বৃষ্টি তোমাকে দিলাম পর্ব-০৮

0
228

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-৮

ফোন হাতে নিয়ে বসে আছি। কল করব কি না বুঝতে পারছি না। বেশিই রাগ দেখানো হয়ে গেছে বিকেলে, তাও আবার শুধু শুধু। জানালার ধারে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম৷ তারার ফুল ফুটে আছে আকাশজুড়ে। মৃদু বাতাসে দুলছে কৃষ্ণচূড়ার শাখা।

সবাই বলে আমার মধ্যে খানিক দার্শনিকতা আছে। এই আকাশের দিকে তাকিয়ে কতকিছু ভেবে ফেলি! আচ্ছা, হাজার বছর আগের কোনো এক রাতেও কি এমনিভাবে কৃষ্ণচূড়ার শাখা দোল খেত গ্রীষ্মের বাতাসে? আকাশভর্তি তারার দল জ্বলজ্বল করত? তখন মানুষেরা কী করত? বনে বনে ঘুরত শিকারের সন্ধানে? এমন এক হাজার বছরের প্রাচীন রাতে যদি জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ আমার সাথে বর্ষণের দেখা হয়ে যেত? গাছপালার শেকড়বাকড় নিয়ে কথা বলতাম আমরা, কথা বলতাম শিকার নিয়ে, আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি নিয়ে? নাকি তখন কথা আবিষ্কৃত হয়নি? শুধু শরীরী ভাষা?

চিন্তার দৌড় কোথায় চলে যেত কে জানে! ভাগ্যিস ফোনটা এসেছিল! দেখি বর্ষণের ফোন।

“রাগ কমেছে ম্যাডাম?”

“স্যরি!”

“স্যরি কেন?”

“তখন অকারণেই তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করলাম।”

“ধুর! ওসব কখন ভুলে গেছি। সারাদিন বকার ওপরেই থাকি।”

“কেন বলো তো?”

“মায়ের বকাঝকা ওই দুই বিচ্ছুর জন্য আমাকেও কম সহ্য করতে হয় না।”

আমি হেসে ফেললাম।

বর্ষণ জিজ্ঞেস করল, “যদি আজ্ঞা হয় তো কথাটা জিজ্ঞেস করতাম।”

“কী কথা?”

“কাল রাগ করলে কেন?”

আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। রাগ করার কিছু ছিল না আদৌ। ওর প্রাক্তন প্রেমিকার কথায় রাগ করার কী আছে? আমি কি এতটাই ইম্যাচিউর? কী উত্তর দেব ভাবছি, সে বলল, “আচ্ছা থাক বলতে হবে না।”

আমি বললাম, “সত্যি বলতে কী, আমি নিজেই জানি না। মা বলে আমার মাথা খারাপ। মাঝেমাঝে উল্টোপাল্টা সিগন্যাল দেয়।”

বর্ষণ হো হো করে হেসে ফেলল। বলল, “ধারা, তুমি গ্রামের বাড়ি যাও?”

“না, গ্রামে কেউ থাকে না বলে যাওয়া হয় না।”

“আমাদের গ্রামের বাড়িতে এক পাগলনী থাকে। সে কী করে পাগল হয়েছে কেউ ঠিকঠাক বলতে পারে না। তবে তার ধারণা তার বিয়ে হয়েছিল এক জ্বিনের সাথে। জ্বিন তার মাথায় একটা ঝিঁঝি পোকা ঢুকিয়ে দিয়ে ছেড়ে চলে গেছে৷ এখন সারাদিন সেই পোকা বিজবিজ শব্দ করতে থাকে। আর সে এলোমেলো কাজ করে। তোমার কথা শুনে ওর কথাটা মনে পড়ে গেল।”

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, “বর্ষণ! তুমি কি আমাকে পাগল বলছো?”

“না, সেরকম কিছু আমি পাগল হলেও বলব না।”

“তোমার সাথে আড়ি!”

“আচ্ছা আড়ি।”

“রাখলাম ফোন।”

“ধারা শোনো!”

সে প্রায়ই এমন করে নাম ধরে ডেকে ওঠে যে শুনলে কেমন যেন অদ্ভুত রকম ভালোলাগায় মন ছেয়ে যায়। বললাম, “বলো।”

“পরে বলব৷ এখন রাখি।”

“কথা ঝুলিয়ে রাখার মতো খারাপ আর কিছু হয় না বর্ষণ!”

সে হেসে ফোন কেটে দিল। আমি রাগ করতে গিয়েও করতে পারলাম না।

ফোন রাখার পর রাশিকের কয়েকটা মেসেজ পেলাম। একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে। লিখেছে, “আগে তো এত ব্যস্ততা দেখাতে না।”

উত্তর দিলাম, “পরিবারের সাথে সময় কাটাতে হয়!”

সে তর্কে গেল না। কিসব হাবিজাবি বকতে শুরু করল। আমি আগে আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনতাম। কথায় তাল রাখার জন্য পড়াশুনা পর্যন্ত করতাম। আজকাল কী হয়েছে যে রাশিককে একদম ভালো লাগছে না? বর্ষণের জন্য? কিন্তু রাশিকের কাছে আসলে বর্ষণ কোনোদিক দিয়েই টিকে উঠতে পারবে না। রাশিকের মতো উচ্চাকাঙ্খা, বাস্তববোধ, চেহারা, স্মার্টনেস কোনোটাই ওর নেই। তবে আমাকে কী টানছে?

রাশিক তার সময়মতো ঘুমাতে গেল। তার আগামীকাল একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। সেজন্য পড়াশুনাও করবে খানিকটা। আমি বেস্ট অফ লাক জানিয়ে দিলাম। সে একটু পর দেখি আবার অনলাইনে এসেছে। বলল, “আমাকে শুভকামনা জানিয়ে একটা ভয়েস মেসেজ পাঠাবে ধারা?”

হঠাৎ এমন কথায় একটু অবাক লাগল। তবে পাঠিয়ে দিলাম। এর আগে কখনো তার সাথে ফোনে কথা হয়নি। অতএব আমার কন্ঠ কেমন সেটা সে জানে না। প্রথমবার শুনে একটু পর লিখল, “দেখো, আমার ইন্টারভিউ কাল খুব ভালো হবে।”

আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। কেন জানি না। রাশিকের প্রোফাইলের ছবিটা একটু খুঁটিয়ে দেখলাম। চোখদুটো বরাবর মুগ্ধ করে। আমার জীবনে প্রেম ভালোবাসা সেভাবে আসেনি। সবসময় ইচ্ছে ছিল বিয়ে করে সেটেল হওয়ার। স্বামীর সাথে প্রেম করার। চোখের সামনে বন্ধুদের প্রেম-বিচ্ছেদ দেখেছি। সেসব ঝক্কির ব্যাপারে জড়াতে ইচ্ছে হয়নি। কাউকে দেখেছি মন ভাঙার সাথে সাথে নিজেও ভেঙে যেতে। কেউ বা সঙ্গীর মন ভেঙেই আনন্দে আটখানা। কারো উদ্দেশ্যই প্রেমিকের সংখ্যা বাড়িয়ে ক্রেডিট নেয়া। কারো বা পছন্দের মানুষের মনোযোগ না পেয়ে নির্ঘুম কাটানো রাতের পর রাত।

নির্ভেজাল প্রেমের অসাধারণ আনন্দও আমাকে মুগ্ধ করে৷ ঝুম বৃষ্টিতে ছাতা ফেলে হাত ধরে ভেজার দৃশ্যে চোখ আটকে যায় সবসময়। প্রিয় মানুষটির বিপদে পাশে আর কেউ না থাকলেও সে থাকে। রাত জেগে ফোনে কথা বলা আর জন্মদিনের সারপ্রাইজ! সব দেখে প্রেম করার ইচ্ছে যে জাগেনি তা নয়, তবে কেন যেন হয়ে ওঠেনি।

প্রথমবার রাশিককে আমি সিরিয়াসলি নিয়েছি। আমার যেমন ছেলে পছন্দ সে তেমনই। একটু পড়াশোনা নিয়ে বকবক বেশি করলেও ভালো আছে। কিন্তু মাঝে কেন মাইন্ড ডাইভার্ট হয়ে যাচ্ছিল তবে?

কারণ কি এটাই যে রাশিকের সাথে সরাসরি দেখা হয়নি? অন্য সবকিছুর মতো ভার্চুয়াল বন্ধুদেরও অবাস্তব, অধরা মনে হতে থাকে? কে জানে!

তবে যেটাই হোক, আজ আবার রাশিকের প্রতি ভালোলাগাটা ফিরে আসছে দেখে ভালো লাগল। তবে ভালোবাসা তো অন্য জিনিস তাই না? শত চেষ্টা করেও কি কাউকে ভালোবাসা যায় যদি না সেই জিনিস টুপ করে আকাশ থেকে পড়ে মনের মধ্যে ঢুকে না যায়?

রাতে বর্ষণ মেসেজ দিলেও সীন করলাম না। ওকে এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো হয়৷ খুব জাঁকিয়ে বসে যাচ্ছে জীবনে। সবকিছুকে পাত্তা দেয়া যাবে না৷ অবিবেচকের মতো কিছু করে বসলে আমাকেই পস্তাতে হবে। দেখা যাক জীবন কোথায় নিয়ে যায়! মোবাইল রেখে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু