বিষ করেছি পান পর্ব-১+২

0
550

#বিষ_করেছি_পান
লাবিবা_তানহা_এলিজা
সূচনা পর্ব __________

(কপি করা নিষেধ)
রাত একটা বারো। আকাশে কালো মেঘ জমেছে। উত্তর থেকে বাতাস বইছে। ঝড়ের পূর্বাভাস। যেকোন মূহুর্তে বৃষ্টি শুরু হবে। সোফার পাশে ফকফকে সাদা টাইলসের উপর হাটু ভাঁজ করে বসে আছেন রুম্পা আহমেদ। তার চোখে মুখে অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। একবার জানালার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার সিঁড়ির দিকে। আরেকবার স্বামীর দিকে । এক মিনিট , পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট চলে গেলো আর নিশ্চুপ থাকা সম্ভব না। সোফার কোনা ধরে উঠে দাঁড়ায়।
— মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে । আকাশে ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেয়েটা যে ছাদে দরজা বন্ধ করে আছে তোমার দেখি কোন হেলদোল নাই।
ছানোয়ার আহমেদ রুম্পা আহমেদের দিক আড় চোখে তাকালো । পরক্ষনেই টেলিভিশনের দিকে চোখ ফেরিয়ে নিলো । স্কিনে ন্যাশনাল জিওগ্ৰাফি চ্যানেল চলছে। দুটো লায়নকে দেখানো হচ্ছে । একটা বাচ্চা লায়ন আরেকটা মা লায়ন । মা লায়নের উপরে উঠে বাচ্চা লায়ন ক্রমাগত লাফাচ্ছে। এতেই বোধ হয় সে মজা পাচ্ছে।
— কি বলি কানে যায়না?মেয়েটাকে নামতে বলবাতো? আমার ডাকে তো সাড়া দিচ্ছে না।’ আহত গলায় শুধায় রুম্পা আহমেদ। ছানোয়ার আহমেদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কর্কশ গলায় বলে,
— মারার সময় বুঝতে পারো নাই? এখন এতো দরদ কই থেকে আসছে?
— তো শাসন করবোনা?
— ঘ্যান ঘ্যান করবানা। যাও এখান থেকে। টিভি দেখতে দাও।
রুম্পা আহমেদ প্রত্যাখ্যান হয়ে ব্যস্ত পায়ে ছুটলো ছাদে। দরজা ধাক্কিয়ে কয়েকবার ডাকলো ছুটিকে।
— ও ছুটি!দরজা খুল মা। ঝড় আসতাছে। জিদ করিসনা আর। দরজা খুল। তোরে আর মারবোনা। হাজার বার ফেল করবি কিচ্ছু বলবোনা। দরজা খুল মা।
রুম্পা আহাজারি করতে লাগলো। যদিও তার প্রত্যেকটা কথাই মিথ্যা তিনি ভালো ভাবেই জানেন। এখন যতই মাথা নুয়াক সময়মতো সিংহী আচরন তিনি ঠিকই দেখাবেন।

সাড়া না পেয়ে ছুটলেন রিতীর ঘরে। অন্ধকারে হাতিয়ে লাইট জ্বালালেন। বিছানায় শুয়ে আছে রিতী। তার বুকেই আঁটোসাঁটো হয়ে শুয়ে তমাল। রাতের খাবারের পর যখন ছুটিকে স্কেল দিয়ে পেটাচ্ছিলেন তখন হাউমাউ করে কাঁদছিল তমাল। ভয়ে বাবার পেছনে লুকিয়েছিলো। কাঁদতে কাঁদতেই রিতীর রুমে এসে শুয়ে পরেছে। রুম্পার কাছে যাবেনা সে। ভীষণ ভয় পেয়েছে। ঘুমানোর সময় বার বার হিক তুলতে তুলতে রিতীকে বলছে,
— মা রাক্ষসী। মা মারে।
রুম্পা নিচু স্বরে রিতীকে ডাকে।
– এই রিতী উঠ। উঠনা।
– মা!কি হয়েছে?
– ছুটি নামেনি ছাদ থেকে।
রিতী চট করে উঠে বসে । কাঁচের জানালা ভেদ করে বিদ্যুত চমকানো দেখে ভয়ার্ত মুখে রুম্পার দিকে তাকায়। খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটে ছাদের দিকে। পেছন পেছন রুম্পাও ছুটে। অনবরত দরজা ধাক্কিয়ে চলছে রিতী। চিৎকার করে ডাকছে। কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুম্পা এবং রিতী। দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে কোথাও যেনো বাজ পরে। বাজের শব্দে বিল্ডিং ও কেঁপে উঠে। সাথে সাথে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কানে হাত চেপে ধরে রুম্পা ছুটি__ বলে বিভৎস এক চিৎকার দেয় ।

ছানোয়ার আহমেদ উঠে দাঁড়িয়েছে। তার কলিজায় যেনো কেউ আচর কেটে দিয়েছে। ছোট মেয়ের উপর অত্যন্ত রাগে জেদে দুর্যোগ অবস্থা দেখেও বসে ছিলো। গণিতের টিচারের মেয়ে হয়ে যদি গণিত সাবজেক্টে একশতে বিশ পেয়ে ফেল করতে পারে তাহলে তারও এতোক্ষণ বসে থাকা ঠিক কাজ হয়েছে। কিন্তু তার এই ঠিক কাজটি এখন বেঠিক মনে হচ্ছে। কারন সে বাবা। আর তার মেয়ে এই ঝড় বৃষ্টির রাতে ছাদে বন্দী আছে।

ছানোয়ার যখন ছাদের দরজায় পৌঁছলেন তখন বিদ্যুত চলে এসেছে। শহরের বিদ্যুত ব্যবস্থার এই একটি সুবিধা। ঝড়ের মাঝেও তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সাথে তুফান। দুর্বল চিত্ত রিতী মায়ের গলা ধরে কাঁদতে শুরু করেছে। ছানোয়ার নিজেও চেষ্টা করলেন। শক্ত স্ট্রীলের দরজা ভাঙা সম্ভব না। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
— ও রিতীর বাবা, মেয়েটা আমার ঠিক আছে তো? বাজ পড়লো যে। বাজে মেয়েটা ভয় পায় যে!
ছানোয়ারের মুখে আধার নেমে এসেছে। ছাতা ছাড়াই সদর দরজা খুলেই চললো বাইরে। দুতলার ছাদের চারপাশে খুঁজলো কোথাও ছুটির দেখা নেই। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো।
— রুম্পা ছুটি ছাদে আছে তো ? আশেপাশে কোনো বাড়িতে যায়নিতো?
— কোথায় যাবে? ও তো ছাদে।
— তোমার মেয়ের কাছে ছাদ আর মাটি একই কথা। লম্ফঝম্প তো কম জানে না!আশে পাশের বাড়ি গুলোতে ফোন দাও কোথায় আছে?
— এতো রাতে মানুষ কি ভাববে?
— আগে আমার মেয়ে তারপর তোমার ভাবনা।

হাতে ফোন নিয়েই দরজায় কড়া নাড়লেন বীনা।ভেতর থেকে আওয়াজ এলো।
— কি হয়েছে?
— দরজা খোল বাঁধন।
ঢিলে ঢালা ট্রাউজার টা গোড়ালী অব্দি টেনে টি শার্ট গলা দিয়ে নামিয়ে দরজা খোললো বাঁধন। মায়ের দিকে তাকিয়ে হাই তুলে বললো,
— এতো রাতে কি হয়েছে মা।
— বাইরে ঝড় হচ্ছে রে বাঁধন।
— হুম। তুমি কি ভয় পাচ্ছো? বাবা কই?
— শোন রিতীর বাবা ফোন করেছিলো। ছুটিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। কারো বাসায় যায়নি। ছাদে গিয়ে দরজা দিয়েছে। এতো ডাকাডাকির পরেও দরজা খুলছে না। তুই একটু যা না বাবা।
— এই বৃষ্টিতে?
— রিতীর বাবা একা মানুষ কি করবে?
বাঁধন আর কথা বাড়ালো না। ছাতা নিয়ে রিতীদের বাসার সামনে উপস্থিত হলো। এই বৃষ্টিতেও প্রতিবেশীরা ‌অনেকেই এসেছে। কি হলো? কি হলো? গুন গুন আওয়াজ উঠেছে। বাঁধন কে দেখেই ছানোয়ার প্রায় কেঁদে ই ফেললেন।
— একটু সাহায্য করোনা বাবা। মেয়েটা মনে হয় ছাদেই আছে।
বাঁধন শিপ্রু রতনকে নিয়ে বাইরে এলো। ঝুম বৃষ্টি। উপরে তাকাতে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। সেই সাথে বাতাস। বাঁধন বললো,
— রতন, শিপ্রু তোরা পিঠ বাঁকিয়ে দাঁড়া। এদিক দিয়ে মনে হচ্ছে ছাদে কোনভাবে উঠা যাবে।
বাঁধনের কথা অনুযায়ী রতন এবং শিপ্রু তাই করলো। ওদের পিঠে পা রেখে বাঁধন বাউন্ডারির দেয়ালে উঠে গেলো। খুব কষ্টে যখন ছাদে উঠতে সক্ষম হলো তখন বৃষ্টির প্রকোপে চোখ খুলা দায়! এদিক ওদিক খুঁজে গোলাপ গাছের নিচে ছুটিকে পাওয়া গেলো। লাশের মতো পড়ে আছে। বাঁধন দ্রুত গিয়ে ছুটিকে কোলে তুলে নিলো। ঠান্ডা বরফ একটি দেহ। পালস চেক করলো। নিশ্বাস বেশ ধীরে ধীরে পড়ছে। বিলম্ব না করে অর্ধমৃত দেহটাকে কাঁধে তুলে নিলো।

চলবে,

~ লাবিবা_তানহা_এলিজা

#বিষ_করেছি_পান (২)

(কপি করে নিষেধ)
ছুটির জ্ঞান ফিরছে। তেল দিয়ে হাত পা অনবরত মালিশ করে দেওয়া হচ্ছে। ঘর ভর্তি মানুষ। হাত পা পিঠে স্কেলের দাগ। লাল হয়ে ফুলে ফেঁপে আছে। ভেজা কাপড়ে কৈশরপ্রাপ্ত শরীরটা কলির মতো ফোটে উঠেছে। চেঞ্জ করিয়ে দেবার উপায় ও নেই। এভাবে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। বাঁধন নিঃশব্দে ছুটির উপর থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।হুট করেই মাথায় একটা কথা ঘুরে ঘুরে আসে। ছোট্ট ছুটি আর ছোট নেই। বাঁধন দরকার কাছে এসে উপস্থিত ছেলেদের ইশারায় বেরিয়ে আসতে বললো। যাওয়ার আগে রিতীকে বলে গেলো ছুটির কাপড় এখনি যেনো পাল্টে দেয়।

বসার ঘরে বসে আছে ছেলেরা। ছানোয়ার সাহেব রুম্পাকে চা করতে বলেছেন। রাত এখনো শেষ হয়নি। অনেকেই ছাতা মাথায় নিজ গৃহে ফিরে গেছে। ছুটি ঘুমোচ্ছে। রিতী এসে বাবার পাশে বসলো। কান্নাকাটি তে মাথাটা ধরেছে। চা খেয়ে তারপর একেবারে রুমে যাবে।
— কাল সকালে ডাক্তার এসে ছুটিকে দেখে যাবে চাচা। আমি ফোন করেছিলাম।
শিপ্রুর কথায় মাথা দোলায় ছানোয়ার। মুখে অস্ফুট শব্দ করে,
— হু।
রুম্পা চা নিয়ে আসে। সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দেয়। বাঁধন চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— ছুটির শরীরে কিসের দাগ ওগুলো চাচী?
— মারের দাগ। মা মেরেছে।
রিতী ঝটপট উত্তর দিয়ে দেয়। রতন ভ্রু কুচকায় ?’
— এতো বড় মেয়েকে এভাবে কেনো মারলো?
— গনিতে ডাব্বা মেরেছে । বাবাকে কোন এক টিচার বলেছে। বাড়ি এসে মারতে গিয়েছিলো। মায়ের কথামতে বাবাদের মেয়ের গায়ে হাত তুলতে নেই। সেজন্য মা ই ইচ্ছা মতো পিটিয়েছে।
— গণিতে ফেল?
ভ্রু খানা নিমেষেই একটু উঁচু হয়ে গেলো। ছানোয়ারের ছুটির ফেল এর কথা মনে পড়তেই মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। কলিগ সিদ্দিক স্যার আজ তাকে টিটকারী দিয়ে কথা বলেছে। বড় মেয়েটা সব সব টপার আর ছোট মেয়েটা ফেল। এক মেয়ে বাবা-মাকে উঁচুতে উঠায় তো আরেক মেয়ে টেনে নিচে নামায়। আজ বেশ অপমান বোধ করেছে ছানোয়ার। গণিতের টিচারের মেয়ে নাকি পায় একশতে বিশ নাম্বার! রিতী জিজ্ঞাসা করে,
— ঝিমা কত পেয়েছে বাঁধন ভাই?
— আটাশি।
ছানোয়ার বলে,
— ঝিমা ছাত্রী ভালো। তার পড়ার ধরন দেখেই বোঝা যায়। গার্লস স্কুলের গণিত স্যারের সাথে আমার মাঝে মাঝে ঝিমাকে নিয়ে গল্প হয়। নিজেরটাকে নিয়ে তো কথাই বলতে পারিনা।
— না মেরে ধীরে সুস্থ একটু বুঝিয়ে পড়াবেন চাচা। ধৈর্য ধরুন। এমনিতেই তো অন্য সাবজেক্ট গুলোতে ভালোই।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ায় বাঁধন । বাঁধনের দাঁড়ানো দেখে রতন শিপ্রুও দাঁড়ায় না। মেইন দরজার দিকে রাস্তা মাপে। যাবার আগে বাঁধনের মনে হলো ছুটিকে দেখে আরেকবার যাওয়া উচিত। কি মনে করে আর ছুটিকে দেখতে গেলো না । বিদায় নিয়ে ছাতা মাথায় বাড়ির দিক রওনা দিলো।

ছুটি চোখ খুলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই তমাল শুয়ে শুয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা নাচিয়ে ডিং ডং খাচ্ছে। ছুটি তমালের দিকে তাকিয়ে এতো জ্বরেও হেসে ফেলে। দু বোনের বড্ড আদরের ছোট ভাই তমাল।ভাব সাব ও যেমন অদ্ভুত দেওতেও তেমনি কিউট। ছোট ছোট হাত,পা, চোখ,নাক, ঠোট কি সুন্দর! সব থেকে ভালো লাগে মাথার চুল। একদম সিল্কি। চুলে হাত দিতেই আবেশে চোখ বুজে আসে। এ ছেলে বড় হয়ে যে মেয়ে পটিয়ে ঘুরবে সেটা ছুটি চোখ বুঝেই বলে দিতে পারে।
— কিরে ভাই? খাট কি ভেঙে ফেলবি নাকি? ছোটাপুর শরীর খারাপ না? উঠে আয় ওখান থেকে।
রিতী কথায় দুজনেই তাকায়। তমাল ছুটির দিকে আরেকটু চেপে আসে। মুখে ডিং ডং নিয়েই বলে,
— ছোটাপু ঘুমায় না। হাতে ব্যথা।
— তোকে মা ডাকে। যা।
— মা রাক্ষসী। মারবে।যাওয়া যাবে না।
— তুই যদি না যাস তাহলে মা তো তোর উপরেও ক্ষেপে যাবে। এখনো সময় আছে দৌড় দে।
— কেনো এতো জরুরি তলব?
— তুই গিয়ে শুনে আয়।
— মা ডাকে না। ডাকলে মনিদের বাড়ি থেকে শোনা যায়। তুমি মিথ্যা বলছো।
— হ্যা মিথ্যা বলছি। তোকে ভালো লাগছে না। সরতো সর।
তমাল খামচি দিয়ে মুখে একগাদা ডিং ডং ঢুকিয়ে নিলো। প্যাকেট টা টেবিলের উপর ঢিল ছুড়ে দিলো। হাতটা প্যান্টের উপর মুছতে মুছতে দৌড় দিল।সাথে সাথেই রিতী খ্যাক করে উঠলো,
— এই প্যান্ট নষ্ট করিস করবিনা ?বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়া যায় না? ময়লা প্যান্ট কে সাফ করবে তোর?
— ছোটাপু করবে।
রিতী ছুটির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে তাকায়,
— জীবনে কোন দিন করেছিস?
— তোমরা থাকতে আমি করবো কেনো?
দু বোন একসাথে হেসে দিলো।রিতী পাশে এসে শুয়ে পড়লো। ছুটি রিতীকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো।
— শরীরে তো জ্বর তোর ছুটি। একটা প্যারাসিটামল দেই খা।
— উহু। আপু?
— বল।
— রাতে কে এনেছে আমায়?
— বাঁধন ভাই ।
ছুটি নিভু নিভু চোখে রিতীর দিকে তাকায়। আবার চোখ বন্ধ করে কম্বল টেনে নেয়। রিতী মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অনুরোধ করে বলে,
— তুই এবার একটু পড়াশোনায় সিরিয়াস হ না রে ছুটি।‌ এস এস সির আর কয়েক মাস আছে। আমি তো গল্ডেন পেলাম। তুই যদি প্লাস ও না পাস তাহলে মান সম্মান কি থাকবে বল? একটু ভালো করে পড় দেখবি ঠিকই পারবি।‌ কাল তোর জন্য বাবা কত অপমানিত হয়েছিল বুঝতে পেরেছিস? কলেজে যখন আমাকে আনতে গেলো তখনি বাবার মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। বাড়ি এসেই না বোমা টা ফাটলো। বাবা কি কখনো তোকে মারে?কাল তোকে মারতে পর্যন্ত গিয়েছিলো। কতটা কষ্ট পেয়েছে একটু ভাব। ছুটি?শুনছিস?এই ছুটি?
রিতী ছুটির সাড়া পেলো না। ঘুমিয়ে‌ গেছে মেয়েটা।

রীতি আর ছুটি দুবছরের ছোট বড়। রীতি কলেজে পড়ছে আর ছুটি স্কুলে। গার্লস স্কুল পেরিয়ে যেতে হয় কলেজে। রিতী প্রতিদিন ছুটিকে নামিয়ে দিয়ে যায় কলেজে। আজ ছুটি অসুস্থ থাকায় রিতী একাই রিকশা করে কলেজ যাচ্ছে। মোড়ের মাথায় আসতেই রিতীর বুক কাপাকাপি শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন তো ছুটিটা থাকে তাই তার সাহসও থাকে। রিতী একটু ভয় পেলেও ছুটি বেশ সাহসী। রিতী মাথায় ঘোমটা টেনে চোখটা খুলা রাখলো। চায়ের দোকানের বিপরীত দিকে ঘুরে বসলো। ক্রস হতেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। রিকশা থেকে মাথা বের করে ফাঁকা বেঞ্চিটা পড়ে থাকতে দেখলো। নিমেষেই রিতীর ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটে উঠলো। শান্তির হাসি, বেঁচে যাওয়ার হাসি। মনে মনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
— আল্লাহ বখাটেটা আজ নেই। বাঁচিয়ে দিয়েছো। তোমার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। আর যেনো সামনে না পরে দেখো আল্লাহ।
ভাগ্যের ফেরে দুই মিনিট যেতে না যেতেই সেই হাসি গায়েব হয়ে গেলো। চলন্ত রিকশায় লাফ দিয়ে রিতীর পাশে বসে পড়লো। রিতী সরে যেতেই পরে যেতে নিলো। রিকশার হুড আঁকড়ে ধরে কোনমতে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলো।
— সইরা যাও কেনো পিরিতি? প্রেম পিরিতি একসাথেই থাকনের কথা। আলাদা হতে গেলেই রাস্তায় পইড়া সোজা উপরে উঠি যাবা।
রিকশাওয়ালা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। দাঁত গুলো ভ্যাটকিয়ে বলে,
— হিরোর মতো ধইরা ফেলবেন মামা। নায়ক মান্না ময়ুরীরে একটানে ধইরা কাছে নিয়ে আয়সা বাঁচায়।
— হে হে__ মামা বুঝি বাংলা সিনেমার ভক্ত!
— মান্না ভাইয়ের ভক্ত। হলে দারুন একটা সিনেমা নামছে মান্না ভাইয়ের। আজকে দেখতে যামু। যাইবেন নাকি মামা?
— আপনের মামী যদি সঙ্গ দেয় তাহলে তো যাওয়াই যায় ।
শেষের কথাটা বলেই কড়কড়ে গাঢ় হলুদ চশমাটা চোখের উপর থেকে নাকের ডগায় এনে বিশ্রী একটা চাহনী দেয়। রিতীর গা শির শির করে উঠে ।বাংলা সিনেমা! তার উপর ময়ুরী মান্না! এদের সিনেমা কোনদিন দেখেছে বলে রিতীর মনে পড়লোনা। দাঁতে দাঁত চেপে ভয়ার্ত চাপা গলায় বলে,
— রিকশা থেকে নামুন। এক্ষুনি নামবেন।
— নামার জন্য উঠেছি নাকি পিরীতি?
— দেখেন সোহাগ ভাই আমার কলেজ ক্যাম্পাসের রাস্তা এটা।আপনি নামুন নয়তো আমি __
— থামো। এর পর কি বলবা জানা আছে আমার। কি চিৎকার করবা? লোক জড়ো করবা তাইতো? বুঝলেন মামা? সিনেমার উৎপত্তি কই থেকে হয় ? এই যে রং ঢং মাখা ডায়লগ অভিনয় গুলা দেখেন এইগুলা কি এমনি এমনি আসে?এই গুলা আসে আপনের প্রতিদিনকার পেসেঞ্জার গুলার থেকে। আপনের মামীরে ভালো করে চিনে রাখেন। পরের বার সিনেমা দেখার টাকা না থাকলে আপনার মামীর কাছে আসবেন আপনেরে আরো সুন্দর সুন্দর ডায়লগ ডেলিভারি দিবো।
— আপনি কি নামবেন সোহাগ ভাই?রিতী একটু জোরেই বলে।
— ঐ কিসের সোহাগ ভাই ? কিসের সোহাগ ভাই? কোন ভাই টাই না।প্রেম ডাকবা বুঝছো ? প্রেমিক লাগি তোমার।
— ঐ মামা রিকশা থামান নামবো আমি।
রিকশাওয়ালা রিকশা থামালো না। বরং মনের সুখে আরো জোরে রিকশা টান দিলো। পেসেঞ্জারের কথা কাটাকাটি‌ শুনে বেশ মজা পাচ্ছে। সোহাগ রিতীর মতি গতি বুঝে রিকশাওয়ালা কে ঝাড়ি দিয়ে বললো,
— ঐ তোমারে রিকশা থামাইতে বলে নাই ?
সোহাগ রিকশাওয়ালা কে থামানোর সুযোগ না দিয়েই ঠিক যেভাবে চলন্ত রিকশায় চেপে বসেছিলো সেভাবেই লাফ দিয়ে নেমে গেলো। রিতী বুকে হাত চেপে রিকশার মাঝখানের ফাক দিয়ে সোহাগের যাত্রার পথে এক মিনিট তাকিয়ে রইলো।

রিতী বাসায় ফিরে হাত মুখ ধুয়ে ছুটির রুমে গিয়ে ছুটির পাশে ধপ করে শুয়ে পড়লো। খাট নড়ে উঠাতে ছুটি বেশ বিরক্ত হলো। গলায় তেতো ভাব নিয়ে বললো ,
— আহ আপু ! মাথায় লাগে।
— তাড়াতাড়ি সুস্থ হ তো। আমার একা যেতে ভালো লাগে না।
— ঝিমা যায়নি তোমার সাথে? আমি তো বলে দিয়েছিলাম।
— ঝিমাকে বাঁধন ভাই নামিয়ে দেয়। বাইক ছেড়ে সে আমার সাথে রিকশায় কেনো যাবে ?
— তুমিও তো চাইলেই যেতে পারো বাইকে।
— বাঁধন ভাইয়ের বাইকের যে সিট! একজনের বেশী উঠাই যায়না । আগের দিনের বাইক গুলো ভালো ছিলো। দুই তিনজন আরামছে বসা যেতো। এখন সব কাপল বাইক। একজনের বেশী বসাই যায়না। সেবার যাত্রাবাড়ী থেকে তুই আর আমি কত কষ্ট করে রিক্স নিয়ে এসেছিলাম ভুলে গেছিস ?
ছুটি রিতীর দিকে তাকায়। দুজনের চোখে চোখে কথা হয়। রিতী হুট করেই রাগে ফুসে উঠে। গলার স্বর টেনে বলে,
— টেনে দেবো এক চড়। আরেকবার এরকম ফাজলামো করলে। হারামজাদা টা কি করেছে আজ জানিস? বলা নেই কওয়া নেই কই থেকে জানি এসে চলন্ত রিকশায় উঠে বসেছে।
— তাই! বাইক ছেড়ে রিকশা!
— হেতো। আমাকে নিয়ে বাংলা সিনেমা দেখার শখ জেগেছে তাও আবার মান্নার সিনেমা। ইসস…কি রুচি!
— ছিহ আপু! মান্না আমাদের দেশের এক নাম্বার নায়ক । তাকে নিয়ে এভাবে বলোনা।
— আরে রাখ তোর মান্না। আরো কি করেছে জানিস ?
— কি করেছে?
— আমার নামটাকে তো আগেই অপবিত্র করে ছেড়েছে এখন নিজের নাম পাল্টে প্রেম রেখেছে। বলে প্রেম পিরিতি একসাথে থাকবে।
ছুটি খিল খিল করে হেসে উঠে। রিতী বিরক্ত হয়ে ছুটির দিকে তাকায়। সিরিয়াস কথাকে এ মেয়ে কখনোই সিরিয়াসলি নেয় না। বরং আবালের মতো হাসতে থাকে। রিতীর আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগলো না।বালিশের পাশ থেকে উড়নাটা নিয়ে চট করে উঠে যায়।
চলবে,

লাবিবা_তানহা_এলিজা