বৃষ্টি তোমাকে দিলাম পর্ব-১১+১২

0
235

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-১১

ইউনিভার্সিটি লাইফে এলোমেলো ভাববার খুব একটা সময় পাওয়া যায় না৷ গেলেও সেটা প্রায়ই চাপা পরে যায় পড়াশোনার চাপে। আমিও সেই চাপে পড়ে গেলাম৷ টানা ক্লাস, টিউটোরিয়াল, প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট, একেবারে যা তা অবস্থা! একটু আধটু সময় যাও বা বের করতে পারি, হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাই। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

পরীক্ষার মধ্যে একদিন বর্ষণ ফোন করে জানাল বাজারে তার নতুন বই এসেছে।

বললাম, “দারুণ ব্যাপার।”

সে মন খারাপ করে বলল, “যার প্রথমে বইটা পড়ার কথা ছিল সে নিজেই কিন্তু পড়েনি! তার ওপর তুমি জানোও না আমার বইয়ের কথা।”

“ফেসবুকে থাকি না বর্ষণ, আমি সময় পাচ্ছি না বলেছি তো!”

“তুমি কি ইচ্ছে করে আমার সাথে কথা কমিয়ে দিচ্ছ ধারা?”

“কেন সেরকম মনে হচ্ছে?”

“নো আইডিয়া! মনে হলো তাই বললাম।”

“সেরকম কিছু নয় বর্ষণ।”

“তোমার জন্য বইটা কুরিয়ার করেছি।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। পড়বে কিন্তু সময় করে।”

“অবশ্যই।”

“ধারা তোমাকে অনেকদিন দেখিনি।”

“তো?”

“ভিডিও কল করবে?”

আমার নিজেরও ইচ্ছে হছিল বর্ষণকে দেখার। কিন্তু যা অবস্থা আমার! এই চেহারা দেখলে ভূত পালাবে! মানা করে দিলাম। সে একটু ক্ষুন্ন হয়ে বলল, “আচ্ছা থাক।”

“বাড়ির সবাই কেমন আছে?”

“মারাত্মক আছে। চিনি রিনি দুটিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল রান্নাঘরে। ভাগ্য ভালো সেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা গেছে দ্রুত।”

“বলো কী? কবে হলো?”

“সপ্তাহখানেক হবে।”

“আমি কিছু জানি না কেন?”

বর্ষণ এবার একটু রাগ করেই বলল, “তুমি জানার চেষ্টা করলে তো জানবে।”

“কিন্তু আমি…” কথা খুঁজে পেলাম না। এটা সত্যি যে আমি ইচ্ছে করেই সময় বের করি না। চাইলে কথা বলা যায়। কিন্তু ব্যস্ত থাকতে চাচ্ছি।

বর্ষণ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, “রাখি।”

বইটা এলো তাড়াতাড়িই, কিন্তু কুরিয়ার অফিসে যাওয়ার সময় হয়নি বিধায় সেটা আর নেয়া হলো না আমার। ফেরত চলে গেল বর্ষণের কাছে। কোন দিক দিয়ে এসব হলো কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার মনেই ছিল না কুরিয়ার থেকে ফোন এসেছে! ছেলেটা রাগ করে বসল। আমি কয়েকদিন রাগ ভাঙানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ক্ষান্তি দিলাম। কোনো প্রয়োজন নেই এত রং ঢং এর!

অবশেষে মাসখানেক ধরে প্রেশার কুকারে সেদ্ধ হওয়ার পর একটু শ্বাস নেবার সময় মিলল। সপ্তাহখানেক পর ঈদের ছুটি। অনেকদিন নীনার সাথে গল্প হয় না, অতএব ওর কাছেই সবার আগে গেলাম।

ঘরে ঢুকতেই পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে এলো।

“তুই আজকাল পারফিউম মাখিস নাকি?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দেখলাম ওর ঘরে চেহারাও বদলেছে। অনেকটা গোছানো, পরিপাটি। আমি অবাক হয়ে গেলাম।

নীনা মিষ্টি হেসে বলল, “বোস।”

“ঘটনা বল আগে।”

“বলব সব। তুই আগে বল তোর ঘটনা কী?”

“আমার আবার কী হবে?”

“ওইযে রাজশাহীর উনি?”

“ধুর! কিছু হয়নি।”

“কেন? প্রপোজ করেনি?”

“এখনো না।”

“তবে?”

“পছন্দ করে, কিন্তু আর কথা এগোয়নি।”

“কী আজব!”

“আজবের কী আছে?”

“কিছু না।”

“নীনা, সত্যি করে বল কী হয়েছে?”

সে লজ্জা পেয়ে গেল। আমকে নিজের মোবাইলে অনেকগুলো ছবি দেখাতে লাগল। সেই যে শাড়ি পরেছিল সেদিনকার ছবি। সুন্দর হয়েছে ছবিগুলো। এরপরেও আরেকদিন সাজগোজ করেছিস। সব ছবি দিয়ে ভর্তি গ্যালারি। আগে ওর মোবাইলে লেকচার শীট আর নোটের ছবি ছাড়া কিছু পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ!

আমি জিজ্ঞেস করার আগে সে বলল, “যা ভাবছিস তাই৷ কিন্তু এখনই আর কিছু বলব না রে। নিষেধ আছে।”

আমি বেকুবের মতো মাথা ঝাকিয়ে বললাম, “ওকে!”

ও আমাকে উপদেশ দিল, “শোন ধারা, প্রেম করে বিয়ে করে ফ্যাল। এত পড়াশোনা করে কী হবে?”

আমি এবার হতাশ ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকালাম। ওর টেবিলের ওপর ধুলো জমেছে। আজীবনের অগোছালো টেবিল গোছানো। হঠাৎ মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মানুষ কত দ্রুত বদলে যায়!

ঈদের ছুটি পড়ে গেল। ছুটলাম বাড়িতে। কতদিন পর বাড়িতে ঢুকে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম। শ্রান্তি-ক্লান্তি সব ধুয়ে গেল বাড়িতে ঢুকেই।

ভেবেছিলাম বর্ষণের সাথে গল্প করব, ওর সাথে সেই যে মন কষাকষি হয়েছে, এরপর আর ঠিক হয়নি৷ কিন্তু এসেই শুনলাম তারা ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেমন যেন ফাঁকা লাগতে থাকল সবকিছু।

ঈদের সময়টাতে রাশিক মোটামুটি ফ্রি। ব্যস্ততায় ফেসবুকে থাকার সময়কাল যেখানে আধঘন্টার গন্ডি পেরোয় না, সেখানে সে দিনে তিন চার ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে। তার সেই কাঙ্ক্ষিত চাকরিটা হয়ে গেছে। তাই এখন পড়াশোনা নিয়েও নেই। সেই পড়ুয়া ছেলেটাই যখন আমার সাথে হাস্যরসাত্মক লেখা শেয়ার করে, মজার মজার কৌতুক শোনায়, ঘুরতে গিয়ে কত রকম সকমের সেলফি তোলে, আমি চিনতে পারি না। অদ্ভূত রকমের ভালো লাগে। সবসময় রুটিন মেনে চলে বলে বোধহয় চেহারায় আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে যেটা বেশি আকর্ষণ করে।

এই টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে ঈদের ছুটি চলে গেল। ঈদে ফুপিরা বেড়াতে এসেছিলেন। সুযোগে আমাকে বিয়ে নিয়ে কিছু উপদেশ দিয়ে গেলেন৷ কিছু পাত্রের বায়োডাটা ধরিয়ে দিয়ে গেল। মা বাবাও দেখলাম বিয়ে নিয়ে একটু আধটু বলাবলি করছেন। যদিও সারাজীবন বাবা বলে এসেছেন, “আমার একটাই মেয়ে, বিয়েই দেব না। সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেব। বিয়ে দিলেও ঘরজামাই নিয়ে আসব।”

সেই বাবাও দেখি বিয়ে বিষয়ে কথা উঠলে তাতে সাগ্রহে যোগ দিচ্ছে। কে জানে এদের কাকে পছন্দ হয়! তার আগেই রাশিকের ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে হবে!

এদিকে ছুটি ফুরোতেই আমি আবার ছুটলাম ক্যাম্পাসে।

দিন গড়িয়ে যেতে থাকল তার নিজের মতো। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে ঘুরে আরও কতটা পথ অতিক্রম করে ফেলল! শুধু আমি এখনো কোথাও নড়েচড়ে বসতে পারলাম না!

হঠাৎ একদিন রাশিক ভোরবেলা আমাকে ফোন করে বলল সে আমার ক্যাম্পাসে আসছে, ঘুরবে।

আমি একটা হালকা বেগুনি রঙের জামা পরলাম। চুল খোলা রাখব নাকি বাঁধব ঠিক করতে না পেরে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকে ফেললাম সামনের চুলগুলো। আর হালকা লিপস্টিক দিলাম৷ এই সাজই ভালো।

রাশিকের সাথে দেখা হলো গেটের কাছে। সে একটা হালকা নীল শার্ট, কালো জিন্স আর কেডস পরে এসেছে। চোখে সানগ্লাস। ছবির চেয়ে বাস্তবে বেশি সুন্দর মানুষ।

সে প্রথমেই হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “আপনাকে ডিসটার্ব করলাম না তো?”

আমি হাসলাম শুধু। নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে! অবশ্য আমি বকপটু নই কখনোই।

আমরা হেঁটে হেঁটে অনেকদূর পর্যন্ত গেলাম। তারপর একই পথে আবার ফিরলাম। দু’পাশে গাছপালার সারির ঘন সবুজের মধ্যে দিয়ে নানা আকাশ পাতালের কথায় মশগুল হয়ে হাঁটতে থাকলাম পাশাপাশি। কখনো বা গাছের ফাঁক থেকে দু’একটা পাখির ডাক শোনা যায়। একটা দুটো রিকশা টুংটাং শব্দ তুলে চলে যায় পাশ কাটিয়ে। আকাশে আজ মিষ্টি রোদের আভাস। পুড়িয়ে দেবার ইচ্ছে নেই যেন৷ একটা দোকান থেকে ওয়ান টাইম কাপে কফি নিয়ে পিচঢালা পথের পাশে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে গেলাম। তার কথার যেন খই ফুটেছে। কী থেকে কী বলবে বুঝতে পারছে না। আমি তেমন কিছু না বলে শুধু শুনছি।

দুপুর হয়ে এলে একটা খাবারের দোকানে ঢুকলাম। একটা টেবিলে বসে খাবার অর্ডার দেয়ার পরপরই আমার বন্ধুর দল কোথা থেকে হুড়মুড় করে ঢুকল দোকানে। আমাকে দেখতে পেয়ে সে কি উল্লাস তাদের! আর টিপ্পনী কাটা, এটা-সেটা ইঙ্গিত করা তো আছেই! লজ্জায় মাথা কাটা যাবার অবস্থা! এদিকে রাশিককে দেখি মাথা নিচু করে হাসছে।

খাওয়ার পর্ব চুকে গেলে তাকে আমার ডিপার্টমেন্টটা ঘুরিয়ে আনলাম। কয়েকটা ছবিও তোলা হলো।

এরপর বিকেল হয়ে এলো। সে ফিরবে। এখন যাবে কোনো এক বন্ধুর বাসায়। সেখান থেকে নিজের বাড়ি।

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি পাশাপাশি, হঠাৎ দেখি সে নেই। কোথায় গেল? আমায় না বলে বাসে উঠে গেল না তো? ভাবতে ভাবতে একটু পর দেখি সে আসছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে চট করে আমার হাতটা ধরে ফেলল। আমি চমকে উঠলাম, কিন্তু হাত সরালাম না। সে আমার হাতে একটা বেলীফুলের মালা জড়িয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে হাতের মুঠিতে দিয়ে লাফিয়ে একটা বাসে উঠে চলে গেল।

আমি বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধাতস্থ হয়ে চিরকুট খুলে দেখি লেখা-

“তোমাকে খুব ভালো লেগে গেছে মেয়ে!
এই অধমের সাথে একটা জীবন পার করা যাবে কি?”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-১২

“তুমি আমার সাথে এভাবে বিট্রে করতে পারলে? আমি কত আশা করেছিলাম তোমার সাথে নীল পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট কাঠের ঘরে বাসা বাঁধব? বৃষ্টি এলে বাঁশের মাচায় হাত ধরাধরি করে বসে হা করে বৃষ্টি গিলব? বলেছিলাম তোমাকে আমার স্বপ্নের কথা! তবু তুমি পারলে এমন করতে?”

“কিন্তু আমি কিছু করিনি।”

“করেছ। তুমি রাশিককে বিয়ে করতে চাও সেটা আমাকে আগে বললেই পারতে। বন্ধুত্ব করলে কেন? সময় দিলে কেন?”

“তুমি বন্ধুত্বটাকে অন্যভাবে দেখছ কেন?”

“তুমি গ্রীন সিগন্যাল দিয়েছ তাই।”

“মোটেও না।”

“আমার প্রেমিকার কথা শুনে তবে জ্বলেপুড়ে গেলে কেন?”

“আমি জ্বলিনি। মিথ্যে বলো না।”

“তুমি মিথ্যে বলছ। আমার কাছে, নিজের কাছে। ওই ছেলেটার ক্যারিয়ার দেখে পাগল হয়ে গেছ। আমি কিছু করি না, তাই আমার সাথে প্রেম করা যায় না, আমাকে বিয়ে করা যায় না তাই তো?”

“না। ভুল বুঝছ তুমি।”

“ঠিক বুঝেছি। তুমিও অন্য সব মেয়ের মতোই। আলাদা কিছু নও।”

“এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে!”

“আমার সাথে আর কথা বলতে হবে না। গুডবাই।”

“বর্ষণ শোনো…”

আমি দৌড়াতে শুরু করলাম বর্ষণের পিছু পিছু। সে ঢিমেতালে হাঁটছে। অথচ আমি দৌঁড়েও তাকে ধরতে পারলাম না। হারিয়ে গেল কুয়াশায়।

আমি উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে ঘোলাটে আলো আসছে। নীরা আপু ঘুমাচ্ছেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে। আমি শীতে অল্প কাঁপছি।

এখন ভরা বর্ষাকাল। অবিশ্রান্ত বর্ষণ হচ্ছে তিনদিন ধরে। আমি ক্লাসে যাই না, ঠিকমতো খাই না, সারাদিন আবোল তাবোল ভাবি আর রাতে ঘুমালেই আজগুবি স্বপ্ন দেখি। এমন নয় যে খুব মানসিক চাপে আছি, তবে কেমন যেন অদ্ভূত অনুভূতির মেঘ সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। বৃষ্টির জলের মতো ঝুপঝাপ করে কী একটা যেন নামতে থাকে মনের জানালায়। কালচে আকাশ আর শীতল হাওয়া মনে বরাবরের মতো ভালোলাগার জন্ম দেয় না, বিষাদের মেঘ ঘনিয়ে আসে আরও। আমি কী চাই? জানি না! এসব আজব স্বপ্ন দেখার মানে কী? কখনো দেখি রাশিক প্রশ্ন করছে, তো কখনো বর্ষণ। দুজনেই নিজ নিজ জায়গায় ঠিকঠাক। সমস্যা আমার মনে। এতকিছুর পরেও আমি মন থেকে সেই সাড়াটা পাচ্ছি না যেটা বহু আগেই পাওয়ার কথা ছিল! নিজের কাছে প্রশ্ন করে করে আমি ক্লান্ত!

ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমি জীবনে প্রথমবার প্রেমে পড়েছিলাম। গার্লস সেকশনের ক্লাস শেষ হতো সাড়ে এগারোটায়, বয়েজদের শুরু হতো বারোটায়৷ আমি যখন ছুটির পর বের হতাম, তখন ছেলেটাকে দেখতাম গেটের পাশে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন চোখাচোখি হতো, একটু করে ভালোলাগা বাড়ত। একদিন আমার বান্ধবীকে দিয়ে খবর পাঠাল, দেখা করলে খুশি হবে। দেখা করলাম প্রথমবার। তারপর আরও কয়েকবার। হাত-ধরাধরি করে ভয়ে ভয়ে হাঁটা। এক কাপে চা খাওয়া ইত্যাদি টুকিটাকি প্রেম চলল। তারপর এসএসি, শহরের দুই প্রান্তের কলেজে ভর্তি আর শেষে তার নতুন প্রেমিকা। সব মিলিয়ে আমার প্রথম প্রেমের ইতি ঘটিয়েছিল এরাই। কিন্তু সেই সময়ে মনের যে একটা টান ছিল, যে আকর্ষণ, যে ভালোবাসা সেটা আর কক্ষনো কারো জন্য আসেনি। না, সেই ছেলের জন্য কোনো অনুভূতি এখন অবশিষ্ট নেই, শুধুই স্মৃতি। কিন্তু অন্য কারো জন্য কেন হবে না?

সেদিন পুরোটা সময় তার চালচলন, কথাবার্তা, সুন্দর চেহারা দেখে আমি বারবার তার প্রেমে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টাই শুধু করে গেছি!

আমি রাশিককে ‘হ্যাঁ’ বলে দিতেই পারি! কিন্তু যদি কখনোই তার প্রতি মুগ্ধতার চেয়ে বেশি ভালোবাসার জন্মই না নেয় তবে? সারাজীবন এভাবে কি কাটতে পারে?

রাশিককে বলেছি একটু সময় দরকার। নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে বিয়ের কথা ভাবব। সে রাজি হয়েছে, কিন্তু বলেছে জলদি করতে। কারণ তার বাড়িতে বিয়ের জন্য জোরাজোরি করতে শুরু করেছে।

রাতে কিছু খাইনি। সন্ধ্যায় খুব ঝাল করে বানানো মুড়িমাখা খেয়েছিলাম নীরা আপুর সাথে। তাই আর খেতে ইচ্ছে হয়নি। শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি, হঠাৎ বর্ষণের মেসেজ এলো।

ওর সাথে ঝামেলা মিটে গেছে এখন৷ কথাবার্তা হয় প্রায়ই। আগের মতো সাড়া দেয় না৷ আজ এমন কী হলো যে এত মজার একটা মেসেজ লিখেছে?

“ধারা! তুমি কি বৃষ্টির ধারা নাকি ধারাবাহিক নাটক?”

উত্তর দিলাম, “কী বলতে চাও?”

“কিচ্ছু না। কেমন আছেন ম্যাডাম?”

“যেমন থাকার কথা।”

“খুব জঘন্য? বাড়ি থেকে দূরে কেউ ভালো থাকে না। জানি।”

“সেজন্য না।”

“সেজন্যই। বাড়ি চলে এসো। কতদিন দেখা হয় না!”

“তুমিই তো ঈদে ছিলে না।”

“এবার এসো, থাকব।”

“আসব।”

“ওখানে বৃষ্টি হয়?”

“খুব!”

“এখানেও।”

“বাহ।”

“তোমার কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো শেষ হয়ে গেছে।”

“তা তো হবেই।”

“তোমাদের বাড়িটা মৃত মনে হয় জানো?”

“মা বাবা আছেন তো।”

“তবুও।”

“কী আর করার!”

“তুমি এবার বৃষ্টিতে ভিজেছ?”

“না।”

“এর কোনো মানে হয়? আমি ভিজছি রোজ।”

“জ্বর আসে না?”

“উহু! ভিজতে ইচ্ছে করে না তোমার?”

“জানি না।”

“খুব বেশি বিষন্ন?”

“হুম।”

“মন খারাপের টনিক আছে আমার কাছে।”

“কী শুনি?”

“কী করছ শুনি?”

“শুয়ে আছি।”

“উঠে পড়ো। ভিজতে চলে যাও। দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে।”

“পাগল?”

“তা খানিকটা। তবে ট্রাই করে দেখতে দোষ কী?”

“ধুর!”

“আমি ওয়েট করছি ধারা। যাও। এসে মেসেজ দিও।”

ওর পাগলামি বুদ্ধি আমারও কেমন মাথায় চড়ে গেল আচমকা। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়ে এক দৌড়ে চলে গেলাম নিচে। হলের মাঝে গোল চত্বরে কাঠগোলাপ গাছের নিচে সিমেন্টে বাঁধানো বেদীতে গিয়ে বসলাম। বৃষ্টির জল গাছের পাতা চুইয়ে পড়তে পড়তে মিনিটখানেকের মাথায় ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমায়। আমি চুপটি করে ভিজতে থাকলাম৷ বৃষ্টির শব্দ বাদে চারদিক নিস্তব্ধ। প্রায় সবাই ঘুমে, আঙ্গিনার বড় বাতিটা ছাড়া প্রায় সব আঁধার। সেটার উল্টোদিকে বসেছি বলে সহজে কেউ দেখবে না আমায়। ঠান্ডা পানির কণাগুলো কাটার মতো বিঁধছিল শুরুতে। এখন অসম্ভব ভালো লাগছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাবার অবস্থা, তবু বসে রইলাম। মনের মেঘ বৃষ্টি হয়ে কখন ঝরে গেল টেরই পেলাম না।

আধঘন্টা পর উঠে গোসল করে জামাকাপড় বদলে শুতে গেলাম। বর্ষণ তখনো জেগে। লিখলাম, “ভিজেছি।”

সাথে সাথে উত্তর এলো, “দারুণ! এবার ফিলিংস বলো।”

“খুব খুব ভালো।”

“থ্যাংস দাও।”

“অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

“ফোন করি? কতদিন গলা শুনি না তোমার!”

“করো।”

অনেকদিন পর বর্ষণের গলা শুনে এত ভালো লাগল, বলার মতো না। তবে ভেজার কারনে নাকি ক্ষুধায় কে জানে, ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিল। কখন ঘুমিয়েছি জানি না। সকালে যখন উঠলাম, দেখি বর্ষণ মেসেজ দিয়ে রেখেছে, “জানো ধারা, তুমি হালকা নাক ডাকো। আমি রেকর্ড করে রেখেছি। কী কিউট!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু