাবা বলেছিলেন “ওখানে গেলেও যে তুই ভালো থাকবি নিশ্চয়তা নেই। এখানে তোর সতীন আছে তবুও একটু নিজেকে গুছিয়ে নিস সাবধানে থাকিস।”
ব্যস এটুকু বলেই বাবা বিদেয় নেয়। এখন পুরো বাড়ি ফাঁকা প্রায়! এখন আর কোনো সঙ্গী রইলো না আমার,সঙ্গে কথা বলার কেউ আর মা বলে সম্মোধন করে এটা ওটার আবদারও করবে না! কারো সঙ্গে আর বিকেলে চায়ের আড্ডায় গল্প করা হবে না। কাউকে আর বাবা বলে ডাকা হবে। কথাগুলো যখুনি মনে পড়ছে কেমন জানি অদ্ভুত রকমের কষ্ট ধরে বসেছে মনের ভেতরে যা বলার বাহিরে! আমার নিজের বাবা তো থেকেও যেনো নাই হয়ে গেছিলেন প্রায় কিন্তু এই মানুষটাকে সত্যিই নিজের বাবার আদরে পেয়েছিলাম আজকেও সে চলে গেলো! আমি এখন পুরো একলা, কেউ রইলো না আর আমার সঙ্গে কেউ না!

আজকে বাবা চলে যাবার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। পরিস্থিতি সব আগের মতনই আছে কোনো পরিবর্তন নেই। কলি আর একা ঘুমায় না, আমার সঙ্গে এসে ওই ছোট্ট রুমটাতে ঘুমায়। কলেজ সেড়ে আগে নিজের রুমে থাকতো এখন কলেজ কোচিং সব সেড়ে এসে বাকিটুকু সময় আমার সঙ্গেই থাকে। কলি থাকাতে একটু কাউকে পেয়েছি নিজের করে। কলি যখন থাকে না তখন পুরো সময় যেনো আমি একলা একা! সকালবেলা নাস্তা তৈরী করে রান্না করে দিই ওরা খেলে খায় নইলে দেখি একটু পরপর বাহিরে চলে যায়। আবার মাঝে মধ্যে আমাকে এটা ওটা করেও দিতে বলে আমি করেও দিই। যদিওবা নিজের স্বামীর সঙ্গে পরনারীকে কোনো মেয়েই নিতে পারবে না কিন্তু আমার যে কোনো উপায় নেই? কিচ্ছু নেই আমার হাতে সেজন্যে তো পড়ে আছি নইলে কে থাকতো এখানে?

আজকেও বাজারে এসেছি একটুখানি জিনিসপত্র কিনতে তখুনি এক সাদা রঙের গাড়ি দেখতে পাই, গাড়ি থেকে এক লোক আসে আমার কাছে,

–“আপনার বাসা নিশ্চয়ই এই আশেপাশেই হবে? আমাকে বোধহয় চিনেন না আমি জাহিদ। আকাশের বাবা। আকাশ খুব বায়না করছিলো ক’দিন ধরে ওর মিষ্টি আন্টির কাছে যাবে, মা ছাড়া ছেলে তো আমার খুব বায়না ধরে কি করবো বলুন? ছেলের বায়না মিটাতে বাবাকে হাজির হতে হলো।”

–“ওহ্ আপনিই আকাশের বাবা। হ্যাঁ আমার শশুড়বাড়ি এখানেই ওই তো পাশের নীল রঙের বাড়িটা। তা আপনু কি করে খুঁজলেন আমাকে?”

–“আগেরবার এখান থেকেই তো আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছিলাম। তাই ধারনা করে নিয়েছিলাস এদিকের আশেপাশে ই হবে আপনার বাসা হয়তো। সেজন্য আজকে নিয়ে দু’দিন এই সময়টাতে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আপনার জন্য আর আজকে আপনাকে খুঁজেও পেলাম দেখুন।”

–“এত্তো কষ্ট কেন করতে গেলেন?”

–“ওই যে ছেলের জন্য। বললাম না মা হারা ছেলে বায়না একটু বেশিই। আপনি যদি আপত্তি না করেন একটু যাবেন ওর কাছ? ও আপনার জন্য অধীর আগ্রহে আছে।”

ভদ্রলোকের কথা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলাম যাবো কি যাবো না? কিন্তু না গেলে যে ছেলেটা অপেক্ষায় থাকবে। আর বাড়িতেও তো আমার কিছুই নেই! কলিও কলেজে চলে গেছে আর এখন তো বাবা নেই যে ওনার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো আমি। বাড়িতে থেকেও তো কিছুই করতে হবে না কেবল ওদের৷ ফরমায়েশ খাটতে হবে! তার চেয়ে বরং ওই মিষ্টি ছেলেটার সঙ্গে একটুখানি সময় কা*টিয়ে আসি তাও ভালো।
উনার সঙ্গে গাড়িতে ওঠে বোসলাম। কিছুক্ষণ পরই গাড়িতে করে ওই বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। আমাকে দেখেই আকাশ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো! আমিও পরম যত্নে আগলে নিলাম তাকে। এতো সুন্দর বাচ্চা কাছে না নিয়ে থাকা যায়? কি মায়াভরা মুখ তার অথচ আল্লাহ তার কপাল টা আমার মতন করে দিছে মা নেই! যার মা নেই তার তো সব থেকেও নেই! আর এখন তো আমি এতিমই বলতে গেলে পুরোপুরি ভাবে। মায়ের মতন শাশুড়ি পেয়ে ভেবেছিলাম মায়ের শূন্যতা পূরন করতে পারবো কিন্তু তিনিও চলে গেলেন। নিজের বাবা তো থেকেও নেই যেনো! যিনি ছিলেন সেও চলে গেলো। জীবন বড়ই অদ্ভুত যার কতো কি আছে অথচ বাবা মা নামক দুটো মানুষ নেই তার তো কিছু থেকেও নেই!
#চলবে?