বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-৪১+৪২

0
569

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪১
চোখে মুখে পানির ছিটা পরতেই আস্তে আস্তে চোখ খুললো আরাবী।মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে।ঝাপ্সা দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই নিজেকে কারো বাহুডোরে আবিষ্কার করলো।সাথে সাথে শ্রবণ হলো জায়ানের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর, ‘ এখন কেমন লাগছে?ঠিক আছো তুমি?’

আরাবী উঠে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলে জায়ান আরাবীকে সাহায্য করলো।আরাবী উঠে বসতেই দূর্বল গলায় বললো, ‘ আমি ঠিক আছি!’

সাথি আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বলে, ‘ হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছো।আমরা কতো ভয় পেয়েছিলাম জানো?’

আরাবী মলিন হাসলো।নিহাদ সাহেব বললেন, ‘ এখন থেকে জায়ান ওকে আরো বেশি বেশি করে খাওয়াবে।এতো দূর্বল হলে চলবে নাকি?’

জায়ান হাসলো বাবার কথায়।আরাবী এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওর মাকে খুজছে।কিন্তু না পেয়ে জায়ানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আম্মু কোথায়?’

জায়ানের জবাব, ‘ আব্বুর কাছে আছে।’

সাথে সাথে আরাবীর সকালের সব ঘটনা মাথা চড়া দিয়ে উঠলো।অস্থির হয়ে উঠলো মন।প্রায় একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে ছুট লাগালো একপলক বাবাকে দেখার জন্যে। এদিকে আরাবীকে এমন করতে দেখে জায়ান ঘাবড়ে গেলো।চিল্লিয়ে উঠলো, ‘ আরাবী সাবধানে!’

কিন্তু কে শুনে কার কথা।একছুটে কবরস্থানে গিয়ে দেখলো ওর মা এখনো ওর বাবার কবরের উপর লেপ্টে আছেন।কান্না করছেন এখনো।দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার সমাপ্তি।এতো সহজে কি কান্না থামে? আরাবী আর একমুহূর্ত দেরি করলো।বাবার কবরের ঠিক মধ্যিখানটায় মাথা এলিয়ে দিলো।সাথে সাথে আরাবীর শরীর ঝংকার দিয়ে উঠলো।মনের মাঝে এক শান্তির প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।মনে হলো সত্যি সত্যি বাবার বুকের মাঝে নিজের মাথা গুজে দিয়েছে।সাথে সাথে দরদর করে জল গড়িয়ে পরলো আঁখি কোল হতে। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দিলো আরাবী।পৃথিবীর সমস্ত কাতরতা কন্ঠে ঢেলে ঢেলে ডেকে উঠলো, ‘ আব্বু! আব্বু গো! আব্বু ও আব্বু,আব্বু।আব্বু আমি এসেছি আব্বু।আব্বু আমি আরাবী।আব্বু!’

মেয়ের এমন অস্থির কাতরতা ভড়পুর এক একটা ডাক শুনে আরাবীর মা আচঁলে মুখ লুকিয়ে আরো জোড়ে কাঁদতে লাগলেন।আরাবী যেন আজ সব ভুলে বসেছে।এতোদিনের সকল,দুঃখ, কষ্ট সব যেন বাবার কবরের মধ্যিখানটায় মাথা রাখতেই ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে এসেছে। বুক ভাঙ্গা আর্তনাদগুলো বিভৎসভাবে কান্নায় রূপান্তর হয়েছে।কি করুন সেই দৃষ্য।জায়ানের মতো শক্তপোক্ত মানুষটাও আজ স্ত্রীর বাবা হারানোর তীব্র বেদনা অনুভব করতে পারছে বোধহয়।জায়ানের চোখজোড়া লাল হয়ে উঠেছে।এই শক্ত হৃদয়ের মানুষটার হৃদয়ও যে ভীতরে ভীতরে কাঁদছে তা ওর চোখ দেখলেই বোঝা যাবে। মৃত্যুর পরেও বাবাকে একপলক দেখতে পারেনি আরাবী।না ওর মা’কে দেখতে দিয়েছে একবার কেউ। দুনিয়াতে যে এতো পাষান হৃদয়ের মানুষও হয়।তা সেদিন ছোট্ট আরাবী একটু হলেও বুঝতে পেরেছিলো।একে একে সকল যন্ত্রনার ঘটনাগুলো মনে পরে যাচ্ছে আরাবী।কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের সুরে বলছে ও, ‘ আব্বু! তু..তুমি জানো? তো..তোমার মা না বড্ড খারাপ আর পা…পাষাণ হৃদয়ের গো আব্বু।তোমার মৃত্যুর পর এ..একটাবার তোমাকে দেখতে দেয়নি আমাদের। আমি আর আ…আম্মু কতো কেঁদেছি।মা উনার পায়েও ধরেছিলো।তার দেখাদেখি আমিও উ..উনার পায়ে পরেছিলাম।কিন্তু উনি দেননি আব্বু। এমন পাষাণ মহিলার গর্ভে তো..তোমার মতো মানুষ কি..কিভাবে জন্ম নিলো আব্বু?তুমি কেন চলে গেলে আব্বু?তো..তোমায় ছাড়া আমরা একটুও ভালোছিলাম না আব্বু।ও আব্বু।তুমি শু..শুনছো আমার কথা?ও আব্বু!’

আজ বাবাকে পেয়ে আরাবী যেন একটা ছোট্ট বাচ্চা শিশুর ন্যায় বাবার কাছে নালিশ করছে।মায়েরা যখন বাচ্চাদের মারলে তারা বাবাদের অফিস থেকে বাসায় ফিরার অপেক্ষা করে।তারপর বাবা আসলে কেঁদে কেঁদে সকল নালিশ জানায়।আরাবীও ঠিক একইভাবে আজ ওর বাবার কাছে নালিশ করছে।কিন্তু আফসোস সেই বাচ্চাদের বাবা তাদের নালিশগুলো শুনে যেমন চকোলেট দিয়ে কান্না থামায়,অথবা আদুরেভাবে কপালে চুমু খান,অথবা মিথ্যে রাগ দেখিয়ে মায়েদের বকে দেন।কিন্তু আরাবীর সাথে হলো সম্পূর্ণ বিপরীত।ও নালিশ করলো ঠিকই কিন্তু ওর বাবা শুনলো না।শুনেও যদি থেকে থাকেন মেয়ের এমন আর্তনাদ।তারপরেও আরাবীর বাবা কিছুই করতে পারবেন না। জায়ান সহ্য করতে পারছে না আর আরাবীর এই কান্না।দ্রুত পায়ে আরাবীর কাছে গিয়ে ওকে টেনে তুললো জায়ান।আরাবী দূর্বল হয়ে পরেছে। জায়ান দুহাতে আরাবীর সর্ব মুখশ্রীতে লেগে থাকা পানিগুলো মুছে দিলো।নিজেকে সম্পূর্ণ শক্ত রাখার চেষ্টা করে।ধরা কন্ঠে বলে, ‘ হয়েছে তো।আর কাঁদেনা।তুমি এতো কাঁদলে আব্বু তো কষ্ট পাবেন।তিনি কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছেন আরাবী।আর কাঁদেনা। হয়েছে তো।নালিশ করে দিয়েছো না আব্বুর কাছে? তিনি সব শুনেছেন আরাবী।আর কাঁদেনা।তিনিও কাঁদছেন, কষ্ট পাচ্ছেন তোমার কান্না দেখে।’

আরাবী হিচঁকি উঠে গিয়েছে।তাই জায়ানের কথার কোনপ্রকার জবাব দিতে পারলো না।জায়ান আরাবীকে ধরে দাড় করালো।নিজের সাথে আরাবীকে ধরে আগলে রাখলো।অতঃপর আরাবীর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ আম্মু।হয়েছে তো আর কাঁদবেন না।আপনি যদি এমন করেন আরাবীকে সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে।প্লিজ আম্মু সামলান নিজেকে।আরাবী কিন্তু অনেক দূর্বল হয়ে গিয়েছে।’

জায়ানের কথায় যেন আরাবী মা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন।অতঃপর সাথি এগিয়ে এসে উনাকে ধরে নিয়ে গেলেন।তবে বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন।আরাবীকে ধরে নিয়ে আসছে জায়ান।চোখ বুঝে জায়ানের গায়ে গায়ের সবটা ভাড় ছেড়ে দিয়ে হেটে যাচ্ছে।অতঃপর মহিলারা কবরস্থান হতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করে নিলেন।তারপর শেষ হতেই জায়ান সবাইকে নিয়ে বাড়ির ভীতর প্রবেশ করলো। জায়ান আরাবীকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।আরাবীকে একগ্লাস পানি খাইয়ে দিলো।সাথিকে ইশারা দিতে তিনিও আরাবীর মা’কে পানি দিলেন।পানি খেয়ে আরাবী ঠিক সেইভাবেই বসে আছে।জায়ান নরম স্বরে বললো, ‘ আরাবী দেখো।এটা তোমাদের বাড়ি।তোমার আর আম্মুর বাড়ি।আরাবী দেখবে না?’

আরাবী দূর্বল চোখে চারপাশ তাকিয়ে দেখলো।ছোট্টো বেলার কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে তার।এই ড্রয়িংরুমে কতো বাবার পিঠে চড়ে বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে খেলেছে।কতো দুষ্টুমি করেছে। একে একে সব মনে পরছে আরাবীর।চোখ ভরে উঠলো আবারও।জায়ান আরাবীর চোখজোড়া মুছে দিয়ে বলে, ‘ কাঁদে না তো।’

এমনসময় সেখানে উপস্থিত হলেন শায়লা ভূইয়া আর শিলা আহমেদ। সাথে আজ একটা ছেলেও আছে। সেটা আর কেউ না শিলা আহমেদের ছেলে শাওন হোসেন।শাওন কেমন একটা লোলভ দৃষ্টিতে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে। আরাবী সেই দৃষ্টি লক্ষ করে জায়ানের পেটের কাছের পাঞ্জাবি খামছে ধরলো।জায়ান সেটা দেখতেই ওর চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে আসলো।নূরকে ইশারা করলো আরাবীকে ধরতে।নূর ভাইয়ের ইশারা মতো এগিয়ে গেলো দ্রুত।এদিকে শাওন আরাবীর দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে,’ তুই নাকি আরাবী? বড় হয়ে গেছিস।সাথে সুন্দরীও।তোকে আমার প….!’

বাকিটুকু কথা সম্পূর্ণ হলো না শাওনের।তার আগেই জায়ানের শক্তপোক্ত বেশিবহুল হাতের ঘুসি গিয়ে পরলো শাওনের গালে।শাওন ছিটকে নিচে পরে গেলো।শিলা দ্রুত ছেলেকে ধরলেন।অতঃপর আস্তে ধীরে দাড় করালেন।শাওনের ঠোট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে,নাসিকাপথ হতেও রক্ত আসছে।শাওন রক্তগুলো মুছে নিলো হাত দিয়ে।শিলা ছেলের এমন অবস্থা দেখে রাগে কিরমির করে বললো, ‘ তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলেকে মারার? তোমাকে আমি পুলিশে দিবো।’

জায়ানের রাগে কপালে রগগুলো দপদপ করছে।চোয়াল শক্ত,মুখশ্রী লাল হয়ে আছে।জায়ান দাঁতে দাঁত চিপে বলে, গো এহেইড।নাকি আমি হেল্প করবো পুলিশে ফোন দিয়ে?দিবো?যদি একবার ফোন দেই অতঃপর সবকটা বিনাবাক্যে জেলে যাবেন বলে দিলাম।’

অতঃপর আবারও তেড়ে শাওনের কাছে গেলো।শিলা কিছু বলার আগেই সপাট করে একটা চড় মারলো জায়ান।শাওন সহ শিলাও পরে যেতে নিলেও নিজেদের সামলে নিলেন।জায়ান রাগে কিরমির করে বললো, ‘ ফারদার যদি দেখি আমার আরাবীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে তোর চোখ আমি উপরে ফেলবো।সম্মান দিয়ে কথা বলবি।ওয়ান সেকেন্ড। তুই কথাই বলবি না কোন।ইনফেক্ট আপনারা কেউই বলবেন না।আমার ফ্যামিলির প্রতিটা মেম্বার হতে দূরে থাকবেন।নাহলে বিনাবাক্যে উপরের টিকিট কনফার্ম করে দিবো। আর এই বাড়িতে যে তোদের থাকতে দিচ্ছি এটাই অনেক।আমি শুধু আম্মু আর আরাবীর একটা কথার অপেক্ষায় আছি।কারন এই বাড়ির মালিক তারা।তারা একবাক্যে অনুমতি দিলে আমি সাথে সাথে তোদের ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।আম্মু আপনি কি বলেন?’

আরাবী মা জায়ানের প্রশ্ন শুনে বলে, ‘ বাবা আমি তো আর উনাদের মতো জানোয়ারের হৃদয় দিয়ে তৈরি না। আমি মানুষ।আমার মায়া,দয়া আছে।কিন্তু উনারা যে জানোয়ার তা আমি জানি।জানোয়ারের যেমন কারো প্র‍তি কোন মায়া নেই।উনাদেরও নেই। কিন্তু আল্লাহ্ আমায় মানুষ বানিয়েছেন।আর মোট কথা তারা আমার স্বামির ফ্যামিলি এখন তারা যতোই খারাপ হোক।তাই সেই উছিলায় আমি তাদের বাড়ি হতে বের করে দিবো না।তাদের এই বাড়িতে থাকতে দিলাম।ভিক্ষা সরূপ। আর বাবা তোমাকে আমি আরাবীর বাবার কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে দিলাম।না করবে না বাবা।তুমিই যেহেতু আমাদের সব ফিরিয়ে দিয়েছো। নাহলে তো আমরা আজীবনও এসবের ধারে কাছেও আসার সাহস পেতাম না।বাবা না করো না। আমি চাই আরাবী আর তুমি একসাথে ওর বাবার কোম্পানিটা সামলাও এখন থেকে।আমার কথা ফেলো না।’

আরাবীর মায়ের কথা জায়ান ফেলতে পারলো না।আদেশ সরূপ মেনে নিলেন।এদিকে জায়ানের এমন ভয়ংকর রাগ দেখে শায়লা ভূইয়া,শিলা আহমেদ আর শাওন ভয়ে দমে গেলেন।আর একটা বাক্য উচ্চারন করে করলেন নাহ। অতঃপর জায়ান বললো, ‘ চলো।এখন বাড়ি যাই সবাই।’

আরাবীর মা আমতা আমতা করে জায়ানকে বললো,’ বাবা আমি এখানেই থাকি? এটাই তো আমার বাড়ি বাবা। আরাবীর বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে!’

জায়ান আরাবীর মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,’ আমাকে নিজের ছেলে মানেন।অথচ নিজের ছেলের কাছে থাকতে চাইছেন না? আমি আপনার কথা মেনে নিতাম আম্মু।যদি এখানে কেউ ভরসাযোগ্য মানুষ থাকতো।কিন্তু এখানে আমি আপনাকে কার কাছে রেখে যাবো?এই পশুদের মাঝে আপনি একা থাকতে পারবেন না আম্মু।তবে আমি আপনাকে আর আরাবীকে রোজ শুক্রবার এখানে নিয়ে আসবো।তবুও এখানে থাকার কথা বলবেন না।আমি আমার মা’কে নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা রাখি।চলুন আম্মু।আমাদের দেরি হচ্ছে।’

আরাবী মা ছলছল চোখে তৃপ্তির হাসি দিলেন।নিজের মেয়ের ভাগ্য যে এতো ভালো হবে ভাবতে পারেননি তিনি। আরাবী জায়ানকেই একধ্যানে দেখে যাচ্ছে।ঠিক কি বলবে জায়ানকে।কি দিয়ে ধন্যবাদ দিবে।জায়ান যা করেছে তার কাছে ধন্যবাদ শব্দটা খুব ছোট হয়ে যায়।জায়ান আরাবীর কাছে এসে আরাবীর হাত ধরলো।নমনীয় কন্ঠে বলে,’ চলো বাড়ি যাবার সময় হয়ে গিয়েছে।’

আরাবী সন্তর্পণে ভরসাযোগ্য হাতটা আকঁড়ে ধরলো।জায়ানকে বুঝালো যে আপনি আমার সব।সব মানে সব।জায়ান আলতো হেসে বেড়িয়ে গেলো বাসা হতে।অতঃপর জিহাদ সাহেবের কবরটা আরেকবার আরাবী আর ও মা দেখে নিয়ে সবাই বাড়ির পথে রওনা দিলেন।

#চলবে__________
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।

#বৃষ্টি_ভিজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪২
অফিস থেকে মাত্রই ফিরেছে জায়ান।বেশ ক্লান্ত আজ ও। আবারাবীর বাবার কোম্পানিটায় আজ গিয়েছিলো ও। আরাবী কাল থেকে জয়েন করবে।মেয়েটার উপরে বড্ড চাপ পরে যাবে।কিন্তু কিছু করার নেই।আরাবীকে সবটা বুঝতে শিখতে হবে।নিজেরটা নিজেকেই সামলে নেওয়াটা শিখতে হবে। অবশ্য আরাবীর পাশে তো ও আছেই।বিপদে আপদে সর্বদা নিজের স্ত্রীর পাশে আছে ও।
তবে ইফতিকে বলেছে হাফ টাইম যেন ও সামলায়।কারন সকালে আরাবীর ভার্সিটি আছে।ভার্সিটি শেষ করে তারপরেই দুপুরের থেকে আরাবী বসবে অফিসে।তবে খুব বেশি জরুরি হলে জায়ানও যাবে।কিছু করার নেই দুটো কোম্পানি সামলানো অনেক টাফ ব্যাপার।কারন নিহাদ সাহেব এখন বিশ্রাম নিয়েছেন।তার শরীরটা ভালো না।তাই তিনি জায়ান আর ইফতির কাধে সম্পূর্ণ কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন। ক্লান্ত শরীরটা টেনে টুনে ডায়নিং টেবিল হতে একগ্লাস পানি খেয়ে নিলো জায়ান।অতঃপর রুমের দিকে অগ্রসর হলো।রুমের দরজা খুলেই দেখতে পেলো আরাবী নামাজ পরছে।সারাদিনের ক্লান্তিগুলো নিমিষেই যেন হাওয়া হয়ে গেলো।ঠোঁটের কোল ঘেসে হাসির রেখা দিলো। জায়ান দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করে আলমারি হতে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেশি সময় নিলো না।ঝটপট গোসল সেরে ওযু করে নিয়ে নিজেও গিয়ে আরাবীর সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। অবশ্য আরাবীর নামাজ প্রায় শেষের দিকে।নামাজ শেষ হতেই আরাবী জায়নামাজ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো। জায়ানকে দেখে হাসলো আরাবী।তারপর বিনাবাক্যে ওয়াশরুমে গিয়ে জায়ানের জামা কাপড়গুলো ধুয়ে বারান্দায় শুকাতে দিয়ে দিলো।তারপর নিচে রান্নাঘরে গিয়ে চট করে একগ্লাস শরবত বানিয়ে রুমে এসে দেখলো জায়ানের নামাজ শেষ। আরাবী রুমে এসে বললো, ‘ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।শরবতটা খেয়ে নিন!’

জায়ান হাসিমুখে এগিয়ে আসলো আরাবীর কাছে।আরাবীর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে দিলো। আরাবী মৃদ্যু হাসলো।জায়ান শরবতটা হাতে নিয়ে একটানে শেষ করে ফেললো।আরাবীর হাতে গ্লাসটা দিয়ে বলে, ‘ নামাজ শেষে উঠলে কেন?আমার নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকবে নাহ?’

আরাবী মৃদ্যু আওয়াজে বলে, ‘ উঠতাম না।আসলে আপনি গোসল করেছেন সেটা টের পেয়েছি।তাই গিয়ে আপনার জামা-কাপড়গুলো ধুয়ে দিলাম।আর আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো সেইজন্যে এই শরবতটা বানিয়ে আনলাম।’

জায়ান আরাবীকে কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরে বলে,’ ধন্যবাদ সবকিছুর জন্যে।’

পরক্ষণে হালকা দুষ্টু হেসে বললো, ‘ তবে শরবতটার বদলে অন্যকিছু দিলে আরো ভালো লাগতো।রাতে ডিনারও করা লাগতো না তাহলে।’

আরাবী প্রথমে বুঝতে পারেনি জায়ানের এমন কথা।কিন্তু জায়ানের চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ দেখে যা বুঝার বুঝে ফেললো আরাবী।জায়ানের কাছ থেকে দ্রুত সরে গেলো।লজ্জা পেয়েছে বেশ আরাবী।গ্লাস নিয়ে নিচে যেতে যেতে বলে, ‘ আপনার অসভ্য ইংগিতগুলো নিয়ে দূরে থাকেন।সবসময় মাথাতে এসবই ঘুরে।নিচে আসুন খাবার দেই।নূর,বাবা,মা,আম্মু খেয়ে নিয়েছে।শুধু আপনি আর আমি বাকি।’

জায়ান নিশব্দে হেসে উঠলো।আরাবী লজ্জা পেয়েই এমন করে পালিয়ে গেলো সেটা বেশ বুঝেছে জায়ান।দ্রুত আরাবীর পিছে পিছে নিচে চললো। অতঃপর খাবারের পালা শেষ হতেই।আরাবী জায়ানকে রুমে যেতে বলে।ও বাকি টুকটাক কাজগুলো সেরে নিলো।এতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেলো।সব কাজ শেষে আরাবী জোড়ে শ্বাস ফেললো।সবগুলো লাইট নিভিয়ে দিয়ে রুমের দিকে চলল।রুমের দরজা খুলে ভীতরে ঢুকে আবার দরজা লাগানো শেষ হতেই ঝট করে জায়ান কোলে তুলে নিতেই ভয় পেয়ে মৃদ্যু আওয়াজ করে উঠে আরাবী।আকস্মিক এমন করায় অনেকটা ভয় পেয়েছে ও।জায়ান হেসে দিলো।আরাবী নিজেকে সামলে নিয়ে রাগী চোখে তাকালো জায়ানের দিকে।আরাবীকে এমনভাবে তাকাতে দেখে জায়ান বললো, ‘ উফ! রেগে গেলে আরো সুন্দর লাগে তোমায়।লুকিং সো হট!’

আরাবী রাগে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ ছি! অশ্লীল কথাবার্তা!’

জায়ান আরাবীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,’ এখন অশ্লীল কাজও করবো।ইউ নো নাহ?’

আরাবী জায়ানের কোল থেকে ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করছে।আর বলছে, ‘ ছাড়ুন আমায় অসভ্য লোক।শুধু বাজে কথা বলে।আমায় এইভাবে ভয় দেখালেন কেন আপনি?ছাড়ুন!’

জায়ান আরাবীকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।অতঃপর বললো, ‘ এতো ছাড়ুন ছাড়ুন করো কেন?একটু তো ধরুন ধরুন তো বলতে পারো? নিজ ইচ্ছায় আমাকে কখনো একটা চুমু পর্যন্ত দিয়েছো আমায়?’

আরাবী মুখ ফুলালো জায়ানের কথায়।বিরবির করে বললো, আমি আপনার মতো নির্লজ্জ না।আমার লজ্জা করে নাহ?’

জায়ান আরাবীর গালে চুমু খেলো।মৃদ্যু কেঁপে উঠলো আরাবী।অতঃপর জায়ানের দিকে তাকালে জায়ান বলে,’ এতো লজ্জা কোথায় পাও তুমি? আমার সামনে কিসের লজ্জা?’

আরাবী দৃষ্টি নত করলো।তারপর মিনমিন করে বললো,’ আপনার সামনেই তো আমি লজ্জা বেশি পাই।আর কারো সামনে এতো লজ্জা আমার আসে না।আপনি আপনার ওই শীতল চোখের চাহনী নিয়ে আমার দিকে তাকালেও আমার লজ্জা করে।তো আমি করবো?’

জায়ান হেসে দিলো আরাবীর কথায়।অতঃপর আরাবীর কানে কানে বললো, ‘ আচ্ছা তুমি লজ্জা পেতে থাকো আমি তোমার লজ্জা ভাঙ্গাতে থাকি।তোমার এই লজ্জারাঙ্গা মুখটা আমার ভীষন পছন্দ।তো ম্যাডাম এখন কি আপনার লজ্জাটা আজ রাতে আবার ভাঙ্গাতে পারি?’

আরাবী লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে জায়ানের বক্ষে মুখ লুকালো।অতঃপর রাতটা তাদের পার হলো দুজন দুজনার ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে।
__________
কেটে যেতে লাগলো দিনের পর দিন। মাসের পর মাস।বছরের পর বছর।আরাবী গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে।বেশ কঠিন গিয়েছে সময়গুলো সংসার সামলানো,পড়াশোনা,সাথে অফিস সামলানো।বেশ কষ্ট করতে হয়েছে আরাবীকে।তবে জায়ান ওকে প্রতিটা পদক্ষেপে সাহায্য করেছে।ওর পাশে থেকেছে।তাই আরাবী সবটা কষ্ট হলেও সবটা সামলাতে পেরেছে। সাথি সংসারের দায়ভার আরাবীর কাধে দিয়েছে বছর হবে।সে এখন প্রায় অসুস্থ থাকে।তাই আরাবীকে সবটা বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর হাতে তুলে দিয়ে তিনি হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন।আরাবী অফিস রুমে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।বড্ড ক্লান্ত লাগছে।ইদানিং কাজের প্রেসার অনেক। আরাবী প্রায় নেতিয়ে যায় কাজ করতে করতে।হাঁপিয়ে উঠে।তারপরেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও মনোবল শক্ত করে রুখে দাঁড়ায়।বাবার স্বপ্নটাকে সে কিছুতেই ভেস্তে যেতে দিবেন্না।নিজের মনপ্রাণ লাগিয়ে কাজ করে ও।কোম্পানিটাকে আরো বড়ো করার স্বপ্ন বুনে নিয়েছে মনের মাঝে।তা বাস্তবতায় রূপ দিতে হলেও ওকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। চোখ বুজে এসব চিন্তাই করছিলো আরাবী।এমন সময় মাথার উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকায়।আরাবী সেই দূর্বল চোখের চাহনী দেখে ইফতি নরম কন্ঠে বলে,’ ঠিক আছিস তুই?এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?’

আরাবী হালকা হাসলো।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দূর্বল গলায় বলে,’ ও কিছু না ভাইয়া।কাজের প্রেসারটা অনেক ইদানিং। ক্লান্ত লাগছে।’

আরাবী ব্যাগ গুছিয়ে নিতেই ইফতি আরাবীর হাত ধরে যেতে যেতে বলে,’ চল বাড়িতে।খেয়ে দেয়ে জম্পেশ ঘুম দিস।’

আরাবী ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে ইফতির সাথে বাড়ি চলে গেলো।অবশ্য জায়ান আর ইফতি একসাথেই আসে ওকে নিতে।কিন্তু আজ দুদিন যাবত জায়ান বিডিতে নেই।অফিসের কাজে ডুবাই গিয়েছে।জায়ানকে ছাড়া যে দিনগুলো কি বিটঘুটেভাবে কাটছে আরাবীর তা বলে বুঝানো যাবে না।বাড়িতে এসে দেখলো ওর দুই মা রাতের রান্নাবান্না সেরে ফেলেছেন।কয়েকদিন যাবত এটাই করছেন তারা।ছেলে মেয়েরা এতো কষ্ট করছেন।দম ফেলবার সময় নেই।বিশেষ করে আরাবী পড়াশোনা, সংসার আর অফিস তিনটে সামলাতে গিয়ে মেয়েটার শরীর সাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে।শরীর শুকিয়ে কাঠ গয়ে গিয়েছে।সাথির মাজে মাজে মন খারাপ হয়।মেয়েটাকে সংসারের দায়িত্ব এতো তাড়াতাড়ি দিয়ে বোধহয় তিনি ভুল করেছেন মনে হয়।কিন্তু কিছু করার নেই তার।তিনি কিছুই মনে রাখতে পারেন না ঠিকঠাক।সব ভুলে যান।চোখে কম দেখান।হাটুতে ব্যাথা। এখন আর আগের মতো সবটা সামলাতে পারেননা তিনি।
এদিকে সাথি আর লিপিকে এতো কাজ কর‍তে দেখে দুজনকে একদফা বকে দিলো আরাবী।এটা রোজই করে।দুইমাকে কতো শাষন করে।কিন্তু তারা শুনলে তো?বয়স হচ্ছে দিনদিন আরো বাচ্চা হয়ে যাচ্ছেন যেন তারা।নিহাদ সাহেবও কোন অংশে কম না।হাসিঠাট্টার মাধ্যমে রাতের খাবারদাবার শেষ হলে।সবকিছু গুছিয়ে রেখে রুমে আসলো আরাবী।রুমে আসতেই জায়ানের নিসঙ্গটা মনটাকে একনিমিষে বিষিয়ে তুললো। একটু আগেই তো কথা বললো।তাও মন খারাপ হয়েই যায়।ভালোবাসার মানুষটিকে দেখার জন্যে,ছোঁয়ার জন্যে মনটা ছটফট করতে থাকে অনবরত।ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো আরাবী।জায়ানের শোয়ার স্থানটায় হাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।ঘুমানোর আগে বিরবির করে বললো,
‘ কবে ফিরবেন আপনি?জলদি এসে পড়ুন।আপনার কাঠগোলাপ আপনাকে ভীষন মিস করছে।’

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।