বিষ করেছি পান পর্ব-৭+৮

0
246

#বিষ_করেছি_পান(৭)

(কপি করা নিষেধ)
সবাই বাসে উঠলো। এত্তো মানুষ!ছুটিদের সিট ছাড়া কোন সিট ই খালি নেই। অথচ বাস এসে থেমেছে দু মিনিট হলো। বাঁধন সবাইকে আরামছে বসিয়ে দিলো। ইয়াং বড় ছেলে থাকলে দায়িত্ব সব তাকেই নিতে হয়। ছুটির পাশের জানালার সাইডে একটা মেয়ে বসেছে। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিব্যি গান শুনছে। ছুটির দমবন্ধ লাগছে। বাসটা ছাড়েও না। জানালার ধারের সিট ছাড়া ছুটি একদমি বসতে পারেনা। বাধ্য হয়ে ছুটি মেয়েটাকে ডাকলো। কিন্তু আশানুরূপ কোন সাড়া পেলো না। একচোখ খুলে কটকটে গলায় বলল,
— কি প্রব্লেম? যত্তসব!
ছুটি হতভম্ব। দুবার নয় ডাক ই দিয়েছে তাতেই যত্তসব হয়ে গেলো? এটা মেয়ে নাকি দাজ্জাল দাদীমা! বাস যেন আজ ছাড়বেই না। ভিতরের পরিবেশ দেখতেই ছুটির মাথা ব্যথা শুরু হলো। কয়েকজন হাঁসমুরগির খাঁচা নিয়ে বসেছে মাঝখানের হাঁটা চলার রাস্তায়। নিচে বসলে মনে হয় ভাড়াটা একটু কম দিতে হয়। রিতীর চোখে চোখ পড়লো। রিতী ভ্রু নাড়াতেই ছুটি মাথা নাড়িয়ে কিছুনা বুঝালো। রিতী তবুও বুঝে গেলো। হাত তুলে বললো,
— একটু ম্যানেজ করে নে।
ছুটি চোখ রাঙালো।
— পারলে তুমি উঠে আসো।
রিতী উঠলোনা। সে উঠবে না ছুটি ভালো করেই জানে। এইযে বাস ছাড়বে .. জানালা দিয়ে হাওয়া আসবে তারপর বাবার কাঁধে মাথা রেখে রিতী আরামছে ঘুমিয়ে পড়বে। যদি তাকে এই সুবিধা টুকু না দেওয়া হয় তাহলে সারা রাস্তা বমি করতে করতে পুরো বাস নোংরা করবে। বাস জার্নি এর জন্য রিতীর বড্ড খারাপ লাগে। ছুটি হাঁসফাঁস করতে লাগলো।ড্রাইভারের পাশে দুটো সিট ফাঁকা দেখা গেলো। ওখানে বসলেও তো জানালাটা খুলা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ছুটি উঠে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে জানালার ধারে বসলো। জানালাটা খুলে দিতেই শরীর জুড়ে ঠান্ডা হাওয়া বইয়ে দিলো। বিষয়টা প্রত্যেকেই খেয়াল করলো। ছানোয়ার বলে উঠলো,
— ছুটি ওখানে গিয়েছো কেনো? সিটে এসে বসো।
— এখানে বাতাস বাবা।
— এইতো কিছুক্ষন। বাস ছেড়ে দিবে। নিজের সিটে এসে বসো।
ছুটি এলোনা। চুপ করে সেখানেই বসে রইলো। বীনা ঘাড় ঘুরিয়ে কানে হেডফোন গুঁজা মেয়েটিকে বললো,
— আপনি একটু জানালার পাশে বসতে দিননা ছুটিকে। মেয়েটা জানালার পাশে ছাড়া বসতে পারেনা।
মেয়েটা মুচকি হাসলো। বাহ! কি সুন্দর হাসি! এক হাসিতেই বীনার মন ভালো হয়ে গেলো। মেয়েটা মিস্টি কন্ঠে বললো,
— একচুয়েলি আন্টি আমিও জানালার পাশ ছাড়া বসতে পারিনা।
— ওহ আচ্ছা।
বাঁধন ছুটিকে একবার দেখলো। জানালার বাইরে মুখ দিয়ে বাইরের মানুষ দেখতে ব্যস্ত। বাঁধন জোরে নাক টানলো। ফোনটা পকেটে ডুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
— মা। তুমি এপাশটায় এসে বসো। ছুটিকে ওপাশটায় বসতে দাও। আমি ছুটির সিটে গিয়ে বসছি।
বীনা সাথে সাথে আপত্তি করে বসলো।
— না না তোর যেতে হবেনা। তুই এক কাজ কর বুঝলি?
— কি করবো?
বীনা এদিক সেদিক তাকালো। কী একটা ভাবলো। তারপর বললো,
— আমিই পেছনে যাচ্ছি। তুই বোস।
— তুমি কেনো উঠবে? আমিই যাচ্ছি। তুমি বসো।
— আমি গেলে কি সমস্যা?
— আরে আমি গেলেই কি সমস্যা? এই ছুটি এদিকে আয়।
বাঁধন বলতে বলতেই উঁকি দিলো । ছুটির সীটের পাশে ফর্সা সুন্দর গড়নের একটা মিস্টি মেয়ে বসে আছে। লম্বা চুল গুলো ব্রাউন কালার করাতে বডির সাথে গর্জিয়াস লাগছে। মুখে সুন্দর করে মেকাব দেওয়া। বাঁধনের মনে হলো ছোট খাটো এক হার্টবিট মিস করলো। এর জন্যই যে মা সেখানে যেতে দিচ্ছেনা সেটা বেশ বুঝতে পারছে। ইতোমধ্যে বীনাও সিট ছেড়ে নেমে গেছে। দেখতে দেখতেই মেয়েটার পাশে গিয়ে বসেও পড়েছে। মাকে মেয়েটার পাশে দেখে বাঁধনের যেনো হুস ফিরলো।
— এই ছুটি এদিকে আয়।
বলেই ডেকে উঠলো। ছুটি বসেই জানালাটা বড় করে খুলে দিলো। চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। বাস ছেড়ে দিলো। এখানে হাঁসের প্যাক প্যাক শব্দটা অতোটা আসছে না। যা আসছে সব বাঁধনের শার্টে লাগানো পারফিউমের স্মেল আর বাস চলার শব্দ। ছুটির ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে। বাঁধন ছুটিকে এভাবে শ্বাস নিতে আর ছাড়তে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— বেশী খারাপ লাগছে?
ছুটি মুচকি হাসলো। চোখ দুটো বন্ধ করে বললো,
— ভীষণ খারাপ লাগছে।
বাঁধন নড়ে চড়ে বসলো। ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— এরপর আর তোদের নিয়ে বাসে জার্নি করা যাবেনা বুঝছিস? ট্রেইনে যাতায়াত করতে হবে।
— শেরপুরে রেইল স্ট্রেশন পাবে কই?
— এখনো হয়নি না? তাহলে প্রাইভেট কারে করে যেতে হবে।
— প্রাইভেট কারে ফেমেলির সাথে যাওয়া আরো প্যারা বাঁধন ভাই। সবাই গাদা গাদা! একজনের উপর আরেকজন।
— ঐ একটু হয়েই থাকে। আরাম করে বসলেই হলো। ফেমেলি মেম্বারস ছাড়া কি আর ভালোলাগে?
— আমরা কি প্রাইভেট কার করে বউ আনতে যাবো বাঁধন ভাই?
— না । হাইস করে যাবো। তোর যদি বেশি খারাপ লাগে কাঁধে মাথা রাখ। একটা ঘুম দে দেখবি পৌঁছে গেছিস।
— ঠিক আছি।
ছুটি বাইরের দিকে মুখ রাখে। সে যদি ঘুমোয় তাহলে শুনশান মায়াময় রাস্তাগুলো দেখবে কে? একটু পর পর বাঁধন উঁকি দিচ্ছে। মাকে জিজ্ঞেস করছে — ঠিক আছো? বীনার মুখে স্পষ্ট হাসি। সুন্দরী মেয়েটার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে তার। ছুটি ডেকে উঠে,
— বাঁধন ভাই?
— বল? মাথা ব্যথা করছে?
— হুম। কাকীমনির পাশে দেখো মেয়েটা বসেছে।
— হুম। কি হয়েছে?
— আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।
— কেনো?
— আমি একটু দুবার আপু আপু বলে ডেকেছিলাম যাতে তার সিটটা আমাকে দেয়। কিছু না বলতেই এমন ধমক দিয়েছে যে আমার কান্না চলে আসছিলো। বড্ড কর্কশ গলায় কথা বলে। আমাকে বলে,কি প্রব্লেম?যত্তসব!
বাঁধন ভ্রু কুঁচকে ফেলে। মাথা নিচু করে এনে বলে,
— এর জন্যই উঠে গিয়েছিলি ঐখানে?
— হুম।
— আগে বলবিনা? কার কি প্রব্লেম দেখে নিতাম। ছোট বাচ্চাদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ডিঙ্গি মেয়ে হয়েও জানেনা।
ছুটি মুচকি হাসে। বাঁধনের কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে মনে মনে স্বগোক্তি করে,
— ছুটি আর ছোট নেই বাঁধন ভাই। আপনার কোলে হাসতে খেলতেই বড় হয়ে গেলাম। আপনার চোখেই পড়লোনা। কোন দিনই কি পড়বেনা?
প্রশ্নটা থেকেই যায়। বাঁধন আদরে ছুটির মাথাটা ভালোভাবে কাঁধে বসিয়ে নেয়। একহাতে ছুটির কাধ চেপে বলে,
— এবার ঘুমা।

একতলা বিশালাকার বাড়ি। এ বাড়িতে বড় মানুষ কম বাচ্চাই বেশি। পুচকে গুলো সব বাঁধনের কোলে উঠে বসেছে। কেউ কেউ হাত ঝুলছে। কেউ কেউ আবার গলা ধরে ঝুলছে।আর একটু বড়রা বাঁধনকে ঘিরে ধরেছে। ঝিমাকে দেখেই মেয়েগুলো বাঁধন কে ছেড়ে দিলো। ঝিমার সাথে ছুটিকে দেখে আরো হৈ হৈ করে উঠলো। ঝিমা রিতী ছুটি বসার রুমে বসেই ঝিমার কাজিন গুলোর সাথে এ গল্প ও গল্প করতে লাগলো। সকাল হয়ে গেলো সেখানে বসেই। ফজরের আযানের সাথে সাথে নামাজ পড়তে গেলো সবাই। এ বাড়িতে ছোট বড় সবাই নামাজ পড়ে। নামাজের আলাদা ঘর ও রয়েছে। মনে হয় এক টুকরো মসজিদ। নামাজ শেষে ঘন্টা দুই তিনেক সবাই ঘুমোলো। লেবু মামার দেখা নেই। তাকে খুজতে খুঁজতেই বাঁধন মেয়েদের রুমে এসে ঢুকলো । ঝিমা বসে বসে ঝিমুচ্ছে। বাঁধন ঝিমাকে বললো,
— শুয়ে শুয়ে ঘুমা। বসে বসে ঝিমুনোর কি মানে? যে গাদাগাদি! একটার উপর আরেকটা টাস করে পড়বি আর মাথা ফাটাবি।
ঝিমা ছুটিকে ধাক্কাতে লাগলো।
— ঐ ছুটি সর। সর শুইতে দে।
ছুটির কোন হেল দোল নেই। টিপ শুনতে পেয়ে একটু জায়গা করে দিলো। ঝিমা সেখানেই শরীরটা ছেড়ে দিলো। মাথাটা গিয়ে লাগলো ছুটির মাথায়। সাথে সাথেই ছুটি চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। ও বাবা গো!ও মাগো! বলতে বলতেই কপাল সহ মাথা ঘসতে লাগলো। সবটাই বাঁধনের চোখের সামনে ঘটলো। তমাল হুট করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। ড্রয়িং রুমে যেতে যেতে চিৎকার করতে লাগলো — ও বাবা গো! ও মাগো! ছোটাপু দুইসিডেন্ট করলো ।ও বাবা গো! ও মাগো! ছোটাপু দুইসিডেন্ট করলো ।

চলবে,

#বিষ_করেছি_পান(৮)

(কপি করা নিষেধ)
ছুটির মাথায় কপালের উপর ওয়ান টাইম লাগানো। খুব একটা আঘাত পায়নি। ঝিমার হেয়াল ক্লিপ লেগেই এই অকান্ড ঘটেছে। এতোক্ষন বেশ জ্বলছিলো। তবে এখন ঠান্ডা লাগছে। ফার্মিশিতে দাঁড়িয়েই বাঁধন তাড়া দিলো,
— এই ছুটি চল চল। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।
— একটু দাঁড়াও।
ছুটি ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয়। বাঁধন বিল পে করে এগিয়ে এসে ছুটির হাত ধরে বেরিয়ে আসে। ছুটির চোখে পড়ে রাস্তার মাঝের ইয়া বড় এক আনারসের ভাস্কর্য। ছুটিকে যে মধুপুরের সেই আনারস চত্ত্বরে আনা হয়েছে আসার সময় মাথার ব্যথায় খেয়াল ই করেনি। ছুটি এদিক সেদিক মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে।
— কি খুজছিস?
বাঁধনের কথায় ছুটি থমকে দাঁড়ায়। বাঁধন টেনে ছুটিকে এক সাইডে নিয়ে যায় ।
— রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো? সাইডে আয়। এবার বল কি খুজছিস?
— স্পঞ্জের মিস্টি।
— রাস্তায়?
— না দোকানে। খাবো।এই দিকটায় একটা দোকান ছিলো। গতবার যখন লেবু মামার সাথে এসেছিলাম তখন খেয়েছিলাম। কি যে মজা বাঁধন ভাই! না খেলে বুঝতেই পারবেনা। একদম মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই গলে যায়। মনে হয় মিস্টি না দুধের ছানাই মুখে দিয়েছি। বাঁধন ভাই আপনি খাবেন?
ছুটি এমনভাবে মুখে রস আনার ভঙ্গি করে বলে যে বাঁধন দেখেই হেসে দেয়। ফের ছুটির হাত শক্ত করে ধরে বলে,
— চল তোর ঐ দোকানটা খুঁজি।
দোকানটা পেতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। মধুপুরের আনারস চত্ত্বরের পাশেই ছোট্ট দোকানটা। ছুটি এই নিয়ে চারটি মিস্টি মুখে নিয়েছে। একেকবার মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছে। এমনভাবে মুখ নাড়াচ্ছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার এখন ছুটি চিবুচ্ছে। ছুটির খাওয়া দেখে বাঁধনের হাসি পাচ্ছে। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সেও একটা মুখে দিলো। সত্যিই ভেতরে গিয়ে গলে যাচ্ছে। এতো মজার মিস্টি। তবে ছানার পায়েসের সাথে কম্পেয়ার করা যাবে বলে মনে হচ্ছে। বাঁধন টিস্যুতে হাতটা মুছে বললো,
— তোকে শেরপুরের ছানার পায়েশ খাওয়াবোনি। রসমালাই এর থেকে ছানার পায়েশটা আমার কাছে বেশী ভালো লাগে। ঐটা আরো মজার।
— চল খেয়ে আসি।কাছেই তো তাইনা?
— এখন কি শেরপুর যেতে চাস?
— হুম।
— বিয়েতে কে থাকবে? এমনিতেই বাবা ফোন দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি চল। দুপুর বেলা আবার নতুন মামী আনতে টাঙ্গাইল যেতে হবে।
— টাঙ্গাইল যেনো কি মিষ্টির জন্য বিখ্যাত?
— চম চম। নতুন মামীর নাম কি জানিস?
— কি?
— চম চম।
— সত্যি?
— লেবু চমচম।
একগাল হেসে উঠে বাঁধন।

চারটা হাইস ভর্তি করে যাচ্ছে বরযাত্রী। বরের গাড়িতে ড্রাইভার,লেবু মামা আর বাঁধন। ঠেলাঠেলি খেতে খেতে ছেলে মেয়েদের অবস্থা খারাপ। রিতী তো সহ্য করতে না পেরেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। রুম্পা সাথে সাথে অন্যগাড়ি থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,
— কিরে নামলি কেনো? গাড়িতে উঠ।
— ভেতরে জায়গা নেই মা।
তাহলে আয় আমার কাছে আয়। রিতী গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সেখানে আরেক বিপত্তি। বাচ্চাদের গাড়িতে তাও মজা করে যাওয়া যাবে। কিন্ত এখানে জায়গা তো নেইই আরো মায়ের কোলে চড়ে মা চাচী মামীদের বোরিং সংসারের আলাপচারিতা। রিতী আবার নেমে পড়লো। রুম্পা পড়লো চিন্তায়। কোথা থেকে নাচতে নাচতে চলে এলো ঝিমা ছুটি। বিয়েতে এদের দুজনের ই মজা বেশী। রিতীর অবস্থা দেখে ঝিমা বলে,
–আপু তুমি গাড়িতে আমাদের সীটে গিয়ে বসে পড়ো। আমরা তো লেবুমামার সাথে যাচ্ছি।
— ঐ গাড়িতে যেতে মানা। চারটা সিট। বউ আনবে তো।
— আগে তো জামাই নিয়ে যাই। তারপর না বউ আনবো।
ঝিমা ছুটি দৌড়ে গিয়ে বরের গাড়িতে উঠে বসে। লেবু তো দুই ভাগনীকে দেখে হৈ হৈ করে উঠে। ভালোকরে দুজনকেই দেখে বলে — সেম ড্রেইস? কেয়া লাগতিহে!
বাঁধন ফোন ঘাটছিলো। লেবু মামার কথা শুনে মাথা উঁচিয়ে তাকায়। ঝিমা ছুটি লাল রংয়ের ফ্লোর টাচ পরে আছে। কানে লম্বা সাইজ স্টোনের দুল। গাল ভরা পাউডার। ঠোঁট ভরা লিপিস্টিক। চুলগুলো পানিটেইল বেঁধেছে। বাঁধন দাঁতে আঙুল বসিয়ে দুজনের দিক তাকিয়ে থাকে। ঝিমা জিজ্ঞেস করে,
— কি ভাইয়া? সুন্দর লাগছেনা?
— এই ড্রেসটা গত ঈদে তোদের এনে দিলাম না?
— হে। সেম সেম। কেমন লাগছে বলো।
— ভালোই লাগছে…বাট..
— বাট?
বাঁধন কি বলবে খুঁজে পায়না। ভালোই লাগছে কিন্তু কেমন অদ্ভুত। সব ঠিক ঠাক। তবে মানাচ্ছে না কেনো যেনো। কি মনে করে বাঁধন চুল খুলে দিতে বললো। এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে দেখলো। লেবু মামা বুঝতে পেরে বললো — টিপ পড়। সাইড ব্যাগ থেকে মাঝারি সাইজ টিপ বের করে দুজনেই পড়লো। তবুও মনপুঃত হলোনা। ঝিমা ছুটি দুইপাশে ওড়না নিলো। ঠোঁটের লিপস্টিক আরো গাড় করলো। চোখে কাজল দিলো। আইল্যান দিয়ে দিলো লেবু মামা। তারপর আবার দুজনকে দেখতে লাগলো । কিছুতেই মনপুঃত হলোনা। গাড়ি ছেড়ে দিলো। ঝাকিতে বাঁধনের যেনো ঘোর ভাঙলো। কপাল কুঁচকে জ্যাম দুর করলো। চোখের উপর হাত দিয়ে সিটে গা এলিয়ে দিলো। ঝিমা ছুটি কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেললো । গাল ফুলিয়ে বললো,
— এখনো ভালো লাগলো না?
লেবু মামা হে হে করে হেসে বললো,
— আরে আরে মামনীরা মন খারাপ করে কেনো। অনেক সুন্দর লাগছে তোমাদের।
— ভাইয়াতো বললো..এই ভাইয়া বলোনা এখন ঠিক আছে?আমাদের কেমন লাগছে?
বাঁধন চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। সোজা হয়ে বসে বললো,
— কলির মতো লাগছে। গোলাপ ফুটেনি। সৌন্দর্য আড়ালে রয়ে গেছে।
— এটা কোন কমপ্লিমেন্ট?
— হুম। ছোট বাচ্চা তোরা।কি বলবো? সুন্দর লাগছে। বড় হ আরো সুন্দর লাগবে।
— ও এই ব্যাপার ! দুজনেই খুশি হয়ে যায়। মুখের উপর আরেকটু ফেস পাউডার মাখিয়ে নেয়। বাঁধন জানালার বাইরে মুখ করে নেয়। বিরবিরিয়ে বলে,
— শালার বয়সটাই কম।
কথাটা লেবু মামা ঠিক ই শুনতে পায়। মিটি মিটি হেসে বলে,
— বয়স বেশী হলে কি করতে বাঁধন?
— তুমি আজ যা করছো।
বাঁধন মুচকি হাসে। হকচকিয়ে উঠে লেবু। কথাটা কেমন যেনো লাগে। অস্থির কন্ঠে বলে,
— বাঁধন?
বাঁধন চোখ বন্ধ করে নেয়। মামাকে বলে,
— তোমার একটা ঘুম নেওয়া উচিত মামা। ঘুম থেকে উঠলে ফ্রেশ লাগে। দেখতে সুন্দর লাগে। রাতে ঘুমাওনি তোমাকে বিদ্ধস্ত লাগছে।
— তোমার সাথে আমি এ বিষয়ে পরে কথা বলবো।
— আমি কোন কথাই বলবো না। মামী কেমন দেখতে মামা?
— কথা ঘুরাচ্ছো?
— আহ বলোনা।
— আমি দেখিনি।বাড়ির লোকেরা দেখেছে। পছন্দ করেছে।
— না দেখেই বিয়ে করছো? এটা কিন্তু ঠিকনা মামা। যার সাথে সারাজীবন কাটাবে সে তোমার পছন্দের হওয়া উচিত।
— বয়স বেড়ে গেছে। এখন একটা বিয়ে করলেই হলো। আপা তোমার জন্য মেয়ে দেখছে। আমাকেও বললো দেখতে।
— তার মনে হয়না প্রয়োজন হবে। আসার সময় একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো জানো? মা তো ভাব জমিয়ে নিয়েছে। ফোন নাম্বারো আদান প্রদান হয়ে গেছে দেখলাম। কিছু একটা মনে হয় হবে।
লেবু মামার দিকে তাকিয়ে বাঁধন প্রস্তর হাসে। লেবু ভ্রু কুঁচকে ফেলে । বাঁধনের ব্যপারটা তেমন সুবিধার লাগে না।ঝিমা ছুটি খুনসুটি করছে। ওদের দিকে চোখ বুলিয়ে লেবু বলে,
— এই ব্যপারে তোমার সাথে আমি পরে কথা বলব।
— আমি কোন কথাই বলবোনা মামা।
বাঁধনের মুখে সেই হাসি। লেবু হার মেনে বলে,
— আমি আপার সাথে কথা বলবো।
— ঐ সুন্দরীর ব্যপারটা কতদূর এগিয়েছে জানিওতো ।
— তুমি সিরিয়াস মামা?
— দেখা মাত্রই হার্টবিট মিস করলো তো।
বাঁধনের কথা বার্তা লেবু মামার কেমন কেমন যেনো লাগলো। সে আলোচনা টা আপাতত ক্লোজ করলো।

বিয়ে বাড়ি পা রাখারো জায়গা নেই।মেয়ে পক্ষের আরো বড় পরিসরে প্যান্ডেল সাজানো উচিত ছিলো। কার সাথে কার ধাক্কা লাগছে কি একটা অবস্থা! দুই কদম আগে মানুষটাকেও যেনো হারিয়ে ফেলছে। বাইরে এই অবস্থা ভেতরে তো আরো ভিড়। সেই ভিড়ে মুখ ঠেলে ঠেলে ঢুকছে ঝিমার কাজিনরা।বউকে তাদের এখন দেখতেই হবে। সবার আগে সেলফি তুলে পোস্ট দিবে।রিতীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে বীনা। বড় মেয়ে বলে কথা। ভীড়ে পারাপারি মারামারি র মধ্যে কিছুতেই যেতে দিবেনা। বিয়ে বাড়ি কে কোথায় হাত দিয়ে দিবে বলা যায়না। একটু আগে একটা মেয়েকে চেপে ধরেছিলো কোথাকার এক ছেলে । মেয়েটা ভাগ্যিস চিৎকার দিয়েছিলো বলে সাথে সাথেই ছাড়া পেয়েছে। রিতীর যা অবস্থা! এরকম হলে ভয়ে এই মেয়ে কথা বলাই বন্ধ করে দিবে। রিতীর আর ভালো লাগছে না। দুঘন্টা ধরে এসেছে তবুও নতুন বউয়ের দেখা পেলো না। মাটিতে সু দিয়ে চটকাতে চটকাতে বলে,
— কাকী মনি দেখো ভিড় কমে গেছে । আমি যাই?
— বউ বাড়িতে নিয়ে যাবো তখন মন ভরে দেখিস। এখন চুপ চাপ বসে যা। কথা বলিসনাতো।
— ধুর এভাবে কেউ বিয়ে খেতে আসেনাকি? সারারাত জার্নি করে আসলাম। ঘুম নেই, খাওয়া নেই। বউয়ের বাড়ি এসে বউ দেখতে পাচ্ছিনা। এরকম বিয়ে হবে জানলে কখনোই আসতাম না।
— আমিইকি জানতাম রে? তুই মন খারাপ করিসনা। সামনে তোর বাঁধন ভাইয়ের বিয়ে দিবো দেখিস।এমন আয়োজন করবো না? যা যা শখ আছে সব মিটিয়ে নিস।
— বাঁধন ভাইয়ের বিয়ে? কবে? কখন? কিভাবে?কার সাথে?
— এক পরীর দেখা পেয়েছি রে। হুর পরী। আল্লাহ আল্লাহ কর পরীটাকে যেনো আমার বাড়িতে নিয়ে আসতে পারি।
রুম্পা এসে দাঁড়ায়।রিতীকে বলে,
— তোকে কখন থেকে ডাকছি। এই বউ দেখবি? মুরুব্বিরা যাচ্ছে। যা যা তাদের সাথে যা।
রিতী হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে যায়। বাঁধনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাঁধন ভিড় খালি করে রাস্তা করে নিচ্ছে মুরুব্বিদের জন্য। গ্ৰামের মহিলাদের সরে দাঁড়াতে বললে সরে না । বরং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বাঁধনের শরীর বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। ইন করা শার্ট টা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। রিতীর পেছনে ছুটি ঝিমা এসে দাঁড়ায়। বাঁধন এক এক করে মহিলাদের সরিয়ে সরিয়ে বরপক্ষের লোকজন কে ঘরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বউ দেখবে বলে। রিতীকে দেখে মামাতো ভাই পরশকে ডেকে জায়গা করে দিতে বলে। পিছু পিছু ঝিমা যেতেই হুলুস্থুল হয়ে কিছু ছেলে উপরে উঠে পরে। ধাক্কা লেগে ঝিমা হাতে ব্যথা পেয়ে আহ করে উঠে। বাঁধন ছেলে গুলোকে বকা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়। ঝিমাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। পিছনে তাকাতেই ছুটিকে নজরে পড়ে। ছুটিকে হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনে। ঠেলাঠেলিতে ছুটি বাঁধনের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। ভেজা শার্টের ঘামের গন্ধ টা ঠিক এসে নাকে লাগে। কেমন যেনো একটা গন্ধ। বাজে লাগে না। মিষ্টিও লাগে না। বরং ছুটি বার বার শ্বাস টেনে নাকে শুষে নেয়।

চলবে,

লাবিবা_তানহা_এলিজা~