বিষাদময় প্রহর পর্ব-০৪

0
576

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৪ ||

পরেরদিন প্রতিবারের মতোই ফজরের আযানে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
জ্বর এখন নেই বললেই চলে।
চোখ কচলাতে কচলাতে ওয়াশরুম গিয়ে ওযু করে নিলাম।
ওযু করে রুমে এসে নামাজ শেষ করলাম।
আজকে বাইরে বের হতে ইচ্ছা করছে না তাই আগে গিয়ে নাস্তা বানানো শুরু করলাম।
মা বা জিনিয়া এখনো উঠেনি।
রুটি বেলতে বেলতে খাবার টেবিলের সাথের দেয়ালে থাকা ছোট ঘড়িটার দিকে তাকালাম।
সেটায় ৬ঃ০৭ বাজছে।
কি মনে করে রুটি বেলা বাদ দিয়ে দৌড় লাগালাম মেইন দরজার দিকে।
দরজা খুলে দেখলাম আজকেও চিঠি।
আশেপাশে ভালোভাবে তাকালাম, কিন্তু না চিঠি দেয়ার মতো কাউকেই দেখতে পেলাম না।
চিঠি কি হাওয়ায় ভেসে দরজার সামনে আসে নাকি?
অদ্ভুত!
কিছু না ভেবে চিঠিটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
দরজা লাগিয়ে আমার রুমে গিয়ে ব্যাগে চিঠিটা রাখলাম।
কারণ, মা কখনো আমার ব্যাগ চেক করে না তাই এটাই একটা সুরক্ষিত জায়গা চিঠি রাখার জন্য।
রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আবার কাজে লেগে পরলাম।
বাসায় ২টা ছোট আলু আছে আরেকটা ডিম আছে।
হঠাৎ হিদের ফোনে দেখা কয়েকটা রেসিপি মনে পরে গেলো।
বিদেশিরা একটা ডিমকেই কতো বড় করে ভাজে।
তার মাঝে আলু ছাড়াও কিছু সবজিও দেখা যায়।
আমি সেই নাম না জানা রেসিপিটা ট্রাই করলাম।
ডিম, আলু, পিয়াজসহ আরও কিছু সবজি দিলাম যা বাসায় ছিলো।
ব্যাস হয়ে গেলো! এখন খেতে কেমন হয়েছে কে জানে।
আমি কোনোকিছু না ভেবেই একটু ছিঁড়ে মুখে পুরলাম টেস্ট করার জন্য।
ওয়াক থু!
করে মুখ থেকে ফেলে দিলাম।
প্রচন্ড ঝাল আর লবণ কম হয়েছে।
এ তো পুরো অখাদ্য! ধুর কেন এমন পাকামো করতে গেলাম?
এখন তো আমার সবজিসহ ডিমটাও খোয়া গেলো।
এখন ভাজি-টাজি বানানোর মতোও যে কিছুই ঘরে নেই।
হতাশ হয়ে রুটিগুলো ভাজতে লাগলাম।
সেই অখাদ্য ফেলে দিয়েছি আমি।
রুটি ভাঁজা শেষে হঠাৎ মনে পরে গেলো আমি তো কাল রিক্সা ভাড়া দিয়ে বাসায় আসিনি।
নিহান ভাইয়া পৌঁছে দেয়ায় আমার রিক্সা ভাড়া বেঁচে গেছিলো ৫০ টাকার মতো।
আমি রুটিগুলো ঢেকে রুমের দিকে দৌড় লাগালাম।
রুমে গিয়ে ব্যাগ হাতিয়ে দেখি ৫০ টাকার একটা নোট আর সাথে ২টা ২পয়সা।
আমার মন আনন্দে নেচে উঠলো।
এই টাকাটা দিয়ে হোটেল থেকে ভাজি, ডিম আর চা আনতে পারবো।
ভেবেই বাসার কাপড় চেঞ্জ করে বাইরে যাওয়ার জন্য চটজলদি রেডি হয়ে গেলাম। এতক্ষণে ৭টার বেশি বেজে গেছে তাই আমি নিশ্চিত হোটেলগুলো খুলেছে।
গলায় ওড়না পেঁচিয়ে এই ৫৪টাকার হিসাব করতে করতে মেইন দরজা খুললাম।
খুলতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।
দরজার সামনে দেখি ইয়া বড় একটা বক্স।
আমি হাটু গেড়ে বসে বক্সটা পর্যবেক্ষণ করলাম।
হাত দিতেই কিছুটা গরম অনুভব হলো।
চটজলদি বক্সটি নিয়ে ভেতরে চলে আসলাম।
তখনই মা বড় হা দিতে দিতে লিভিংরুমে আসলো।
মা এই বড় বক্স দেখতে পেতেই তার চোখের ঘুম উড়ে গেলো।
ধপাধপ পা ফেলে আমার দিকে চলে আসলো।

—“নাফি এতো বড় বক্স আসলো কোথা থেকে?”

আমি বোকার মতো তাকালাম মায়ের দিকে যার উত্তর আমি জানিনা।
মা কথা না বাড়িয়ে বক্সটির টেপগুলো খুলতে শুরু করলো।
খুলে দেখলো অনেকগুলো আলাদা আলাদা রঙের প্লাস্টিকের বক্স।
আমি হা করে তাকালাম।
তবে বক্সগুলোর উপর একটা চিরকুট আছে।
মা সেটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো কিছুটা শব্দ করে।
চিরকুটে লেখা,
—“ভাবী আজ আপনারা নাকি বাসা চেঞ্জ করবেন তার জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে তো আর রান্নাই করতে পারবেন না। তাই আজ সারাদিনের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিলাম। সাবধানে যাবেন আপনারা।”

এগুলা হিদের মা মানে আন্টি পাঠিয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারলাম।
মা তো চরম খুশি হলো সেটা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
আমি অবাক হলাম একটা বিষয়ে আমরা বাসা পাল্টাবো? কিন্তু কেন?
মাকে অবাক হয়ে বললাম,

—“মা আমরা বাসা কেন বদলাবো?”

—“বাড়ির দেয়ালগুলো লক্ষ্য করেছিস? আমরা ফার্নিচার বদলিয়ে পুরো বাড়িও রঙ করাবো। এসবের মাঝে কি করে আমরা এখানে থাকতে পারবো? তাই আমরা আজই বাসা চেঞ্জ করবো। যেদিন এই বাড়ি পুরো নতুনে চকচক করবে সেদিনই আমরা আবার ফিরবো।”

মায়ের মুখে বিজয়ের হাসি।
সে আমাকে এসব বলতে বলতে খাবারের বক্সগুলো নামাচ্ছে।

—“তাহলে আমরা থাকবো কোথায়? বাড়ির কাজ করার পরে কি করে আমরা ভাড়া বাসাতে থাকবো?”

—“তোর বাবার ধানমন্ডিতে একটা ফ্ল্যাট ছিলো মনে আছে?”

—“আরে হ্যাঁ ভুলেই তো গেছিলাম। যখন বাবা ছিলো তখন তো আমরা সেখানেই থাকতাম। পরে এই বাড়িতে এসেছি।”

—“হ্যাঁ। এটা তোর দাদাদাদুর বাড়ি ছিলো। তোর বাবা এই বাড়ির কাজ ধরতে চেয়েও ধরার সময় পায়নি। এখন আমরা নাহয় তার অপূর্ণ কাজটা করি।”

বলেই মা চুপ করে গেলেন।
মায়ের আচরণে ভালোই বোঝা যায় যে মা এখনো ভালোবাসেন বাবাকে।
ভালোবাসারই কথা, তাদের তো লাভ ম্যারেজ ছিলো।
কিন্তু বাবা যে কেন মাকে একা ফেলে চলে গেলো এটাই বুঝতে পারছি না।

—“কিন্তু আন্টি জানলো কি করে বাসা চেঞ্জ করার কথা।”

—“ঘুমানোর আগে কথা বলেছিলাম সেই সুবাধে উনি জেনেছেন।”

আমি কিছু বলতে যাবো এমন সময় কলিংবেল বাজলো।
আমি উঠে দরজা খুলে দেখলাম নিবিড় ভাইয়া।

—“আরে নিবিড় ভাইয়া যে।”

—“মা বললো আজ নাকি তোরা বাসা চেঞ্জ করবি তাই আমাকে পাঠিয়ে দিলো তোদের হেল্প করতে।”

—“বাহ বেশ করেছো বাবা। আসো আসো ভেতরে আসো। নাফি যা চা করে আন।”

চায়ের কথা বলতেই আমার মনে পরলো আমি চা কিনতেই বের হচ্ছিলাম।
নিবিড় ভাইয়া ভেতরে এসে বসলো।
আমি মাকে চা আনার ব্যাপারটা বলে রান্নাঘরে আসলাম ফ্লাক্স নিতে।
ফ্লাক্স নিয়ে এলাকার একটা টঙএ আসলাম।
রাস্তাতেই টিউশনির বাচ্চার মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম পড়াতে যেতে পারবো না।
আর ভার্সিটিও যাওয়া হবে না এই বাসা বদলানোর চক্করে।
টঙ থেকে চা নিয়ে বাসার ফিরে আসলাম।
বেশি সকাল হবার ফলে তেমন মানুষজন এখনো আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না।
বাসায় এসে নিবিড় ভাইয়াকে চা দিয়ে মাকে বললাম,

—“আমরা কি ফার্নিচারও নিয়ে যাবো?”

—“না। সেই ফ্লাটে আগে থেকেই ফার্নিচার আছে। তুই গিয়ে জিনিয়াকে ডাক আর জলদি জলদি জরুরি জিনিসপত্র গুছানো শুরু কর।”

আমি মাথা নাড়িয়ে জিনিয়ার রুমে চলে আসলাম।
ম্যাডামজি কি সুখের ঘুম ঘুমাচ্ছে।
জিনিয়াকে টেনেটুনে ঘুম থেকে উঠালাম।
হুট করে গতরাতে ওই হিটলারের টানাটানি মাথায় এলো।
সাথে সাথেই মেজাজ গরম হয়ে গেলো।
বুঝি না কাজের সময় এই হিটলার মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করে কেন? আজিব!

নিহান চোখ ডলতে ডলতে নিচে নামলো।
খাবার টেবিলে সবাইকে দেখলেও নিবিড়কে দেখলো না।
এতে নিহানের ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে গেলো।

—“মা নিবিড় কই?”

—“নাফিহাদের আজ বাসা চেঞ্জ করবে তাই নিবিড়কে পাঠিয়ে দিয়েছি সাহায্য করতে। তিনজন মেয়ে কতোই বা সব সামলাতে পারবে।”

নিহানের চোখমুখ কেমন করে উঠলো।
তারপর ঝটপট খেয়ে নিহান উপরে চলে গেলো।
নিহানের এহেম কান্ডে সবাই হা করে তাকিয়ে রয়।
নিহানের বাবা চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলে,
—“কি হলো ছেলেটার?”

—“তোমার ছেলের কখন কি হয় তা বোঝা দায়!”

—“আম্মু আমিও যাই নাফুর কাছে?”

—“না। তুই কাল ভার্সিটি যাসনি আজ কোনোরকম মিস দিতে পারবি না।” চোখ গরম করে বললো নিহানের মা।

—“তাহলে নিবিড় ভাইয়াকে পাঠালে কেন ভাইয়ার তো পরীক্ষা চলছে।” মুখ গোমড়া করে বললো নাহিদা।

—“কারণ, নিবিড়ের পরের পরীক্ষা আসতে আরও ৫ দিন বাকি। এতো কথা না বলে চুপচাপ খা।”

নিহান সবুজ টিশার্টের উপর কালো জ্যাকেট পরলো।
চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বেরিয়ে গেলো।
কেউ আর সেদিকে নজর না দিয়ে নিজেদের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।

নিজের বাড়িকে বিদায় দিয়ে মেইন দরজায় বড় একটা তালা ঝুলালাম।
কেন জানিনা খুব বেশি কষ্ট লাগছে এই প্রিয় বাসা থেকে অন্যকোথাও গিয়ে থাকতে।
তালা ঝুলিয়ে পিছে ফিরতে ধ্রুম করে কারো সাথে ধাক্কা খেলাম।
তার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে উপরে তাকালাম।
নিহান ভাই!
ওনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি।
আজ কি সুন্দর লাগছে তাকে।
সবুজ টিশার্ট, একহাতে কালো জ্যাকেটটা ঝুলিয়ে রেখেছে।
কয়েকটা চুল তার কপালে লেপ্টে আছে।
সূর্যের আলো তার মুখে এসে পরছে যার কারণে তার ফর্সা মুখটা কেমন লাল হয়ে চিকচিক করছে।
বিন্দু বিন্দু ঘাম তার কপালের কোণা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।
কেন জানিনা তার সেই খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ঢেকে রাখা গালটা স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছা অনুভব হলো।
নিহান ভাইয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকায় নিহান ভাইয়া হাতে তুড়ি বাজিয়ে আমার ধ্যান ভাঙ্গালো।
আমি চোখ নামিয়ে বলি,

—“আপনি এখানে কেন?”

—“নিবিড় কল করেছে। বলেছে নিবিড় তোমার মা আর বোনকে সহ বাকি জিনিসপত্র নিয়ে ফ্লাটের দিকে চলে গেছে তাই যেন আমি তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসি।”

আমি হা হয়ে নিহাম ভাইয়ার দিকে তাকালাম।
যেই নিহান ভাই সারাক্ষণ মিটিং, প্রেস, রাজনীতি নিয়ে বিজি থাকে সে কিনা আসছে আমাকে সামান্য ড্রপ করার জন্য এসেছে?
সত্যিই অবাক করার বিষয়।
আর সবচেয়ে বড় কথা, এতোদিন আমাকে “তুই” করে বলতো আর আজ!
আজ সে আমাকে “তুমি” করে বলছে।
আর কতো ঝটকা খাবো খোদা?
হে আল্লাহ দঁড়ি ফেলো আমি উঠে যাই, এতো ঝটকা হজম হচ্ছে না।

—“আবার কোথায় হারিয়ে গেলি?”

—“আপনি আমাকে তুমি করে বললেন যে?”

—“কেন বললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?” নিহান ভাইয়ার স্বাভাবিক ভঙ্গি।
আমি ভেঙচি কাটলাম।
এই হিটলার কোনোকালে সোজা ভাবে কথা বলবে না, সারাজীবন কথাকে জিলাপির মতো পেঁচাবে অসহ্য!

—“কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি যাবি? তোর মতো ফালতু টাইম নাই আমার দাঁড়িয়ে থাকার। তাড়াতাড়ি চল নয়তো কান ধরে টেনে নিয়ে যাবো।”

—“আরে যাচ্ছি যাচ্ছি।”

বলেই হাঁটা শুরু করলাম।
নিহান ভাইয়া আমার পিছন পিছন আসছে।
এহ ভাব দেখলে বাঁচি না।
আমি বুঝি তাকে বলেছি আমাকে নিয়ে যেতে?
নিজে এসে আবার আমাকেই ব্যস্ততা দেখায় ঢং!

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।