বৃষ্টির রাতে পর্ব-৮+৯

0
392

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৮)

“তৌফিক ভাই কতবার বলেছি আপনাকে এই ক্যাটক্যাটে রঙের পাঞ্জাবী পরে বসবেন না আমার সাথে।” প্রচণ্ডরকম তিরিক্ষি মেজাজে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল মিনি। তৌফিক যারপরনাই বউকে সামলানোর চেষ্টা করছে, “বউ প্লিজ রাস্তাঘাটে এমনে ভাই বইলো না ইজ্জতে লাগে।”

“লাগুক, আমি আপনাকে ছাইরঙা শার্ট বের করে দিয়েছিলাম না আপনি সেটা কেন পরেন নি?”

“আমার ওইসব রঙ ভাল্লাগে না। তোমার পাশে ঘুরতে আমার এমন রঙ পরতেই ভাল্লাগে।”

সামনের সিট দুটো স্ট্যান্ডে খালি হতেই একজোড়া কাপল এসে বসেছে। তাসিন সেদিকে এক পলক দেখে আবার সুপ্রভাকে দেখছে। মেয়েটা ভারী মুড দেখিয়ে দুজনের মাঝে ব্যাগটা রেখেছিল। কি লাভ হল তাতে? সেই তো নিজে ঘাড় বাকিয়ে ব্যাগ ডিঙিয়ে তাসিনের কাঁধে পড়ে আছে। ভাবতে ভাবতেই তাসিনের হাসি পাচ্ছিল কিন্তু সামনের কাপলের হঠাৎ চাপা গলায় ঝগড়া কানে আসতেই সেদিকে মনযোগ দিল। তাদের ঝগড়া কারণ টের পেয়ে প্রচণ্ডরকম হাসি পাচ্ছে। পোশাকের রঙ নিয়েও ঝগড়া করতে পারে মেয়েরা? কি আশ্চর্যজনক কান্ড!

“মামী, তুমি কি তাসিন ভাইয়ের জন্য অনেক সুন্দর বউ আনবে?”

মাছুমা আচারের বৈয়ামগুলো খাওয়ার ঘরের একটা ছোট্ট কাঠের শোকেসে রাখছিল। পেছন থেকে আয়নার এমন কথা কানে আসতেই সে সন্দিগ্ধ নজরে তাকালো।

“কেন রে!”

“আগে বলো না খুব বেশিই সুন্দরী বউ আনবা?”

মাছুমা শিক্ষিতা তথা বুদ্ধিমতিও খুব। সে আগে থেকেই বুঝতো আয়না যে তাসিনকে চোখে হারায় কিন্তু এখন সে যদি ব্যাপারটা সহজভাবে নিচ্ছে প্রকাশ করে তাহলে মেয়েটা অন্যরকম আশা নিয়ে বসে থাকবে। তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই না বোঝার ভাণ করলো।

“তা তো তাসিনই বলতে পারবে যে। বউ তার পছন্দও তারই হবে।”

“তুমি নিজে পছন্দ করে আনবে না?”

“না, বউ যার তার পছন্দই হবে সব। সংসার সে করবে আমি আমার পছন্দ চাপিয়ে দিয়ে তার ওপর কোন অন্যায় করবো না। তুই হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস কেন?”

মামীর জবাবে সে প্রচণ্ডরকম হতাশ হলো। না চাইতেও চোখ দুটো সিক্ত হচ্ছে বুঝতে পেরেই সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে বের হলো। মাছুমা পেছন পেছন অনেক বার ডাকলেও সে ফিরে তাকালো না। আজ আয়না আবার শাড়ি পরেছিল ইচ্ছে করেই শাড়ি পরে মামীর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। গত সপ্তাহে তাসিন তার ওপর রেগেই বাড়ি থেকে চলে গেছে তা জানে আয়না। কিন্তু কি করবে বয়সটা যত উপরের ঘরে উঠছে মনটা তার ততোই চঞ্চল হচ্ছে তাসিন ভাইয়ের জন্য। বেহায়া মন এখনই কেমন বিয়ে নিয়ে কল্পনা করে। এখনও তো কলেজই শেষ হয়নি তবুও খুব ইচ্ছে করে তাসিন ভাইয়ের বউ হয়ে সারাক্ষণ তার আশেপাশে থাকতে। অথচ তাসিন ভাই যেন তাকে সহ্যই করতে চায় না। আর এ কারণেই বোধহয় সেজেগুজে এসে মামীর সামনে দাঁড়িয়েছিল। মামী যদি তাকে পছন্দ করে তাহলে নিশ্চয়ই তাসিন ভাইকে বিয়ে করা সহজ হবে। কিন্তু না, তার ধারণা শতভাগ মিথ্যে করে মামী বলল ছেলের পছন্দের মেয়ের সাথেই বিয়ে হবে। এরপর আর মামীর সামনে থাকা চলে না। লজ্জায় এবার তার মরতে ইচ্ছে করছে। একবার মনে হলো মামার পুকুরটাত গিয়েই ঝাপ মারবে পরে মনে হলো সে সাতার জানে যখন মনে হবে মৃত্যু খুব কাছে তখনই নিশ্চয়ই সাঁতরে পাড়ে চলে আসবে। এত অপরিপক্ক মন নিয়ে তার হয়েছে যত জ্বালা। এই রাত দুপুরে এসব ভাবনায় আয়না ভুলেই গেছে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এত কথা ভাবছে। হঠাৎ কানে শিশ বাজানোর আওয়াজ আসতেই গা শিউরে উঠলো তার। এভাবে শিশ একমাত্র রায়হান বাজায়। ভয়ে এবার গা কাঁপতে লাগল আয়নার। এই ছেলেকে সে জমের মত ভয় পায়। এক নাম্বারের বখাটে ছেলে রায়হান। তার বাবা পুলিশের এস আই। সারাবছর পোস্টিংয়ে বাপ অন্য এলাকায় পড়ে থাকে আর ছেলে বাবার ঘুষের টাকায় বন্ধু বান্ধব নিয়ে দিনরাত আড্ডায় মজে থাকে। বয়সে তো তাসিন ভাইয়ের থেকে দু এক বছরের ছোট হবে কিন্তু পড়াশোনায় চারবার ফেল করে সবে কলেজ পাশ করেছে। আয়না তাকে দেখেই বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। এই বদমাশের তো আবার বহুদিনের নজর আয়নার দিকে৷

“আয়না শোনো।”

রায়হান ডেকে আরেকটু সামনে এলো আয়নার। রাতের আঁধারে অস্পষ্ট রায়হানের মুখ৷ সে দাঁড়াতে চাইলো না তাই পাশ কেটে রায়হান একদম তার মুখোমুখিই হলো।

“আমাকে দেখলেই পালাও ক্যান বলো তো?”

“পথ ছাড়েন।” ভয়ার্ত স্বর আয়নার।

“ছাড়বো না কি করবা?” গলার স্বর গম্ভীর করে কথাটা বলেই রায়হান আবার হো হো করে হেসে বলল, “এত ভয় পাও কেন তুমি আমাকে? আমি তোমার ক্ষতি করবো এমন ভাবো নাকি?”

আয়না এবার সত্যিই ভয় পেল খুব। সে আর রায়হানের দিজে না তাকিয়ে সোজা দৌঁড় লাগালো বাড়ির দিকে। পরনে শাড়ি থাকায় একটু যেতেই হোঁচট খেল তা দেখে রায়হান আবার কথা বলল, “আরে সাবধানে। পাগল মেয়ে!”

আয়না আর রাস্তার ধারে কাছেও নেই। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ঘরে ঢুকে। আয়নার মা তাদের ঘরের সামনের বারান্দার মত করিডোরেই ছিলেন৷ মেয়েকে হঠাৎ রাস্তার দিক থেকে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। রাতের বেলা মেয়েটা একা কেন এলো? সে তো বলেছিল মামীর কাছে যাচ্ছে রাতে মাইশার সাথেই থাকবে। মনটা কু ডাকছে তবুও মেয়ের ঘরে ঢুকলেন আগে। আয়নাকে প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই কানে এলো ফোনটা বাজছে তার ঘরে৷ দ্টুত পায়ে আবার নিজের ঘরে ঢুকে ফোন হাতে নিয়ে ভয় আরো গাঢ় হলো। ভাবী ফোন করছে তারমানে কি সেই বাড়িতে কিছু হয়েছে? তাসিনের ফুপু মিনতি সাথে সাথে ফোন ধরে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর এলো মাছুমার, “আয়না কি বাড়ি আসছে মিনতি?”

“কি হইছে ভাবী?”
থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো মিনতি।

“কি হইছে মানে?”

“কানতেছে আয়না বাড়ি আইসা।”

” কান্না করবে কেন ও তো আমার সাথে কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তুহিন, মাইশাকে জিজ্ঞেস করলাম ওরা বলল আয়নাকে দেখেনি তাই ফোন করা।”

“কি কথা হইছে?”

“ও তাসিনকে কোথায় বিয়ে করাবো তাই জিজ্ঞেস করছিল।”

মিনতি আর প্রশ্ন করলো না। সে ভাবীকে পরে ফোন দিবে বলে কল কাটলো। মেয়ের পাশে বসে প্রশ্ন করলো, “তুই তাসিনের বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিস কেন?”

ধমকে উঠলো মিনতি। মেয়ের হাবভাব সে আরো আগে থেকেই টের পেত। তার ধারণা তার স্বামী, ভাই, ভাবী এমনকি ভাতিজাও জানে আয়না ভালোবাসে তাসিনকে৷ কিন্তু আগ বাড়িয়ে নিজেরা তো এ নিয়ে কথা বলা যায় না আর মেয়েও সবে কলেজে পড়ছে। সে ভেবেছিল আর একটা বছর যাক তাসিনের ততদিনে মাস্টার্স শেষ হবে। এরপর না হয় ভাই ভাবীর কানে কথাটা তুলবে৷ মেয়ের খুশি যেমন তার কাছে বড় তেমনি ভাই ভাবীরও নিশ্চয়ই তাদের ছেলের খুশি বড়। আর তাসিনও আয়নাকে পছন্দ করে কিনা সেসবেরও একটা ব্যপার আছে। আয়নাকে ধমকে, বকে সামনে থেকে সরে গেল।

“বাস থেমে গেছে?” চোখজোড়া টেনে খোলার চেষ্টা সাথে এই প্রশ্নটা করলো। তাসিন বসা থেকে উঠে দু হাতে শার্টের নিচের অংশ টেনে কুঁচকানো শার্টটা ঠিক করলো৷ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখলো রাত একটা ছুঁই ছুঁই। সুপ্রভা সবটা খেয়াল করে বিরক্ত হলো। সে এবার বলল, “একটা প্রশ্ন করলে তার জবাব না দিয়ে শার্ট, প্যান্ট ঠিক করা কোন ধরণের ভদ্রতা বুঝলাম না।”

তাসিন কথাটা শুনেও না বোঝার ভাণ করে বলল, “কিছু বললে?”

“ফালতু লোক!”

শব্দটা স্পষ্ট তবে খুব আস্তে বলল সুপ্রভা। তাসিন একটু হেসে কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করলো, ” মামা কতক্ষণের জন্য থামলো বাস?”

“আধঘন্টা মামা। যান খানাপিনা চাইলে করতে পারেন।” কন্ডাকটর কতাটা বলে চলে গেল। তাসিনও বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেল সামনের সিটের পুরুষটার সাথে।”

“দুঃখিত ভাই, আমি বুঝতে পারিনি।” তাসিন বলতেই সামনের মানুষটিও বলল, “সমস্যা নাই আমিও বুজি নাই… বুঝিনি।” কথাটা বলতে গিয়ে মিনির দিকে তাকিয়ে তৌফিক শব্দটা দ্বিতীয়বার শুদ্ধ করে উচ্চারণ করল। মিনি আজকাল খুব করে বকে তাকে এত অশুদ্ধ কথা বলার জন্য। তার ব্যবসার পরিধি যত বড় হয়েছে ততোই সে খুব বড় বড় নামীদামী লোকের সাথেও মিশছে৷ তাই মিনির জোর অনুরোধ ছিল পথেঘাটে যেন একটু সুন্দর করে কথা বলে অনেকটা মোশাররফ করিমের ড্রামার মত। সিকান্দার বক্সের বউও তাকে কত বোঝাতো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে সে বলতোও কিন্তু ওইযে, নিজের গায়ের টান তার কথাতে থেকেই যেত। তৌফিকেরও আজকাল সেই অবস্থা। তাসিন স্বাভাবিকভাবে নিলেও সুপ্রভা ফিক করে হেসে দিল তৌফিকের কথা শুনে। তৌফিক মাইন্ড করেনি তবে তাসিন চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছিল। বাসের সাদা বাতির আলোটাতে সেই চোখ দেখে সুপ্রভার হাসি মিলিয়ে গেল। তারপর দু পক্ষই একসাথে বাস থেকে নেমে গেল। তাসিনের হোটেল দেখেই খিদে পেয়ে গেল সেই সাথে তৌফিকেও দেখা গেল মিনিকে তাড়া দিচ্ছে কি খাবে কি খাবে না প্রশ্ন করে। পাশাপাশি দুটো মেয়ে প্রায় কাছাকাছি বয়স। দুজনেরই মুখ দেখা যাচ্ছে সামনের পুরুষ দুটোর আচরণে দুজনেই মনে মনে রেগে যাচ্ছে আর তা স্পষ্ট হচ্ছে একজনের চোখ রাঙানো তো অন্যজনের নাকের পাটা ফোলানো দেখে৷ মিনি শান্ত প্রকৃতির মেয়ে সে চোখ রাঙিয়ে তৌফিককে শাসাচ্ছে এত খাই খাই না করার জন্য । ওদিকে কোন অধিকার নেই কিছু বলার তা ভেবেই রাগে নাক ফুলিয়ে গম্ভীর হয়ে তাসিনকে দেখছে সুপ্রভা। পুরুষমানুষ কতটা বিরক্তিকর তা যেন সুপ্রভার এখন বোঝা হয়ে গেল। এই বদলোকটা সত্যিই খুব ফালতু। যত্তসব উদ্ভট আচরণ আর স্বভাব বিদ্যমান এর মাঝে। হোটেল নাম খুব বড় করে লেখা তৌফিক সেটা জোরে জোরে উচ্চারণ করল, ” মাতৃ ভান্ডার।” খুবই নামকরা একটা হোটেল এই মাতৃভান্ডার। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা ইতোমধ্যে প্রায় বেশিরভাগেই হোটেল ঢুকে পছন্দসই খাবার নিয়ে কেউ বেতরেই বসে খাচ্ছে কেউ কেউ আবার প্যাকেট করেও নিচ্ছে। তারমধ্যে মোটামুটি রসমালাইটাতে যেন সবার প্রচণ্ড লোভ। তৌফিক আগেও এখানকার মিষ্টান্ন খেয়েছে মিনি আর পরিবারের জন্যও নিয়েছে। কিন্তু তাসিন কখনোই আসেনি এদিকটাতে৷ কয়েক মিনিটেই তৌফিকের সাথে তার ভালো আলাপ জমে গেছে। দুজনেই নিজেদের গ্রাম, পরিবার আরো কত কি গল্প করছে। এক ফাঁকে তৌফিক জানালো মিনি তার স্ত্রী। এ কথা শোনার পর সে চোখ দুটো রসগোল্লা পরিমাণ বড় বড় করে বলেছিল, সত্যি!
তাসিনের প্রতিক্রিয়া সাথের তিনজনকেই বিষ্মিত করেছিল। হোটেলে ঢুকে রসমালাই আর দু পদের মিষ্টি অর্ডার করে তৌফিক চেয়ার টেনে বসলো তাদের মাঝে। তাসিনকে প্রশ্ন করলো, “ভাই আপনে না আপনি ওরকম রিয়াকশন দিলেন কেন?”

“কিছু মনে করবেন না আপনার স্ত্রী বাসে বসে আপনাকে পাঞ্জাবীর কথা বলেছিল সেটা আমার কানে এসেছিল। তখন উনি আপনাকে তৌফিক ভাই বলে সম্মোধন করেছে বোধহয়!”

তাসিন কথাটা বলতে তৌফিক খুব জোরেই হেসে ফেলল। মিনি অবশ্য তাতে লজ্জা পাচ্ছিল খুব৷ আর সুপ্রভা তো ঘুমের রাজ্যে ছিল তাই তাদের কথা বোধগম্য হলো না কিছুই। তৌফিক বলল, “এই যে আমি লাল টকটকে রঙের পাঞ্জাবী পরছি সেটা নিয়েই তখন রাগ ছিল। আর আমরা তো একই গ্রামের তাই এলাকার হিসেবে চাচাতো ভাই বোন ছিলাম। আমি আবার তারে না মানে তাকে বোন ভাবতাম না। পছন্দ করতাম তো খুব আমার রজনীগন্ধারে।” শেষের বাক্যটা বলার সময় তৌফিক কিছুটা ঝুকে তাসিনের কাছে এসে বলল। যেন তার কথাটা তাসিন ছাড়া উপস্থিত আর কেউ শুনবে না। মিনি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল খুব৷ মানুষটা এত নির্লজ্জ কি করে হতে পারে! হঠাৎ দেখা যাত্রী হয়ে এতেই কেন সব বলতে হবে বুঝে পায় না মিনি। সে টেবিলের তলায় হাত ঢুকিয়ে তৌফিকের হাতে চিমটি কাটলো। এতে মিনিকে আরো বেশি লজ্জায় পড়তে হলো যখন তৌফিক জোরেই বলল, “চিমটি দিচ্ছো ক্যান?”

সুপ্রভার এবারও হাসি থামলো না সে তখনকার মতো হি হি করে হাসতে লাগলো। মিনির লজ্জায় কান, গাল সব গরম হয়ে উঠলো। মনে মনে বকতে লাগল, “অসভ্য লোক বউকে এভাবে লজ্জায় ফেলতে লজ্জা লাগে না!”

মুখ ফুটে সে পারলো না কিছুই বলতে উল্টো তার ইচ্ছে করলো বসা থেকে উঠে বাইরে যেতে। তৌফিক বোধহয় এবার কিছু বুঝতে পারলো। এভাবে সে তার বউকে লজ্জায় ফেলছে এটা তো ঠিক নয়। তাই সে মিনির দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যরি।”

তাসিনও বুঝি টের পেল কিছু সে যেচে বলল, “মাইন্ড করবেন না আপু উনি দুষ্টুমি করছে আমি বুঝতে পারছি। প্লিজ বি ইজি!”

আরো কিছু সময় হোটেলে বসে একটু খাওয়াদাওয়া করে পরেই বের হলো তাসিনরা। বাস ছাড়লো আরো দশ মিনিট বিলম্বে। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাস চলল, রাত আরো ঘন হয়ে এলো। এবার ঘুম শুধু সুপ্রভা নয় তাসিনের চোখেও নেমে এলো ধীরে ধীরে। জানালার পাশের সিটেই বসেছিল সুপ্রভা। ভোরে আলো ফোটেনি তখনো সদ্য সরে যাওয়া আঁধারের পর আকাশটা ঘোলাটে সাদায় শুভ্র হয়েছে। এ আলোটাই চোখের পাতায় ভারী ওজনদার লাগলো। সে চোখে মেলে তাকিয়ে মাথাটা সোজা করতে গিয়েই আর্তনাদ করে উঠলো মৃদুস্বরে৷ তার কয়েকটা চুল পেঁচিয়ে আছে তাসিনের শার্টের বোতামে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো যখন বুঝতে পারলো ঘুমটা সে এই ফালতু লোকের বুকে পড়েই দিয়েছে বুঝি! সুপ্রভার নড়াচড়ায় মাত্র দু ঘন্টা আগেই আসা ঘুমটা ছুটে গেল তাসিনের। তার বুকের ওপর টানটান হয়ে থাকা সুপ্রভার চুল আর বুকের সামনেই মেয়েটাকে দেখে ঘাবড়ে গেল ভীষণ। কিছুটা ভয়ে ভয়েই সে বোতামে লাগা চুলগুলোতে হাত লাগালো। এলোমেলো হয়ে পেঁচিয়ে থাকা চুল গুলো ছাড়াতে কষ্ট হয়নি। আধুনিক মেয়ে চুলে হয়ত হাজারটা প্রসাধনী বয়বহার তাই বলেই চুল সহজেই খুলে গেল। সুপ্রভা কি একটু আড়ষ্ট হলো এতোটা কাছাকাছি হওয়ায়! তার মুখ দেখে তাসিনের তেমনই মনে হলো৷ নিজেও কিছুটা সংকোচ বোধ করে সে একটু নড়েচড়ে তার ডান পাশের সিটগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরালো। সুপ্রভাও সরে গিয়ে নিজের সিটে গা এলিয়ে বা দিকে জানালার বাইরে তাকালো। দৃষ্টি তার ঝাপসা বাইরের পথঘাট, দোকানপাট কিছুতেই খেয়াল নেই৷ ঢাকার রাস্তায় চলছে বাস তাদের। গন্তব্যে পৌঁছুতে আর একটু দেরি। তারপরই এ সফর শেষ হবে দুজনার।

চলবে

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৯)

বাস এসে থেমেছে গন্তব্যে ; গন্তব্যে পৌঁছায়নি সুপ্রভা আর তাসিন৷ বাস থেকে নেমে আবার রিকশায় চড়তে হবে তাসিন সুপ্রভাকে হোস্টেলে পৌঁছাতে। তাসিন নামার আগেই নেমেছে তাদের সামনের সিটের যাত্রী তৌফিক আর তার স্ত্রী মিনি৷ সুপ্রভা এখনো একটু ঝিমিয়ে পড়া পায়ে নামলো বাস থেকে৷ তার কি হলো কে জানে ঘুম ভেঙে নিজেকে তাসিনের বুকে পেয়ে তার বুকটা ধ্বক করে উঠেছিল। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেল এক মুহূর্তেই। শক্ত পুরুষালি অচেনা কিংবা খুব একটা চেনা নয় বলা চলে এমন এক বুকে সে অর্ধেকটা রাত পার করে দিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার নিজেকে অনিরাপদ মনে হয়নি একটিবার৷ বরং কক্সবাজার থেকে মেহউইশ আপু যখন বলল, একা ছাড়বে না তখন শুধু মনে হয়েছে এই লোকটা ছাড়া সে আর অন্য কারো সাথে বের হবে না। কি আজব! যাকে মাত্র এক ঝড়বৃষ্টির রাতে দেখেছে। যে জোরজবরদস্তি করে তাকে বাড়ি দিয়ে এলো সেই লোকটার প্রতি কারণ ছাড়াই ভরসা জন্মে গেল। এমনটা কেন হলো আগে তো কখনো কারো প্রতি হয়নি!

“এত আস্তে চললে তো এক দুপুরেও হোস্টেলে পৌঁছুতে পারবে না।” আকস্মিক বেজে ওঠা স্কুল ঘন্টার মত কানে বাজল তাসিনের কথাটা। সুপ্রভাও যেন তাতে চেতনা ফিরে পেল। সে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো রাতের সেই যুগল সামনেই একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়েছে। তাসিনের দিকে না তাকিয়েই সে খুবই ক্ষীণ স্বরে বলল, “স্যরি।”

তাসিন হাতের ঘড়িতে সময় দেখছিল। সুপ্রভার স্যরি শব্দটা কানে আসতেই সে চকিতে তাকালো৷ বিড়বিড়িয়ে বলল, “বাহ্ অসভ্য, ফালতু বলা লোককে আবার স্যরিও বলে তাহলে।” সেও রিকশা ডেকে সুপ্রভাকে বলল, “হোস্টেলের লোকেশন বলো ঠিকঠাক।”

সুপ্রভা রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বলতেই তাসিন রিকশায় চড়ে বসল। বিপত্তিটা শুরু হলো তখনই যখন সুপ্রভা খেয়াল করলো তাসিন দু পা ফাঁকা রেখেই বসেছে। পাশে অল্পখানি জায়গা আর তাতেই সংকোচ বোধ করলো সুপ্রভা। কি করে বসবে সে তার পাশে! লোকটার কি কমন সেন্স নেই নাকি?

সুপ্রভাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাসিন বলল, “রিকশা কি দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য ডেকেছি?”

তাসিনের এবারের কথাটা খুব লাগলো সুপ্রভার। সেও বলে বসল, “এক রিকশা একা নিজেই নিয়ে বসলে অন্যরা কোথায় বসবে?”

তাসিনের খেয়াল হলো নিজের দিকে। সে বাম পা সরিয়ে বা দিকে জায়গা দিলো। সুপ্রভার সংকোচ হলেও আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় বলেই উঠে বসলো। সুপ্রভা বসার পরই তাসিন কেমন গুটিয়ে গেল। একটা রাত বাসে পাশাপাশি বসে আসতেও এতোটা সংকোচ কিংবা দ্বিধা হয়নি এখন আচমকা যতটা হচ্ছে। ঘাড় বাকিয়ে সে রাস্তার বিপরীতে তাকিয়ে রইলো। রিকশা চলতে শুরু করতেই চোখে পড়ল তৌফিকদের রিকশা ছাড়েনি৷ মিনি রিকশায় বসে আছে আর তৌফিক কোথা থেকে ছুটে আসছে হাতে একগুচ্ছ সাদা রজনীগন্ধা নিয়ে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালেও পলকেই পেছনে পড়ে রইলো সেই দৃশ্য আর রিকশা সামনে এগোতে লাগল তাসিনদের।

” আপনিই মুরাদ তাই তো!”

রিশাদ প্রশ্ন করতেই অবাক হয়ে তাকায় মুরাদ আর টিয়া। দুজনেই সকালে ঘুম থেকে উঠে বিচে হাটতে বেরিয়েছিল। সেখানেই গিয়ে রিশাদ কথাটা জিজ্ঞেস করলো। মুরাদ হ্যাঁ বলতেই রিশাদ আবারও কণ্ঠস্বর আগের মতোই ভারী রেখে বলল, “তাসিন কবে ফিরবে বলেছে?”

“জ্বী, ও সুপ্রভাকে পৌঁছে দিয়ে আর দেরি করবে না।”

রিশাদ ভালো করে মুরাদের দিকে চেয়ে আবার আশেপাশে চোখ বুলালো।

“আপনার বাকি দুই বন্ধু কোথায়?”

“তারা দুজন ঘুমাচ্ছে এখনও।”

“তাদের ডেকে তুলন এবং খুব শিগ্রই সবাই বাড়ি ফিরে যান৷ আপনারা পালিয়ে এসে অন্যায় করেছেন। সেটা আমার বলার বিষয় ছিল না কিন্তু তাসিন মেহতাবের মামা ফোন করেছেন একটু আগে। আপনারা গ্রামে বড় কোন ঝামেলা সৃষ্টি করে এসেছেন যা আপনারাই সমাধান করতে পারেন।”

রিশাদের কথা শুনে ঘাবড়ে গেল টিয়া। মুরাদ শক্ত মানুষ ভয় ডর তার খুব কমই আছে। তবুও একটু যেন আতকে উঠল। তারপরও সাহস করে প্রশ্ন করলো, “ভাইয়া আপনাকে কি কিছু বলেছে তাসিনের মামা?”

” বলেছে আপনারা দুটো মেয়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন৷ তার মধ্যে একজনের ভাইয়েরা তাদের বোনের জন্য আপনাদের এলাকায় খুব ঝামেলা বাঁধাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওনার ভাইয়েরা!” রিশাদ টিয়াকে দেখালো। টিয়া এবার ভয়ে কাঁন্না শুরু করে দিল কিন্তু তারই মাঝে মুরাদ বলল, “না তার তো একটাই ভাই। সমস্যা সম্ভবত শিকদার পরিবার করছে। সুপ্রভার পরিবার কিছুটা ভয়ংকর রুপে থাকে সবসময়। আর সুপ্রভা তাদের একমাত্র বোন।”

“সুপ্রভা কি রাতে যে চলে গেল সে?”

এবার টিয়া কথা বলল, “হ্যাঁ ওর নাম সুপ্রভা।”

রিশাদ কিছু একটা ভেবে বলল, “তাসিন তাহলে বিপদ সঙ্গে করেই বেরিয়েছে। তার মামা ফোন করে বলেছে তার মা খুব চিন্তিত আছে। আপনারা তাকে সাবধান করে দিন আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের পরিবারের মুখোমুখি হোন আপনারা। পালিয়ে বিয়ে করা যতোটা অসম্মানের ততোটাই ভুল পদক্ষেপ। পরিবারের কথাটা ভেবে দেখুন তাদের কেমন লাগছে।”

রিশাদ আর দাঁড়ায়নি। সে চলে যেতেই মুরাদ রিমন আর সুমনকে ফোন দিলো। কথা বলে ঠিক করলো তারা গ্রামে ফিরে যাবে তার আগে কনফার্ম করবে সুপ্রভা তার পরিবারের সাথে কথা বলেছে কিনা৷

হোস্টেলের গেইটের কাছে এসে রিকশা থেকে নামলো তাসিন, সুপ্রভা। সকালের নাশতটাও আজ করার সুযোগ হয়নি এখনো৷ রিকশার ভাড়া মিটিয়ে তাসিন সুপ্রভাকে ডাকলো, “শোনো!”

সুপ্রভা তার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। ডাক শুনে চোখ তুলে তাকালা তাসিনের দিকে। এই প্রথম, হ্যাঁ এটাই প্রথমবার সুপ্রভার তাসিনকে দেখা ভোরের আলোয় স্পষ্ট অবয়ব। ঠিক কতগুলো দিনের চেনা দুজন জানাশোনাও একটুখানি হয়েছে। যা হয়নি তা হলো সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির চোখে তাসিনের মুখ দেখাটা। তাসিন দেখেছিল স্পষ্টভাবে সুপ্রভাকে হোটেলে তার ভাইয়ের পেছনে দাঁড়ানো৷ হোস্টেল গেইটের পাশে থাকা কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁকে কমলা রোদটা উঁকি মেরে পড়ছে তাসিনের বা চোখের পাপড়ি, তার ঠোঁট ঘেঁষে লম্বালম্বি খোঁচা দাঁড়িময় চিবুকে। কোন পুরুষের চোখের পাপড়ি কি এত ঘন হয়! সুপ্রভা কয়েক সেকেন্ড থমকে গেল নিজের ভাবনায়৷ তাসিন বলছে, “ফোন চালু করে বাড়িতে কল দিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে। তোমার পরিবারের মানুষ গুলো হয়ত উত্তেজিত স্বরে কথা বলবে, চেঁচামেচি করবে তুমিও হাইপার হইয়ো না৷ বরং শান্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করবে কি হয়েছে যেন গত দু দিন তুমি এখানেই ছিলে৷ তুমি কিছু জানো না এমন ভাব কোরো। আমি ফিরে গিয়ে মুরাদদেরও বাড়ি পাঠাবো।”

একজন দ্বায়িত্ববান অভিভাবকের মত তাসিন বলে চলল। সুপ্রভা গরম মাথার মানুষ হয়েও কেমন করে যেন তাসিনের কথা চুপচাপ শুনলো। কথা শেষে সুপ্রভাকে হোস্টেলে ঢুকতে বলল তাসিন। সুপ্রভা পা বাড়ালো ঢোকার জন্য আবার ফিরে বলল, “নাশতা করবেন না?”

“এখানে নাশতা পাবো কোথায়? তুমি ভেতরে যাও গিয়ে নাশতা করে বাড়িতে যোগাযোগ করো। আর ভুল করেও বোলো না তুমি মুরাদ টিয়ার সাথে ছিলে।”

সুপ্রভা কথাগুলো শুনলো। তাসিন ফোনে সময় দেখে বলল, তুমি ভেতরে যাও।

” আপনি এখনই চট্টগ্রামে ফিরবেন?”

“হ্যাঁ, এখানে আর অপেক্ষা করে লাভ কি। এখানে আমার পরিচিত কেউ নেই যেখানে বসা যায় কিছু সময়।”

“আচ্ছা! ” বলেই সুপ্রভা তার কাঁধের ব্যাগটা থেকে ছোট একটা ব্যাগ বের করলো৷ তার থেকে টাকা পয়সা বের করছিল তা দেখে তাসিন বলল, “টাকা বের করছো কেন?”

“হোটেল রুম, খাওয়া আর বাস ভাড়া।”

কঠিন ভাষায় কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল তাসিন। তার কি প্রয়োজন অযথা এই মেয়েটার সাথে ঝামেলা করার। বয়সের তুলনায় ম্যাচিউরিটি কম তার মধ্যে এমনটা ভেবেই নিজেকে সংযত রাখলো। শুধু ভারী কণ্ঠে বলল, “গেইটের ভেতরে যাও আমার লেট হচ্ছে। ”

তাসিন পা বাড়ালো এবার সামনের দিকে। কয়েক কদম চলেও গেল সুপ্রভা আবারও ডাকলো, “শুনুন।”

“বলো।” তাসিন থামলো কিন্তু এগিয়ে এলো না।

“ফোন নাম্বারটা দিন তো আপনার যদি কোন প্রয়োজন পড়ে বা টিয়াদের আপডেট জানার হয়!” প্রচণ্ডরকম একটা স্বাভাবিকতা ধরে রেখে কথাটা বলল। তবুও বুকটা দুরুদুরু করছে।
তাসিন মুখে মুখে নম্বরটা বলতে গিয়েও থামলো৷

“তোমার ফোন বন্ধ কিসে উঠিয়ে রাখবে নাম্বারটা?”

“কলম আছে আমার ব্যাগে” বলেই সুপ্রভা ব্যাগ থেকে কলমটা নিয়ে বা হাতের তালুতেই নাম্বারটা টুকে নিল। এরপর আর তাসিন দাঁড়ালো না। সুপ্রভা গেইট দিয়ে ঢোকার সময়ই দারোয়ান বলল, “তুমিই সুপ্রভা না?”

“হ্যাঁ মামা, এক সপ্তাহের মত ছিলাম না তাতেই আবার ভুলে গেছেন আমায়?”

“ভুলি নাই মেডামের অফিসে দেখা করো তোমার ডাক পড়ছিলো।”

হোস্টেল প্রধান শিলা মেডামের রুমে তার ডাক পড়েছিল মানে সিরিয়াস কোন ব্যাপার। না চাইতেও যেন একটা ভয় আগুনের হলকার মত গায়ে লাগল সুপ্রভার। তড়িঘড়ি সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় নিজের রুমে ঢুকে ব্যাগ রেখে একটা নোটবুক হাতে নিয়ে ছুটলো মেডামের কাছে। মিথ্যে একটা বাহানা সাজাতে গিয়ে ভালো কোন বুদ্ধি পেলো না। শেষ পর্যন্ত মেডামের কাছে যাওয়া ক্যান্সেল করে ঢুকলো নিজের রুমে৷ ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে চালু করে আগে চার্জে লাগালো। তার রুমমেট মেহরিন মাত্রই গোসল সেরে রুমে ঢুকেছে। তাকে দেখতেই ভূত দেখার মত চমকে গেল মেয়েটা।

“তুমি কোথা থেকে এলে?”

কৌতূহলী দৃষ্টিতে মেহরিন তাকিয়ে আছে। সুপ্রভা সেই দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, “কক্সবাজার থেকে।”

“তুমি কি পালিয়েছো বাড়ি থেকে?”

“পালাবো কেন?” ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব সুপ্রভার চোখে মুখে। মেহরিন বিষ্ময়ের শেষ পর্যায়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি যেমন তোমার পরিবারও ঠিক তেমন।”

“এ্যাই আমার পরিবার নিয়ে বলছো কেন মেহরিন? ”

“তো কি বলবো তোমার ভাইরা একেকজন তো পুরাই ভিলেন ভিলেন। তারওপর তুমিও এমন সব কথা বলো আচরণ করো যেন দুনিয়ায় কিছুরই পরোয়া নেই।”

“সত্যিই নেই গো মেহু। আমার সত্যিই পরোয়া নেই কিন্তু তুমি আমার ভাইদের ভিলেন বললে কেন? ”

“যেমন দেখতে তেমনই বলবো না! কি অবাধ্য লোক, কত করে বললাম ভাইয়া আমি জানি না সুপ্রভার ব্যাপারে কিছুই। শুনলোই না লোকটা বলে কিনা তোমার ফোন চেক করবো। দেখতে তো একদম দানব তারওপর চুলগুলোও বড় বড় আর কেমন নাদুসনুদুস।”

“মেহরাব ভাইয়া এসেছিল?”

“নাম জানি না দুজন এসেছিল। বলে গেছে তোমার খোঁজ পেলেই যেন জানাই তা নয়ত আমাকে দেখে নেবে। কি ভয়ংকর কথাবার্তা।”

সুপ্রভার প্রথমে ভয় না লাগলেও এবার লাগলো একটু। সে চার্জে থাকা ফোন দিয়েই বড়দা ভাই এর নাম্বারে ডায়াল করল।

রোদে চকচকে আকাশটা মাত্র আধঘন্টার মধ্যেই মেঘে কালো হয়ে এলো। তাসিন একটা হোটেল থেকে নাশতা করে বাইরে এসেই বেশ খুশি হলো। দিনের জার্নিটা বৃষ্টিময় হলে মন্দ হবে না। আরো ভালো লাগত যদি ট্রেনে যাওয়া যেত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ট্রেনে গেলে আবার ঘুরে কমলাপুর যাওয়া লাগবে। তাই আর না ভেবে সে বাসের টিকিট কাটলো৷ সরাসরি চট্টগ্রামের বাস দুপুরের আগে একটাও নেই। কিন্তু অনেকটা সময় এখানে বসে কাটানোর মানেই হয় না ভেবে সে কুমিল্লার টিকিট কাটলো। চারপাশে ভালো করে এক নজর বুলিয়ে দেখলো জায়গাটাকে৷ এখান থেকে সুপ্রভার হোস্টেলে যেতে মাত্র সাত কি আট মিনিট লাগে। আচ্ছা মেয়েটা আজকে এমন ভিন্ন আচরণ করলো কেন?। গত দুদিন এবং সেই বৃষ্টির রাতে মেয়েটা এমন ছিল না। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার মত ছিল তার আচরণ ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল তাসিনের। সে হাসতে হাসতে বাসের দিকে গেল। পুরো বাসে মাত্র তিনজন যাত্রী তারমানে বাস ছাড়তে দশটার জায়গায় নির্ঘাত এগারোটা বাজাবে। তাসিন উঠলো না বাসে। রাস্তার পাশেই চায়ের দোকান। বাতাসে চায়ের ঘ্রাণে তার নেশা নেশা লাগছিল৷ এক কাপ চা না খেলেই নয় ভেবে সে চা খেতে দোকানে ঢুকল৷ কিছুটা সময় চায়ের সাথেই না হয় কেটে যাক পরে ভাবা যাবে বন্ধুদের বিপদ থেকে উদ্ধারের কথা।

চলবে