বিষাদময় প্রহর পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0
1339

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| শেষাংশ ০১ ||

—“নির্ঝর তোর চাচ্চুকে নিয়ে ইমিডিয়েটলি জামিন আঙ্কেলের বাড়িতে নিয়ে আয় আমিও সেখানেই যাচ্ছি। যে করেই হোক আজই এই ইমরান আর আমিরের ব্যবস্থা নিতে হবে।”

—“ওকে বস! তুই যা আমিও আসছি।”

—“ওকে।” বলেই নিহান ফোন কেটে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।
নিহানের পাশেই বসে আছে নাফিহা।
নাফিহা সব জেনেছে, কী করে তার বাবাকে অপহরণ করে এতদিন বন্দি করে রেখেছিলো।
সাথে এও জেনেছে ইমরানের ছেলে আমিরের তার উপর কুনজর ছিলো।
জামিন রহমান এখন মোটামুটি সুস্থ, তাই নিহান আর দেরী করতে চাইছে না।
ইনু আর মিনু পেছন সিটে দৌড়াদৌড়ি আর ধস্তাধস্তির উপরে আছে।
নাফিহা ধমক দিলেই দুটো একদম চুপ মেরে বসে থাকবে।
তার কিছু সময় পর আবার খামচাখামচি শুরু।
পুরো রাস্তায় দুটোকে ধমকাতে ধমকাতে নাফিহা ক্লান্ত।
কে বলবে এরা জামাই-বউ!
অবশেষে দুজনেই নাফিহার বাড়িতে এসে গাড়ি থামালো।
নাফিহা গাড়ি থেকে নেমে ইনু, মিনুকে একটা ঝুঁড়িতে নিয়ে ভেতরে চলে আসলো।
জিনিয়া তো ইনু আর মিনুকে দেখে বেশ খুশি হলো।
নাফিহার হাত থেকে ঝুঁড়িটা নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেলো।
নাফিহা আর নিহান চলে গেলো জামিন রহমানের রুমে।
ঘরে রনিয়া রহমান এবং জামিন রহমান গল্প করছে।
নিহান আর নাফিহাকে দেখে দুজনেই চমকে উঠলো।

—“আরে আরে হঠাৎ জামাইবাবা, নাফি তোরা! কোনো সমস্যা হয়নি তো?” চিন্তিত সুরে বললো রনিয়া রহমান।

—“না মা তেমন কিছু না। আমরা এসেছি বাবার অপহরণের পিছে কে আছে সেই বিষয়ে প্রশ্ন করতে।”

নিহানের কথায় রনিয়া রহমান, জামিন রহমান উভয়েরই মুখ কালো হয়ে গেলো।
রনিয়া রহমান এতদিন পর স্বামীকে পেয়ে সেসব বিষয় একদম ভুলে বসেছিলো।
ভাগ্যিস মনে করালো ওরা।
রনিয়া রহমান এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জামিন রহমানের দিকে তাকালেন।
জামিন রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

—“হ্যাঁ বলবো। আজ সব বলবো! অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা আর সম্ভব না।”

বলেই জামিন রহমান থামলেন।
জামিন রহমান থামতেই নির্ঝর তার চাচ্চুকে নিয়ে হাজির।
উনি লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে মাথা থেকে পুলিশের ক্যাপটি খুলতে খুলতে বলে,

—“আমি কী বেশি দেরী করে ফেললাম?”

জামিন রহমান নির্বাক হয়ে অফিসারের দিকে তাকালো।
পুলিশ কেন তার বাসায় আসলো তা-ই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
নিহান জামিন রহমানের বিস্ময় বুঝতে পেরে হেসে বলে,

—“চিন্তিত হবেন না বাবা আমি-ই ওনাকে এনেছি। উনি আপনার সকল ঘটনা শুনবে এবং রেকর্ড করবে। তারপরের কাজ আমি সারছি। আর চাচ্চু, আপনি সোফায় গিয়ে বসেন!”

অফিসার সম্মতি জানিয়ে সোফায় বললো আর তার পাশে নিহান।
নাফিহা একটা চেয়ার এনে দিতে নির্ঝর সেটায় বসলো।
নাফিহা চেয়ার দিয়ে মায়ের পাশে বিছানার কোণে বসলো।
অফিসার রেকর্ডার চালু করে বললো শুরু করতে।
জামিন রহমান কিছুটা সময় নিয়ে বলা শুরু করলেন,

—“আমি একজন সরকারি সিক্রেট এজেন্সি ছিলাম। তার মাঝে রেলমন্ত্রীর সাথে আমার বেশ ভাব হয়। উনি আমাকে কোনো কাজ দিলেই আমি তা করতাম। একসময় খুবই গোপনে জানতে পারলাম ইমরান একজন নারী পাঁচারকারি। অনেক সহজ-সরল গ্রামের মেয়েকে চাকরি দিবে বলে শহরে নিয়ে আসতো, তারপর সেই মেয়েদের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে ভারতে পাঁচার করতো। বিষয়টা আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। তাই এক সহকারীর সাহায্য নিয়ে ইমরানের নেক্সট টার্গেট মানে সেই গ্রামে গিয়ে ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। সে ঠিকই আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে গ্রামে চলে আসলো। তখন আমি নিজে প্লান করি এই ইমরানের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ জোগার করার জন্য। সেই ছদ্মবেশ নিয়েই ইমরানের সাথে বিভিন্ন অযুহাতে ওর এই বিজনেস পার্টনার হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে সে তার সকল কুকর্ম ফাঁস করতে থাকে আর আমিও সেগুলো প্রমাণ হিসেবে নিখুঁতভাবে এক গোপন জায়গায় রেখে দেই। একসময় সহ্য করতে না পেরে নিজের আসল পরিচয়ে ইমরানের কাছে গিয়ে হুমকি দেই, যদি সে এসব আবারও করে তাহলে তার ব্যবস্থা আমি নিজে করবো কারণ আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ ছিলো। ”

বলেই জামিন রহমান থামলো।
সকলে উৎসুক হয়েই ওনার দিকে তাকিয়ে আছে।
জামিন সাহেব লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করে,

—“আমার হুমকিতে তার এই পাঁচার কারবার কয়েকমাস বন্ধ রেখেছিলো। সরকারের নানান কাজে আমাকে সবসময়ই এদিক সেদিক ছুটতে হতো তা ইমরান বেশ ভালো করেই জানে। তো তিনি একদিন বললো যে অন্য দেশে কয়েক বছরের একটা মিশন আছে আমাকে সেখানে যেতে হবে। আমার মনে প্রথমে প্রশ্ন উঠেছিলো, সরকার ছেড়ে ইমরান কেন তাকে এই কথা বলবে? পরে সরকারের আদেশ ভেবে আমিও ছুটে গেলাম সেই ভিন্ন দেশে। হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সেদিনই করেছিলাম। সেখানে গিয়ে বুঝলাম ইমরানের এটা একটা ফন্দি ছিলো, আমাকে তার রাস্তা থেকে সরানোর। সেখান থেকে এও জানলাম ইমরান শুধু নারী পাঁচারকারী নয়, একজন মাদক ব্যবসায়ীও! সেদিন আমি আর বসে থাকতে না পেরে ছয় বছরের জায়গায় ৪ বছরের মাথায়ই আমি দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু দেশে ফিরলেও পরিবারের মুখ দেখতে পারলাম না। ইমরান প্লান করে আমাকে কিডন্যাপ করে। প্রতিদিন নানানভাবে অত্যাচার করতো। ১ মাসে এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারতাম বিশ দিন। কারণ সে চেয়েছিলো যেন আমি বেঁচে থাকি। আমি যদি মরে যাই তাহলে তার সব প্রুভগুলো খুইয়ে ফেলবে। অত্যাচার করতে করতে আমার এমন অবস্থা করেছে তবুও আমি মুখ খুলিনি, কোথায় রেখেছি তার প্রমাণগুলো। এগুলোর জন্য ইমরান যেমন আমার চিকিৎসা দিতো তেমনই অত্যাচার করতো। এমনও দিন গেছে ৩-৪দিন না খেয়ে অজ্ঞান অবস্থায় পরে ছিলাম!”

বলেই জামিন রহমান দুই আঙ্গুল দিয়ে নিজের চোখের কোনা মুছলো।
রনিয়া রহমান আঁচলে মুখ বুজে নিশব্দে কাঁদছে আর নাফিহার চোখ দিয়ে আঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পরছে।
কতো কষ্ট দিয়েছে মানুষটাকে এতগুলো বছর।

—“যখন কোনোকিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না তখন আমাকে সিরিঞ্জের মাধ্যমে জোর করে ড্রাগস দেয়া হতো। এইযে আমার হাতের এই দাগগুলোই তার প্রমাণ!”

বলেই জামিন রহমান নিজের হাতগুলো সামনে এগিয়ে দেখালো।
উজ্জ্বল শ্যাম হাতদুটোতে সুঁইয়ের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
নির্ঝর তৎক্ষনাৎ তার কাঁধে থাকা ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে হাতের দাগগুলোর ছবি তুলে নিলো।

—“এতো এতো অত্যাচারের পরেও আজ আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি। কারণ, এই ইমরান যতো অত্যাচার করেছে ততোই আমাকে চিকিৎসা দিয়েছে। নয়তো এই এতোদিনের ড্রাগস নেয়া নিয়ে আমার উপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলতো। যাহোক আসল কথায় আসি, এভাবে এতোগুলো বছর অত্যাচার করে এসেছে কিন্তু ২ বছর আগে ইমরানের সাথে আরও একজন যোগ হলো ইমরানের ছেলে “আমির”! এই আমির বাবার চেয়েও বড় ধূর্তিবাজ। কতো মেয়েকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাব নেই। আমার কাছে প্রমাণ ছিলো না কিন্তু এই আমির আমারকাছে এসে তাদের অন্তরঙ্গের মুহূর্তগুলোর ছবি দেখাতো। রাগে, কষ্টে, ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে রাখলেও আমির জোর করে চোখ খুলিয়ে সেসব দেখাতো। বিশ্বাস করেন অফিসার সাহেব এইসব দৃশ্য দেখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিলো। যখন দেখলো কোনো কিছুতেই আমি দুর্বল হচ্ছি না তখন আমিরের নজর গেলো আমার বড় মেয়ের দিকে। সে আমাকে প্রতিজ্ঞা করেছে আমার সামনেই আমার মেয়েকে সে….”

বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো জামিন রহমান।
কোন মেয়ের বাবা এসব কথা সহ্য করতে পারবে!
এদিকে এসব শুনে নিহানের পুরো মুখমন্ডল লাল হয়ে গিয়েছে। হাত দু’টো মুঠিবদ্ধ করে নিজের দমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই সে সফল হচ্ছে না।
নাফিহার কাঁদতে কাঁদতে নিহানের দিকে চোখ যেতেই দেখলো নিহান ভয়ংকর রেগে আছে।
নিহানের এমন রূপ দেখে অজানা ভয়ে নাফিহার গা শিউরে উঠলো!
জামিন সাহেব নিজেকে সামলে আবার বলা শুরু করে,

—“সেদিন আল্লাহ্’র দরবারে বারংবার মিনতি করেছি যাতে আল্লাহ্ আমার মেয়েটাকে এই অমানুষটার হাত থেকে বাঁচায়। আল্লাহ হয়তো আমার কথা শুনেছিলেন, তাই হয়তো আমার নাফিহা মা বেঁচে যায় ওই শয়তান অমানুষটার হাত থেকে!”

নাফিহা আবার নিহানের দিকে তাকালো।
সেদিন যদি নিহান এসে তাকে না বাঁচাতো কতো ভয়ংকর ঘটনা যে ঘটে যেত তা নাফিহা কল্পনা করতে পারছে না।

—“বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে শুনে আমির ভয়ংকর রেগে আমার উপর অত্যাচার চালায়। আমার সামনেই সে অন্য মেয়ের সাথে….। তখন ড্রাগসের ডোজ ছিলো বিধায় আমি অজ্ঞান অবস্থায় পরে ছিলাম তাই ওই নির্মম ঘটনা দেখার হাত থেকে বেঁচে গেছিলাম। এরকম নিয়মিত ড্রাগস দিতে দিতে অবস্থা খারাপের দিকে পৌঁছে যায়। ইমরান তার ছেলেকে শান্ত করে আবারও আমার চিকিৎসা করান। চিকিৎসা করিয়ে একটু ভালো হতেই একদিনে দুই সিরিঞ্জ ড্রাগস দিয়ে আমাকে রাস্তায় ছেড়ে দেয়। যার ফলে আমি পাগলের মতো এদিক সেদিন ঢলে ষলে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। এতো যুদ্ধের পরে আমি আজ এখানে আমার পরিবারের মাঝে উপস্থিত আছি। আল্লাহর দরবারে লাখো শুকুরিয়া জ্ঞাপন করছি উনি আমাকে সেই অন্ধকার থেকে বের করেছে।

অফিসার সাহেব, আমার কাছে এইটুকু ঘটনাই আছে। আর বাদবাকি প্রুভ সুরক্ষিত স্থানে আছে আমি আপনাকে দিবো। তবে আমিরের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই।”

বলেই মাথা নিচু করে ফেললো জামিন রহমান।
সবাই নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে জামিন রহমানের দিকে।
একটা মানুষ কতোটা ধৈর্যশীল হতে পারে, সেটা জামিন রহমানকে না দেখলে বোঝা যাবে না।
অফিসার রেকর্ডার অফ করতেই নিহান নির্ঝরকে নিয়ে বাহিরে এসে বললো,

—” যেগুলো ইমপর্টেন্ট কথা সেগুলো রেকর্ডারে রাখবি আর যেগুলো অপ্রয়োজনীয় সেসব লাইন বা কথা ডিলিট দিবি। আমি আসছি তুই বাদবাকি ক্যা করার কর!”

বলেই নিহান চলে যেতে নিচ্ছিলো নির্ঝর পিছু ডেকে তাকে থামালো!

—“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

—“আমিরের ব্যবস্থা করতে। ভেবেছিলাম দু-একদিন বন্দি রেখে পুলিশের হাতে ধরায় দিবো। কিন্তু এই জানোয়ারের কাজে-কর্মে এর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”

বলেই নিহান হনহন করে বেরিয়ে গেলো।
পরেরদিন প্রতিটি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ,
“মিনিস্টার ইমরান সাহেবের একমাত্র ছেলে আমিরকে কেউ টুকরো টুকরো করে পুরো বডির পার্ট বাই পার্ট বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়েছে।
পুলিশ এখনো আমিরের শরীরের বিভিন্ন পার্ট খুঁজে পায়নি।
তদন্ত চলছে ব্যাপকভাবে। ”
এই একটা নিউজই পুরো দেশবাসীকে ভয়ংকরভাবে কাঁপিয়ে তুললো।

চলবে!!!

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| শেষাংশ ০২ ||

আজ ৩ দিন হলো আমার পরীক্ষা শেষ হলো।
এই পরীক্ষার মধ্যেই আমার অনার্স জীবনের সমাপ্তি ঘটলো।
কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে আমার বড্ড মন খারাপ।
বিয়ের আজ প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলো অথচ আমার হানিমুন যাওয়া হলো না।
ওদিকে নিবিড় ভাইয়া আর অর্ণা আপুর বিয়ে হওয়ার পরপরই কি সুন্দর হানিমুন করতে রাঙামাটি গেলো আবার হাসি খুশিভাবে ফিরেও আসলো।
এদিকে আমার নেতাসাহেবকে দেখো!
সারাজীবন এই কাজ সেই কাজ করতে করতে আমাদের হানিমুনে যাওয়াই হলো না।
এইজন্য আমার এই রাজনীতি পছন্দ না।
সারাদিন আমার জামাইটা রাজনীতির পিছে দৌড়ায় আর আমি বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনি!
কবে যাবো আমি ঘুরতে ধুর! ভালো লাগে না।
সেদিন সব প্রুভ’স নেয়ার পর নির্ঝর ভাইয়ার চাচ্চু ইমিডিয়েটলি ইমরানকে এরেস্ট করে বাট আমির নিখোঁজ ছিলো।
পরেরদিন আমিরের এমন নির্মম মৃত্যু দেখে আমার শরীর কেঁপে উঠেছিলো।
আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম যে এটা নেতাসাহেবের কাজ।
কিন্তু না, যখন টিভিতে এসব দেখে ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিলাম তখনই নেতাসাহেব চেঁচাতে চেঁচাতে রুমে ঢুকে বললো,

—“একটা কাজও যদি ঠিকমতো হয়! যখনই পুলিশ আমিরকে এরেস্ট করতে গেলো তখনই হতচ্ছাড়া পালিয়ে গেলো! এরে একবার হাতের মুঠোয় পাই…”

—“আপনার আর পেতে হবে না আমিরকে কেউ খুন করে দিয়েছে।”

সেদিন নিহানের বিস্ময়কর চেহারা দেখে নাফিহা বেশ অবাক হয়েছিলো আর নিজের অযৌক্তিক চিন্তা-ভাবনায় নিজেকে বেশ কটা গালিও দিয়েছিলো।
কিন্তু নিহানের তৃপ্তিময় হাসিটা খেয়াল করেনি নাফিহা।

—“জানপাখি তোমার এই বিষাদময় প্রহরটা মরেনি গো। তোমারই আড়ালে-আবডালে বিষাদের আগুন আজীবন জ্বলবে অথচ তুমি টেরই পাবা না।”
ভেবেই নিহান একটা৷ শয়তানি হাসি দিয়েছিলো।

এরপর ইমরানকে কোর্টে নেয়া হলো, ছেলের শোকে সে সব অপরাধ স্বীকার করলো।
জাজ তাকে প্রশ্ন করেছিলো কেন সে তাকে এভাবে দিনের পর দিন বাঁচিয়ে রেখেছিলো?
সেদিন ইমরান মাথা নিচু করে বলেছিলো,

—“আমি ওকে ভেবেছিলাম ১সপ্তাহর মতো টর্চার করে মেরে ফেলবো কিন্তু আমার ছেলে আমিরের হঠাৎ রক্তশূণ্যতা দেখা দিয়েছিলো। জামিনের সাথে ব্লাডগ্রুপ ম্যাচ করায় প্রতি মাসে ওর থেকে ১ব্যাগ করে রক্ত নিয়েছিলাম। এভাবে তিন মাস রক্ত নিলাম। রক্ত নেয়া শেষে আবারও ওকে পরিপূর্ণ করেছি কারণ ওর কাছে অতি মূল্যবান একটা ওষুধ ছিলো যেটা আমি বেশ কড়া দামে অন্য দেশে রপ্তানি করতে পারতাম! তাও হলো না যখন তখন আমার সব প্রুভ ওর কাছে আছে বিধায় বাঁচিয়ে রাখলাম। পরে ভাবলাম মেরেই ফেলি কিন্তু পরে ভাবলাম জামিন মারা গেলে যদি তার পরিবারের কেউ এই প্রুভসগুলো পেয়ে যায় তখন তো আরেক বিপত্তি। তাই ওকে টর্চার করতাম অতিমাত্রায়, একসময় এই টর্চার করাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়, তাই জামিনকে সুস্থ করে তুলতাম তো আবার টর্চার। এভাবে যেতে যেতে আমি আবার ড্রাগসের বিষয় নিয়ে চিন্তা করলাম। যেগুলো বিক্রি করতাম সেগুলা বিক্রির আগে এই জামিনের শরীরে টেস করতাম। ওর মাধ্যমেই আমি ড্রাগসের দাম নির্ধারণ করতাম মানে ওর উপর ট্রাই করে করে। এভাবেই আমার কার্যকলাপ চলতো। আমার ছেলে ওর সাথে কী করতো আমি জানতাম না। একদিন জানতে পারি জামিনকে পুলিশরা হন্য হয়ে খুঁজছে তাই সেদিন আমার লাস্ট বড় ১টা ডিলের তিনটা আলাদা আলাদা ড্রাগস ট্রাই করে ওকে রাস্তায় ফেলে আসি। আমার চিন্তা ছিলো কোনো না কোনোভাবে ওর রোড এক্সিডেন্ট হবেই কিন্তু ওর ভাগ্য সহায় ছিলো।”

ইমরানের এসব কথায় তাকে উপস্থিত সকলের ঘৃণায় থু থু দিতে ইচ্ছা করছিলো।
অবশেষে বড়রকম সাজাই আদালত তাকে দিয়েছিলো।

—“এই বউ!!”

—“একদম বউ বউ বলে ঢং মারাবেন না। সারাদিন পরে এসে নাটক করতে আসছে এহ!”

—“যদি নাটক পারতাম তাহলে রাজনীতিতে না স্টুডিওতে থাকতাম বউউউউ!!”

—“সরেন তো আপনার এইসব ন্যাকামি একদম সহ্য হচ্ছে না।”

বলেই সরে যেতে চাইলো নিহান হাত ধরে আটকিয়ে ফেললো।

—“কি হলো কী আমার প্রতি এমন বিরক্তি দেখাচ্ছো কেন?”

—“বুঝেন না কেন এমন করছি?”

—“এতো বুঝার টাইম নাই তুমি বলো।”

—“কিছু না হাত ছাড়ুন।”

এমন সময়ই অর্ণা রুমে প্রবেশ করলো।
নাফিহা হাত ছাড়িয়ে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে,

—“আরে অর্ণা আপু, কিছু বলবে?”

—“আসলে হ্যাঁ তবে মনে হচ্ছে বেটাইমে চলে এসেছি। আচ্ছা তাহলে আমি আসছি কেমন?”

বলেই চলে যেতে নিলো তার আগেই নাফিহা বলে উঠে,

—“আরে আপু তুমি আসো কিছু হবে না।”

অর্ণা দাঁড়িয়ে গেলো।
নাফিহা আর অর্ণা কিছুক্ষণ কথা বললো।
অর্ণার কথা শেষ হতেই অর্ণা বেরিয়ে গেলো আর নাফিহা গেলো তার ইনু, মিনু, রিনুকে দেখতে।
রিনু আরেকটা পুঁচকে বিড়াল, বলা যায় ইনু মিনুর মেয়ে।
এই পুঁচকে বিড়াল আবার নাফিহার ভক্ত।
অর্ণা বেরিয়ে দেখলো নিহান রুমের বাইরেই ঘুরঘুর করছে।
অর্ণা আর নাফিহার কথা বলার সময়ই নিহান বেরিয়ে এসেছিলো।
নিহানকে চিন্তিত দেখে অর্ণা গলা পরিষ্কার করে বললো,

—“আপনি কী কোনো কারণে চিন্তিত?”

—“আর বলিও না, নাফি হুট করে কেমন বিহেভ করছে, কি হলো তাও বলছে না।”

—“আই থিংক আমি বুঝতে পেরেছি কারণটা!”

—“কী?”

—“হু। আসলে ভাইয়া আপনাদের বিয়ের তো দীর্ঘদিন হয়ে গেছে কিন্তু আপনি ওকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাননি তাই নাফি একটু নারাজ।”

—“ওও তাহলে এই ব্যাপার! ধন্যবাদ ভাবী এই ইনফরমেশনটি দেয়ার জন্য।”

অর্ণা হেসে ফেললো।
নিহান তার অনেক বড় তার উপর নিবিড় নিহানের ছোট ভাই, সেখানে নিহান তাকে অলয়েজ ভাবী ডাকে যা অর্ণার কাছে হাস্যকর।

নিহান ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল করে সব ব্যবস্থা করে ফেললো।
রাতে রিনুকে নিয়ে নাফিহা বসেছিলো তখনই তার কল আসে।
ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
বেশ আনন্দের সাথে ফোন রিসিভ করে প্রথমে সালাম দেয়।
জামিন রহমান সালামের উত্তর নিয়ে বলে,

—“কেমন আছিস মা?”

—“আলহামদুলিল্লাহ বাবা তুমি কেমন আছো?”

—“আলহামদুলিল্লাহ। যে কথা বলতে ফোন দিলাম, জলদি ব্যাগ গুছিয়ে নে।”

—“কেন বাবা?”

—“ফজরের নামাজের পর আমরা দুই ফ্যামিলি পিকনিকে সেন্টমার্টিন যাচ্ছি।”

বাবায় কথায় খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
কেউ যেন বুকের ভেতরটায় ঢাক-ঢোল বাজাচ্ছে।
অত্যন্ত খুশি হয়ে বললাম,

—“সত্যি বাবা!”

—“হ্যাঁ রে পাগলি মেয়ে। জলদি কর আমি রাখছি।”

—“আচ্ছা বাবা, সাবধানে থেকো।”

বলেই মুচকি হেসে কল কেটে দিলাম।
তারপর রিনুকে বিছানায় বসিয়ে আমি ব্যাগ গুছানো শুরু করে দিলাম।
এর মাঝে নেতাসাহেব এসে বলে,

—“বউ! আমার ব্যাগটাও গুছিয়ে দিও কেমন?”

—“আচ্ছা।”

বলেই খুশিমনে নিহানের ব্যাগও গুছাতে শুরু করলো।
নাফিহা আনন্দের ঠ্যালায় ভুলেই গেছে সে নিহানের উপর রেগে ছিলো।
নিহানের প্রতিটা শার্ট, টিশার্ট সব নিজে পছন্দ করে ভরছে আর নিহান তার বউকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে।
নাফিহা দিন দিন আরও সুন্দর হচ্ছে বলে তার ধারণা।
ব্যাগ গুছিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে সকলে ঘুমাতে চলে গেলো।
নাহিদা আর আদ্রানও তাদের সাথে পিকনিকে জয়েন করবে।

ফজরের আযানে নিহানের ঘুম ভাঙ্গলেও নাফিহার ভাঙলো না।
তাই নাফিহার মুখে পানি দিয়ে ঘুম থেকে উঠালো নিহান।

—“পানির ছিটা দিয়ে একদম ঠিক করেননি আপনি!”

—“আচ্ছা বুঝলাম। এখন জলদি করো, নামাজ পড়েই বের হবো।”

নাফিহা আড়মোড়া ভেঙ্গে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
এদিকে নিহান মাথায় টুপি দিয়ে জায়নামাজ হাতে নিয়ে নাফিহার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
নাফিহা আসতেই দুজন একসাথে নামাজ আদায় করলো।
তারপর রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো।
সার্ভেন্ট আগেই লাগেজগুলো নিয়ে গেছে।
নাফিহা শুধু ঝুঁড়িতে ইনু, মিনু আর রিনুকে নিলো।
ওরা তিনজনও বেশ এক্সাইটেড বাইরে বের হবে বলে।
গাড়িতে উঠে সবাই রওনা হলো।
নাফিহার বাবা-মা এবং জিনিয়াকে পিক করার জন্য নিহান গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
আর ওদিক দিয়ে সাজিদও চলে আসবে।
সাজিদ মাসখানেক আগে জিনিয়ার বাসায় তার বাবা-মাকে নিয়ে গেছিলো।
সেই থেকে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যায় জিনিয়া এবং সাজিদের।
গুরুজনদের সিদ্ধান্তে জিনিয়ার পড়াশোনা শেষ হলেই বিয়ে হবে।
জিনিয়া এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।
আদ্রান আর নাহিদাও তাদের গাড়ি করে ডাইরেক্ট কক্সবাজার চলে যাবে।
প্লানমাফিক, কক্সবাজারে গিয়ে সবাই একই লঞ্চে করে সেন্টমার্টিন যাবে।
সেখানে ৪ দিন ৩ রাত থাকবে।
সারাটাপথ নাফিহা নিহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
আর নিহান তার প্রিয়তমাকে দেখেই জার্নি শেষ করলো।

আজ বারবিকিউ করছে জামিন রহমান আর সিফাত চৌধুরী।
দুই বন্ধু মিলে ধুমসে বারবিকিউ করছে আর পুরানো গান গাইছে।
শাশুড়ী মা আর আমার মা মিলে তাদের টুকটাক হেল্প করছে।
আর আমরা ইয়াং জেনারেশন মানে আমি, নেতাসাহেব, আদ্রান ভাইয়া, হিদ, নিবিড় ভাইয়া, অর্ণা আপু, জিনিয়া, সাজিদ ভাইয়া, নির্ঝর ভাইয়া একসাথে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে গানের কলি খেলছি।
আমার ছোট সৈন্যদলকে রিসোর্টের কেয়ারটেকারের কাছে রেখে এসেছি।
রিসোর্টের বাগানেই আমরা বারবিকিউ করছি।
তবে কক্সবাজারের মতো বাগানের মাটিতে ঘাস নেই, শুধু বালি আর বালি।
তাই আমরা আগুন জ্বালাতে পেরেছি।
নির্ঝর ভাইয়ার সামনের মাসে বিয়ে তাই সে আমাদের হবু ভাবী সম্পর্কে টুকটাক কথা বললো তারপরই গানের কলি খেলা শুরু
আদ্রান ভাইয়ার গান শেষ হতেই বাবা আর শশুড়মশাই বড় বড় ডিশে বারবিকিউর চিকেনগুলো আনলো আর আমরা সবাই সেগুলো নিয়ে আবার নিজেদের জায়গায় বসলাম।
সবার হাতেই চিকেনের দুই-তিনটা কাঠি।
আমার দুইহাতে দুইটা।
আমি একটু একটু কামড় দিয়ে খাচ্ছি আর সবার হাসি – ঠাট্টায় হেসে চলেছি।
পাশে চোখ যেতেই দেখলাম নেতাসাহেব আমাকে দেখছে আর চিকেনটাকে একবার করে কামড় দিচ্ছে, খাচ্ছে।
ওনার এমন চাহনিতে আমি কেঁপে উঠলাম।
এমন চাহনি দিয়ে তাকানোর কি আছে?
উনি কি জানেন না ওনার এই চাহনিকে আমি ভয় পাই?
একটা শুকনো ঢোক গিলে সকলের আড্ডায় মনোযোগ দিলাম।
তখনই নির্ঝর ভাইয়া বলে উঠে,

—“ওই নিহান, এখন তুই গান ধর। সেই কলেজ লাইফে তোর গলায় গান শুনেছিলাম আর শুনতেই পারিনি। প্লিজ ভাই আমার একটা গান ধর!”

নির্ঝর ভাইয়ার সাথে বাকিরাও গলা মিলিয়ে বলে যেন উনি গান ধরে।
এদিকে আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, উনি গানও জানে।
নিহান আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে,

—“আচ্ছা গান গাইবো গিটারটা দে!”

নিহান ভাইয়া বলতেই নির্ঝর ভাইয়া আগুনের উপর দিয়ে গিটারটা ছুঁড়ে মারলো।
আর নেতাসাহেব খপ করে ধরে ফেললো গিটারটা।

“ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই-হারাই’ সদা হয় ভয়
‘হারাই-হারাই’ সদা হয় ভয়,
হারাইয়া ফেলি চকিতে
আশ না মিটিতে হারাইয়া
পলক না পড়িতে হারাইয়া-
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া
ফেলি চকিতে

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না…♪

♪ওহে কী করিলে বল পাইব তোমারে,
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে♪

ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ
এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ,
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কিবা তোমারে-
দয়া না করিলে কে পারে-
তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না…♪”

গান শেষ হতেই সকলে জোরে হাততালি দিলো।
আর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে নেতাসাহেবের দিকে তাকিয়ে আছি।
ওনার কন্ঠে গানটি এতো সুন্দর মানিয়েছে বলার বাহিরে,
গানটি আমার পছন্দের লিস্টের শীর্ষে আছে, সেখানে এই গানটি মনপুরুষের কন্ঠে কতোটা মধুময় লাগে তা না শুনলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না।

নিহানের দিকে নাফিহা তাকিয়ে আছে দেখে নিহান মুচকি হেসে নাফিহার কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

—“ওহে কি করিলে বলো, পাইবো তোমারে
রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে।”

নিহানের নেশাভরা কন্ঠে এই দুই লাইন শুনতে পেরে নাফিহার পুরো শরীরে অজানা শিহরণ বয়ে গেলো।
নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো নাফিহা।

সমাপ্ত।

বিঃদ্রঃ কেমন লেগেছে পুরো গল্পটা অবশ্যই অবশ্যই জানাবেন। যদি গল্পে কোনো ভুল করে থাকি তাহলে ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। নতুন গল্প নিয়ে ইন শা আল্লাহ খুব শীঘ্রই ফিরবো।