বিষ করেছি পান পর্ব-৯+১০

0
254

#বিষ_করেছি_পান(৯)

(কপি করা নিষেধ)
নতুন বউকে ক্ষেপিয়ে চলছে লেবুর বন্ধুরা। চমচম ভাবী চমচম ভাবী বলে মুখে ফেন তুলে ফেলছে। নতুন বউ লজ্জায় মাথা নীচু করে আছে। মাঝে মাঝে চোখ ও বন্ধ করে নিচ্ছে। বাঁধনের নানুর ধমকে বাঁদর বন্ধু গুলো নতুন বউয়ের ধার ছাড়ে। ডালা ভর্তি ফুল হাতে দিয়ে বাসর সাজাতে পাঠাতে হয়। আগে থেকেই বাসর সাজাচ্ছে বাঁধন আর লেবু। নিজের বাসর নিজের হাতে সাজাচ্ছে। মনে তার হাজার হাজার লাড্ডু ফুটছে। ঠোঁটের কোনে মিটি মিটি হাসি। বাদর বন্ধু গুলো এসেই লেবুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একের পর এক অসভ্য কথায় মজা নিতে থাকে। বাঁধন সেদিকে কান দিচ্ছে না। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে। লেবুর বন্ধুরা গালি খেয়ে ঘর সাজানো কমপ্লিট করার কাজে লেগে পড়ে। বাঁধন কে দেখে একটু আটকে যায়। বাঁধন যে এতোক্ষণ এখানে ছিলো তারা কেউ খেয়াল ই করেনি। একজন বাঁধনের দিকে তাকিয়ে হৈ হৈ করে উঠে।
— বাঁধন নাকি এটা?
— জি মামা। ভালো আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ।আমাদের বাঁধন তো লেবু শালার জন্য ই আটকে ছিলো। এবার তাহলে নেক্সট বাঁধনের বিয়ে খাচ্ছি আমরা।
বাঁধন হালকা লজ্জা পায়। মুচকি হেসে কাজ চালিয়ে যায়।
— তা আর বলতে! এবার আমাদের বাঁধনের পালা। তা মামা পছন্দ টছন্দ আছে নাকি? ওয়েট ওয়েট আবার এটা বলোনাযে তুমিও তোমার মামার মতো কাজ করে বসে আছো। ইয়াং ম্যান তোমার মতো হ্যান্ডসাম বয় আবশ্যই গার্লফ্রেন্ড আছে।
— না মামা। তেমন কিছু না।
— আরে লজ্জা পেও না। মামা হলেও আমরা তো বন্ধুর মতোই। বলে ফেলো হেল্প টেল্প যা লাগে সব করবো।
— না মামা।বাড়ি থেকে যা বলবে তাই। আমি আপনাদের উপর ভরসা করেই আছি।
— তাই নাকি?বেশ বেশ। আজকাল তো তোমার মতো ছেলেই পাওয়া যায়না। তোমাকে দেখে কেউই বিশ্বাস করবে না।
লেবু মামা পাঞ্জাবীর কলার উঁচিয়ে ভাব নিয়ে বলে,
— কার ভাগিনা দেখতে হবেনা? লেবুর ভাগিনার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র।
— বিয়া করিয়া তুমার মুখের বুলি ফুটছে তাইনারে শালা?
লেবু মামা চুপ। ঘর জুড়ে এক হাসির বন্যা বয়ে গেলো। বাঁধন কাজ সেরে লজ্জায় মুখ ঢেকেই বেরিয়ে এলো।

বাসর ঘরে যাওয়ার জন্য লেবুকে ঠেলছে তার বন্ধুরা। লেবু উঠছেনা। কেনো উঠছেনা তাও তিনি বলছেন না। একসময় বীনার ধমকে উঠে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বললো,
— আপা। ঐ ঘরে মেয়ের দল আছে।
— তো কি হয়েছে?টাকা দিবি ঘরে ঢুকবি? তোর বউ কতক্ষন অপেক্ষা করবো?
— আপা ছেলেমেয়েরা দুষ্টুমি কবরে এটা আমি নিশ্চিত।
বীনা একচোখ কুঁচকে তাকালো। সীনা উঁচু করে বললো,
— ছুটি ঝিমারে নিয়া আমি বেরিয়ে যাবো। তুই যা এবার ঘরে যা।
বন্ধুরা লেবুকে ধরে বেঁধে নিয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। মেয়েরা হাত পাতলো। পাঁচ হাজার টাকা না দিলে ঘরে ঢুকা নিষেধ। লেবু ধমকে উঠলো,
— চুপ কর। কি এমন সাজিয়েছিস যে পাঁচ হাজার টাকা দিবো? যা বের হ।
— তিন হাজার টাকার ফুল কিনে আনছে বাঁধন ভাই। পাঁচ হাজার থেকে তিন হাজার তো তাকেই দিতে হবে।বাকি দুই হাজার আমরা এতো গুলো ছেলে মেয়ে কয়টাকা করে পরবে ভাগে একবার চিন্তা করো। তাও তো কম হয়ূ গেছে। দশ হাজার টাকা দাবী করা উচিত ছিলো।
— মামা বাড়ি আবদার নাকি?
— মামার কাছেই তো আবদার।
লেবু এতো টাকা দিবে না। মেয়েরাও ছাড়বে না। দশমিনিট ধরে এই তর্ক চলছে। হটাৎ নতুন বউয়ের গলা পাওয়া গেলো। রিনরিনি গলায় ধ্বনিত হলো,
‘ দিয়ে দেন না টাকাটা। ওরা এতো কষ্ট করে সাজালো।’
তর্ক থেমে গেলো। লেবু মামা পকেট থেকে চারটা হাজার টাকার নোট বের করে ঝিমার হাতে গুঁজে দিলো। আর একটা নোট দাবী জানালো কিন্তু পাওয়া গেলোনা। মেয়েরা মুখ ফুলিয়েই লেবুকে ঘরে ঢুকতে দিলো। বীনা এসে সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আসার সময় ছুটি ঝিমাকে নিজের সাথে নিয়ে এলো। আজ আরো বেশি ভিড়। ছেলেরা মাদুর কাথা নিয়ে ছাদে চলে গেলো। আজ ছাদেই রাত কাটাবে তারা। রুম্পা ছুটি কে নিয়ে একরুমে একটু থাকার জায়গা করে নিলো। তখনি ঝিমা এসে বায়না ধরলো আজকেও তারা একসাথে ঘুমোবে। রুম্পা বললো,
— সেখানেতো জায়গা নেই।
— জায়গা করে নিবো। আমরা সব ভাই বোনেরা একসাথে ঘুমোবো।
ছুটিকে নিয়ে ঝিমা দৌড় দিলো। নিজেদের বরাদ্দকৃত রুমে গিয়ে দরজা দিলো। কাজিনরা মিলে মুখ চেপে এক মিনিট চাপা হাসলো। তখনি তাদের ফোনের স্কিন অন হয়ে গেলো। গুনে গুনে বারোটা মাথা এক হয়ে গেলো।
এ ঘরের আলমারিতে এক্সটা বালিশ আছে। ড্রয়িংরুমে চারটা বালিশ লাগবে। বীনা এসেছে বালিশ নিতে।দরজা বন্ধ দেখে ধাক্কা দেয়।রুম্পা ও ঘর থেকে বলে,
–ওখানে তো ছেলে মেয়েরা ঘুমাতে গেলো।
— তাহলে দরজা দিবে কেনো?
— কিজানি কেনো দিবে দরজা। এই ছুটি…দরজা খুল… ঘুমিয়ে গেলি? ছুটি?ঝিমা?
কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। বীনার এবার ব্যপারটা কেমন জানি লাগে। উত্তর পাশের জানালা দিয়ে উকি দিতেই দেখে সবগুলো মিলে মাথা এক করে ফোনে কি যেনো দেখছে। কিত কিত করে হাসির আওয়াজ ও আসছে। বীনা এবার জোরে ঝিমা বলে চিল্লিয়ে উঠে ‌। মাথাগুলো মুহুর্তেই ছন্ন বিছিন্ন হয়ে যায়। দরজা খুল বলার সাথে সাথেই ঝিমা হুড়মুড়িয়ে উঠে দরজা খুলে দেয়। রুম্পা বীনা ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকে খপ করে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ফোনে এখনো ভিডিও চলছে। ভিডিও বললে ভুল হবে। ভিডিও কল চলছে। লেবু মামা আর চমচম মামী হাত ধরাধরি করে বসে গল্প করছে। কয়েক সেকেন্ড পর পর লেবুমামা চমচম মামীর গাল টেনে দিচ্ছে। আবার মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। রুম্পার চোখ কপালে উঠে গেছে। ভয়ানক একটা ধমক দেয়। সবগুলো একসাথে কাপাকাপি অবস্থা। বীনা হুংকার দিয়ে বলে,
–কে আছে লেবুর রুমে। পাজির হাড্ডি দুটো তো এখানেই আছে।
রুম্পা বলে,
— এই তোরা সবাই একসাথে রিতী কৈ রে?রিতী ? লেবুর রুমে তাইনা?
ছুটি মিন মিনিয়ে বলে,
— আমরা কিছু জানিনা।
— জানস নাতো কে তোদের ভিডিও কলে দেখাচ্ছে?
বীনা কথা না বাড়িয়ে লেবুমামার রুমের দিকে ছুটে। উঁচু গলায় কথা বলায় বাড়ির সবাই আড়মোড়া ঘুম ছেড়ে উঠে এসেছে। বীনা লেবুর রুমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে,
— এই লেবু দরজা খুল। তাড়াতাড়ি দরজা খুল।
লেবু মাত্রই নতুন বউকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলো বীনার ডাকে থতমত খেয়ে গেলো। বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— আপা ডাকতেছো কে?
— দরজা খুল তাড়াতাড়ি।
— কি হয়ছে বলবাতো।
— সাংঘাতিক ঘটনা ঘটছে। দরজা খুল।
— আমার বাসর রাতেই তোমাদের সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে হলো। তোমরা এতোজন আছো সামাল দাও।আমার এতো বছর পরে বিয়ে করা বউটার সাথে শান্তিতে সময় কাটাবো তারো উপায় নাই।
— তুই যদি এখন দরজা না খুলস তোর বাসর লাইফ টেলিকাস্ট দেখাবো সবাইকে এই আমি বলে দিলাম।
লেবু দরজা খুললো। বাড়ি সুদ্ধ মানুষ কে তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো। আতঙ্ক নিয়ে বললো,
— আপা!
— রিতী কই?
— নাই?
— তোর রুমেই আছে। সর‌ সামনে থেকে।
লেবু সরে দাড়াতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে। এরকম পরিস্থিতিতে নতুন বউ ভড়কে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে ঘরের এককোণে গিয়ে দাঁড়ায়। রুমে চিরুনি অভিযান চালিয়ে রিতীকে পাওয়া যায় পর্দার আড়ালে সেন্টার টেবিলের নিচে । ধরা পড়ে রিতী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাহস নিয়ে আর চোখে তাকাতেই দেখে সব গুলো চোখ তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লেবুর মেজাজ ফরটি ফর খেয়ে যায়। তর্জনী তুলে শাসিয়ে বলে,
— তুই এরকমটা করবি আমি ভাবতে পারিনি। বড় হয়ে ছোটদের সাদ ধরস? মনটা চায়তেছে থাপ্রিয়ে দাত ফেলে দেই।
আসাদুজ্জামান শালার কথায় খেক করে উঠে।
— থাপ্রানো তো তোমাকে উচিত। শালা হাবলার নানা। ঘরে কেউ আছে কিনা তা খোঁজ না করেই তুমি বাসর শুরু করে দিয়েছো। আজ রিতী ছিলো বলেই তো রক্ষা যদি তোমার কোন বন্ধুরা থাকতো তখন? বেটা আহম্মক!
— ঐ তুমি আমার ভাইকে গালি দিচ্ছো কেনো? সে কি করে জানবে এরকম কিছু হবে?
— ঘরে কেউ থাকলে নিঃশ্বাসের শব্দেই বুঝা যায়। আর এতো রিতীমতো ফোন তুলে ভিডিও করছে। সেটাও কি চোখে পড়লো না?
লেবু রিতীর দিক ছুটে যায়,
— ব্যাক্কেলে মেয়ে? কে বলেছে তোকে এমন করতে? ছোটদের সাধ ধরেছিস তাইনা?
আসাদুজ্জামান বলে,
— আহ! ছোট মানুষ ভুল করেছে। যা তো মা। এখান থেকে যা।
রিতী এক দৌড়ে ঘর ত্যাগ করে। শোবার রুমে যাবার সময় ছুটির গালে থাপ্পড় মারতে কোন কার্পন্য করেনা। সবাই বুঝে যায় এসব কার কাজ। রিতী কাথা মোড়া দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পড়ে। লজ্জায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জীবনে বেঁচে থাকতে আর শয়তান গুলোর কথা কানে তুলবেনা। ঢের শিক্ষা হয়েছে।

পরদিন সকালের নাস্তা করতে গিয়ে রিতী মাথা নিচু করে থাকে। কেউ কেউ তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। তো কেউ কেউ এমন ভাবে তাকাচ্ছে যে এইটা আবার কে?এখনো এখানে কি করে? লজ্জা শরম খাওয়া মেয়ে। রিতী ধীরে ধীরে গিয়ে বাঁধনের পাশে গিয়ে বসে। ব্রেকফাস্টে রুটি আর গরুর নিহারি করা হয়েছে। রিতীর থেকে নিহারীর বাটিটা একটু দূরে। হাত বাড়িয়ে নিতে যাবে বাঁধন থামিয়ে দেয়।বাটিটা নিজেই রিতীর দিকে এগিয়ে দেয়। বাঁধন খেতে খেতেই লো ভয়েজে বলে,
— মাথা নিচু করে আছিস কেনো?
— লজ্জা লাগছে বাঁধন ভাই।
— বাসর দেখার খুব শখ বুঝি তোর?
— বাঁধন ভাই তুমিও?
— বুঝদার হলে জিন্দাগিতে আর এরকম কাজ করবিনা। আর যদি বেশি শখ থাকে তো বলিস। পোলাপান ভাই ভাবীর বাসরে ঢুকবে। তা না মামার বাসরে ঢুকছে! এই শিক্ষা দিলাম এদের? কি লজ্জা কি লজ্জা! আমার তো নাক কাটা যাওয়া উচিত।
রিতীর লজ্জায় মরে যাবার অবস্থা। বাঁধন ভাইও এভাবে লজ্জা দিচ্ছে? বাঁধন ভাই! প্লেট খানা নিয়ে রিতী সুর সুর করে সেখান থেকে উঠে চলে যায়।

চলবে,
লাবিবা_তানহা_এলিজা~

#বিষ_করেছি_পান(১০)

(কপি করা নিষেধ)
— ঐ খাড়াও। এক পা আগাবানা। কই ছিলা পিরিতী? তোমারেনা বলছি প্রেম পিরিতি একসাথে থাকবো। তো উধাও হয়ছিলা কেন? কলেজ তো আর বন্ধ না।
রিতী দাঁড়ায় না। বরং জোরে জোরে পা চালায়। সোহাগ পিছু পিছু বড় বড় কদম ফেলে আসে।
— ঐ তোমারে কইছিনা দাড়াইতে। কথা কানে যায়না?
রিতী উত্তর দেয়না। সোহাগ গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। রিতী মাথা তুলে তাকিয়ে ও দেখেনা। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যায়। সোহাগ আবার পথ আটকায়।
— খুব তেজ তোমার দেখি পিরিতী! তা থাকবোই তো। তেজি না হয়লে কি আর আমার সাথে টক্কর চলতো?
— পথ ছাড়েন সোহাগ ভাই। ক্লাসে যেতে হবো।
— আমার মুখে কি কালি মাখি আসছি? তাকাও না কেন? এত্তো সুন্দর খোমা দেখে মেয়েরা টাস্কি খেয়ে তাকিয়ে থাকে আর তুমি মাথাই উঠাও না।
— ঐ মেয়েদের রুচি খারাপ।
— পিরীতি মুখে মুখে তর্ক করবানা। চলো আমার সাথে।
— না। আমি কোথায় যাবোনা। হাত ছাড়েন। হাত ধরছেন কেনো?
— তোমারে নিয়া বাইকে ঘুরতে মন চায়তেছে।
— কেনো? আমাকে নিয়ে ঘুরতে মন চায় কেনো?
— আরে বোকা মেয়ে..কিচ্ছু বুঝেনা। এই কলেজে তোমার মতো সুন্দরী আমার চোখে একটারেও লাগেনা। আমার বাইকের পেছনের সিট তোমার জন্যই ধার্য।
— যাবোনা আমি। হাত ছাড়েন। সিনিয়র রা তাকায়ে আছে।
— থাকুক। চলো আমার সাথে। চলো।
— যাবোনা আমি।
— একটা কথা বলবানা। আসো।
সোহাগ জোর করেই রিতীকে বাইকে চাপিয়ে নিয়ে যায়।

সুনশান একটা রাস্তার মাঝদিয়ে যাচ্ছে সোহাগ রিতী।রিতী সোহাগের কাঁধের শার্ট খামচে ধরে বসেছে। বাইকে উঠার অভিজ্ঞতা খুবই কম। হাতে গুনা দু তিন দিন মনে পড়ে বাইকে চাপা হয়েছে। যদিও রাস্তা একদম প্লেইন তবুও সোহাগ দু মিনিট পর পর ব্রেক কষছে। সোহাগ ইচ্ছা করেই কষছে। প্রতিবারই রিতী সোহাগের দিকে হেলে যাচ্ছে। তবুও গাঁয়ের সাথে গা যেনো না লাগে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখছে। তবুও গাঁয়ের সাথে গা লাগছে। রিতীর খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।চোখে পানি টলমল করছে।
— তিব্বত ডিটার্জেন্ট দিয়ে ঘসে ঘসে শার্ট ধুয়েছে আম্মা নিজে। তারপর ডলে ডলে আয়রন করেছে। সেই শার্ট সকালে গোসল দিয়ে পরে আসছি। এমন ভাব লইতাছো কেনো? আমার গায়ে কি দুর্গন্ধ আছে পিরিতী?
— তো কি চেপে বসবো? জামাই লাগেন আমার?
রিতীর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে।
— আরে আরে কান্দ কেন? জামাই কেন হয়তে যামু? প্রেমিক লাগি তোমার? কি লাগিনা?
— জীবন থাকতে না।
— তাহলে আমার সাথে বাইকে ঘুরো কেন?
— আমি কোথায় ঘুরছি? আপনি জোর করে নিয়ে আসছেন। আমাকে নামিয়ে দেন। আমি বাড়ি যাবো।
— আগে বলবানা? তোমার জন্যে বাড়ি বানাইতেও তো সময় লাগবো।
— কথা ঘুরাবেন না। নামায়ে দেন আমাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
— বড্ড বেশী কথা বলবানা। ভাবছিলাম একটা রোমান্টিক ড্রাইভ দিমু তা না ফ্যাস ফ্যাস করে নাক টানার শব্দে মুডের উপর ঠাডা ফেলসো। চুপ করে শক্ত করে ধরো। তোমার গরম শরীরটার ছোঁয়া লাগাও।
— সোহাগ ভাই আমি আপনার সাথে যাবোনা। আমাকে নামিয়ে দেন।
— এত কথা বলতে পারিনা। মেজাজ কিন্তু খারাপ হয়তেছে এবার।
— নামিয়ে দিতে বলছি নামিয়ে দেন।
— ধুর শালি নাম তুই।
সোহাগ ধাক্কা দিয়ে রিতীকে বাইক থেকে ফেলে দেয়। পিচঢালা রাস্তার উপরে চলন্ত বাইক থেকে পড়তেই রিতী ‘ওমাগো ‘ বলে চিৎকার করে উঠে। সোহাগ একটু সামনে গিয়ে বাইক থামায়। পেছনে তাকিয়ে রিতীকে শুয়ে ব্যথায় কাতরাতে দেখে হো হো করে হেসে উঠে। রিতী শব্দ করে কাঁদতে থাকে। সোহাগ হাসতে হাসতেই রিতীর সামনে এসে এক হাঁটুর উপর ভর করে বসে।
— কি সোনা পিরিতী? নামায়ে দেওয়ার জন্য কানতাছিলা এখন নামায়ে দিলাম তাও কানতাছো কাহিনী কি? কাছেও থাকতে চাওনা আবার দূরে গেলেও কান্না কাটি করো আমি কিন্তু নাদান পুরুষ।ওসব জাদু টোনা কিন্তু আমি করতে জানিনা।

দুহাত তুলে জিহবায় কামড় দিয়ে মুখটা ইনোসেন্ট করে বলে সোহাগ। রিতী চোখ বন্ধ করে রাগ সামলাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছা করছে সোহাগের পশ্চাতদেশে কষে একটা লাথি দিতে। বেটা হারামজাদা! ইচ্ছা পূরণের উদ্দ্যেশে রিতী পা দুটো নাড়ায়।সাথে সাথে তার কোমর দেশে মরণ ব্যথা খামচি দিয়ে ধরে। রিতী আরো জোরে
‘ ওমাগো মরলাম গো ‘ বলে চিৎকার করে উঠে। সোহাগ আরো জোরে হাসতে থাকে।হাসির রেশ একটু কমে এলে হাসতে হাসতেই রিতীকে তোলার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। রিতী হাত সরিয়ে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— একদম ছোঁবেন না আমাকে। আমি একাই উঠতে পারি। আল্লাহ যেনো আজকের পর থেকে আপনার মুখ আর আমাকে না দেখায়।
— আল্লাহ তোমার প্রিয় বান্দীর দোয়া কবুল করে নিও। আমিন।
বলেই সোহাগ আরো হাসতে থাকে। রিতী কষ্ট করে কোনমতে উঠে দাঁড়ায়। কোমরের পেছন সাইড পুরো অবশ হয়ে গেছে। হাড়ে ব্যথা লেগেছে। অন্য কোন সময় হলে রিতী চেগিয়ে পরে থাকতো। নড়তো না চড়তো না। কান্নাকাটি করে পুরো কলোনী এক করে নিতো। কিন্তু এখন সে নড়ছে। শরীরে জোড় না থাকলেও মনের জোরে সে এই বখাটে টার সামনে থেকে যেতে চাইছে। আশেপাশে লোকজন নেই। একা পেয়ে না জানি কখন কোন সুযোগ গ্ৰহন করে। এই চিন্তা মাথায় আগেই এসেছে। সোহাগের সাথে না আসলেই পারতো। কিন্তু ঐযে মেয়ে মানুষের ইজ্জতের মান সবার থেকে বেশী। কলেজে চেঁচামেচি করলে সবাই ব্যাপারটা জেনে যাবে। প্রশ্ন উঠবে এতো দিন কেনো রিতী সিনিয়রদের জানায়নি যে তাদের কলেজে এসে একটা বখাটে জুনিয়রকে এতো দিন থেকে ডিস্টার্ব করছে? সিনিয়রদের জানানো মানে স্যারদের কানে যাওয়া। স্যারদের কানে যাওয়া মানে বাবার কানে যাওয়া। বাবার কানে যাওয়া মানে রিতীর পড়াশোনার সপ্ন এখানেই মাটি চাপা দেওয়া। বাবা শিক্ষক, আধুনিক, প্রতিবাদী ঠিক আছে তবুও তিনি গ্ৰামের মানুষ। গ্ৰাম থেকে অনেক বছরের দুরত্ব থাকলেও গ্ৰাম্য মনোভাব এখনো কোথাও তার মাঝে বসবাস করে। সেটা রিতী বুঝতে পেরেছে বাবার সাথে থেকে ধীরে ধীরে। সোহাগ হাসি থামিয়ে রিতীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ছুটির দিকে ঝুঁকে বলে,
— তোমার যে আমার অন্যকিছু দেখতে ইচ্ছে করে সেটা তো আগে বলবা। তোমার জন্যে জামা কাপড় নয় খুলেই দিলাম। সত্যিই তো এই একটা খুমা আর কতোই দেখবা?
আবার সেই দৃষ্টি,আবার সেই মনোভাব,আবার সেই অশ্লীল বাচ্য। ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করে উঠে রিতীর। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়।‌ সোহাগ কে কিছুই বলেনা। অশ্লীল ব্যক্তির সাথে আর কোন কথা না।

রিতী হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে । সাথে সোহাগ নেই। সোহাগ হেল্প করতে চাইলেও রিতী সেই হেল্প নেয়নি। কারন হেল্প করার ইচ্ছেটা ছিলো কম গায়ে হাত দেওয়ার ইচ্ছেটা ছিলো বেশী। এক রিকশাওয়ালার রিকশায় সুয়ে হসপিটালে এসেছে রিতী। মিনিট দুয়েক আগে সে এক্সরে রুম থেকে বেরিয়েছে।‌ রিপোর্ট দিতে ঘন্টা চারেক সময় লাগবে। রিতী রিপোর্ট নিয়েই বাড়ি ফিরবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে পারে। তবে দোয়া করছে বিকেলের মধ্যেই যেনো রিপোর্ট হাতে পায়। আপাতত সুয়ে থাকা যাক।

রিপোর্ট বিকালেই হাতে এসেছে।‌ ডাক্তার জানিয়েছে হাড়ের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে যেভাবে পরেছে হাড় ভেঙে যাবার সম্ভাবনাই ছিলো বেশী। আল্লাহর অশেষ রহমতে এ যাত্রাই বেঁচে গেছে।‌ তবে কয়েকদিন ব্যথা থাকবে। ঔষধ ও প্রেসক্রাইব করেছে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রিতীর শরীরটা আর যেনো চললো না।বেঞ্চিতে আধ শোয়া হয়ে বাড়িতে কল দিলো। যদি মা ফোন ধরে তাহলে বলবে ছুটিকে দিতে। ছুটি ফোন ধরলে বলবে
— আমি গ্ৰীন লাইফ হসপিটালের সামনে আছি। আমার কোমড় ভেঙেছে। ভাঙা কোমড় নিয়ে একা একা বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছেনা। তুই একটা ট্যাক্সি নিয়ে আয়। ট্যাক্সিতে শুয়ে বাড়ি যাবো। রিকশাতে ঠিকমতো শুতে পারিনা।
তের বার কল হবার পরেও যখন রিসিভ হলোনা তখন রিতী ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।লোকজনকে পাত্তা না দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। আকাশটাও কয়েক মিনিটের মধ্যে গুড় গুড় করে উঠলো। একটু পর কাঁদতে শুরু করবে। রিতী কাঁদতে কাঁদতেই আকাশের কান্নার অপেক্ষা করতে লাগলো। আকাশ এই মুহূর্তে তার বন্ধু। দুই বন্ধু আজ একসাথে কাঁদবে।
___________________

উত্তরে মেঘ করেছে। ছুটি ছেলেমেয়েদের সাথে ক্রিকেট খেলতে খেলতেই দেখলো মেঘ দ্রুত ধেয়ে আসছে। ঝিমা চিৎকার করলো,
— এইইইই ছক্কা।
ছুটির ধ্যান ছেড়ে গেলো। ঝিমা মলিদের সাথে সেও উল্লাসে মেতে উঠলো। বলিং এবার ছুটির হাতে। ব্যাটাং করবে রতন। গাধাটা ব্যাটিং করতেই জানেনা। অন্যান্য খেলায় পারদর্শী হলেও এই ব্যাটিং টা সে ঠিকমতো আজো করে উঠতে পারেনা। তাই ক্রিকেটে তাকে কেউ খেলতে নিতে চায়না। সে জোর করে খেলে। তার উপর জোর দেখাতে গেলে জ্ঞানীদের মতো ডায়লগ দেয় ,
— Always remember that, ‘ practice makes a man perfect ‘. যতই ব্যাটিং করিবে ততোই শিখিবে। এই অপরচুনিটি যে কেড়ে নিবে, বুড়ো বয়সে সে সন্তানের মুখ দেখিবে।
ছুটি দুর্দান্ত বলিং করছে। আর প্রত্যেকটা বল ফ্লপ করছে রতন। রতনের মুখ পাংশুটে দেখাচ্ছে। কপালে দুশ্চিন্তার ভাব। মুখে ফুটে উঠেছে অস্থিরতা। সবাই পরলে সে কেনো পারবেনা। এমন অবস্থা কেঁদে দিবে। মেঘে তখন আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিচেনের জানালা থেকে রুম্পা জোরে ডেকে বললো,
— ছুটি.. বৃষ্টি এলো। ছাদে কাপড় আছে। নিয়ে আয়।
ক্রিকেট খেলা স্থগিত হলো। শিপ্রু মৃদু হেসে বললো,
— বৃষ্টি হবে। রতন মন খারাপ করছিস? ফুটবল খেলি চল।
ছুটি বললো,
— আমি আসি।
— আরে বৃষ্টিতে ভিজবো তো। ফুটবল খেলবো। আসবিনা?
— কাপড় গুলো তুলে আসি।
ছুটি কাপড় তুলে ফিরে এলো। রুম্পা ঘর থেকেই চেঁচাতে লাগলো। ছুটি কানেই নিলো না। ছুটির লেজ ধরে তমাল ও শার্ট প্যান্ট খুলে হাফপ্যান্ট পরে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এলো। এতোক্ষনে ফুটবল খেলা জমে উঠেছে। মাঠের জমা পানিতে ফুটবলে কিক করতেই একেকজনের চোখে মুখে লাগছে। ল্যাং খেয়ে একের পর একজন চিৎপটাং হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের কাউ কাউ আওয়াজ মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দে।
রাস্তায় কাকভেজা হয়ে ছাতা মাথায় অফিস থেকে ফিরছে বাঁধন। প্রাইভেট সেক্টরের চাকরি। দশটা টু পাঁচটা রেগুলার ডিউটি। বাসায় ফিরে ব্যাগ রেখে ক্লান্ত দেহ বৃষ্টিতে ঢুবাবে। পথিমধ্যে ই পানির ছিটায় যে পুরোটা ভিজে যাবে সেটা ভাবতে পারেনি। বাদরগুলো পানি মেরে মুখ টিপে হাসছে। বাঁধন চেঁচিয়ে উঠলো,
— আরে কি করলি এইটা?
— বলে কিক দিতেই লেগেছে। ইচ্ছে করে করিনি। সরি।
— বলে কিক দিতেই আমি পুরোটা ভিজে যাবো?
— এতোগুলো পা তো কি করবো?
বাঁধন দেখে সত্যিই এতোগুলো পা।সব একসাথে। ঝিমা বলে,
— ভাইয়া ছাতা দিয়ে কি কাজ? আসো ফুটবল খেলি।
রতন বলে,
— ঐ ঝিমা তুই ভাইয়ের ব্যাগ ছাতা এক দৌড়ে রেখে আয়।
বাঁধন সেখানেই শার্ট প্যান্ট সহ খুলে ঝিমার হাতে ধরিয়ে দেয়। হাটু অব্দি শর্ট প্যান্টটাই শুধু পরনে। ত্রিশ বছরের তাগড়া যুবকের প্রশস্ত কাঁধ বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছে বৃষ্টির পানি। বুকের উপর লোম গুলো ভিজে শুয়ে আছে চেপ্টে। ছুটির দৃষ্টি হলো বেহায়া, নির্লজ্জ। সবার সাথে ফুটবল নিয়ে দৌড়াচ্ছে বাঁধন। ছুটির আর খেলা হলোনা। সে যেখানে ছিলো সেখানেই থমকে গেলো। কাদা পানির মাঠে সটানে শুয়ে পড়লো। বৃষ্টির ঝাপে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। কালচে গোলাপি ঠোঁট দুটো বিরবির করে উঠলো,

‘বাঁধন ভাই, আপনি কী মোহনীয়!
বার বার শত নারী হতে বাধ্য অভিভুত। ‘

চলবে,

#লাবিবা_তানহা_এলিজা ~