বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-২৩+২৪

0
756

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৩
পরন্ত বিকেল বেলা।সূর্য পশ্চিমে হেলে পরেছে প্রায়।আকাশটা লালাভ আভায় ছেঁয়ে গিয়েছে।পাখিরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে।ছুটতে ছুটতে আবার কখনো ভাসমান ওই মেঘের ভেলার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। অদূরে কদম ফুল গাছটায় ফুলে ফুলে গাছটা ভরে আছে।আরাবী মুগ্ধ হয়ে গোধূলি বিকেলের এই অপার সৌন্দর্য দেখছিলো।আরাবী দৃষ্টি সরিয়ে এইবার পুরো ছাদে চোখ বুলালো। জায়ানকে খুজতে গিয়ে আরাবী যেন নিজেকে ফুলের রাজ্যে হারিয়ে ফেললো।এতো এতো ফুল গাছের সমারোহ আর ফুলের বাহার যে আরাবী এই ছাদটাকে ঠিক কি নামে আখ্যায়িত করবে তা ভেবে পেলোনা।হঠাৎ কাঠগোলাপ গাছের দিকে নজর যায় আরাবীর।সেখাকে কি সুন্দর ফুল ফুটে আছে।আরাবী ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেখানে।কাঠগোলাপ গাছটায় আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিতেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে আরাবী।নরম নরম ফুলের পাপরীগুলো ছুঁতে কি যে ভালো লাগছে। হঠাৎ আরাবী কেঁপে উঠে।কারন ওর পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।আর তার মুখশ্রীটা যে ঠিক ওর কাধের উপর তা বুঝতে পেরেছে আরাবী।মানুষটা যে জায়ান তা বুঝার আর বাকি রইলো না।জায়ানের গরম নিশ্বাসগুলো আরাবীর কানে এসে বারি খাচ্ছে।এতে যেন আরাবীর পুরো অস্থিত্ব জুড়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।জায়ান আরাবীর কানে কানে হালকা গলায় বলে উঠে,
-‘ কাঠগোলাপ! তুমি আমার এতো প্রিয় কেন?’

আরাবীর হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে শতোগুন।জায়ান কি ওকে ‘ কাঠগোলাপ!’ বলে সম্বোধন করেছে? নাকি ফুলগুলোকেই বলেছে?আর বললেও এইভাবে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলা কি হলো? আরাবী বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুট দূরে সরিয়ে নিলো জায়ানের থেকে।তারপর পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় জায়ানের দিকে।জায়ান পকেটে দুহাত গুজে বাঁকা চোখে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে।সিল্কি চুলগুলো বাতাসে হালকা দুলছে।সূর্যের লালাভ আভায় লোকটার মুখশ্রীতে পরছে।এতে যেন লোকটার সৌন্দর্যতা দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছে।আরাবী নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো।বেহায়া চোখদুটো দৃষ্টি সরাতে নারাজ।আরাবী মাঝে মাঝে বেশ অবাক হয়। তার কপালে যে এমন একজন সুদর্শন পুরুষ লিখা আছে তা কাশ্মিনকালেও ভাবেনি আরাবী।নিজের ভাগ্য দেখে নিজেই অবাক হয় আরাবী।হঠাৎ জায়ান বড় বড় পা ফেলে একদম আরাবীর কাছে এসে পরলো।আরাবী জায়ান আকস্মিক এমন করায় ভড়কে যায়।পিছাতে নিতেই জায়ান আরাবীর বাহু ধরে একদম কাছে নিয়ে আসে।দুরুদুরু বুক নিয়ে আরাবী চোখ বন্ধ করে ফেললো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
-‘ কি করছেন আ..আপনি?’

জায়ান শীতল কন্ঠে বললো,
-‘ আগে চোখ খুলে তাকাও আমার দিকে।’

আরাবী জায়ানের এমন কথা শুনে পিটপিট করে চোখজোড়া খুলে জায়ানের দিকে তাকায়।জায়ান তাকিয়ে আছে ওর দিকে।সেই চোখে আরাবী দেখতে পাচ্ছে ওর জন্যে এক সমুদ্র ভালোবাসা।সত্যিই কি তাই?জায়ান কি ওকে ভালোবাসে?তবে ওই চোখের দৃষ্টি কেন বারবার আরাবী সেটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।জায়ান আস্তে করে আরাবীর কোমড়ে একহাত রেখে আরাবীকে একদম ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।আরাবী সারা শরীর ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো।জায়ানের প্রতিটা স্পর্শ যেখানেই লাগছে সেই জায়গাটাই কেমন যেন শিরশিরিয়ে উঠছে আর মনে হচ্ছে অবশ হয়ে আসছে।আরাবী সহ্য করতে পারছে না আর।নিজেকে সামলাতে জায়ানের বুকের কাছের টি-শার্ট হাতের মুঠোয় আকঁড়ে ধরলো।জায়ান আরাবীর অবস্থা দেখে বাঁকা হেসে বলে,
-‘ কাঁপাকাঁপি বন্ধ হলো না আর তোমার?’

জায়ানের প্রশ্নে আরাবী লজ্জায় মাথা নিচু করে নিতেই জায়ান সাথে সাথে আরাবীর থুতনিতে হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে নিলো।রোষপূর্ণ গলায় বললো,
-‘ বার বার ওই দৃষ্টি নত কেন হয়?কেন নিজেকে সবার সামনে এতোটা দূর্বল প্রমান করো আরাবী?প্রতিবাদ কেন করতে শিখো না? চোখে চোখ রেখে দৃঢ় সাহস নিয়ে তাকাবে।গলা উঁচিয়ে নিজের জন্যে প্রতিবাদ করবে কেন করো না?এই দূর্বল আরাবীকে সবাই তাহলে কষ্ট দিবে প্রতি মুহূর্তে। আর আমি তা সহ্য করতে পারবো না!’

আরাবীর মনটা ভালোলাগায় ছেঁয়ে গেলো।কিন্তু জায়ানকে আরাবী কিভাবে বলবে?আর যেমন হোক।কিন্তু জায়ানের সামনে আরাবী কখনো মাথা উঁচু করে তাকাতে পারেনা।ওই চোখে চোখ রাখতে পারেনা আরাবী। আর কোনদিন বোধহয় পারবেও না। জায়ান আরাবীর এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিলো।তারপর ওই শক্তপোক্ত হাতটা দিয়ে আরাবীর নরম গাল অতি আদুরেভাবে স্পর্শ করলো।আরাবী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।জায়ান আরাবীর মুখে প্রগাঢ়ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে,
-‘ নিচে ওসব কি হচ্ছিলো?’

আরাবী জায়ানের এমন প্রশ্ন বুঝতে পারলো না।তাই কাঁপাকাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হ..চ্ছিলো?’

জায়ান হালকা আওয়াজে আওড়ালো,
-‘ তামিম তোমার বর?তাহলে আমি কে?আবার ওকে চুমুও দেওয়া হচ্ছিলো তাই নাহ? এই তাকাও আমার দিকে।’

লাস্ট কথাটা ধমকের রেশে বললো জায়ান।আরাবী ভয় পেয়ে চট করে চোখ খুলে তাকায়।জায়ান এইবার ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আরাবীর দিকে তারপর বলে,
-‘ তামিম তোমার বর না হয়েও তুমি ওকে চুমু খেলে।আর আমি তো তোমার সত্যিকারের বর।তাহলে আমি কেন বাদ যাবো?ওকে একটা দিয়েছো।বিনিময়ে আমি ডাবল চাই।’

আরাবী বিষ্ময়ে কি রিয়েকশন দিবে বেমালুম ভুলে গিয়েছে।একটা মানুষ যে এইভাবে বাচ্চাদের সাথে হিংসা করতে পারে তা কখনো ভাবতেও পারিনি আরাবী।আর কি বললো লোকটাকে ডাবল চুমু দিতে হবে?আরাবীর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।গালগুলো লাল হয়ে গিয়েছে। নিশ্বাসের গতি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন।ঠোঁটগুলো তিরতির করে কাঁপছে।সেই কাঁপাকাঁপা ঠোঁটেই আরাবী মিনমিন করে বললো,
-‘ বাই এনি চান্স আপ..আপনি কি জ্বেলাস?’

জায়ান আরাবীর কথাত ভ্রু-কুচকে তাকালো।বিরক্তিকর গলায় বলে,
-‘ অফকোর্স আই এম! তুমি আমার সামনে অন্য একজনকে কিস করবে সেটা দেখে আমি জ্বেলাস হবো না?’

আরাবী জায়ানের এমন কাটকাট গলায় কথাগুলো শুনে হাসি পাচ্ছে ভীষন।লোকটা কেমন বাচ্চাদের মতো আঁচড়ণ করছে।আরাবী বলে উঠে,
-‘ ও একটা বাচ্চা ছেলে।’
-‘ তো?’
-‘ তো মানে আপনি ওকে নিয়ে কিভাবে জ্বেলাস হন।’

জায়ান শক্ত গলায় বলে,
-‘ আমি জ্বেলাস হচ্ছি দ্যাটস ইট।তুমি এখন আমাকে ফটাফট চুমু খেয়ে আমার জ্বেলাসি কমিয়ে দেও।’

আরাবী কি করবে ভেবে পেলোনা।এই ঠোঁটকাটা লোকটা কিসব উল্টাপাল্টা বলছে।আরাবী রিনরিনে কন্ঠে বলে,
-‘ কি করছেন? ছাড়ুন না আমায়।’
-‘ ছাড়বো না!’

জায়ানের সহজ স্বিকারোক্তি।আরাবী আর কিছুই বললো না।চুপচাপ সেভাবেই রইলো।জায়ানও নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আরাবীর মুখপানে।জায়ান হঠাৎ আরাবীর গাল হতে সেই হাতটা সরিয়ে তা আরাবীর মুখের সামনে আনলো। আরাবী জায়ানের হাতের দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেলো।অস্থির কন্ঠে বলে,
-‘ এটা কিভাবে হলো?আপনি আমাকে আগে দেখালেন না কেন?’

জায়ান হাতটা সরিয়ে নিলো।আরাবীকে দুহাতে ধরে আরাবীর মাথাটা ওর বুকে চেপে ধরলো।আরাবীর এতে একটুও ধ্যান নেই।ওতো অস্থির হয়ে আছে জায়ানের হাতে ওই নখের আঁচড়ের দাগ দেখে।আরাবী ধরা গলায় বলে,
-‘ প্লিজ বলুন না ওটা কিভাবে হলো?’

জায়ান আরাবীর কানের কাছে ওষ্ঠ ছুইয়ে দিয়ে বলে,
-‘ হুশ! এটা আমার আমার প্রিয় মানুষটার দেওয়া দ্বিতীয় চিহ্ন।’

আরাবী বুকটা ধ্বক করে উঠলো।জায়ানের প্রিয় মানুষ সেটা আবার কে?আর যদি প্রিয় মানুষ থেকেই থাকে তাহলে ওর সাথে এমন করার কি মানে?জায়ানের ওর প্রতি করা প্রতিটা ব্যবহারে আরাবী স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে জায়ান ওকে ভালোবাসে।জায়ান মুখে না বলুক।তবে জায়ানের চোখ কখনো মিথ্যে বলেনা।আর আরাবী জায়ানের চোখে ওর জম্যে অসীম ভালোবাসা দেখেছে।তবে এখন আবার প্রিয় মানুষ কাকে বলছে জায়ান? হঠাৎ আরাবীর খেয়াল এলো ড্রয়িংরুমে সাথি ওকে হঠাৎ ডাক দেওয়ায় ও ভয় পেয়ে পাশে কারো হাত খামছে ধরেছিলো।আর তা যে কার হাত বুঝতে বাকি রইলো না আরাবীর।লজ্জা পেয়ে জায়ানের বুকে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিলো আরাবী।জায়ান দুহাতে আরাবীকে আকঁড়ে ধরে আছে। আরাবী জায়ানের হৃদস্পন্দনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।চোখ বুঝে অনুভব করছে জায়ানকে গভীরভাবে। এইভাবে কেটে যায় সেকেন্ট,মিনিট,ঘন্টা।কেউ কাউকে ছাড়েনা।দুজন ভালোবাসার মানুষ একে-অপরকে আঁকড়ে ধরে মনের মাধ্যমে ভালোবাসা আদানপ্রদান করছে।হঠাৎ আজানের ধ্বনী কানে আসায় আরাবীর ধ্যান ভাঙ্গে।দ্রুত জায়ানের বক্ষস্থল হতে মাথা সরিয়ে নেয়।ইস,কতোক্ষন ছিলো আরাবী এইভাবে জায়ানের সাথে লেপ্টে।ভাবলেই গালগুলো রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ে। আরাবী লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
-‘ আজান দিচ্ছে।এইবার তো ছাড়ুন।নিচে যাবো।’

জায়ান ছেড়ে দিলো আরাবীকে।চুলগুলোতে হাতের সাহায্যে ব্যাকব্রাশ করে স্থির চাহনী নিক্ষেপ করলো আরাবীর দিকে তারপর বলে,
-‘ চুমু তো দিলে না।ছেড়ে দিলাম যাও।তবে মনে রেখো বিয়ের পর কড়ায়গন্ডায় সব উশুল করবো আমি দেখে নিও।’

আরাবী শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে।সে জানে এখানে আর বেশিক্ষন দাড়ালে এই লোক ওকে লজ্জা দিতে দিতে মেরে ফেলবে।তাই আরাবী দ্রুত ছাদ থেকে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।সিড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে নামছে আরাবী।সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে ওর পিছন হতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ আসছে। আরাবী জায়ানের রুমে কাছে আসতেই।হঠাৎ একটা হাত আরাবীর বাহু আকড়ে ধরে দরজার কাছে আনলো।আরাবী কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা ঘোরলাগানো শীতল কন্ঠ ওর কানে ফিসফিস করে বলে উঠে,
-‘ আবার যদি বৃষ্টি নামে,
আমিই তোমার সঙ্গি হবো।
#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ টি,
কানের পিঠে গুজে দিবো।
লেপ্টে যাওয়া শাড়ির মতো,
অঙ্গে তোমার জড়িয়ে রবো।’

তৎক্ষনাৎ আরাবীর বাহু ছেড়ে দিলো।আর খট করে দরজা আটকানোর শব্দ হলো।আর থরথর কাঁপতে থাকা আরাবী স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

#চলবে___________

ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৪
গ্রামের সেই চিরোচেনা পথটায় জায়ানের গাড়িটা প্রবেশ করতেই ভয়ে ঘামাতে শুরু করে আরাবী।হৃদয়টা মনে হয় কেউ কামড়ে ধরে আছে।বুকের ভীতরে যেই যন্ত্রটা আছে তা চলাচল যেন দ্বিগুন পরিমানে বেড়ে গেলো।আজ ওরা সকাল সলাল রওনা হয়েছে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে।সাথে ইফতি আর নূরও আছে।ইফতিকে জায়ান সাথে আসার জন্যে বলেছে।যদি কোন বিপদ হয় জায়ান যদি একা হাতে সামলাতে না পারে তাই।কিন্তু নূর এসেছে জেদ ধরে।ওকে নিবেনা বলেছিলো জায়ান এটা শুনেই নূর কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে।শেষমেষ না পারতে ওকেও সাথে করে নিয়ে আসতে হয়েছে ।তপ্ত শ্বাস ফেললো আরাবী।ঠোঁট কামড়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে ও।কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।জায়ান হঠাৎ গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না।’

আরাবীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো জায়ান।সাথে সাথে আরাবীর মনটা ভালো হয়ে গেলো একদম।অজান্তেই হাসলো আরাবী।জায়ানকে একপলক দেখে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো।অনেক মানুষই আরাবীদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। কারন সচরাচর গ্রামে এমন কার খুব কম দেখা যায়।জায়ান গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে,
-‘ কোনদিকে যাবো আরাবী?সামনে দুটো পথ!’

জায়ানের কথায় আরাবী তাকালো।শান্ত সুরে জবাব দেয়,
-‘ এইতো ডানে গিয়ে চার নাম্বার বাড়িটার সামনেই গাড়ি থামাবেন!’

জায়ান আরাবীর কথা মতো গাড়ি ডানে ঘুরালো।তারপর চার নাম্বার বাড়ির সামনেই গাড়ি থামালো।গাড়ি থামতেই সবাই নেমে দাড়ালো।শুধু আরাবী নামছে না।এটা দেখে জায়ান এসে আরাবীর সাইডের দরজা খুলে দিলো।আরাবীর দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো বেড়িয়ে আসার জন্যে।আরাবী করুন চাহনী নিক্ষেপ করে জায়ানের দিকে।জায়ান চোখের ইশারায় ওকে আসস্থ করলো।ভয় পেতে মানা করলো।দুরুদুরু বুক নিয়ে জায়ানের হাত ধরে আরাবী নেমে আসলো গাড়ি থেকে।এদিকে গাড়ির শব্দ শুনে তৎক্ষনাৎ ছুটে আসেন আরাবীর মা।এসেই আরাবীকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।আরাবীও এতোদিন পর মা কে পেয়ে হুহু করে কান্না করে দিলো।আরাবীর মা মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিলেন।তারপর আরাবীকে বুক থেকে উঠিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলো।পরম স্নেহে আরাবীর কপালে চুমু খেলো।আরাবী কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
-‘ কেমন আছো মা?’
-‘ আমি অনেক ভালো আছি।’
-‘ তুই ভালো আছিস তো?’
-‘ তুমি যাদের কাছে আমার দায়িত্ব দিয়েছো।তাদের মতো মানুষদের কাছে খারাপ থাকি কি করে বলো?’

মেয়ের কথায় আরাবীর মায়ের খুশিতে চোখ ভরে আসে।এদিকে জায়ান এতোক্ষন মা মেয়ের কথা শুনছিলো এইবার গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,
-‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি।কেমন আছেন?’

আরাবীর মা এইবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান জায়ানের দিকে।তিনি চিনতে পারছেন না।তাও সালামের জবাব দিয়ে বলেন,
-‘ আমি ভালো আছি বাবা।তা তোমাকে চিনতে পারলাম না।’

জায়ান মৃদ্যু কন্ঠে বলে,
-‘ আমি জায়ান।আপনার হবু মেয়ের জামাই।’

আরাবী চোখ বড় বড় করে তাকালো জায়ানের দিকে।আরাবী ভাবতেও পারেনি জায়ান এইভাবে নিজেকে ওর হবু মেয়ের জামাই বলে ওর মায়ের কাছে পরিচয় দিয়ে দিবে। আরাবীর মা অত্যন্ত খুশিতে কি করবেন ভেবে পেলেন না।তার মেয়ের কপালে যে এমন সুদর্শন আর ভালো মনের জীবনসঙ্গী পাবে লিখা আছে তা ভাবতেও পারিননি তিনি।মেয়ের এমন সাত কপাল দেখে মনে মনে অসংখ্যবার উপরওয়ালার কাছে ধন্যবাদ জানায়।এদিকে ইফতি এগিয়ে এসে বলে,
-‘ আমাকে চিনতে পেরেছো মামনি?আমি ইফতি!’

-‘ আল্লাহ ইফতি তুমি কতো বড় হয়ে গিয়েছো।মাশা-আল্লাহ!! ‘

ইফতি হাসলো এমন কথায়।নূরও নিজের পরিচয় দিলো।আরাবীর মা এইবার বললেন,
-‘ তোমরা ভীতরে আসো বাবা!’

জায়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
-‘ নাহ আন্টি আমরা ভীতরে যাবো না।আপনি আপনার জামা-কাপড় গুছিয়ে নিয়ে আসুন!’

এমন সময় ঘর হতে কাজের মেয়ের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসে আসলেন আরাবীর দাদি।যদিও আপন না।তবে আপন দাদিও এমন এতো আদর করে না যতোটা তিনি করেন আরাবীকে।আরাবী তাকে দেখে একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
-‘ কেমন আছো দাদু?’

তিনি হেসে আরাবীর মাথায় হাত রেখে বলেন,
-‘ আমার দাদুভাই যেইহানে ভালা আছে আমিও ভালা আছি। তা হুনলাম বিয়া ঠিক হইছে?তা হেইজন কই লগে আহে নাই?’

আরাবী হাসিমুখে বললো,
-‘ এসেছো তো।’
-‘ কই ডাক দে।আমিও একটু দেহি।’

আরাবী ঘার ঘুড়িয়ে জায়ানকে ডেকে উঠে,
-‘ শুনছেন?দাদু আপনাকে দেখবে।’

জায়ান আরাবীর ডাকে ওর দিকে এগিয়ে আসলো।ইফতি আর নূরও এগিয়ে আসলো।সবাই আরাবীর দাদুর সাথে কুশল বিনিময় করলো।আরাবীর দাদু তো জায়ানের প্রশংসা করতে করতে শেষ। এইভাবে অনেকক্ষন কেটে যাওয়ায় জায়ান তাড়া দিলো সবাইকে,
-‘ আন্টি আপনি আর দাদুর সকল জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুত আসুন।আর দেরি করা চলবে না!’

আরাবীর মা আমতা আমতা করে বলেন,
-‘ সে কি বাবা? এতোদূর এসেছো।কিছু না খেলে হয়?’

জায়ান আরাবীর মায়ের এহেন কথায়।শান্ত সুরে বলে,
-‘ যেখানে আরাবী আর আপনাকে পদে পদে অপমানিত হতে হয়েছে সেই বাড়িতে যে আমি এসেছি এটাই অনেক।আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে রেখেছি।প্লিজ আন্টি জোড় করবেন না।’

আরাবী বুঝলো জায়ান নিজের রাগটাকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে।তাই পরিস্থিতি হাতের বাহিরে যাওয়ার আগে আরাবী ওর মা’কে তাড়া দিলো জলদি করার জন্যে।সব শুনে আরাবীর দাদু বলল,
-‘ লিপি গেলে যাক।আমি যাইয়া কি করমু?এমনেই আমি অসুখ্কা(অসুস্থ) মানুষ।আমারে বাপু তোমরা টানাহেছঁড়া কইরো না।’

আরাবী দাদুর কথায় মন খারাপ করে বললো,
-‘ দাদু এসব তুমি কি বলছো?তুমি যাবে না মানে?তোমাকে যেতেই হবে।’

-‘ কে কোথায় যাবে?’

পিছন থেকে কারো এমন কন্ঠস্বরে ভয়ে কেঁপে উঠলো আরাবী।ঠিক যার ভয় পেয়েছিলো সেটাই হলো। হানিফ আহমেদ এসেছেন।মাত্রই হাট থেকে ফিরেছেন উনি।এদিকে আরাবীকে দেখেই তিনি হা করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন।পরক্ষনে রাগে কটমট করে আরাবীর দিকে তেড়ে আসতে আসতে বলে উঠে,
-‘হারাম*জাদি।আমার মুখে চুনকালি লাগিয়ে ভেগে গিয়েছিলি।এখন আবার ফিরে এসেছিস।তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো। কু****!’

হানিফ আহমেদের এমন বিশ্রি গালিগালাজ শুনে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না জায়ান।রাগে ভয়ংকর ভাবে গর্জে উঠে,
-‘ জাস্ট সাট আপ।আর একটা স্ল্যাং ইউজ করবেন আমি ভুলে যাবো আপনি একজন মুরব্বি মানুষ।’

হানিফ আহমেদ সাথে সাথে থেমে গেলেন। রাগি চোখে জায়ানের দিকে তাকালো।তারপর আবার আরাবীর দিকে তাকাতেই আরাবী ভয় পেয়ে জায়ানের পিছনে নিজেকে লুকিয়ে নেয় আর জায়ানের শার্ট খামছে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।হানিফ আহমেদ বলেন,
-‘ শহরে এই নাগর জুটিয়েছিস তাই তো ভেগে গিয়েছিলি! চু******! তোরে কাইট্টা কুচিকুচি করুম!’

ইফতি এসব সহ্য করতে না পেরে হানিফ আহমেদের দিকে তেড়ে এসে উনার গলা চেপে ধরেন।ইফতি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
-‘ আর একটা খারাপ কথা আরাবীকে বললে আপনার জিহবা ছিরে ফেলবো আমি!’

জায়ান শান্তসুরে বলে,
-‘ থাম ইফতি। ছেড়ে দে উনাকে।’

ইফতি ভাইয়ের কথায় হানিফকে ছেড়ে দিলো।হানিফ গলা ধরে কাশতে লাগলেন।কিছুক্ষন পর চোখ তুলে জায়ানের দিকে তাকাতেই।তিনি ভয়ে আতকে উঠেন।জায়ানের চোখজোড়া ভয়ংকর লাল হয়ে আছে।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
হানিফ ভয়ে তুতলাতে তুতলাতে বলে,
-‘ এইভাবে তাকালেই আমি পাবো ভাবছো নাকি?ভুলে যাও সেটা।আমার এতো টাকার লস হয়েছে ওই মা**** জন্যে।ওরে তো আমি…..’

জায়ান হানিফকে আর বলতে দিলেন নাহ।চপাট করে চ*ড় বসিয়ে দিলো তার গালে।দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
-‘ আগেই বলেছিলা।স্ল্যাং ইউজ করতে না।’

চ*ড় খেয়ে হানিফের মাথা ঘুরে উঠলো। থপ করে মাটিতে বসে পরেন তিনি।জায়ান চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-‘ কতো টাকা হ্যা?কতো টাকা চাই? আমি দিবো তোকে।’

জায়ান সাথে সাথে চেকবুক বের করে সেখানে দশলক্ষ টাকার একটা চেক লিখে ছুড়ে মারে হানিফ আহমেদের দিকে।তারপর আরাবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।ইফতি আর নূরকে ইশারা করলো আরাবীর মা আর দাদুকে নিয়ে গাড়িতে বসতে।এদিকে আরাবীর দাদু কাঁদছেন।তবে ছেলের এই কষ্টে না।এই ভেবে কাঁদছেন এমন মানুষ তার গর্ভ থেকে কি করে জন্ম নিলো। ইফফি উনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলতেই তিনি জানান যাবেননা। তারা যেন চলে যায়।জায়ান আর আরাবীও অনেক রিকুয়েস্ট করেন তাকে কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না।শেষে না পেরে আরাবীর মা’কে নিয়েই ইফতি আর নূর গাড়িতে উঠে বসলো।জায়ান এইবার আরাবীকে নিয়ে হানিফ আহমেদের সামনে আসলেন।হানিফ আহমেদ তখন এতো টাকার চেক পেয়ে তা বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে।একটু আগে যে জায়ানের হাতের শক্তপোক্ত হায়ের চড় খেয়েছে তা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছে।আরাবী ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। জায়ান রাগি গলায় বললো,
-‘ ফারদার আর কখনো যেন আপনার এই বাজে ব্যবহার যেন আমি না দেখি।সেদিন আপনার শেষ দিন হবে এই দুনিয়াতে।আর হ্যা আমি কাল দুজন নার্স পাঠবো দাদুর জন্যে তারা দাদুর খেয়াল রাখবে।আর যেন কোন উল্টাপাল্টা না করতে দেখি।’

জায়ান কথাগুলো শেষ করে আরাবীর হাত ধরে নিয়েই এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে।

#চলবে_________

ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।