বিষ করেছি পান পর্ব-১৬+১৭

0
283

#বিষ_করেছি_পান(১৬)

(কপি করা নিষেধ)
বিয়ে উপলক্ষে ছুটি ঝিমা এক ড্রেস কিনেছে। মেজেন্টা কালার নেটের গাউনে সাদা সাদা ফুল করা। ঝিমাকে একদম বারবি ডল লাগছে। হা করে তাকিয়ে বিছানায় বসে ছুটি দেখে যাচ্ছে। তার হাত দুটো পেটের উপর চাপা দেওয়া। সকাল থেকে পেট ব্যথা শুরু হয়েছে। তারপর পাতলা পায়খানা। ঘন্টায় দুবার বাথরুম করছে। ঝিমা সেজেগুজে ছুটির দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে। ঝিমার ছুটির জন্য বেশ কষ্ট হচ্ছে। আশা ছিলো দুজনে একি ড্রেস পড়ে পরীর মতো সেজে বিয়েতে যাবে। লোকে ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এই অসুস্থতার জন্য আর তা সম্ভব হচ্ছেনা। রুম্পা ছুটিকে নিয়ে চিন্তা করছিলো। তারপর ছুটিই সমাধান করে দিয়েছে। সে বিয়েতে যাবেনা।রিতীর সাথে থেকে যাবে। আর সবাইকে যেতে বলেছে। রুম্পা মেয়েদের জন্য থেকে যেতে চেয়েছে। কিন্তু তার বান্ধবীরা ছাড়লে তো? রিতী ছুটিও বলেছে যেতে। বাড়িতে থাকছে শুধু রিতী আর ছুটি। আর এ বাড়িতে বীনা সহ মুরুব্বি কয়জন। বীনা রুম্পাকে বলেছে একটু পর পর গিয়ে মেয়েদের খবর নিয়ে আসবে। সেই ভরসাতেই রুম্পা রেডি হচ্ছে। তমাল বাচ্চাদের সাথে আগেই রেডি হয়ে নিচে গিয়ে খেলছে। রিতী জানালা দিয়ে একটু পর পর উকি দিচ্ছে। গাড়িতে যখন সবাই উঠবে তখন সে নিচে নেমে আসে। সবাই সুন্দর করে সেজে গুজে এসেছে। ছেলেমেয়েরা রিতীর দিকে তাকাচ্ছে আর চুক চুক করে আফসোস করছে। রিতী রাগ দেখিয়ে চোখ পাকাচ্ছে। ছুটি ঝিমার পিছু পিছু পেট ধরে হেঁটে হেঁটে আসছে। দুষ্টু গুলো ছুটিকে দেখে হেসে কুটি কুটি হয়ে যাচ্ছে। কাকীমনিরা ছুটিকে দেখে ইসস ইসসস করছে। ঝিমা মন খারাপ নিয়ে গাড়িতে উঠে। ছুটি জানালা দিয়ে বলে,
— ফোন সাথে রাখবি। আমি ভিডিও কল দিবো। পুরো বিয়েটা দেখাবি।
ঝিমা মাথা নাড়ায়। মৃদু হাসে। ছুটিকে ছাড়া ওর খালি খালি লগছিলো। এবার আর লাগবেনা। ফোনটাই সাথীকে জুটিয়ে দিবে।
— এই বাঁধন কোথায় রে? আমাদের বর?
— বন্ধুরা মিলে তো সাজাচ্ছে।
–আরে দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। যা যা ডেকে আন গিয়ে।
শিপ্রু দৌড় লাগায়। যাত্রীরা গাড়িতে উঠে অপেক্ষা করে। রুম্পার মন সায় দিচ্ছেনা। এক মেয়ের পেট খারাপ তো আরেক মেয়ের পরিক্ষা। অস্থির লাগছে। ছানোয়ার গাড়িতে উঠার আগে রিতীর হাতে এক প্যাকেট স্যালাইন আর ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়েছে। ঘন্টায় ঘন্টায় ছুটিকে স্যালাইন খাওয়ানোর জন্য পই পই করে বলে দিয়েছে। তমাল রতনের কোলে উঠে লাফাচ্ছে। মিনিট দশেক পর বাঁধনের বন্ধুরা বাঁধনকে নিয়ে আসে। বাঁধনের গাড়িতে শুধু সে আর তার বন্ধুরাই যাবে। বাঁধনকে সিংহাসনে বসা কোন রাজার মতো লাগছে। খয়ারী-কালো ডিজাইনার শেরোয়ানি মাথায় কালো পাগড়ীতে জামাই লুকটা একদম হৃদয়ে গিয়ে লাগছে। ছুটির অবাধ্য বড় বড় চোখ দুটো যতো দেখছে ততোই যেনো মরিয়া হয়ে উঠছে। একদম অবাধ্য একজোড়া চোখ। বেহায়া চোখ। সেই চোখের সামনে দিয়ে মুখে বাঁকা হাসিটা সঙ্গে করে বাঁধন গাড়িতে চাপে তার জীবনসঙ্গীনিকে বীর বেশে তুলে আনতে।

বরযাত্রী যাওয়ার পর পরই বীনা নরম ভাত আর পেঁপে সিদ্ধ ভর্তা দিয়ে যায় ছুটির জন্য। আর রিতীর জন্য গরুর খিচুড়ি ভোনা। ছুটি পেট থেকে হাত সরিয়ে সামনে থেকে ভাতের প্লেট ঠেলে দিয়ে খিচুড়ির প্লেটটা নিজের দিকে টেনে আনে। রিতী তা দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠে।
— এইই এই এই কি করছিস টাকি? তোর না পেট খারাপ? তেলমশলার খাবার একদমি খাওয়া যাবেনা।
— কার পেট খারাপ?
— মানে? তোর পেট খারাপ।
— কখন হলো?
ছুটির কথায় রিতীর মাথা ঘুরে গেলো।
— এইই পেট খারাপ জন্য ই তো তুই বিয়েতে গেলিনা।
— ওহ। ঐটা বাহানা ছিলো।
— মানে কি?
রিতী হা করে তাকিয়ে থাকলো। ছুটি মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে হাফ প্লেট খিচুড়ি খেয়ে নিলো। বাকিটা রিতীকে দিয়ে উঠে গেলো। রিতী পেছন থেকে বললো,
— এই তুই মিথ্যা বলে খিচুড়ি খেলি তাইনা? খিচুড়ি খাওয়ার জন্য তাইনা? এবার যদি বেশি পেট খারাপ করে?
ছুটির উত্তর পেলোনা। তাড়াতাড়ি খেয়ে একটা স্যালাইন বানিয়ে ছুটিকে গিয়ে দিলো। ছুটি স্যালাইন সামনে থেকে সরিয়ে মুচকি হাসলো। আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো,
— আপু কখনো দেখেছো সকাল থেকে আমার পেট খারাপ আর দুপুরেও আমি এতটা তরতাজা সুস্থ?
রিতীর টনক নড়ে। একদুবার বাথরুমে গেলেই ছুটি বিছানা নেয় আর আজ এতোবার যাওয়ার পরেও ছুটি এখনো কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে? রিতী কটমট করে রেগে বললো,
— এতো অভিনয়ের মানে কি?
— যেতে ইচ্ছে করলোনা। এতো গাদাগাদি! এমনিতেই অসুস্থ হয়ে যাবো। তাই একটু অভিনয়। তাছাড়া আমি কখনো দূর থেকে বিয়েতে এটেন্ড করিনি। আজকে দূর থেকে এটেন্ড করবো। নিউ এক্সপেরিয়েন্স। কি বলো?
রিতী কিছু বললোনা। ধপ ধপ পা ফেলে গিয়ে চেয়ারে বসলো। সামনে বই টেনে নিলো। ছুটি গিয়ে আলমারি থেকে সুন্দর একটা থ্রি পিচ বের করলো। লাল টকটকে থ্রী পিচ। রিতীর সামনে নিয়ে বললো,
— এটা পরে এটেন্ট করি। কি বলো আপু?
রিতী রাগ দেখিয়ে বললো,
— যা খুশি কর।
ছুটির কাজকর্ম বিরক্ত লাগছে তার। এর কথা বার্তা শুনে এখন যে কেউ বলবে মেয়েটা পাগল। রিতী জানে ছুটি পাগল নয়। মস্ত বড় বদমাশ আর দুষ্টু। যার হৃদয়টা আগা গোড়া পবিত্র।
ছুটি থ্রী পিচ পড়ে ওড়না গলায় ঝুলালো। টকটকে লাল লিপস্টিক দিলো। চুলগুলো সামনে পাম্প করে পেছনে বেনী করলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে যত্ন করে মেকাপ করলো। কানে লাল স্টোনের কাঁধ সমান দুল আর গলায় লাল ডাবল স্টোনের চোকার পড়লো। একদম বড়দের মতো লাগছে তাকে। রিতী একটু একটু পড়ছে আর ছুটির কাজকর্ম দেখছে আর বিরক্ত হচ্ছে। ছুটি এসে রিতীর সামনে দাঁড়ালো। এপাশ ওপাশ ঘুরে পোজ নিয়ে বললো,
— আপু দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে? সুন্দর?
রিতীর বিরক্তি যেনো আকাশ ছুলো। গজ গজ করতে করতে বললো,
— যতটা সময় যত্ন করে সাজলি তার অর্ধেক যদি পড়াশোনায় যত্ন নিতি তাহলে আর তোকে কোনদিন ফেল্টু খাতায় নাম তুলতে হতোনা।
— কে ফেল্টু ? ঐটাতো সামথিং মিস্টেক!
— ফাউল।
ছুটি ভেংচি কাটে। রিতীর ফোনটা বালিশের উপর রেখে অপেক্ষা করে।

বরযাত্রী কনের বাড়ি পৌঁছেছে বিকেল বেলাতেই। যাওয়ার পর পরই তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সবার পেটে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। আগে পেট ভরবে তারপর অন্য দিকে মন দিবে। অনেক গুলো আইটেম থাকা সত্ত্বেও ঝিমা প্রথমেই গরুর মাংস পাতে নেয়। এক আইটেম এই খাবার শেষ করে। তার খাওয়ার ধরন দেখে বুঝা যাচ্ছে তার বেশ তাড়া রয়েছে। কনের বাড়ির চেংড়া ছেলেগুলো নিয়েছে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ত্ব। দুটো ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে ঝিমার দুপাশে। একজনের হাতে ভাত আরেকজনের হাতে সবজি। ঝিমার খাবার অর্ধেক হতেই চামচে ভাত দিয়ে দিলো প্লেটে। ঝিমা হাত তুলে আর না আর না বলে উঠলো। পাশের ছেলেটা সবজি ও দিলো। আরেক চামচ তুলে বলে,
— বেইনী একটু দেই?
ঝিমা শুকনো হেসে বলে,
— না না বেয়াই দেয়া লাগবেনা। থাক থাক।
— আপনি তো আর কিছুই নিলেন না। রোস্ট আনি? আরেকটু দেই?
— না না। খাওয়া শেষ আমার প্রায়।
একজনকে হাক দিয়ে বলে,
— ঐ দই আন।বেইনীর খাওয়া শেষ।
বলতে না বলতেই দই নিয়ে হাজির। ভাতের উপরেই দই ঢেলে দিলো। আবার ঝিমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— বেইনী একটু দেই?
ঝিমার খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে বলে বেইনী একটু দেই? হলুদ ভাতের উপর ঘিয়া রংয়ের পানি ছাড়া দই দেখে ঝিমার বমি আসতে লাগলো। তার খাওয়া সেখানেই শেষ হলো। প্লেট এগিয়ে দিয়ে দাতে দাঁত চেপে বললো,
— আমি বলছি আপনাদের দিতে? দিলেন তো আমার খাবার টা ঘেঁটে? এবার আপনারাই খান।
— আরে আরে বেইনী খাবেন না কেনো? ভালো লাগছে না? কি খাবেন বলুন। এক্ষুনি আনছি। বেইনী রাগবেন না বসুন। স্পেশাল চিকেন রেজালা হয়েছে। বেইনী একটু দেই?
ঝিমা সাথে সাথে চেয়ার ছাড়ে। রাগী লুক দিয়ে সেখান থেকে গট গট করে চলে যায়। পেছনে আরো দুজন যুক্ত হয়ে ভেঙাতে থাকে,বেইনী একটু দেই? বলেই খিকখিক করে হাসতে থাকে।

ঝিমার কানে হাসির শব্দ পৌঁছাতেই আরো জোরে পা চালায়। মনে মনে বিরবির করতে থাকে,
— বাদরগুলো বান্দরগিরী শুরু করেছে। সুন্দর মেয়ে দেখলেই খিক খিক করতে থাকে। আজ যদি ছুটি থাকতো না? তোদের খিকখিক বের করতো। ছুটির কথা মনে পড়তেই ঝিমা ফোন বের করে। ছুটি লাইনেই আছে। মনে হয় অপেক্ষা করছে। ঝিমা ফট করে ভিডিও কল দেয়। দুই সেকেন্ড ও দেড়ি হয়না ফোন তুলতে। ছুটির হাসিমুখ খানা দেখে মেজাজ ভালো হয়ে যায়। দু চোখের ভ্রু উচিয়ে বলে,
— বাহবা কি সুন্দর লাগছে তোকে। এতো সেজেছিস কেনো হুম?
— বিয়ে বাড়ি সাজবোনা?
— ফ্রকটা পড়তি।
— এটাই পড়লাম। আশেপাশে দেখা। বিয়ে হয়ে গেছে?
— দূর… সে অনেক দেরি আছে। তোকে দেখাচ্ছি দারা। এখানে কিভাবে ডেকোরেশন করেছে।
ঝিমা ছুটিকে দেখাতে থাকে। বাড়ির এ মাথা থেকে ওমাথা। ছেলে গুলোকে দেখিয়ে দেয়। ঝিমার সাথে ফাজলামি করতে এসেছিলো বলে। ছুটি বলে,
— মাথা ফাটিয়ে দিতে পারলিনা?
— বিয়ে বাড়ি ঝামেলা করবো নাকি?
— আমার সাথে ই থাক।
— আহা! মনে হচ্ছে তুই এসেছিস আমার সাথে।
— তোর কাছে এলে আমাকে দেখিয়ে দিবি। যে সেজেছিনা… তোকে রেখে আমার পিছে লাগবে। আমি তো বাবু ছুটি পাখি। বেচারা আঙুল চুষে খাবে। হি হি হি।

ছুটি ভারি জালাচ্ছে রিতীকে। বার বার ঝামা টেনে টুনে বলছে,
— আপু দেখোনা… আপু এই দেখো ওদের বাড়ি। আবার টেনে বলছে, আপু দেখো এবার বউ আসবে পার্লার থেকে। আপু বউয়ের সাঝটা সুন্দর হয়নি। এর থেকে আমি ভালো ভাবে সাজাতে পারি। আপু আমার না এরকম বউ সেজে বিয়ে করার খুব ইচ্ছে ছিলো।
রিতী চোখ রাঙাচ্ছে ছুটিকে। ছুটি তবুও একটু পর পর রিতীকে ডিস্টার্ব করছে। এবার ধমকে বলে,
— পড়তে দিবি তুই আমাকে? যা তো অন্য ঘরে। আমাকে পড়তে দে।
— তুমি পড়ছোনা আপু। তোমার হাতে ফোন।
— আমার হাতে ফোন মানে এইনা যে আমি ফোন চাপছি।
— চিন্তা তো করছো।
— ছুটি…
রিতী হাত থেকে ফোন রেখে দেয়। সত্যি সে চিন্তা করছিলো। কারন ফোনে বারবার আননোন নাম্বার সো করছিলো। রিতী জনে এটা কে ফোন দিচ্ছে। তারমানে এই না যে সে পড়ছেনা। মনোযোগ দিয়ে হয়তো পড়তে পারছেনা কিন্তু অমনোযোগী হয়ে ঠিকই গুনগুনিয়ে পড়ে যাচ্ছে। পরিক্ষা কালকে তাই পড়তে বাধ্য সে।

— আপু দেখো ওরা মনে হয় বাঁধন ভাইয়ের জুতো চুরি করেছে।
— এই তুই চুপ যাবি? আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ যা।
রিতীর আর পড়া হয়না। ফোনটা আপনা আপনি ঠিকই হাতে চলে আসে। বুদ বুদ আওয়াজ হচ্ছে। ছুটিও চুপ হয়ে গেছে। এবার আর সে জালাচ্ছে না। বালিশ ছেড়ে টেবিলে পিঠ ঠেকিয়ে রিতীর বিপরীতে মুখ ফিরিয়ে বসেছে। ছুটির মাথার পাশ থেকে রিতীর সরাসরি ফোনটা দেখা যাচ্ছে। রিতী আনমনে আননোন নাম্বারটি বার বার উচ্চারন করছে। সোহাগের ধ্যানে চলে গেছে। ফর্সা চাপদাড়ি ওয়ালা মুখখানা মুখের সামনে ভেসে আসছে। রিতীকে ব্যথা দেওয়ার দৃশ্য গুলো মনে পড়ছে। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে ভাবনাতেই অসহ্য হয়ে উঠছে। কবে এই ছেলে পিছু ছাড়বে? কবে? লজ্জা নেই এতো বলার পরেও ফোন দিয়ে যাচ্ছে। রিতীর দিকে খারাপ চোখে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে রিতীর ভয় হয় ক্ষতি না করে দেয়। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো ঠিকই করে দিবে। কি করবে রিতী? কি করবে? কে তাকে রক্ষা করবে? কে?

— আপু জানো এবার না বিয়ে পড়ানো হবে।

ছুটির কাঁপা গলার আওয়াজ শুনে রিতীর ফোনের দিকে নজর যায়। মাঝখান রজনীগন্ধার দেয়াল এক পাশে বাঁধন ভাই আরেক পাশে সুমি ভাবী বসেছে। কি সুন্দর লাগছে দুজনকে! বাঁধন ভাই যেমন সুপুরুষ সুমী ভাবীও তেমনি সুন্দরী সুকন্যা। লাল বেনারসী জুড়ে আছে তার আগাগোড়া। বিয়ে প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে সপ্ন। আর এই লাল বেনারসী স্থাপন করে তার অস্তিত্ব। রিতীর চোখেও এ সপ্ন দেখা দেয়। রাতের অন্ধকারে নয় ফকফকা দিনের আলোতে। লাল বেনারসী, সর্বাঙ্গে গহনা, গাঢ় সাজ, খোঁপায় বেলীর মালা…. হবে কি সপ্ন পূরণ? এড়াতে পারবে কি সমস্ত বাঁধা?

— আপুউউ বাঁধনননন ভাই এবার কবুলল বলল বেহ ।
ছুটির কাঁপা গলার আওয়াজে রিতীর ভাবনা ঢাকা পড়ে। রিতী দেখে ছুটি হালকা কাঁপছে। কিশোরী মনে এই মহেন্দ্রক্ষন আলাদা প্রভাব ফেলে। রিতীও অভিভূত হয়েছে ক্ষনে ক্ষনে। কী যে অস্থিরতা কী যে নিরবতা কী যে আকুলতায় মনে প্রাণে কালবৈশাখীর ঝড় নাম! রিতী অভিনব হাসি দিয়ে দু হাত পেছন থেকে ছুটির কাঁধে রাখে। ছুটির কাঁপন বন্ধ হয়ে যায়। সোহাগ বার বার ফোন দিচ্ছে।সেদিকে একবার তাকিয়ে ভেংচি কেটে ফোনের উপর মনোযোগ দেয়। কাজী বিয়ে পড়াচ্ছে। দশলক্ষ এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া আসাদুজ্জামান আকন্দ সাহেবের একমাত্র পুত্র মোঃ বাঁধন আকন্দের সহিত বিবাহে আপনি রাজী থাকলে বলুন কবুল। সুমি মিনিট খানেক সময় নিয়ে বলে,’ কবুল, কবুল, কবুল। ‘ ছুটি মুখে আওরায় কবুল, কবুল, কবুল । রিতী মুচকি হাসে। তারপর বাঁধনকে কবুল বলতে বলে। বাঁধন স্পষ্ট গলায় বলে কবুল, কবুল, কবুল। সবাই বলে আলহামদুলিল্লাহ। রিতীও বলে উঠে আলহামদুলিল্লাহ। ছুটি আরেকবার কেঁপে উঠে। সবাই মোনাজাত ধরে। এদিকে রিতীও মোনাজাত ধরে। বাঁধনের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করে। ছুটির হাতে ফোন। টেবিলে আবার ভুদ করে উঠলে রিতী ফোনটা তুলে। ঘর ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বিরক্তি নিয়ে ফোন তুলে।
— কি হলো এতোবার ফোন দেন কেনো? জানেন না ফোন তুলবোনা?
ওপাশ থেকে কোন শব্দ আসেনা। রিতী আরো রেগে যায়। ফোনটা সুইচ স্টপ করে বিরবির করতে করতে ঘরে চলে আসে। বাটন ফোনটা থেকে সিম খুলতে খুলতে বলে,
— ছুটি এন্ডোয়েড টা দে তো।
ছুটি দেয় না। রিতী বিরক্তি নিয়ে নিজেই ফোন নিতে যায়। ফোনটা নেবার জন্য হাত বাড়ায়। ফোনের দিকে চোখ পড়তেই হাত থেমে যায়। ছুটি…….. বলে বিভৎস চিৎকার দিয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। কালচে স্কিনে স্পষ্ট দেখতে পায় পতিত হচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা লাল রক্ত । যার উৎস তার আদরের ছোট বোনটার টানা টানা চোখ দুটো।

চলবে,

#বিষ_করেছি_পান(১৭)

(কপি করা নিষেধ)
— এই ছুটি কি করলি তুই? আল্লাহ এটা তুই কি করলি? জলদি হসপিটালে চল। চল আমার সাথে। চোখ দুইটা নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ কত রক্ত! বন্ধ হয়না কেনো? মা বাবাকে আমি কি জবাব দিবো? কি বলবো আমি? আমার সামনে বসে চোখ দুইটা নষ্ট করছে। এই ছুটি? ছুটি? কথা বল?উঠ। ছুটি। ছুটি…….

রিতীর চিৎকারে ছুটি হালকা কেঁপে উঠে। চোখ দিয়ে তার ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত বেরোচ্ছে। রিতী বার বার উড়না দিয়ে মুছে দিচ্ছে। ক্ষনিকের মাঝে আবার জড়ো হচ্ছে। রিতী হাউমাউ করে কাঁদতে বসেছে। ছুটিকে ধাক্কাচ্ছে রেসপন্স পাবার জন্যে। ছুটি কোন রেসপন্স দিচ্ছে না। রিতী ছুটিকে ছেড়ে ফ্লোরে মাথা চেপে বসে পড়েছে। কেঁদে কেঁটে আবার গিয়ে রিতীকে ধরে বিলাপ করছে। অনেক ক্ষন রিতীর কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ছুটি শুকনো হাসে। ধীরে ধীরে বলে,
— কানদুটোও নষ্ট করে দেওয়া উচিত তাইনা? কিছু শুনবোনা। কিছু দেখবোনা। কিছু জ্বলবেও না।
— কি বলিশ এগুলা? পাগল হলি নাকি? আমার তোকে সুবিধার লাগছে না। আমি বীনা কাকিকে ডেকে আনি।
রিতী দৌড় লাগায়। দরজা অব্দি যেতেই ছুটি বলে উঠে,
— বাঁধন ভাই কেনো বিয়ে করবে? যদি বিয়েই করবে তাহলে আমাকে ছেড়েই কেনো বিয়ে করবে? আপু?এখন আমার কি হবে?
রিতীর পা আটকে গেছে। দেয়ালের সাথে পিঠ লেগে গেছে। হা করে ছুটির দিকে তাকিয়ে আছে। বাঁধন ভাই বিয়ে করবে! এখানে ছুটি কি করবে? ছুটির কি হবে মানে? বাঁধন ভাইয়ের বিয়ে তো ছুটি কেনো নিজের চোখ নষ্ট করবে?কেনো কান নষ্ট করতে চাইবে?তার মানে কি ছুটি বাঁধন ভাইকে…?এতো উচ্ছাস এতো আনন্দ সব লোক দেখানো? এর জন্য কি বিয়েতে গেলো না? কিশোরী মনে এতো বড় এক অস্বাভাবিক চাওয়া দিনের পর দিন বৃহদাকার ধারন করেছে একসাথে থেকে বড় বোন হয়েও জানতে পারলো না? রিতী শুকনো ঢুক গিলে। গলা শুকিয়ে গেছে। মাথাটা মনে হয় দুবার চক্কর দিয়ে ফেলেছে। থপ থপ পা ফেলে ছুটির সামনে আসে। চোখ বুজে থাকা ছুটিকে অবাক স্বরে ডাকে, — ছুটি?
ছুটি তৎক্ষণাৎ রিতীর বুকে হামলে পড়ে। ফুফাতে ফুফাতে চিৎকার করতে থাকে,– বাঁধন ভাই কেনো বিয়ে করবে? ছুটির কি হবে? ছুটির কথা কেনো ভাববে না? ছুটি মরে যাবে। এবার ছুটি মরে যাবে। চোখের সামনে বউ নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকবে। বেস্ট কাপল হবে ছুটি দেখবেনা। ছুটি শুনবে না। ছুটি কিছুতেই সহ্য করতে পারবেনা। আপু আমার বুকটা জ্বলে যাচ্ছে আপু।
ছুটি ছুটতে চেষ্টা করে রিতী আরো জোরে চেপে ধরে। কাপা ঠোঁটে বলে,
— এ তুই কি করলি ছুটি? তুই তো অনেক দূর!বাঁধন ভাই যে আমার জন্যেও বেমানান!
দুই বোনে একসাথে চোখের জ্বল ফেলতে থাকে। ছুটির গা ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে। উষ্ণতায় রিতীর দেহও গরম হয়ে আসছে। ছুটি হাউমাউ করে বলছে,
— আল্লাহ তুমি আমাকে তুলে নাও। আমি সহ্য করতে পারবোনা। বাঁধন ভাইকে অন্য কারো সাথে আমি সহ্য করতে পারবোনা। আর পারছিনা।
রিতী ছুটিকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ছুটির শরীর ব্যালেন্স করছেনা। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— আবেগের বসে ভূল করিসনা। বাঁধন ভাই তোর জন্য না। চুপ কর প্লিজ। বাবা মার সম্মানের দিকে তাকিয়ে সহ্য করে যা।
— আবেগে এতো কষ্ট কেনো আপু? আবেগে তো কষ্ট থাকে না। আমার তো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আপু। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। আপু প্লিজ আমাকে মেরে ফেল না… ।
বলতে বলতেই রিতী খেয়াল করে ছুটি কাঁপছে। হাত পায়ে খিঁচুনি উঠেছে। রিতী কি করবে ভেবে পায়না। দৌড়ে গিয়ে ফোন হাতে নেয়। অনেক গুলো মিসকলড। পুরোপুরি এভোয়েড করে রিতী মায়ের ফোনে কল দেয়। একবার দুইবার তিনবারেও যখন কল না ধরে তখন ছুটির দিক তাকিয়ে রিতী কান্না কম বেশি চিল্লাতে থাকে। আবার বাইরে শোনা যাবে ভেবে মুখ চেপে ধরে। বীনা কাকিকে কিছুতেই এদিকে পা দেওয়ানো যাবেনা। সব শেষ হয়ে যাবে। রিতী পাগলের মতো মা বাবার ফোনে কল দিতে থাকে । সাতবারের মাথায় বীনা কল ধরে রিতী কিছু বলার আগেই ভগ্নস্বরে বলে,
— রিতীরে বাঁধন টা মনে হয় বাঁচবে নারে । ফেরার সময় ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছে। মায়ের বুকটা মনে হয় খালি হলোরে। তোর কাকীকে কিছু জানাসনারে।

রিতীর দুনিয়া থেমে গেছে। একবার এটাও জিজ্ঞেস করতে পারলোনা মা বাবা তমাল তোমরা ঠিক আছো কিনা?ফোনটা হাত থেকে পায়ের উপর পড়ে গেছে। নিজেও শরীরটা ধরে রাখতে পারেনা। মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে। এভাবে কত সময় গেছে জানেনা। চোখের সামনেই ছুটির খিঁচুনি ইতি টেনেছে। ছুটি জ্ঞান হারিয়েছে। এদিকে রিতী হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। যখন একটু একটু হুস আসে তখন বিরবিরিয়ে বলে, — তোর দোয়া মনে হয় কবুল হলোরে ছুটি। যা দেখতে চাসনি তা দেখতে হবেনা। কিন্তু যা দেখবি সহ্য করতে পারবিতো?
রিতীর মনে পড়ে ছুটির চোখের কথা। ছুটির দিকে তাকিয়েই ফোনটা হাতিয়ে নেয়। সোহাগের আরেকটা নতুন নাম্বার! আগের টা সন্ধ্যায় ব্রাকলিস্টে রেখেছে। আত্ত্বীয় ব্যতীত একমাত্র সোহাগ ই আছে। সাত পাঁচ না ভেবে রিতী ডায়াল করে। প্রথমবারেই রিসিভ হয়। প্রথমেই সোহাগের ব্যঙক্তি !
— কী পিরিতি! খুব তো ভাব দেখাও। রাত বাড়লেই কথা বলতে ইচ্ছে করে বুঝি?
— সোহাগ ভাই! বাড়িতে আসেন।
— বাড়িতেই তো যাইতেছি। বাইকের সাউন্ড পাওনা পিরীতি।
— আমার বাড়িতে আসেন।
— বাড়িতে কেউ নেই বুঝি?
— নাহ।
রীতীর নির্লিপ্ত গলা।
— এতো মেঘ না চাইতেই জল! ওকে ডার্লিং আম কামিং। সারারাত মাস্তি হবে!

সোহাগ যখন আসে তখন বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে আসে। মুখে দুষ্টু হাসি লেগে আছে। মনে মনে কি কি করবে সেসব ভাবতে থাকে। এতোদিনের আকাঙ্খিত বস্তু হাতে পেতে চলছে।কল্পনায় আকাশে ডানা মেলছে। রিতীর অশ্রু ভেজা চোখ দেখে ঠেস দিয়ে বলে,
— নিজের জ্বালা মেটানোর জন্য বাসায় ডাকবে আবার চোখের জ্বলেও ভাসবে। ওয়েট পিরীতি। তোমার যদি এই ধরনের কোন ইন্টেসি থাকে যে আমি তোমাকে যেনো আর না জ্বালাই সেজন্য বাসায় ডেকে পুলিশে ধরিয়ে দিবে তাহলে এটা তোমার বোকামী। তুমি হয়তো জানো আমি কার ছেলে? আমার আব্বা বাংলাদেশের সব এমপি মন্ত্রী দের সাথে উঠবস করে।

কি খারাপ কথা ! তবুও কত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বলছে। কথা খারাপ হোক বা ভালো। ব্যাক্তিত্বের সাথে নিজের নোংরা মনকে কত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে কত স্টেট ভাবে! সোহাগকে না দেখলে রিতী জানতেই পারতো না।একহাত পকেটে হাত গুঁজে আরেকহাতে জলন্ত সিগারেট নিয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলছে। ইস্ত্রি করা শার্টের বোতাম পর পর তিনটি খোলা রয়েছে। লোমশ বুকটা অর্ধেক ই শো করছে। রিতী চোখ বুজে সোহাগকে সহ্য করে নেয়। ‘আসুন’ বলে সিড়ি বেয়ে ছুটির কাছে যায়। সোহাগ দেখে ছুটি বিছানায় শুয়ে আছে। গায়ে মোটা কম্বল চেপে দিয়েছে। চোখের সাইডটা ফুলে রয়েছে।শুকনো রক্ত চটচট করে। সোহাগ ধপ ধপ পা ফেলে ছুটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আতঙ্কিত হয়ে বলে,
— ছুটির কি হয়েছে?
— ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান সোহাগ ভাই। আমি একা পারলামনা।
সোহাগ ছুটির হাত ধরতেই ছেড়ে দেয়। অস্বাভাবিক গরম। এরকম টেম্পারেচার যে ধরাই যাচ্ছে না। একবার রিতীর দিকে তাকিয়েই ছুটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
— আসো।

ভাগ্যক্রমে আজ সোহাগ তার বাইক ছেড়ে গাড়িটা নিয়ে এসেছে। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা আঠারো। সোহাগ ছুটিকে নিয়ে ইমারজেন্সি তে ভর্তি করেছে। এটা ওটা দৌড়াদৌড়ি সে নিজেই করছে। রিতী ছুটির পাশে বসে আছে। ছুটিকে জর কমার ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। চোখ দুটো ওয়াশ করছে। সোহাগ ব্যস্ত গলায় বলে,
— ডক্তর? চোখের আঘাতটা কতটুকু হয়েছে?
— এতোক্ষন রক্ত পড়েছে বুঝে নিন কতোটা হয়েছে? ভাগ্য ভালো চোখ দুটো বেঁচে গেছে।বেশীরভাগ সময় চোখ বন্ধ রাখতে হবে। ড্রপ লিখে দিচ্ছি টানা পনের দিন তিনবেলা দিবেন ঠিক হয়ে যাবে।
রিতী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সোহাগের দিকে তাকায়। সোহাগকে ছুটির বড় ভাই মনে হচ্ছে। ভাই যেমন বোনের কিছুতে অস্থির হয়ে উঠে সব এক করে ফেলে সোহাগ ঠিক তাই তাই করছে। এতো রাতে ডক্টর ডেকে এনে ছয়তলায় ছুটিছুটি করে সত্যিই হাঁপিয়ে গেছে। রিতীর ছুটির একটা কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন ছুটি বলেছিলো রিতীকে।
“শোনো আপু যে ব্যক্তি আমাকে একদমি সহ্য করতে পারেনা তার কাছে আমি আমার বোন দিবোনা। আমার বোনকে তার কাছে দিবো যার কাছে আমার বোনের পর পরই আমার প্রায়রিটি থাকবে। ”
আচ্ছা সোহাগের কাছে কি রিতীর প্রায়রিটি আছে? নাকি তাকে শুধুমাত্র ফ্যান্টাসিই মনে করে? বেচারা কি করতে এসেছিল আর কি করছে! মনে মনে রিতী প্রমোদ গুনে।

চলবে,