বৃষ্টি তোমাকে দিলাম পর্ব-০৩

0
244

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-৩

ছুটির দিন৷ সকালবেলা বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে। কী এক কারণে জানি না, মা চিৎকার করে বলছেন, “আমি বলেই তোমার মতো মানুষের সাথে সংসার করি। অন্য কেউ হলে করত না।”

চিরাচরিত মায়েদের ডায়লগ!

তারপরের কথোপকথন এমন-

বাবা- তাহলে থাকছ কেন? চলেই যাও!

মা- হ্যাঁ! আমি চলে যাই আর তুমি আরেকটা বিয়ে করো। বিয়ে করার খুব শখ না? তোমার শখ আর পূরণ করতে দেব না এই জন্মে!

বাবা- আমার শখ যাতে পূরণ না হয় সেজন্য কষ্ট করে থাকবে আমার সাথে?

মা- তাই-ই!

বাবা- তারপরেও তুমি ভাবো তুমি আমার খুব কেয়ার করো?

মা- কেয়ার করতে গেলে কী করতে হবে? আরেকটা বিয়ে করতে দিতে হবে?

বাবা- না, সেটা না…

মা- করো তাহলে। আমি চলছি।

বাবা- যাবে কোথায়?

মা- জানোই তো যাওয়ার জায়গা নেই, সেজন্য পড়ে আছি। চাইলে আরো দশটা বিয়ে করোগে যাও, আমার সাথে কথা বলতে এসো না। সকাল সকাল মেজাজ খারাপ করতে আসছে…

তারপর মা রান্নাঘরে হাড়ি পাতিলের তুমুল শব্দ করতে করতে নাস্তা বানাচ্ছে। বাবা অপরাধী মুখ করে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এটা সেটা সাহায্য করার চেষ্টা করছে। মা ও মানা করছে না। করুক কাজ।

এটা প্রায়দিনের দৃশ্য। আমার মনে হয় এরা ইচ্ছে করে এমন ঝগড়াঝাঁটি করে, তারপর বাবা সারাদিন পেছনে ঘুরে ঘুরে দেনদরবার করে মাকে মানিয়ে ফেলে। শেষে দুপুরে খাওয়ার সময় হলে দেখা যায় সব ঠিকঠাক। আজও তাই হলো!

খেতে বসে বাবা একগাল হেসে বললেন, “বিনু, আজকের মাংসটা এত ভালো হয়েছে! কী বলব!”

মাও হেসে বললেন, “তুমি একটু খুন্তি দিয়ে নাড়া দিলে না, সেজন্য মজা বেড়ে গেছে। তোমার হাতে জাদু আছে তো।”

বাবা বিদ্রুপটা মোটেও গায়ে না লাগিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেতে থাকলেন।

খাওয়াদাওয়া শেষে বললেন, “বিকেলে ওই বাড়িতে নিয়ে যাব তোমাদের। আলাপ হয়ে যাবে।”

বর্ষণের সাথে যে আমার আলাপ হয়ে গেছে সেটা আর জানালাম না।

বিকালে বাবা আমাদের নিয়ে গেলেন বর্ষণদের বাড়িতে। বাবার এই বন্ধুটির সাথে পরিচয় বিদেশ গিয়ে। বাবা পড়াশোনা শেষ করেছেন লন্ডন থেকে। সেখানে তার রুমমেট ছিলেন বর্ষণের বাবা। দেশে ফেরার পর তাদের যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। বহুদিন পর যোগাযোগ হয়েছে ফেসবুকের কল্যানে। তখন চাচা একটা জায়গা খুঁজছেন বাড়ি করবেন বলে। বাবা বিক্রি না হওয়া নিজের বাড়ির পাশের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছেন।

আমরা ওই বাড়িতে ঢুকে দেখি গৃহযুদ্ধ চলছে। দুই অতি পাজি মেয়ে ছুটোছুটি করে এখানে সেখানে লুকিয়ে পড়ছে, তাদের মা লাঠি হাতে তাড়া করছে। মোটাসোটা শরীর নিয়ে দুটো হ্যাংলা বাচ্চার পেছনে দৌঁড়ানো মোটেও সহজ কাজ নয়৷ ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। আমাদের দেখে হয়ে পড়লেন বিব্রত।

বাবা সালাম দিয়ে পরিচয় দিতেই হাসিমুখে আমাদের নিয়ে বসালেন ড্রইংরুমে।

আন্টি যে অত্যন্ত শৌখিন সেটা বোঝা গেল বসার ঘরটা দেখে। সোফার কুশনগুলো নিজের হাতে নকশা করে। দেয়াল, টি টেবিলের ওপর, কর্নার, সব জায়গায় শোভা পাচ্ছে হাতের তৈরি নানা জিনিস। এক নজরেই বোঝা যায় বাইরে থেকে কেনা নয়।

চাচা এলেন আমাদের খবর পেয়ে। দুই বন্ধুতে গল্প জুড়ে দিলেন। আমাকে খেয়াল হতেই বললেন, “আরে মেয়ে! কেমন আছো? কী নাম তোমার? কত বড় হয়েছ! পড়ছ কোথায়?”

এত প্রশ্নে আমি যখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মৃদু হাসলাম, তখন আন্টি নাস্তা নিয়ে এলেন। হালকা খেয়ে আমি উঠলাম বাচ্চাদুটোর খোঁজে।

দুটিতে বারান্দার এক কোণে বসে খেলছে। একজন পিড়ি বেলুন দিয়ে অদৃশ্য রুটি বেলতে ব্যস্ত। অন্যজন পাশেরটার দিকে চোখ বাঁকা করে তাকিয়ে বলছে, “বউমা, রুটি এমন ত্যাড়া হলো কেন? গোল করে বানাও।”

“জি মা।” বলে বড়সড় ওড়না দিয়ে বানানো শাড়ির ঘোমটাটা একটু টেনে দেয়।

আমি খেলা দেখে হতভম্ব। আর আমাকে দেখে দুজন ছুট!

পেছন পেছন গিয়ে একটা ঘরে ঢুকতেই বর্ষণের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচলাম। সে বোকার মতো হেসে ফেলল। বলল, “আসুন ভেতরে।”

তার ঘরভর্তি বই। পড়ার বই, গল্পের বই, ইতিহাসের বই। বাপরে! এত বই পড়ে কে জানত!

বাচ্চাদুটো দেখি খাটের রেলিং এর ওপর উঠছে আর লাফিয়ে পড়ছে বিছানায়৷

বর্ষণ পড়ার টেবিলের চেয়ার এগিয়ে দিল। বসেই চোখে পড়ল একটা বইয়ের দিকে। নাম ‘শ্রাবণ সন্ধ্যায়’। লেখকের নাম ‘বর্ষণ আহমেদ’। বই হাতে নিতেই দুই পিচ্চি চেঁচিয়ে বলল, “ভাইয়ার বই! ভাইয়ার বই!”

নিঃসন্দেহ হলাম, লেখকটি ইনিই। জনাব লেখক দেখি লজ্জায় লাল। বলল, “একটু লেখালেখি করি আরকি।”

“বইটা নিতে পারি?”

“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”

“একজন লেখকের সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম। কি দারুণ! কাল তো বললেন না লেখালেখি করেন?”

সে আরেকটু লজ্জা পেয়ে বলল, “লেখালেখি এখন আর কেউ ভালো চোখে দেখে না কি না! তার ওপর নিজেকে লেখক বলে বেড়াতেও সংকোচ লাগে।”

“বলেন কী!”

সে যেন আরেকটু লজ্জা পেল।

বললাম, “পড়ে জানাব কেমন লাগল।”

“অবশ্যই। অপেক্ষায় থাকব।”

আন্টি ততক্ষণে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে এখানে। চায়ের কাপ দিয়ে বললেন, “নাও আম্মু।”

বর্ষণ করুণ মুখে জিজ্ঞেস করল, “আমার চা?”

“তোর কত কাপ চা লাগে? সকাল থেকে তো চার কাপ খেলি! এই চিনি-রিনি আয়। দুটোর জ্বালায় আমি শেষ। দুপুর থেকে কিচ্ছু খায়নি৷ মেহমানরা মিষ্টি এনেছে, অনেক মজা। একটু খাবি। আয় তো…”

দুটোকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি টেবিলের ওপর রাখা একটা খালি কাপে অর্ধেকটা চা ঢেলে দিয়ে বললাম, “খান।”

বর্ষণ অবাক হয়ে বলল, “এটা কী হলো? আপনাকে দিয়েছে তো। আমি পরেও খেতে পারব..”

“আমার একা কিছু খেতে ভালো লাগে না।”

চায়ের কাপ হাতে উঠে জানালার ধারে গেলাম। জানালার পাশেই হাস্নাহেনার ঝোপালো গাছ। অতিরিক্ত ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে গাছটা। এই গাছ জড়িয়ে আবার বেড়ে উঠেছে অপরাজিতা। নীল অপরাজিতা ফুটে আছে অনেকগুলো। আজ বৃষ্টি না পড়লেও আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা বাতাস বইছে। এই বাড়ির পরিবেশও কেমন যেন মন ভালো করা সতেজ, শীতল।

বর্ষণের দিকে তাকাতেই দেখলাম চায়ে চুমুক দিচ্ছে আনমনে। কী যেন ভাবছে। চোখদুটো স্বপ্নালু।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু