বিষ করেছি পান পর্ব-৩+৪

0
365

#বিষ_করেছি_পান(৩)

(কপি করা নিষেধ)
রোদেলা দুপুর। গুটি গুটি পায়ে ঝিমার রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ছুটি। ঝিমা বাথরুমে গোসল করছে। পানির ঝম ঝম‌ শব্দ আসছে। ছুটি এসেছে ঝিমা জানেনা। বরং এ বাড়ির কেউই জানে না। ছুটি ডান দিকের বারান্দার দিকে তাকালো। ছোট বড় গাছ আর ফেড়ি লাইটে বারান্দাটি ভরপুর। ছোট ছোট টবে মাসরোজ ফুটে রয়েছে। লাল, হলুদ, গোলাপী,সাদা চার রংয়ের মাসরোজ। বারান্দাটি বাঁধনের ঘরের লাগোয়া। বাধন নিজের মতো করে ডেকোরেট করেছে। রাতের বেলা যখন ফেড়ি লাইট ঝিকিমিকি আলো দেয় দূর থেকে কি যে সুন্দর লাগে! মনে হয় এ এক বিলাসবহুল বারান্দা। ছুটি মাঝে মধ্যে ছাদে উঠে অপলক এই বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিন রাতে তো এই বারান্দা দেখেই সময় কাটাচ্ছিলো। মাঝখান থেকে ঝড় এসে ঝামেলা করে দিলো। ছুটি একটা ব্যপার খেয়াল করলো। দূর থেকে বারান্দা টা যতটা সুন্দর লাগে কাছে থেকে ততোটা সুন্দর না। তবুও সুন্দর লাগছে।
— কিরে কখন এলি?
ঝিমা ছুটির পেছনে এসে দাঁড়ায়।ছুটি ঝিমার দিকে না তাকিয়েই বলে,
— তোর বারান্দায় এসব কি ঘাস লাগিয়েছিস রে ঝিমা? মাসরোজ লাগাবি বুঝছিস? ঐ কর্ণারে মাসরোজের টব টাঙাবি।
— তাহলে আমার মানিপ্ল্যান্ট গুলো কোথায় রাখবো?মাসরোজ ভাইয়ার বারান্দাতে তো আছেই। এখানে আনার কি দরকার?
— তোর ভাইয়া কি আমাকে নিতে দিবে?
— তুই মাসরোজ দিয়ে কি করবি?
— বিছানায় ছড়াবো।তারপর সটানে শুয়ে পড়বো। নাক টেনে ঘ্রাণ নিবো। সারারাত ঘুমাবো। মাসরোজের কি ঘ্রাণ আছে রে ঝিমা? একটু দেখে আসি।
— খবরদার ছুটি একদম না। ভাইয়া রুমেই আছে।
— তাতে কি? আমরা দুজন হামাগুড়ি দিয়ে যাবো। একেকটা ফুল গাছ পাতা ভাইয়ার একেকটা প্রাণ। আমিই কোনদিন ঘ্রাণ নিতে পারিনি।জানিস ঐ গুচ্ছ বেলীর ঘ্রাণ নেওয়া আমার কতদিনের সপ্ন?
— চল আজ আমি তোর সপ্ন পূরন করি।
— একদম না। মেরে ফেলবে একেবারে । চল ছাদে চল। আমার সাথে কাপড় মেলতে হেল্প করবি। আজ মা অনেক গুলো কাপড় ধুয়ে বালতি আমার বাথরুমে রেখে গেছে।
ঝিমা ছুটিকে টানতে টানতেই ছাদে নিয়ে আসে। ছাদে আরেক বাগান। যত রকমের গুল্ম জাতীয় ফুল গাছ আছে সব এখানে ওখানে লম্বা লাইন করে সাজিয়ে রেখেছে। গাছের পরিচর্যা বাঁধন একা হাতে করে। ছুটি ঝিমার সাথে কাপড় মেলে দিলো না। গাছ গুলোর চারপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। ঝিমা চোখ রাঙালে ছুটি ভেংচি কেটে দিলো। ঝিমা শাসিয়ে বললো,
— ছুটি সাবধান!
ছুটি একটা প্রাণবন্ত হাসি দিলো। ঝিমা ছুটিকে রেখে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। ঝিমা চোখ সরাতেই টার্গেটে থাকা হলুদ গোলাপটা টুস করে ছিড়ে নিলো। কানের উপর গুঁজে লাফাতে লাফাতে ঝিমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
— ঝিমা দেখ মেচিং হয়েছে না আমার জামার সাথে?
ঝিমার চোখ উপরে। কপালে হাত দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
— সর্বনাশ!
_____________
ছুটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই বাধন বসে। বিকালে ছাদে পানি দিতে গিয়েই ব্যপারটা নজরে পড়ে। হলুদ গোলাপ নয়টা থেকে একটা মিসিং। খবর নিয়ে মলির থেকে জানতে পারে ফুলটা ছুটির কানের উপর দেখা গিয়েছে। ছুটি একটু পর পর মলির দিকে তাকাচ্ছে। এই মেয়েটাই যে বাঁধনের কানে খবরটা দিয়েছে সেটা আর নতুন করে জানার কিছু নেই।কলোনীর এতোগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে মলিই একমাত্র এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
— মলির দিকে বারে বারে কি দেখিস? আমার দিকে তাকা।
বাঁধনের কর্কশ গলায় ছুটি একটু যেনো কেপেই উঠলো।
— কলোনীর প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ে আমার কথার উপর কথা বলে না।সকলের বড় বলে যা বলি তাই শুনে। আমি যা অপছন্দ করি না আমার সামনে তা করার সাহস পায়না আর তুই? আমার ছাদে এসে আমার গাছের ফুল ছিঁড়ে নিলি!
ছুটি আমতা আমতা করে বলে,
— হলুদ জামার সাথে মেচ হয়ে গিয়েছিলো তাইতো___
— চুপ কর। আমার মুখের উপর তর্ক করিস। ঝিমা কোথায়?ও দেখেনি কান্ডটা ঘটাতে? ঝিমা এই ঝিমা।
ঝিমা দৌড়ে আসে।দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বাঁধনের সামনে দাঁড়াতেই কানের গোঁড়ায় দেয় এক থাপ্পড়। এক থাপ্পড়েই টুপ টুপ করে চোখের জল ছেড়ে দেয়। প্রিয় বান্ধবীর করুন মুখটা একবার দেখে নেয়। ছুটির চোখেও টলমল করছে জল। ছুটি এক দৌড়ে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। ঝিমা কান্নায় মুখ ভেংগিয়ে দেয়। চেউ চেউ স্বরে বলে,
— তুমি আমাকে মারলে কেনো?যে ফুল ছিঁড়েছে তাকে মারো। আমি কি করেছি?
— তোকে মেরেছি কারন তোর সামনে ফুল ছিঁড়েছে।ছুটিকে নিয়ে আর ছাদে যাবিনা মনে থাকবে?
— থাকবে।
— যদি যাস তাহলে ওর হাত দুটো বেঁধে তারপর নিয়ে যাবি।
— আচ্ছা। এবারের মতো মাফ করে দাও।
— দিলাম। যা এবার।

ছুটি ভেবেছিলো আজকে তার খবর আছে। থাপ্পড় টা তার গালেই পড়বে। কিন্তু অবাক করা বিষয় বাঁধন তাকে মারলো না। তার রাগ ঝিমার উপর দেখালো। বাঁধন ভাই আমাকে মারলোনা কেনো? কেনো মারলোনা?কেনো? ভাবনায় ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করলো। মাঝখান থেকে ঝিমাটা তার জন্য মার খেলো। ঝিমার কান্না দেখে সেও কাঁদছে। কিন্তু চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে না ‌। একটু ফুলে গেছে যা।বাঁধন বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। মেজাজ আসমানে তার। গেইটে আসতেই ছুটিকে চোখে পড়লো। মেয়েটা এখনো বাড়িতে যায়নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে দেখে বাঁধনের মনটা একটু হালকা হলো। ছুটির সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাবগতি বুঝে একহাত কোমড়ে রাখলো। আরেকহাত মুখের সামনে নিয়ে চুটকি বাজালো।
— কিরে? যমুনার জল এখনো থামেনি? বান্ধবীর জন্য এতোই টান!
ছুটি নিশ্চুপ।
— তাকা।
— হু।
— আমার দিকে তাকা।
ছুটি তাকায় ‌। বাঁধন হেসে বলে,
— হলুদ জামার সাথে হলুদ গোলাপ সুন্দর লাগছে। আর আমার সামনে একদমি কাদবিনা। ভালো মেয়েরা এভাবে কাঁদেনা।
— আমি একদমি কাঁদছি না বাঁধন ভাই। আমার চোখ ঘুলা।
— তুই যে কাদবিনা সেটা আমি ভালোভাবেই জানি। তবে চোরের মতো মুখ নিচু করে ছিলি। তুই একটা চোর।
— এমা চোর বানিয়ে দিলে?
মলি পেছন থেকে দাঁত বের করে হেসে বলে,
— চোরকে চোর বলবেনাতো কি বলবে?
ছুটি পেছনে তাকিয়ে দেখে মলি আর ঝিমা। এদিকেই আসছে। ছুটি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— বাইরে চল তোকে দেখাচ্ছি মজা।
— ছুটি!! আমি যেনো একদমই কিছু না শুনি।
— আচ্ছা ভাইয়া।
ছুটি মাথা দুলিয়ে ঝিমা মলির হাত ধরে গলির রাস্তায় দৌড়ে যায়। এমনভাবে দৌড়ায় যেনো তারা মিলেমিশে খেলতে যাচ্ছে। বাঁধনের আড়ালে আসতেই মলির পিঠে পড়ে কিল ধাপধুপ। ছুটি জামা টেনে ধরে বলে,
— আমার কথা বলে দেওয়া তাইনা?
— আরে আমি কি ইচ্ছা করে বলেছি নাকি? বাঁধন ভাই যখন বললো তখনি আমার খেয়াল হলো তোর কাছে দেখেছিলাম। কথাটা মনে মনেই বলেছিলাম কিভাবে যেনো জোরে হয়ে গেছে। সত্যি বলছি ইচ্ছা করে বলিনি। আর মারিস নারে বোইন। মারিস না।
ঝিমা বলে,
— তাহলে আইসক্রিম খাওয়া।
— হ খাওয়ামু যা।

মোড়ের আইসক্রিম পার্লারের সামনে দাঁড়িয়েই আইসক্রিম খাচ্ছে ছুটি,মলি এবং ঝিমা। খাওয়া শেষ করে ছুটি বলে,
— তমালের জন্য নিয়ে নেই একটা।
দৌড়ে গিয়ে পার্লারে ঢুকে। সামনেই দেখে সোহাগ দাঁড়িয়ে। সোহাগ ছুটিকে দেখেই বাঁকা হাসে। ফর্সা ধবধবে গাঁয়ের রং। মোটামুটি লম্বা। মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি।চোখে সবুজ রংয়ের রোদ চশমা। ঠোঁটে অভ্যাসবশত আধ খাওয়া সিগারেট। সিগারেটের মাথায় একটু একটু লাল লাল আগুন। এই ভর সন্ধ্যায় বিদ্যুতের আলোয় চেহারায় চমক ছড়াচ্ছে। ছুটি মনে মনে বললো,
— আহ কি সুন্দর! মাশাআল্লাহ।
আবার আফসোস ও করলো এতো সুন্দর ছেলেটাকে তার আপু কেনো মেনে নেয়না? চরিত্র খারাপ বলে? আচ্ছা খারাপ চরিত্রের ছেলেদের কি বিয়ে হয়না? পরক্ষনেই আবার নিজেকে ধমক দিলো। ছি!কি ভাবছে এসব? দুশ্চরিত্রের ছেলেকে তাদের পরিবারে কখনো জায়গা দেওয়া যাবে না। আর এসব উল্টাপাল্টা কথা ভাবাও যাবে না। নেভার!
— মামা আরেকটা চকবার দেন।
— একটা না তিনটা চকবার দেও ওরে।
সিগারেট টা মুখ থেকে টান দিয়ে ছুটির দিকে ইশারা করে সোহাগ বলে দোকানদার কে। ছুটি আপত্তি জানিয়ে বলে,
— না না একটা দেন। আমার কাছে টাকা নেই তিনটার।ওরা নিবে না আর।
সোহাগ বাইরে উকি দেয়। ঝিমা আর মলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। দোকানদার কে বলে,
— ওরে ছয়টা চকবার দেও। টাকা আমি দিতাছি।
— আপনি কেনো দিবেন?
— বড়ভাই হিসেবে দিলাম । দিবার পারিনা? অবশ্যই পারি। নেও।
— আপনি আমার বড়ভাই না। মামা আইসক্রিম লাগবো না।
বলেই পার্লার থেকে বেরিয়ে আসে ছুটি। বিরবির করে বলে — আপনাকে আমার বড়ভাই হিসেবে মানিনা। কখনো মানবো না।
ঝিমা বলে,– নিস নি আইসক্রিম?
— অন্য একসময় নিবো চল।
তিনজনে বাড়িমুখী রওনা দেয়। কিছু পথ এগিয়ে আসতেই শুনে পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকছে। সোহাগকে দেখে একটু ভয় পেয়ে যায় ঝিমা,মলি। ছুটি ভয় পায়না। বরং মুগ্ধ চোখে দৌড়ে আসা ফর্সা সবুজ চশমার মানুষ টাকে দেখতে থাকে। ঝিমা ছুটির হাত ধরে বলে,
— এই ছুটি। এই বদটা তোর নাম ধরে কেনো ডাকছে?
— আইসক্রিম খাওয়াবে তাই।
— কিহ?
— হুম। তোদের ও খাওয়াবে।
সোহাগের হাতে সত্যি সত্যি আইক্রিমের পলি দেখা যাচ্ছে। মলি বলে,
— আমাদের কেনো খাওয়াবে?
— তোদের বড়ভাই তাই।
— ভাই না ছাই। সেদিন ও চেলাপেলা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করেছে জানিস? আমি স্কুলে যাচ্ছিলাম তখনি পাশ থেকে শিষ বাজিয়েছে।
মলির কথাটা কানে পৌঁছায় সোহাগের। দুষ্টু হেসে বলে,
— শালিকাদের দেখলে একটু আধটু শিষ বেরিয়েই যায়। ও তুমি মাইন্ড করোনা শালিকা।‌
সোহাগের কথা শুনে ছুটির দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় মলি ঝিমা। ছুটির ভাবগতি মিনিট দুয়েক আগে থেকেই ভালো লাগছিলো না। এখনো কত স্বাভাবিক! সোহাগ ছুটির হাতে পলিটা ধরিয়ে দেয়। বাঁকা হেসে বলে,
— তুমি যে আমাকে বড়ভাই মানোনা সেটা আমি ভালো করেই জানি। তাই বলে আইসক্রিম না নিয়েই চলে আসবা?
— আপনি এতো জানেন কেনো?
— দায়িত্ত্ব বুঝছো? দায়িত্ত্ব । দুইটা তোমার আপুর আর বাকিগুলো তোমাদের।
— আপু আপনার দেওয়া আইসক্রিম খাবেনা।
— আমার নাম বলবানা। কি বলবা?
মলি ঝিমার দিকে তাকিয়ে করে শেষ প্রশ্নটা। মলি ঝিমা দুজনেই শকে কথা বলতে পারছেনা। বিরবিরিয়ে বলে,
রিতীপু!

— কি হচ্ছে এখানে?
বাঁধনের কন্ঠে চমকে উঠে তিনজনে। সোহাগ ও পিছিয়ে গিয়ে আসি বলে হাঁটা ধরে। বাঁধন তাকিয়ে আছে ছুটির হাতের পলির দিকে। বাজার হাতে বাড়ি যেতেই রাস্তায় চোখে পড়ে ছুটির হাতে সোহাগ কিছু দিচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে আসে। কিছু বলার আগেই সোহাগ স্থান ছেড়েছে। সোহাগ আবার জিজ্ঞেস করে,
— কি দিয়ে গেলো তোকে?
— আইসক্রিম।
— সোহাগ কেনো তোকে আইসক্রিম দিবে?
— খাওয়ার জন্য।
— কেউ এসে আইসক্রিম দিয়ে যাবে আর তুই নিয়ে নিবি? ঝিমা তুই কি করছিলি?
রাগে কটমট করে ঝিমার দিকে তাকায় বাঁধন। ঝিমা বুঝে গেছে ব্যপারটা বকা ঝকার দিকে এগুচ্ছে।‌
— বাড়ি থেকে কি টাকা দেয়না? আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে বাজারে যাওয়ার সময় আমাকে বলা যেতো না? ঐ সোহাগের থেকে নিতে হবে? ফেলে দে। এক্ষুনি ফেলবি।
ছুটির মুখে কথা নেই। এই আইসক্রিম সোহাগ ভাই দিয়েছে। রিতীপুকে কেন্দ্র করেই দিয়েছে। এখন যদি ফেলে দেয় তাহলে সোহাগ ভাইয়ের আইসক্রিম রিতীপু খেতে পারবেনা। কিন্তু রিতীপুর এই আইসক্রিম খাওয়া প্রয়োজন ছুটি মনে করছে। ছুটির ভাবগতি দেখে বাঁধন টান দিয়ে পলি নিয়ে নেয়। ফেলে দেবার আগেই মলি ধরে ফেলে। ঝটপট বলে উঠে,
— এটা আমাদের টাকায় কেনা আইসক্রিম বাঁধন ভাই।
— তাহলে সোহাগ কেনো দিয়ে যাবে?
— আসলে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলাম তো। এগুলো বাড়ির জন্য নিয়েছিলাম। কিন্তু আসার সময় আনতে ভুলে গেছি। তাই ঐ সোহাগ দিয়ে গেলো। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞাসা করে আসুন দোকানদার কে।
— বুঝছি । তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবি। ঝিমা আয়।
বাঁধন বাড়ির দিকে হাটা দেয়। একটু দূরে চলে যেতেই তিনমাথা একসাথে হয়ে যায়। তিনজনেই চাঁপা হাসি দেয়। মলি বলে,
— মাংনা পাইলে আলকাতরাও ভালো।
— আর এইটা তো আইসক্রিম।
— সোহাগ দেক আর যে দেক। খেতে পারলেই হলো।

চলবে,

লাবিবা_তানহা_এলিজা~

#বিষ_করেছি_পান (৪)

(কপি করা নিষেধ)
রুম্পা ঝালে অনবরত শুষিয়ে যাচ্ছে। তাকে পানি এগিয়ে দিচ্ছে ছানোয়ার। দুজনের মধ্যে একটু আগে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে গিয়েছে। ছানোয়ার রেগে মেগে কাঁচা মরিচ খাইয়ে দিয়েছে রুম্পাকে। এটা তিনি বরাবরই ঝগড়ার সময় করেন। স্ত্রী ঝাল খেতে পারেন না এটা যেদিন জানতে পেরেছিলেন সেদিন থেকেই এই কাজটা করে আসছে। রণচন্ডী রুপ ধারণ করা রুম্পাকে ঘায়েল করার এই একটাই উপায় উপর ওয়ালা তাকে দিয়েছেন। সেজন্য অনেক বার তিনি খোদার পানে শোকরিয়া আদায় করেছেন। এজন্য কখনো এই ঘরে কাঁচা মরিচের অভাব পড়ে না। গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে রুম্পা তেতে উঠল। ছানোয়ারের উপর চিল্লিয়ে বললো,
— মরিচ খাইয়ে স্বাদ মেটেনি? এখন কি পেটে পানি ভর্তি করিয়ে মারতে চাও?
— তোমার তো ঝাল কমছেনা রুম্পা।
ছানোয়ার আহত গলায় বললেন। ঝালটা যেনো আজ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে।
— তুমি তো এটাই চাও। আমাকে খেয়ে তোমার শান্তি হবে। ওমাগো ঠোঁট জলে গেলো গো। আমি মরলে আমার তিন তিনটা বাচ্চার কি হবে গো __ ওদের কে দেখবে গো __ কে মানুষ করবে?
— এই এই এখানে মরার কথা কোথা থেকে আসছে? আমি কি একবারও বলেছি তোমার মরার কথা?
— বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
— তুমি বুদ্ধিমান?
— কি বললে?

দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছুটি বাবা মার ঝগড়া দেখছিলো। কিন্তু কি নিয়ে ঝগড়া বেঁধেছে আন্দাজ করতে পারছেনা। তার বাবা মার অবশ্য ঝগড়া করার জন্য যথেষ্ট কোন কারন লাগে না। একটুতেই বেঁধে যায়।এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তিনভাইবোন। ছুটি পা টিপে টিপে রুমের দিকে এগোয়। তখনি মায়ের চোখে পড়ে যায়।
— এই ছুটি। এই হলো তোর সময় বাড়ি ফেরা?
ছুটি আর ঘরে গেলো না। মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো। মনে মনে বিরবির করলো
— যেখানে সন্ধ্যে হয় সেখানেই বাঘের ভয়। আগে জানলে আরেকটু রাত করে ফিরতাম।
রুম্পা ছুটির হাতে পলি দেখে বললো,
— কিরে তোর হাতে?
— আইসক্রিম মা।
— দেতো খাই। তোর বাপে আজকেও আমাকে মরিচ খাইয়ে দিয়েছে। এই শেষ বার বলে দিলাম ছুটি। এর পর যদি ফের এরকম কিছু করে তোর বাপে তোরা তিনভাইবোন এর একটা বিহিত করেই ছাড়বি।
— করবো।

রুম্পা একটি আইসক্রিম শেষ করলো। তারপর বাকিটাও নিয়ে মুখে পুরে দিলো। ছুটি একটু হকচকিয়ে গেলো। নিজেরা খেয়ে রিতীর জন্য এই দুটোই এনেছিলো। তার মা যে এমন রাক্ষসের মতো আইসক্রিম খাবে সেটা জানলে ছুটি আরো দুটো আইসক্রিম নিয়ে আসতো। রিতীর আইসক্রিমে কিছুতেই ভাগ বসাতে দিতো না। ছুটির মনে হলো রিতীর ভাগ্যে নেই। কি নেই?কে নেই? সোহাগ কি নেই?

রিতী বইয়ের উপর হামলে পরেছে। সন্ধ্যা লাগলেই এই মেয়ের পড়তে বসতে হয়। বাইরে তুফান বয়ে গেলেও একে এখান থেকে তুলা যাবেনা যতক্ষন না সে নিজে উঠে। ছুটি তমালকে খুঁজতে লাগলো। আজ মা অনেক চেঁচামেচি করেছে। তমাল টা নিশ্চয় ভয় পেয়েছে। মায়ের চেঁচামেচি দেখলেই এই ছেলে ভয়ে গুটিয়ে পালায়। এভাবে চলতে থাকলে ছুটি ভেবে নিয়েছে তমালের ভবিষ্যত কি হবে? তমাল ভালোবেসে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলবে,
— মা আমি বিয়ে করেছি। তোমার বউমাকে বরণ করে ঘরে তুলে নাও।
মা পায়ের স্যান্ডেল তমালের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলবে,
— হতচ্ছাড়া বিয়ে করেছিস? তোর বউয়ের শখ আজ মেটাচ্ছি।
তমালকে আর কোথাও পাওয়া যাবেনা। যাক সব যাক। নতুন বউ চুলোয় যাক। তমাল শুধু মায়ের হাত থেকে বেঁচে যাক।

তমালকে খুঁজে পাওয়া গেলো বারান্দার এক চিপায়। ছুটিকে দেখে দৌড়ে এসে চেপে ধরলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ রাক্ষসী আজ ক্ষেপেছে। চুপ চাপ ঘরে গিয়ে পড়তে বসো। নাহলে কপালে দুঃখ আছে।’
তমালের কথা শুনে ছুটি মুচকি হাসে। কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমে আসে। পুচকেটা তাকে শাষাচ্ছে। কি একটা অবস্থা! ভেবেই আবারো ছুটির হাসি পায় । তমালের গালে চুমু দিয়ে বলে,
— সামনের বছর তোকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো। তারপর মা রেগে গেলে দৌড়ে গিয়ে পড়তে বসবি। তখন আর তোকে লুকানোর জায়গা খুঁজতে হবেনা।
— না না। আমি স্কুলে ভর্তি হবো না। সংসারের যে হাল! তোমাদের দুজনকে লেখাপড়া করাতেই সব যায় যায়।তার উপর আবার আমি! সামান্য বয়েজ স্কুলের গনিত শিক্ষকের কি এতো সামর্থ্য!
বলেই কোল থেকে নেমে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে সটানে শুয়ে পরে তমাল। ভাব খানা এমন যে সে নিজেই একজন গণিত মাস্টার। এইভাবে মাঝে মাঝে ছানোয়ার বলে। আত্মীয় স্বজনের সামনে দুঃখ প্রকাশ করে। তার হুবহু কপিবাজ তমাল। রিতী বাবার সাথে দুঃখিত হলেও ছুটি মোটেও দুঃখ প্রকাশ করে না। রিতীর উপর ছুটির বড্ড হাসি পায়। বোকা মেয়েটা জানেও না বাবা এসব এমনিতেই মুখের বুলি আওড়ায়। এইযে এতো এতো ছাত্রের ব্যাচ পড়ায়!মাসে পাঁচশ করে জনপ্রতি বেতন পায় এসব কোথায় যায়? সেই হিসেব কি কেউ করে? কেউ না করলেও ছুটি করে।
— তোর চিন্তা নেই তমাল।‌ তোর পেছনে যখন বেশি খরচ হবে তখন দেখবি আপু মস্ত বড় এক চাকরী করছে। তখন বাবাকেও আর তোকে খরচ দিতে হবেনা। তোর জন্য আমরা দুই বোন ই যথেষ্ট।

তিন মাথার খবর এখন পাঁচ মাথায় গিয়ে চেপে বসেছে। সবগুলো একসাথে শিপ্রুদের বাসার ছাদে মিটিং বসিয়েছে। রতন চোখ বন্ধ করে আছে। শিপ্রুও মুখ বাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝিমা মলি ছুটিও চুপ। অথচ একটু আগে কার আগে কে কথা বলবে তার ছোট খাটো প্রতিযোগিতাও হয়ে গেছে। তবে এখন পরিবেশ শান্ত। শিপ্রু তো চিৎকার দিয়ে ধপ করে বসে পড়েছিলো গরম খবরটা পাবার সাথে সাথে। রতন ঠোঁট চৌখা করে বলে,
— কি বলিস! ঘটনা এতোদিনের?আমরা কেউ কিছুই জানিনা? বাঁধন ভাই কে বলতে হবে।
ঝিমা রতনের পিঠে হালকা দেয় এক চাপড়।
— ভাইয়া কালকে যে রিয়েক্ট করেছে এই খবর জানতে পারলে তো কেলেঙ্কারি করে ছাড়বে। তুই কি‌ জানিস না ভাইয়ার মাথা কেমন গরম?
মলি ভাব নিয়ে বলে,
— হয় হয়। এরকম মাথা গরম লোক একটু আধটু হতে হয়। নয়লে কি আর পুরো কলোনীর দাদা হওয়া যায়? এই কলোনীর ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে সব থেকে বড় হচ্ছে বাঁধন ভাইয়া। আমরা তো সমবয়সী তাছাড়া ছোট বড় মিলিয়ে বাইশ জন বাচ্চাকাচ্চা। সব গুলারে সামলাতে গেলে মাথা গরম তো এমনিতেই হয়ে যায়।মুরুব্বিরাও তো বাঁধন ভাইয়ের কথার দাম দেয়। সেক্ষেত্রে বাঁধন ভাই কে বলাই যায়।
— তারপর কথাটা সোজা বাবার কানে যাক তোরা তাই চাস তাইতো?
ছুটির এই কথাটায় সবাই চুপ হয়ে যায়। আকাশ পাতাল অনেক ভাবনার পর রতন একটা বুদ্ধি বের করে।
— এই শোন। বড়দের কানে দেবার কোন দরকার নেই। যেহেতু ব্যপারটা আমরা জানতে পেরেছি সেহেতু আমরাই সলভ করে ফেলবো। আইডিয়া।
পাঁচ মাথা আবার এক হয়ে যায়। প্ল্যান প্রোগ্ৰাম শেষ করার পর সবার মুখে হাসি ফুটে। গোল চত্ত্বর হয়ে হৈ হৈ করতে করতে ঘুরে ঘুরে একসাথে নাচে। ঝিমা ছুটিকে বলে — তুই যদি আগেই আমাদের সাথে ব্যপারটা ডিসকাস করতি তাহলে কবেই ব্যবস্থা হয়ে যেতো। মাঝখান থেকে আপুকে এতো পেরেশানি হতে হতো না। মলি গালে হাত দিয়ে হতাশা নিয়ে বলে,
— হায়রে! প্রেমের পিরিতি আপু!
সবাই একসাথে খিলখিল করে হেসে ফেলে।
— ঐ ঐ রেডি হ। অপারেশন আজকে রাতে।
— জিও!
______________
রাত তিনটায় সোহাগ হুমুস্থুল করে বাড়িতে ঢুকলো। সোহাগের মা সোহাগী বেগম ছেলের জন্য ইজি চেয়ারে প্রহর গুনছিলেন। ছেলেকে এভাবে ঢুকতে দেখে চেয়ার ছেড়ে দু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন।
— আব্বা! আব্বা। কি হয়ছে আমার আব্বার! এমন করতাছো কে আব্বা! হায় আল্লাহ। ও সোহাগের বাপ! সোহাগের বাপ! পোলা কেমন করতাছে। তাড়াতাড়ি আসো।
সোহাগী সোহাগকে ছেড়ে পানি আনতে দৌড় দিলো। কাজের মেয়েটাও চিৎকারে জেগে উঠেছে। সোহাগীকে পানি না নিতে দিয়ে নিজেই জগ গ্লাস একসাথে করে আনলো। সোহাগ সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। ধর ধর করে ঘামছে। রমিজ উদ্দিন ছেলের অস্বাভাবিক ঘাম দেখে দিক হারা হয়ে যায়। একটা মাত্র ই বংশের বাতি তার। কলিজা ছেড়া ধন। আদরের পুত্র। এই অবস্থা দেখে তাড়াহুড়ো করে পার্সোনাল ডাক্তারকে কল দেয়। সোহাগী কাজের মেয়েটাকে ধমক দিয়ে বলে,
— এইটা কি আনছিস? ফ্রিজের পানি আন। আমার আব্বা ঘামতাছে দেখস না ?
সোহাগ হাঁপাতে থাকে। কোন মতে কথা বলার শক্তি পেয়ে মাকে আস্বস্ত করে,
— আমি ঠিক আছি আম্মা। আপনে শান্ত হন।
— তুই ঠিক নাইরে আব্বা। হাতপা ছাইড়া দিতাছস কেন?ও বাপ!
— আম্মা গোসল করমু। আমার শরীরে ঠান্ডা পানি ঢালো।
রমিজ উদ্দিন ফোনে ডাক্তারকে পেলোনা। বেটা যে বুড়ো বয়সে বউকে নিয়ে মালদ্বীপে হানিমুনে গিয়েছে এটা মনেই ছিলো না। ফোনটা সোফায় ছুড়ে ফেললো। ছেলের কাছে এসে ছেলেকে ধরলো। সোহাগ বললো,
— আব্বা আমারে বাথরুমে নিয়ে চলেন।
রমিজ সোহাগী মিলে বাথরুমে নিয়ে গেলো । বাথটবের পানিতে একগাদা বরফ ঢালা হলো। প্রায় আধ ঘন্টা ঢুবে থেকে সোহাগ বেরিয়ে এলো। রমিজ ছেলেকে বুকে টেনে নিলো।
— সোহাগ! বাপ আমার। ভয় পাইছো?
— হ আব্বা। জনমের তরে ভয় পাইছি। এমন জিনিস কোনদিন দেখিনাই। আজকে তুমি তোমার পোলারে পাইতানা আব্বা।
— আব্বা এসব কথা বলা লাগেনা। কি হয়ছে কও।
সোহাগী মুখের সামনে গরম দুধ ধরে। সোহাগ ঢুক গিলে তার গলা দিয়ে তরল দুধটাও আজ নামবে না। এতো বছর থেকে এলাকায় সারারাত চষে বেড়াচ্ছে কখনো অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। আর আজ! কি দেখলো এটা? চেলাপেলার সাথে আড্ডা শেষ করে যখন বাড়ি ফিরছিলো তখন সে একা। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় বাইকের হেড লাইট ই ভরসা। শিষ বাজাতে বাজাতে বাইক চালাচ্ছিলো ।হুট করেই লাইটের আলোয় কি যেনো একটা দেখলো। যত কাছে আসতে লাগলো ততো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সাদা শাড়ি লাল পাড়ে কে যেনো রাস্তায় মাঝখানে এসে হেলছে দুলছে। সোহাগ জোরে জোরে বললো,
— ঐ কে এটা? সরেন। সরেন সামনে থেকে।
তখনি কিটকিটিয়ে হাসির শব্দ পেলো। সোহাগের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো। স্বভাব বশত পকেট থেকে খুরটা বের করে নিলো। একদম কাছে আসতে যা দেখলো তা দেখে খুর ফেলেই আল্লাহ আল্লাহ করে বাইক ঘুরিয়ে উল্টোদিক টান দিলো। কিছুটা যাবার পরে আবারো সামনে সেই সাদা শাড়ি লাল পেড়ে ভয়ঙ্কর ব্যক্তিকে দেখতে পেলো। সোহাগ গাড়ি ঘুরিয়ে আবার টান দিলো। আশ্চার্য বিষয় সেই ব্যক্তিটা আবার সামনে এসে উপস্থিত। সোহাগের আর বুঝতে বাকি রইল না। ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়েছে সে। আজ তার মৃত্যু নিশ্চিত। চোখ বন্ধ করে যতটুকু পারা যায় পাওয়ার বাড়িয়ে বাইকে টান দিলো। বাকি পথ কিভাবে বাড়ি এসেছে সে জানে না।
সবটা শুনে সোহাগী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ছেলেকে শাসিয়ে বললো,
— তুমি আর দেড়ি করে বাড়ি ফিরবে না। দশটার পর বাইরে থাকবেনা। আব্বা তুমি আমাদের সব। কেনো বুঝো না। তোমার নিরাপত্তা ই একমাত্র আমাদের কাম্য।
রমিজ ও সায় জানালো। সোহাগ চুপ থাকলো। তার শরীর আর চলছে না। বাবার বুকে ঘুম চলে এলো।
চলবে,

লাবিবা_তানহা_এলিজা~