বিষ করেছি পান পর্ব-১৪+১৫

0
247

#বিষ_করেছি_পান(১৪)

(কপি করা নিষেধ)
ছুটি কিছুটা চমকে উঠে। বাঁধন ফোনটা সোফায় ছুড়ে প্যান্ট হাঁটুর ভাঁজে কিছুটা টেনে খাটের কোনায় বসে। সামনে উপস্থিত তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
— আমার বয়স হয়েছে। ত্রিশ পেরোলো বলে। আর চারপাচঁটা ছেলেমেয়ের মতো আমিযে প্রেম করিনি তা না। কলেজ লাইফে প্রেম হয়েছে দুই তিনেক। কিন্তু তারা কেউই আমার জন্য নয়। এ বয়সে এসে নতুন করে প্রেমে জড়ানোও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পরিবারের উপর ই ভরসা। সুমিকে মা পছন্দ করেছে। আমারো ভালো লেগেছে। সুন্দরী,মিস্টিভাষী, পড়াশোনা শেষ করেছে,ভালো ফেমেলী। আর তো কিছু চাওয়ার নেই। কথা বলছি ভালো লাগছে। বিয়ে হবে। একসময় ভালোবাসাটাও হয়ে যাবে। এরেঞ্জ ম্যারেজে ব্যপারটা এভাবেই আগায়। তোরা কি বলতে এসেছিস আমি বুঝতে পেরেছি। ছোট্ট মাথা চাপ নিসনা। বড় হ। সমাজের ভাব গতি আপনা আপনি বুঝে যাবি।
— আপনি রাজী?
— এখনো বলতে হবে বোকার হাড্ডি?
মলি আবদার করে বসে,
— ভাবীর সাথে কথা বলবো।
বাঁধন হো হো করে হেঁসে ফেলে। মনে হচ্ছে মলি কি দারুন হাসির একটা কথা বলেছে। ঝিমা ভ্রু কুচকায়। বাঁধনের হাসির মাঝেই ছুটি স্থান ত্যাগ করে। বাঁধন তা দেখে আরো হাসে। মলি ঝিমাকে কাছে টেনে একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— তোদের ভাবীর সাথে দেখা করিয়ে দিবো। ছুটিকে নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম খেয়ে আয়।

বাঁধন তার কথা রাখে। একটা রেস্টুরেন্টে ছোটদের নিয়ে গিয়ে সুমির সাথৈ দেখা করায়। সুমিকে দেখে রতন বলে উঠে, — ভাবী আপনার কাজিন টাজিন কি নেই? সুমি হাসতে হাসতে আফসোস করে বলে,
— নাগো দেবর নেই।
রতন ব্যথা পেলো এমন ভান ধরে বুকে হাত রাখে।সবাই একযোগে হেসে উঠে। সুমি সবার সাথেই কথা বলে। সবার ই সুমিকে প্রচন্ড ভালো লাগে। সুমির চোখ পড়ে ছুটির উপর। ছুটিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
— এইযে দুষ্টুগার্ল। তুমি নাকি আমার নামে বিচার দিয়েছিলে বাঁধনের কাছে?
ছুটি মাথা নাড়ে। সুমি ছুটির মাথা নাড়ানো দেখে হাসে। আরেকটু জড়িয়ে ধরে বলে,
— সরি সরি সরিইইইই। জার্নিতে আমার মেজাজ একদমি ভালো থাকেনা। বাস ছাড়া উপায় ও নেই আপুর কাছে যাওয়ার। তুমি জানো না। তোমার মতো পুচকে মেয়ে গুলো বাসে বেশী ডিস্টার্ব করে জানালার পাশের সিট নিয়ে। আমি তো নিজেই জানালার পাশের সিট ছাড়া বসতে পারিনা। সেখানে সেক্রিফাইস কিভাবে করবো বলো?
— বুঝতে পেরেছি।
— গুড গার্ল। ইউ আর সো সুইট ইউ নো?
ছুটি মিস্টি হাসে। পুরো বিকেল মিলে একসাথে সবাই মজা করে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পার্কে যায় ঘুরতে। সুমির সাথে সবার ভাব হয়ে গেছে। ছুটির মনের মেঘ নিমেষেই দূর হয়ে যায়।সুমিকে তার বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। বেশ মিস্টি লাগে সুমিকে। সুমি আইসক্রিম খায় না বলে সবার আগে ছুটি সুমির আইসক্রিম নিয়ে দৌড় দেয়। সবাই দৌড়ায় ছুটির পেছনে। এতো হৈ হুল্লোড়ের মাঝে বাঁধন সুমির হাতটা ঠিকই ধরে রাখে। নতুন একটা অনুভুতির সাগরে দুজনেই ভেসে চলে। যার যে স্তর! সেই স্তরেই রয়েছে।

ধীরে ধীরে বিয়ের দিন এগোতে থাকে। বউয়ের শপিং সব আলাদা করেই হয়। মহিলারা এক হয়ে নতুন বউয়ের জন্য একটু একটু করে শপিং করে আনছে। তাদের একটু মানে ছেলেমেয়েদের চোখে পাহাড় সম। এতো এতো শপিং দেখে ঝিমা তো আফসোস করেই বসলো — ইসসস.. আমার যে কবে বিয়েটা হবে!
মলি এই নিয়ে তাকে পচাতে লাগলো।রিতীর টেস্ট পরিক্ষা। সে সারাদিন টেবিলে বসে থাকে আর বাইরে আওয়াজ শুনতে পেলেই জানলা দিয়ে উঁকি দেয়। ছুটির তো দেখাই পাওয়া যায়না। সে আছে নানান রঙে। রুম্পা এতো ব্যস্ততায় সময় করে রিতীকে তিনবেলা খাইয়ে দিয়ে যায়। রিতীর তিনবেলা খাওয়া পড়া আর একটু একটু উঁকি দেওয়াতেই জীবন চলছে। এর ই মাঝে একটা উটকো নিয়মবিরোধী কাজ ও রয়েছে। সোহাগের ফোন রিসিভ করা। রিতী কল কাটে না। রিসিভ করে রেখে দেয়। টাকা বেশী হলে মানুষ কে ভীমরতি তে ধরে। রিতীর মতে সোহাগের ভীমরতিতে ধরেছে। তার কত টাকা আর কত ডিস্টার্ব করতে পারে রিতীও দেখে ছাড়বে। একটু পর পর বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে আর দেখে কল কাটলো কিনা। কল কাটলে আবার কল দিলে আবার রিসিভ করে আবার বালিশের নিচে রাখে।

এরি মধ্যে একগাদা অর্কিড হাতে ছুটি রিতীর রুমে আসে। রিতীর সামনে রেখে বলে,
— আপু নিচে যাও। এক্ষুনি যাবে। এই মুহূর্তে।
— কেনো রে? কি হয়েছে? এমন করছিস কেনো?
— নিচে তোমার পেয়ারের প্রেম এসেছে।
— থাপ্পড় খাবি একটা। আবোল তাবোল বলিস কেনো?
— তুমি নাকি সোহাগ ভাইকে বলেছো এখানে আসতে? তোমার জন্য অর্কিড ও এনেছে। আপু! তুমি নাকি ডেইলি কথা বলো ঐ বখাটে টার সাথে।এতো দূর!
— একদম বাজে কথা বলবিনা। মার কানে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? আমি মোটেও তাকে ডাকিনি।সে কল দেয় কিন্তু আমি একটাও কথা বলিনা।
— তাড়াতাড়ি বিদায় করো। গলিতে বিয়ে উপলক্ষে মানুষের যাতায়াত বেশি। দেখে ফেললে সর্বনাশ।
রিতী ধপ করে বসে পড়ে। এখন কি হবে? সে মোটেও নিচে যাবেনা। কিছুদিন থেকে কলেজ যাচ্ছেনা তাই চোখের সামনে ও পড়ছেনা। কতটুকু শান্তি পাচ্ছে তা শুধু রিতীই জানে। আবার দেখা দিয়ে এই শান্তির মাকে গলা টিপে হত্যা করার কোন ইচ্ছেই নেই। রিতী অর্কিড গুলো ছুটির হাতে তুলে দেয়। কাঁধে ধরে দরজায় ধাক্কিয়ে বলে,
— যা বোন যা। তুই গিয়ে বিদায় করে আয়। আমি কিছুতেই নিচে যাবোনা।
— সোহাগ ভাই বলেছে মানবেনা।
— কোন ব্যপার না। আমি ফোনে কথা বলছি তাও তুই যা।

ছুটি গিয়ে সোহাগ কে বলে,
— ফোন কানে নিন আপু কথা বলবে।
— ফোন কানেই আছে। তোমার আপু কথা বলছেনা।
— আপনি মজা নিচ্ছেন ভালো কথা।বাড়িতে আসলেন ভালো কথা। আমার আপু দেখা করবেনা সেটাও ভালো কথা। এবার আপনি চলে যাবেন সেটাও ভালো দেখায়।
— তো আমার লাভ?
— আপুকে দেখে কি লাভ?
— এনার্জি পাই। এক্সটা। সে তুমি বুঝবেনা।
— ফুলগুলো দোকানে দিয়ে দিবেন। দামী ফুল। অনেক টাকা। পচেই যাবে। শুধু শুধু টাকা খরচ করে লাভ নেই।এই টাকায় কয়েকটা আইসক্রিম খাওয়া যেতো। আইসক্রিম খেয়ে লাভ আছে । এনার্জি আসে। এক্সটা।
— তোমার আপুতো কথা বলছেনা।
রিতী কথা বললো। অনুনয় করে বললো,
— আপনি চলে যান প্লিজ। আমার বাড়ির কাছে আসবেন না।
— দেখা করতে বলেছিলাম। দেখাতো করলেনা।
— সামনে পরিক্ষা। প্রথম পরিক্ষা দিয়ে আমি দেখা করবো।
— পাক্কা?
— পাক্কা। এবার যান।
— আচ্ছা।
সোহাগ চলে গেলো। যাবার সময় বাঁধনের মুখোমুখি হলো। বাঁধন একবার সোহাগকে দেখে ছুটিকে পেছনে দেখতে পেলো। ছুটির হাতে অর্কিড ফুল। বাঁধন আড়চোখে দেখতে দেখতেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

বাঁধনের হলুদের দিন রিতীর প্রথম পরিক্ষা। রিতী পড়ছে কম উশখুশ করছে বেশী। পড়া থেকে মন আগেই চলে গেছে। লাউড মিউজিকে বক্সে গান বাজছে। রিতীর প্রিয় গান। গায়ে হলুদ, পায়ে আলতা,হাতে মেহেদি…. । ক্লাস টুতে ফাইভের বিদায় অনুষ্ঠানে এইগানের নেচেছিলো রিতী আজো মনে আছে। রিতী উদাস হয়ে আছে। একবার ইচ্ছে করছে ঐ বাড়িতে কি হচ্ছে দেখে আসতে। আরেকবার ইচ্ছে করছে না গেলে পড়া যা পড়েছে সব গুলিয়ে ফেলবে। এতো উতলা সময়ের মাঝে সোহাগ ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তার সাথে দেখা করতে হবে। হলুদের গানের সাথে রিতীর মনে মেলোডি গান বাজছে। সোহাগ মানেই রিতীর কাছে এক আতঙ্ক। ছেলেটা বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া এক অকর্মা। দামী দামী ড্রেসাপে গেটাপে বুঝার উপায় নেই। ভাব খানা এমন যে একজন হিরো। চেহারা খানাও মাশাআল্লাহ।যে কোন মেয়ে একবার তাকালে আরেকবার তাকাতেই চাইবে। কিন্তু তার ভেতরটা যে এমন তা কে জানবে? রিতীর জীবনটা কাপড়ের মতো কেচে যাচ্ছে। কম আঘাত সহ্য করছে না এর জন্য। রিতী ঠিক করে সোহাগের সাথে এবার ফাইনাল কথা বলবে। এভাবে বিরক্ত হবার জন্য রিতী জম্মেনি। রিতী সোহাগকে শর্ত দেয় রিতী যদি অক্ষত থাকে তবেই রিতী সোহাগের সাথে দেখা করবে। শর্তের কোন ফিডব্যাক আসেনা। বরং আসে গা জ্বালানো হাসি।

গায়ে হলুদ দিনে না হবে সন্ধ্যায়। বাঁধনের বন্ধুবান্ধব আসবে। সে কারনেই সময়টা পিছিয়ে দিয়েছে। খবরটা শোনা মাত্রই ছুটি রিতীর কাছে দৌড়ে এসেছে। রিতী কলেজের জন্য রেড়ী হয়ে গেছে। রুম্পা রান্নাঘর থেকে চেঁচাচ্ছে।
— স্কেল,পেন, এডমিট ভালো করে দেখে নিয়েছিস?
— হ্যা মা। নিয়েছি।
— টেবিলে বস। আয়। খায়িয়ে দিচ্ছি।
রিতী গিয়ে টেবিলে বসে। রুম্পা ভাজা মাছের বড় বড় কাটা বেছে বড় বড় লোকমা করে রিতীকে খাইয়ে দিচ্ছে। ছুটি এসে রুম্পার পাশে বসে।
— আপু তুমি হলুদে নিশ্চয় থাকতে পারবে। হলুদ সন্ধ্যায় হবে। আমরা সবাই হলুদ শাড়ি পরবো। তাই না মা?
— এতো লাফাস না। ঢ্যাং ঢ্যাং করে করে যে তিন চারদিন থেকে লাফাচ্ছিস খাওয়া নেই ঘুম নেই খালি বক্সের তালে নাচা। চুপ করে বসতো। আপুর সাথে খা। হা কর।
ছুটি হা করে। দুই মেয়েকে একসাথে খাওয়াতে থাকে। রিতী মুখে কাঠিন্য বজায় রেখে বলে,
— কয়দিন থেকে স্কুলে যাসনা?
— পরের সপ্তাহেই যাবো।
— কিহ? এতো দিন? মেহের স্যার ফোন দিয়েছিলো। তোর নামে বিচার দিয়েছে।
— এসব মেহের টেহের সোহাগ মোহাগ তোমাকেই যে কেনো ফোন দিতে যায় আমি বুঝিনা বাপু।
রিতী ঠোটে আঙুল চেপে চুপ করতে বলে। চোখ রাঙিয়ে রুম্পাকে দেখিয়ে দেয়। ছুটি মুখে টেডি স্মাইল ঝুলিয়ে রেখে এক ঢুক পানি খেয়েই দৌড় লাগায়।

পরিক্ষা শেষে উদাস হয়ে হল থেকে রিতী বের হয়। পরিক্ষা তার ভালো হয়নি। ভালো হবারো কথা নয়। পড়তেই তো পারেনি। গোল্ডেন আর তার এবারে থাকলোনা। স্যারদের সামনে মুখ দেখাবে কি করে? কি যে হচ্ছে তার সাথে! হাটতে হাঁটতেই উস্টা খায়। পরতে নিলেই নিজেকে ব্যালেন্স করে নেয়। পাশের একটা মেয়ে বলে,– আর ইউ ওকে?
রিতী চকিতে ফিরে মাথা নাড়ায়। সে ঠিক আছে। কানে গলা ফাটানো হাসির আওয়াজ পায়। একদম হো হো করে হাসি।কোথা থেকে আসছে? আশে পাশে চোখ বুলাতেই সামনে রাস্তায় বাইকের উপর বসা সোহাগকে দেখতে পায়। পাগলের মতো হাসছে ছেলেটা। মনে হচ্ছে কোন সারকাস দেখেছে। সারকাস দেখে মজা পেয়েছে। রিতী সারকাস! রাগে দুঃখে রিতীর কান্না চলে আসে। সোহাগ হাত দিয়ে রিতীকে কাছে ডাকে। রিতী মুখ ফুলিয়ে ধপ ধপ পা ফেলে সোহাগের সামনে দাঁড়ায়। সোহাগ এখনো হেসে চলেছে। রিতী নাট সিঁটকায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— পৃথিবীর জঘন্য হাসি।
সোহাগের হাসি থেমে যায়। রিতীর দিকে হেলে বলে,
— কি পিরিতী? পেলে তো ব্যথা? আমার সাথে না তোমার ব্যথার একটা কানেকশন আছে। যখন তখন আমার সামনে ব্যথা পাবে। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে। আমি দিলেও পাবে।না দিলেও পাবে।এইযে শর্ত দিয়েছিলে… আমি ভাই মেনে নিলাম। তুমি তো এমনিতেই…. হা হা হা।
সোহাগ আবার হাসতে লাগলো। সোহাগের হাসিতে রিতীর গা জ্বলে যাচ্ছে। একেতো রিতীর কষ্টে হাসছে তারউপর ভয়ঙ্কর সুন্দর ছেলেটার হাসি। রিতী আচমকা একটা কাজ করে বসে। একহাতে সোহাগের মাথা আরেকহাতে থুতনি ধরে একসাথে লাগিয়ে দেয়। ঘটনায় সোহাগ টাস্কি খেয়ে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে।

চলবে,
লাবিবা_তানহা_এলিজা~

#বিষ_করেছি_পান(১৫)

(কপি করা নিষেধ)
সোহাগের হাতের মুঠোয় রিতীর হাত। রিতীর মুখের উপর সোহাগের দৃষ্টি। রিতীর চোখ দুটো ঘাসের দিক নিবদ্ধ। ধৈর্য শক্তি বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। সোহাগ একটু পর পর মুখ দিয়ে বাজে সাউন্ড করছে। রিতীর বিরক্ত লাগছে। ফস করে সোহাগের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। সোহাগের মুখের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— সোহাগ ভাই আপনার কি মা বোন নাই?
— মা আছে বোন নাই। আমার রাজ্যে আমিই রাজা।
— আপনি যে শুধু শুধু আমার পিছু লেগেছেন। বিরক্ত করছেন।ঠিক একি কাজ যদি আপনার মায়ের সাথে করা হতো তখন কেমন লাগতো আপনার মার?
— আম্মার ভালোই লাগতো। না হলে কি আর আমার আব্বার সাথে সংসার করতো?
— ওহ! আপনার আব্বাও! তাইতো বলি ডেলিভারি কোই থেকে আসে? সোহাগ ভাই আপনার আম্মার ভালো লাগলেও আমার ভালো লাগেনা। আমি জীবনেও আপনার সাথে সংসার করবো না।
— ঠেকা লাগছে? তোমার সাথে সংসার করার তো আমার ঠেকা লাগছে? বড়লোক বাপের পোলা দেইখা পইটা গেলা? হায়রে মেয়ে মানুষ! সবগুলা শালা এক বিছনের চারা।
রিতীর মুখটা অপমানে লাল হয়ে আসে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। তেজের সাথে বলে,
— আমি জীবনেও আপনার মুখ দেখতে চাইনা। তার আগে যেনো আল্লাহ আমার চোখ দুটা নিয়ে নেয়। ব্যাগটা তুলে রাস্তার দিকে হাটা দেয়। কি মনে করে দাঁড়িয়ে পরে। আবার ফিরে এসে ঠিক সোহাগের মুখের সামনে মুখ নিয়ে আসে। চোখে চোখ রেখে বলে,
— আপনি অত্যন্ত নোংরা প্রকৃতির একটা মানুষ। লালসা থাকলে লালসা মেটানোর মেয়েও আছে। তাদের কাছে যান। আমার মতো ভালো মেয়েদের উত্ত্যক্ত করবেন না। আমার আপনার এবং আপনার বাবার সম্পত্তির প্রতি ইন্টারেস্টেড নেই। চুপ করে আছি বলে ভাববেন না সবসময় চুপ করেই থাকবো। আপনার রাত দিনের সিডিউল খুব ভালো করেই জানা আছে আমার।
— বাহ খোঁজ খবর ও রাখা হয় বুঝি?
— খোঁজ খবর রাখতে হয়না। পতিতা পল্লীর সামনের রাস্তায় পা পড়লেই দেখা যায় কে ঢুকলো আর কে বেরোলো।
— পিরিতী? তোমার ভয় লাগেনা?
— নাহ।
সোহাগ ফিচলে হাসে। রিতী তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করে।

ছাদের সব গাছ এক জায়গায় করা হয়েছে। বড় করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। হলুদের আয়োজন করা হচ্ছে। মাগবিরের পর পরই ভিডিওগ্ৰাফি শুরু হবে। মেয়েরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াচ্ছে। এ বাড়ি কাজল দিচ্ছে তো ও বাড়ি লিপিস্টিক দিচ্ছে। ছেলেরা লাইটিং এর জন্য ক্যাবল ঠিক করায় লেগে পরেছে। রুম্পা রিতীকে দুইঘন্টার জন্য ছেড়ে দিয়েছে। খাটের উপর শাড়ি ব্লাউজ রাখা আছে। রিতীর কোন হেলদোল নেই। সমস্ত মনখারাপিরা আজ তার মনে আচর কেটেছে। রুম্পা এসে একবার তাড়া দিয়ে গেছে। রিতীর ভালো লাগছে না। কাল শুক্রবার তারপরদিন আবার পরিক্ষা। রিতী জানালা ছেড়ে দাড়ায়। একটা বই নিয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়ে। মুখের সামনে বই ধরে পড়ার চেষ্টা করে। পড়তে পারেনা। চোখ বন্ধ করে থাকে। ছুটির ডাকে চোখ মেলে। ছুটি শাড়ি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। রিতীকে বলে
— আপু পড়িয়ে দাও।
রিতী উঠে বসে। শাড়িটা হাতে নেয়। হলুদ জমিনের গোলাপী পাড়ের জামদানি শাড়ি। খুব সুন্দর। রিতী ছুটিকে ইশারা করে বলে,
— তুই আর ঝিমা এই শাড়ি নিয়েছিস বুঝি?
— না। শুধু আমি নিয়েছি। ঝিমা অন্য শাড়ী।
— বাব্বাহ! আলাদা কেনো?
— কারণ আজ ঝিমা আলাদা সাজবে আর আমি আলাদা সাজবো। দুজনের লুক হবে আলাদা আলাদা।
–ওহ। আয় এদিকে আয়।
রিতী ছুটিকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। ছুটি মেকাপ বক্স এনে ইচ্ছেমতো গালগুলো হালকা পিংকিশ করে নেয়। ঠোটে লাগায় কড়া গোলাপী লিপস্টিক। চুলগুলো ফুলো বেনী করে বাধে। শাড়ি ধরেই এক দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে ফুলের ডালা নিয়ে আসে। গাদা ফুলগুলো রিতীর হাতে ধরিয়ে দেয়।
— বেনীর ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দাও।
লম্বা বেনীটার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ গাঁদা গুঁজে দেয়। গাদার মালা হাতে গলায় এমনভাবে পড়ে যেনো আজ তারই গায়ে হলুদ। রিতী হা করে ছুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথায় হাতে দিয়ে বলে,
— আরেব্বাস!ছুটি? আজ বাঁধন ভাইয়ের গায়ে হলুদ নাকি তোর?
ছুটি মাথা থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
— আমার হতে যাবে কেনো? বাঁধন ভাইয়ের হলুদ। আমি তো হলুদে যাবো জন্য সাজলাম মাত্র!
— এত্তো! এই সত্যি করে বলতো কাকে পাগল করতে যাচ্ছিস?
— আমি এখনো ছোট আপু। আমার এসব কথা শুনতে নাই।
ডালাটা হাতে নিয়ে কোমড় বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে হেঁটে ছুটি চলে যায়। রিতীর মাথা খুলতেই একলাফে শাড়িটা হাতে নিয়ে নেয়। মাথায় একটা কথাই চলছে। ছুটির সাথে থাকতে হবে। মেয়েটাকে আজ তার থেকেও বড় লাগছে।

বাঁধন হলুদ পাঞ্জাবী পড়েছে। তাকে ঘিরে তার বন্ধুরা রয়েছে। একেকজন একেকটা কথা বলছে আর পুরো বন্ধু মহল হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাঁধন সুবোধ বালকের মতো বসে আছে। একটু পর পর মুচকি মুচকি হাসছে। কি সুন্দর লাগছে! ছুটির চোখ যেনো সরেই না। চোখ দুটো নিজের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ দেখা যেনো শেষ দেখা। এরপর আর কোনদিন চোখ মেলে দেখা হবেনা। বন্ধুমহল সরে যেতেই বোনদের দল ঘীরে ধরে বাঁধন কে। ফটোগ্ৰাফি চলছে। বাঁধনের পাশে ঝিমা বসে। ছুটি তারপরেই। দু তিনটা ছবি তোলার পর ই ছুটি ঝিমাকে টেনে তুলে ঝিমার জায়গায় গিয়ে বসে। বাঁধন আর ছুটি পাশাপাশি। হলুদে হলুদ মিলন। ছুটি হাসি হাসি মুখে এপাশ ওপাশ ফিরে সুন্দর সুন্দর পোজ দেয়।এরপর আসে ভাইদের দল। লেবুমামা এসে ঝিমা ছুটি বলে ডাক ছাড়ে। মেয়েদের দল দৌড়ে যায়। নিচ থেকে হলুদ বাটার ট্রে সাথে করে নিয়ে আসে। ভিডিওগ্ৰাফি চালু হয়েছে। এক এক করে সব মেয়েরা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সুন্দর করে সিনেমাটিক পোজে বাঁধনের পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রথমে মুরুব্বিরা বাঁধনকে হলুদ মাখিয়ে দেয়। তারপর ছেলেমেয়েরা যে যেভাবে পারে এসে বাঁধনকে হলুদ মাখিয়ে দেয়। ছুটি ঝিমা তালে আছে। তারা একসাথে হলুদ মাখাবে। দুজনে চোখে চোখে কথাও বলছে। যেই না দুজনে একসাথে গিয়ে বাঁধনের দুই পাশে বসেছে তখনি ছেলেরা হৈ হৈ করে উঠে। রিতী বলে,
— আরে কি করছিস? একে একে যা।
বাঁধন হাত তুলে রিতীকে থামিয়ে দেয়।
এ ফাঁকে ছুটি ঝিমা দুজনেই হাত ভরে হলুদ মাখিয়ে নেয়। রিতীকে ভেংচি দিয়ে দুজনেই বাঁধনের কানের কাছে মুখ নেয়। কি যেনো কানকথা বলবে এমন ভাব। বাঁধন ও আগ্ৰহী হয়ে আছে। দুজনেই ঠোঁট টিপে একসাথে বলে,
— ভাইয়া অনেক ভালোবাসি।
— আমিও তোদের অনেক ভালোবাসি।
— তাহলে ভালোবাসা নাও।
ঝিমা হলুদ মাখা হাত বাঁধনের সারা মুখে লাগিয়ে দেয় আর ছুটি সরাসরি বাঁধনের বুকে ঢুকিয়ে দেয়। ঠিক যে জায়গায় হার্ট থাকে সে জায়গায় সম্পুর্ন হলুদ মাখিয়ে ঘাড় গলা এক করে দেয় ‌। দুজনের দুষ্টুমিতে হৈ হৈ রব পড়ে। হাসতে হাসতে বড়রা একেকার হয়ে যায়।বন্ধুরা গিয়ে বাঁধনের পাঞ্চাবী খুলে সারা গায়ে হলুদে ভুত বানিয়ে দেয়।
— দোস্ত আজকে তোমাকে পেয়েছি।কোন ছাড়াছাড়ি নেই। হলুদে চুবাবো। আমাদেরই সময়।
বাঁধনের নাজেহাল অবস্থা। চোখে নাকে হলুদ লেগে গেছে। তাতে কারো খেয়াল নেই। একেবারে হলুদে ঢুবিয়েই তাকে গোসল দেওয়ানো হয়।

হলুদ মাখানোতে বাঁধনের স্কিন চকচক করছে। কাচা হলদে রেশ টেনেছে। তাকে কোন রাজ্যের রাজপুত্র লাগছে। ছুটি বাঁধনের ঘরের সামনে দিয়ে ছুটাছুটি করছে। শাড়ি পরেই তাকে এই চেয়ার,মোড়া টানাটানির কাজে নেমে পড়ছে। ঘরের ভেতর থেকে বাঁধনের ডাক পড়ে। ছুটিকে জিজ্ঞেস করে,
— আমার ফোন কোথায় রেখেছে জানিস? পাচ্ছিনাতো।
— কাকীমনির কাছে। আলমারিতে তুলে একেবারে চাবী মেরেছে। নয়তো এতো মানুষ।চুরি হয়ে যাবে।
— ওহ। আচ্ছা। যা।
ছুটি চলে যেতে নেয়। বাঁধন আবার ডাক দেয়।
— শোন। আচ্ছা তোর ফোন হবে?
— আমার যদি ফোন রাখার বয়স হতো তাহলে কি আমি এখানে থাকতাম?
— কোথায় থাকতি?
— থাকতাম কোথাও তবে এখানে থাকতামনা। এভাবে জ্বলতাম ও না।
বাঁধন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পুরোপুরি সন্দেহের দৃষ্টি। আজকাল ছুটি কি করে কোথায় যায় কার সাথে মিশে কার সাথে কথা বলে তা নিয়ে বাঁধন ঘোলাটে অবস্থায় আছে। ঠিক নেই। কিচ্ছু ঠিক নেই। সাতপাঁচ চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বলে,
— আচ্ছা লাগবেনা। ছুটি শোন।তোকে আজ বড় বড় লাগছে। এদিক সেদিক কোথায় যাবিনা। বাড়িতে অনেক ছেলেপুলে আছে। বড় কারো সাথে সাথে থাকবি। ছাদে যাবি আমার চোখের সামনে থাকবি। ঝিমা কোথায়? ঝিমার হাত ছাড়বিনা।

ছাদে একপাশে নাচের জন্য জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে।উচ্চস্বরে গান চলছে। সাজন সাজন গান। ছুটির পছন্দের। সব পছন্দের গান গুলোই ছুটি ঝিমা বক্সে বাজাবে বলে মেমোরীতে লোড করে এনেছে। একে একে সবাই চলে এলে নাচের আসর শুরু হয়। বাঁধনের মামাতো বোনরা অনেক ভালো নাচাতে পারে। তারাই আসর মাতিয়ে তুলছে। কিছুক্ষন পর পর শীষ বেজে উঠছে। গান শেষ হতেই একজোড়ে হাতের তালি দিচ্ছে। ঝিমা ছুটি মলি মিলে দলীয় নৃত্য দিবে। তারা একসাথে উঠে গিয়ে দিললাগাদিয়া গানে নাচতে থাকে। দীর্ঘ চারদিন রিয়ার্সেল করে আজ তাদের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে। এতো সুন্দর পারফরমেন্স শেষে আবার হাততালি পড়ে। সবটাই ভিডিও করা হয়েছে। বাঁধনের এক বন্ধু খুশি হয়ে তিনজনকে ডাকে। কাছে যেতেই তিনজনের হাতে তিনশ টাকা ধরিয়ে দেয়। ছুটির খুব আফসোস হচ্ছে। সে এতো সুন্দর পারফর্ম করলো অথচ রিতী দেখতে পেলোনা। হলুদ পর্ব শেষে সে বসেছে পড়ার টেবিলে। পরের পরীক্ষার পড়া পড়তে।
ছুটি অনেক ক্ষন থেকে খেয়াল করছে একটা কিউট মিউট ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আছে তো আছেই তার পিছু পিছুও যাচ্ছে।ছুটি মনে মনে প্রমোদ গুনে। ঝিমাকে বলতেই ঝিমা বাঁধনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে ছেলে মেয়েরা আস্তে আস্তে ফ্লোরে এক হচ্ছে। লাস্ট ফিনিশিং টা একহয়ে পাগলা নাচ নেচেই শেষ হবে। ঝিমার শরীরে ফাল উঠেছে। সে ছুটিকে টানছে। ছুটি নড়ছেনা। ছেলেটা ধীরে ধীরে ছুটির কাছেই আসছে। ছুটি আড়চোখে দেখছে। যেই ছেলেটা ছুটির পাশে এসে দাঁড়াবে সেই ছুটি ছেলেমেয়েদের ভিতরে ঝিমাকে নিয়ে ঢুকে পড়ে। ঝিমা ছুটির হাত ধরে ইচ্ছা মতো গানের তালে লাফাচ্ছে। ছুটিও লাফাচ্ছে। দুজনে ডুয়েট নাচছে। তালে তালে পা নাড়াচ্ছে। ঝিমার শাড়ি প্রায় খুলে গেছে। একটানে শাড়ি ফেলে নিচের স্কাট পড়েই নাচা শুরু করেছে। ছুটিও শাড়ী কোমড়ে গুঁজে ডিজে গানের পাগলা নাচ নাচছে। গাদা ফুলের মালা ফ্লোরে পড়ে পায়ে পায়ে পিষ্টন হচ্ছে। হটাৎ ছুটির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথা শোনে।
— এইযে আপু? শুনছেন? নামটা কি বলা যাবে?
পেছন ঘুরতেই ছেলেটার খোমাটা সামনে পড়তেই ছুটি চিৎকার করে উঠে,
— বাঁধন ভাই……….এই ছেলেটা ফোন নাম্বার চাইছে।
ঘটনা আকষ্মিকে সবাই হতভম্ব। বক্সে গান একটা মাত্র ই শেষ হয়েছে। সেইসুবাদে ত্রিশ সেকেন্ড আওয়াজ বিহীন রয়েছে। তৎক্ষনাৎ ছুটির চিৎকারে বাঁধন দৌড়ে এসেছে। ছেলেটা বাঁধনের বন্ধুর ছোট ভাই লাগে। ছেলেটা ভীষন লজ্জায় পড়ে মুখ ঢেকে ছাদ থেকে দৌড় দিয়েছে।

চলবে,~