বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-০৩

0
379

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি (৩)
হুযাইফা মাইশা

দু’দিন গেল যেমন তেমন। কেউ কাউকে কল দিলনা। যে যার মতো দিন কাটালো। তিনদের মাথায় ইয়াভকিনের ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলো। ইয়াভকিন তখন অফিসে। মিটিং আছে, সেটার প্রস্তুতি নিচ্ছে যথারীতি। কল রিসিভ করবে না, করবে না করেও করে ফেলল। কল ধরে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
‘ হ্যালো, কে বলছেন?’
‘ আমি ফারুক মির্জা, পূর্ণতার বাবা।’

থতমত খেয়ে একবার নাম্বারটায় চোখ বুলাল ইয়াভকিন। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘ আসসালামু আলাইকুম।’
‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম, বাবা। তুমি কি অফিসে?’
‘ জ্বি আঙ্কেল।’
‘ আহহা, আঙ্কেল ডেকে পর বানিয়ে দেয়ার মানে হয়? যাইহোক, দেখা করে কথাগুলো বলার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু কিছু কাজে গ্রামে আটকা পড়ে গেছি।
আমার ছোট মেয়ে পূর্ণতা ভীষণ চঞ্চল। কিন্তু আমার মুখের উপর কোনোদিন, কোন সিদ্ধান্তে মানা করেনি। সর্বদা আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নেই, এমনটাই মেনে আসছে। তোমার বাবা আর আমি স্কুল লাইফ থেকে বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়েও কিভাবে যেন এক ছিলাম। আমাদের ভাই-ই বলা চলে। ভাইয়ের ছেলের কাছে মেয়ে দিতে আপত্তি ছিলনা আমার। আমার মেয়েটা মুখ ফুটে কিছু বলেনি। হুট করে বলার পরও নিশ্চুপ থেকে আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। আশা করি, আমি ভুল সিদ্ধান্ত নেই নি। তোমার মতো ছেলে হয়না জানি, সব দিক দিয়েই তুমি পার্ফেক্ট। একদম তোমার বাবার মতো। আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো বাবা। আমি চাইনা ও কষ্ট পাক। রাখছি।’

সালাম দিয়ে কল কেটে দিল ইয়াভকিন। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।

ফারুক সাহেবের আদুরে মেয়ে হলেও তাকে ভীষণ ভয় পেত পূর্ণতা। শুধু ও না, ওর বড় ভাই, আর বোনও ভীষণ ভয় পায় বাবাকে। উনি বাইরে কঠোর দেখালেও মনে ছেলেমেয়েদের জন্যে অগাধ ভালোবাসা। সর্বদা তাদের সুখের কথা ভেবে কতো কষ্ট সহ্য করেছেন! এই বিয়ের প্রস্তাব মূলত ইয়াসিন সাহেবই দিয়েছেন। ছেলে ভালো দেখে মানা করেননি।

বাসায় ফিরে পূর্ণতাকে দেখবে সেটা মোটেও আশা করেনি ইয়াভকিন। ক্লান্ত চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে সোফায় বসা পূর্ণতাকে দেখছে বারবার। পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
‘ কি?’
‘ তুমি?’
‘ হ্যাঁ, আমি। ফ্রেশ হয়ে আসুন, কথা আছে।’

ইয়াভকিন রুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে গায়ে কালো টিশার্ট জড়াতে জড়াতে ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যা সাতটা। পূর্ণতা কি এখন এসেছে? নাকি আরো আগে?

রুম থেকে বের হয়ে দেখল পূর্ণতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে সবে। হাতে দু’টো কাপ। কফির কাপটা ইয়াভকিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে সোফায় এসে বসল। ইয়াভকিন বসল অন্য সোফাটায়। তীক্ষ্ণ নজরে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা টিভিতে নজর রেখে বলল,
‘ বিকেলের দিকে এসেছি। জানতাম বাসায় থাকবেন না। যাইহোক, আমার বড় খালা দাওয়াত দিয়েছেন। বিয়েতে আসতে পারেননি, হুট করে হওয়ায়। উনার বাসাটা পাশেই। কালকে যেতে বলেছেন, আপনি কি যাবেন? না যাওয়ার হলে বলে দিন, ম্যানেজ করতে পারবো!’

দাঁতে দাঁত চেপে বসা ইয়াভকিন। মেয়েটা এতো কথা বলে ফেলল! খানিক চুপ থেকে কফিতে চুমুক দিয়ে ছোট্ট করে বলল,
‘ যাব।’
এরপর উঠে চলে গেল। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পূর্ণতা। ওদের সম্পর্কটা এমন অস্বাভাবিক কেনো! পূর্ণতার প্রথমদিন অস্বস্থি হতো ভীষণ, দেখাতো না। এখন সেটার মাত্রা কমেছে।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে বসে আছে পূর্ণতা। দশটার উপরে বাজে। ইয়াভকিনের দরজা খোলার নাম গন্ধ টুকু নেই। একটু পরে গিয়ে দরজা ধা’ক্কাল। খুললনা। এরপর বিরক্ত হয়ে ড্রয়িং রুমটায় বসে রইল। খানিক পরে দরজা খুলল ইয়াভকিন। অফিসে যাবেনা সেটা আগেও ম্যানেজারকে বলে রাখা। চোখমুখে ঘুম। তাকে এমনভাবে দেখে ভ্রু কুঁচকাল পূর্ণতা। থমথমে গলায় বলল,
‘ আপনি রেডি হননি?’
‘ এতো জলদি?’
‘ এগারোটা বাজতে চলল।’
‘ জাস্ট টেন মিনিটস, আসছি।’

আবারও রুমে ঢুকে পড়ল। মিনিট দশের জায়গায় বিশ মিনিট পর বেরিয়ে এল। গায়ে কালো রঙের ব্লেজার। ভেতরে স্কাই ব্লু শার্ট। লম্বাটে দেহের সঙ্গে মানিয়েছে ভীষণ। পাতলা, সিল্কি চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বের হয়েছে। পূর্ণতা নজর সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ধুপধাপ কদম ফেলে এগিয়ে গেল।

গাড়িতে বসে পূর্ণ দৃষ্টিতে পূর্ণতার দিকে তাকাল ইয়াভকিন। মেয়েটা শাড়ি পড়েছে! মেরুন রঙের সিল্কের শাড়ি। গোলগাল মুখশ্রীতে মেকাপের ছোঁয়া নেই। কিন্তু বড় বড় চোখে কাজল টানা। দৃষ্টি সরিয়ে নিল ও। নিজেকে ধাতস্থ করে ড্রাইভিং এ ধ্যান দিল।

পূর্ণতার খালার বাসায় জমজমাট পরিবেশ। বোনের ছেলে-মেয়ে তিনটেকে নিজের ছেলেমেয়ের মতোই দেখেন উনি। পূর্ণতা এসবে অভ্যস্থ হলেও অচেনা মানুষজনদের মাঝে খাপ খাওয়াতে যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছে ইয়াভকিন। মানুষজন কম না এ বাড়িতে! খাবার টেবিল কোনোমতে খেয়ে উঠে পড়েছে, ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে পূর্ণতা। খালা তখন রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছেন। অনেক দিন পর বোনজিকে পেয়েছেন কিনা!

রুমটা পূর্ণতার খালাতো বোন ঊর্মির। সেখানেই আপাতত বসা ইয়াভকিন। পূর্ণতা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। বিকেল হয়েছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সেদিকে তাকিয়ে আছে এক নজরে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করল ইয়াভকিন। আরেকবার পূর্ণতাকে ঠিকঠাক ভাবে দেখে নিল। খুব সূক্ষ্ণভাবে তাকালেই চেহারাটায় বিষন্ন ভাবটা ধরে ফেলা যাবে। সেটা ধরেও ফেলল ও। গলা ঝে’ড়ে বলল,
‘ তুমি কি এখানে থাকতে চাইছো?’
‘ না, না।’
‘ তাহলে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেনো?’

উত্তর না পেয়ে খানিকটা দমে গেল ইয়াভকিন। মেয়েটা বলতে চাইছেনা, থাক!
কিছুক্ষণ পরে পূর্ণতা রুম থেকে বেরোলো। আবার ফিরে এসে বলল,
‘ বৃষ্টি আসার আগে বেরিয়ে পড়ি চলুন।’
‘ আন্টিকে বলেছ?’
‘ হু। ‘

বলতে বলতে পা বাড়াল।
ওদের ছাড়তে চাইছিলেন না বিথি। আজকে রাতটা অন্তত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু পূর্ণতা ইয়াভকিনের অফিস আর ভার্সিটির দোহাই দিয়ে থাকলনা। যাওয়ার আগে বিথি শান্ত স্বরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
‘ মন দিয়ে সংসার করো।’
না চাইতেও গালভর্তি হাসি উপহার দিয়ে এসেছে পূর্ণতা। ইয়াভকিন বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। লক্ষ্য করল, পূর্ণতার হাসিটা ভীষণ সুন্দর। হাসলে মেয়েটার ডান দিকের গজদাঁতটা দেখা যায়। সুন্দর লাগে তাতে!

মাঝরাস্তায় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। গাড়ির গতি কমিয়ে দিল ইয়াভকিন। গ্লাস তুলে দেয়ার জন্যে হাত বাড়াতেই থামিয়ে দিল পূর্ণতা,
‘ এদিকের গ্লাস লাগাবেন না। থাকুক।’

তাও অর্ধেক গ্লাস তুলল ইয়াভকিন। ভেজার শখ হয়েছে নাকি মেয়েটার!

বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টির মাঝেই ছুটে এপার্টমেন্টের নিচে গেল পূর্ণতা। বেশ ভিজেও গেল। গা ঝা’ড়তে ঝা’ড়তে সামনের দিকে তাকাল। বহু দিন বৃষ্টিতে ভিজে না। এই নিয়ে অনেক দিন মায়ের কথা শুনেছে ও। তবুও ভিজেছে।

ইয়াভকিন গাড়ি পার্ক করে এসে তব্দা খেয়ে গেল। খালি জায়গাটায় বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে পূর্ণতা। চোখ বন্ধ করে মুখশ্রী আকাশের পানে স্থির করে রেখেছে। গায়ের শাড়ি লেপ্টে আছে শরীরে। কাজল লেপ্টানো চোখে। লাস্যময়ী, আকর্ষণীয় লাগছে পুরো। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ও। পরক্ষণে চেঁচিয়ে ডাকল। পূর্ণতা পাত্তা দিলনা। আবার ডেকে গম্ভীর গলায় বলল,
‘ জ্বর আসবে মেয়ে, জলদি আসো।’
‘ একটু আধটু ভিজলে আমার জ্বর আসেনা। ‘
‘ তুমি আসবে নাকি তোমার বাবার কাছে কল দিয়ে বলবো তুমি কথা শুনছ না?’

এমন হু’মকি ইয়াভকিনের নিকট হতে কস্মিনকালেও আশা করেনি পূর্ণতা। বৃষ্টির নিচ থেকে সরে এল ধুপধাপ পায়ে। থমথমে মুখশ্রী। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে লিফটের দিকে পা বাড়াল।

রাতে কাজল ফোন দিলেন। পূর্ণতাকে কল দিয়েছেন সকালে। ইয়াভকিন সেটা জানেনা। ইয়াভকিন কল রিসিভ করতেই বললেন,
‘ কি ব্যাপার, বাপ মা-কে কি ভুলেই গেছ নাকি?’
‘ ব্যস্ত ছিলাম।’
‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। জানি সব। রাগ টাগ রেখে সংসারে মন দাও। যা হওয়ার হয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো।’
মায়ের এমন কথায় বিরক্ত ইয়াভকিন। চুপচাপ শুনে গেল। কাজল নিজের বক্তব্য শেষ করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ পূর্ণতা কোথায়?’

ইয়াভকিনের চোখে ভেসে উঠল বৃষ্টিস্নাত পূর্ণতার মুখশ্রী! কাজল লেপ্টানো চোখগুলো বন্ধ করে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যেন মেয়েটা। পরপর কাজল আবার প্রশ্ন করতেই অপ্রস্তুত গলায় উত্তর দেয়,
‘ ও ঘুমোচ্ছে মা।’
‘ এখন কিসের ঘুম?’
‘ ওর খালার বাসা থেকে এসেছি একটু আগে। ক্লান্ত সেজন্য ঘুমিয়ে গেছে।’
‘ ওহ।’

ইয়াভকিন ঢোক গিলে খুব করে গলা দিয়ে উচ্চারণ করতে চাইল,
‘ বৃষ্টিস্নাত মেয়ে কি একটু বেশিই সুদর্শনা মা? চোখে ভাসে শুধু? কাজল লেপ্টানো বড় বড় চোখগুলোয় কি হুট করে এমন মায়া মায়া লাগে? বন্ধচোখের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে কি মুক্ত দানার ন্যায় লাগে? ওর মতো লাস্যময়ী লাগে? আমার নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে কেনো, মা?’

চলবে।