বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-৩৯+৪০

0
571

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৯
মন খারাপ করে নিয়ে জায়ানের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বারান্দার সেই ছোট্ট বিছানাতেই ঘুমিয়ে পরেছে আরাবী।জায়ানের জন্যে অপেক্ষা করেছিলো ও।লোকটাকে ফোন করেছিলো দুপুর একটার দিকে।তখন সে জানায় বিকেল তিনটা, চারটা বাজবে ওর আসতে আসতে।তাই আরাবী আর দুপুরের খাবার খায়নি।ভেবেছিলো জায়ান আসলেই জায়ানের সাথে খাবে।কিন্তু বিকেল পাঁচটা বেজে যায় জায়ানের আসার কোন খবর নেই।এর মধ্যে ফোনও দিয়েছিলো তিন চারবার কিন্তু লোকটার ফোনও বন্ধ।চিন্তায় অস্থির হয়ে ইফতিকে ফোন করে জানতে পারে জায়ান ওর সাথেই আছে।আর একটা খুব জরুরি কাজে আটকে পরেছে তারা তাই আসতে দেরি হচ্ছে।তাতে যেন সস্থি মিললো আরাবীর।কিন্তু জায়ানের ফোন এইভাবে বন্ধ থাকায় একঝাক অভিমান জড়ো হয় মনের কোনে।ফোন বন্ধ করে রাখার কি দরকার ছিলো?একবার বললেই তো হতো। সেই অভিমান ধরে এখানে এসে একটা বই পরছিলো আরাবী।কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পরলো জানেই নাহ।হঠাৎ আরাবীর মনে হচ্ছে কেউ ওকে চুমু দিচ্ছে।তাও আবার পুরো মুখশ্রীতে। জড়িয়ে ধরেছে। তাও আবার শক্ত করে।এমন করে ধরেছে যে আরাবীর মনে হচ্ছে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে।আরাবী হালকা গোঙ্গালো।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে চোখজোড়া মেলে তাকাতেই জায়ানের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী নজরে আসে।লোকটা মুচঁকি হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।আরাবী ওই হাসি দেখে থম মেরে রইলো।কারো হাসিমাখা মুখটাও বুঝি এতো সুন্দর হয়?এইযে লোকটাকে দেখে ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে।এটার দ্বায় কে নিবে? আরাবী কিছু বলতে যেয়েও বললো না।অভিমানটা আবারও নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো মনের মাঝে। মন খারাপ করে জায়ানকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা কর‍তে লাগলো ও।কিন্তু ওর সেই নরম হাতদুটো জায়ানের শক্তপোক্ত হাত আর পা’কে সামান্য পরিমান সরাতে পারলো নাহ।ব্যর্থ হয়ে আরাবী মুখ ঘুরিয়ে নিলো।তাকাবেই না আর লোকটার দিকে। আরাবীকে অন্যদিকে তাকাতে দেখে জায়ান হুট করে নিজের মুখ গুজে দিলো আরাবীর ঘাড়ে।সেখানে ছোট ছোট উষ্ণ স্পর্শ দিতে লাগলো জায়ান।আকস্মিক এমন আক্রমণে বাকরুদ্ধ আরাবী।বহু কষ্টে একটা হাত জায়ানের চুলের মাঝে ড়ুবিয়ে দিয়ে তা খামছে ধরলো ও।আবেশে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেলো।জায়ানের অধর ছোঁয়া যেন আরো তীব্র হয়ে উঠলো এর কারনে।আরাবী এইবার মুচঁড়ে উঠলো।নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে ছটফট করতে লাগলো।অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, ‘ ছেড়ে দিন প্লিজ।’

কথাটা শুনে সাথে সাথে ঘাড় থেকে মুখ উঠিয়ে নেয় জায়ান।আরাবীকে এখনো চোখ বন্ধ করে রাখতে দেখে বললো, ‘ চোখ খুলো।’

আরাবী জবাব দিলো না।জায়ান এইবার গম্ভীর গলায় বললো, ‘ চোখ না খুললো এইবার ফাইনাল রোমান্স শুরু করবো।এখন তুমি কি চাও বলো?’

আরাবী আৎকে উঠে সাথে সাথে চোখ মেলে তাকালো।জায়ান ওই দৃষ্টিতে দেখতে পেলো অভিমানের সাগর। জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ দুপুরে খাওনি কেন?আম্মুদের সাথে খেয়ে নিতে।আমি তো বলেই দিয়েছিলাম আমার দেরি হবে। ‘

আরাবী চুপচাপ রইলো।একটা কথাও বললো না।জায়ান আরাবীর উপর থেকে উঠে গিয়ে আরাবীর হাত ধরে ওকেও টেনে তুললো।আরাবীকে ঠেলেঠুলে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে নিজেই চোখমুখে পানি দিয়ে দিলো। আরাবী এখনো চুপ।এতে জায়ান বেশ রেগে গেলো।আরাবীকে ধমক দিয়ে উঠলো, ‘ কি সমস্যা কথা বলছো না কেন? এমন করলে আমি আবার চলে যাবো।তারপর আর আসবো না।চাইলেও আমাকে আর খুঁজে পাবে নাহ।’

চমকে উঠলো আরাবী জায়ানের এমন কথায়।মনের ভীতরটা কেমন হু হু করে উঠলো।চিনচিনে ব্যাথা সৃষ্টি হলো বুকের বা-পাশটায়।ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হুট করে জায়ানকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আরাবী। ভেজা কন্ঠে বললো, ‘ এগুলো কেমন কথা বলছেন আপনি? আর কখনো এসব বলবেন না প্লিজ।’

জায়ান আরাবীকে জড়িয়ে ধরলো।বললো, ‘ তাহলে কথা বলছিলে না কেন?’

আরাবী বলে, ‘ আপনি নিজের ফোন বন্ধ করে কেন রেখেছিলেন?আমি কথাবার ফোন করেছিলাম আপনাকে।টেন্সন হচ্ছিলো খুব।পরে ইফতি ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম আপনি তার সাথে আছেন। এইজন্যেই রাগ করেছিলাম।’

জায়ান আরাবীর চুলের ভাজে চুমু খেয়ে। আরাবীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘ চলো খাবে।এতোক্ষন কেউ না খেয়ে থাকে? দুপুরে মেডিসিনও তো ছিলো।এমন করলে চলবে?’

আরাবী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে জায়ানের সাথে নিচে নেমে আসলো খাবারের জন্যে।জায়ানকে টেবেলি বসতে বলে আরাবী গেলো খাবার গরম করতে। একে একে সব খাবার গরম করে এনে জায়ানের প্লেটে খাবার বেরে দিলো।তারপর পাশের চেয়ারে বসে নিজের প্লেটে খাবার নিতে গেলে জায়ান বাধা দেয়।আরাবী ভ্রু-কুচকে তাকালে জায়ান খাবার মেখে আরাবীর মুখের সামনে ধরলো।ওমনেই মনে একটু আধটু যেই অভিমানটুকু ছিলো তা একনিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো আরাবীর।জায়ান খাবারটা মুখে নেওয়ার জন্যে ইশারা দিতেই আরাবী মুচকি হেসে খাবারটুকু খেয়ে নেয়।জায়ান আরাবীকে খাইয়ে দিলো পরক্ষনে নিজেও খেয়ে নিলো।খাওয়া দাওয়া শেষে আরাবী সবকিছু গুছিয়ে রাখলো।জায়ান বসে আছে ওর জন্যে। লোকটাকে বললো রুমে চলে যেতে ও একটু পর আসবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা।লোকটা ত্যাড়ামি করে এখানেই বসে আছে।হাতের কাজগুলো শেষ করে জায়ানের কাছে আসলো আরাবী।জায়ান তখন ফোনে কি যেন ঘাটাঘাটি করছিলো। আরাবী নিচু স্বরে বললো, কাজ শেষ।চলুন!’

জায়ান আরাবীর কথা শোনামাত্রই ফোনটা পকেটে গুজে নিয়ে আরাবীর হাত ধরে রুমে চলে আসলো।আরাবীকে সুইয়ে দিয়ে রুমের পর্দাগুলো টেনে দিয়ে আসলো।রুমের লাইটটাও নিভিয়ে দিলো।অতঃপর বিছানায় এসে টি-শার্ট’টা খুলে আরাবীর গায়ে কম্বলটা মেলে দিলো।রুমে এসি চলছে মেয়েটার এমনিতেও ঠান্ডা বেশি।জায়ান নিজেও এইবার কম্বলের ভীতরে ঢুকে আরাবীকে টেনে বুকে নিয়ে আসলো।আরাবী ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে জায়ানের দিকে।জায়ান আরাবীকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,, ‘ কি সমস্যা? এমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

আরাবী ছোট্ট কন্ঠে বলে, ‘ রাত আটটা বাজে আর আপনি এখনি আমাকে নিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।এটা কি হলো? ‘

জায়ান গম্ভীর গলায় বললো, ‘ তো কি সমস্যা?বাড়িতে কেউ নেই।খালামুনি অসুস্থ। মা,বাবা আর নূর সেখানে গিয়েছে।তাহলে তুমি এখন করবেটা কি শুনি?’

জায়ানের যক্তিতে কি বলবে ভেবে পেলো না।জায়ান আরাবীর মাথাটা বুকে চেপে ধরলো।
‘ ঘুমাও।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’

আরাবী চুপচাপ চোখ বন্ধ করে নিলো।আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জায়ান নিজেই ঘুমিয়ে পরেছে।কিন্তু আরাবীর চোখে ঘুম নেই। সে তো পুরো বিকেল ভরেই ঘুমোলো।এখন আর ঘুম আসছে না।ডাগর ডাগর আঁখিজোড়া মেলে ও তাকিয়ে জায়ানের দিক।লোকটা এতো সুন্দর যে আরাবী একধ্যানে তাকিয়ে থাকে জায়ানের দিকে। জায়ানের সৌন্দর্যের কাছে তো ও কিছুই না।সেখানে নাকি এই লোকটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে।মাঝেমধ্যে বড্ড হাসি পায় আরাবীর।ওদের প্রেমটা কেমন যেন।নাহ কোন কোন প্রেম নিবেদন হলো, না কোন ফুল আদানপ্রদান হলো,না কেউ কাউকে ভালোবাসি বললো।অথচ মন দিয়ে দুজন দুজনার তীব্র ভালোবাসাটা খুব করে অনুভব করতে পারে।আচ্ছা আরবী যে লোকটা এতো ভালোবাসে লোকটা কি তা জানে?ওকে কি বুঝতে পারে?ওর চোখের ভাষা পড়তে পারে?ওর হৃদয়ের ব্যাকুলতা অনুভব করতে পারে?যেমনটা ও করতে পারে জায়ানেরটা? আরাবী হাসলো।মনে মনে বললো, ভালোবাসা বড্ড অদ্ভূত।’

#চলবে__________
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪০
মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেছে বহুক্ষন।জায়নামাজের উপরে বসে দু হাত তুলে আল্লাহ্’র কাছে নিজের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করছে আরাবী। দু চোখ বেয়ে অজোড়ে অশ্রু ঝরছে আরাবীর। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছে ও।
এদিকে ঘুমের মাঝে আরাবীকে নিজেকে সন্নিকটে না পেয়ে কপাল কুচকে আসে জায়ানের।গাঢ়ো ঘুমটা কেটে গিয়েছে।আস্তে আস্তে চোখ খুলে বিছানায় আরাবীকে না পেয়ে ধীরে উঠে বসে জায়ান।ড্রিম লাইটের আলোতে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখা মিলে তার কাঠগোলাপের। যে নামাজ আদায় করছে।আল্লাহ্ তায়ালার কাছে মনের কথা ব্যক্ত করছে দুহাত তুলে।চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু।তবে আজ আরাবীর অশ্রু সিক্ত চোখজোড়া কোন পিড়া দিলো না জায়ানকে।বরং মনের মাঝে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো। জায়ান লম্বা হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো।আলমারির কাছে গিয়ে সেটা খুলে একটা পাঞ্জাবি বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো।তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে আসলো। ড্রয়ার হতে টুপি নিয়ে পরিধান করে নিজের স্ত্রীর থেকে একটু সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে ও নিজেও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে লাগলো।হোক না রাতটা নির্ঘুম।আজ নাহয় তারা দুজন মিলে তাদের রাতের ঘুমটা আল্লাহ্’র নামে করে দিলো।এদিকে মোনাজাত শেষ করে জায়ানকেও ওর সাথে নামাজ আদায় করতে দেখে ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে আরাবীর।আবারও রাব্বুল আলামিনের দুয়ারে লুটিয়ে পরে ও। ফজরের আজান দিলে দুজন সালাত আদায় করে একেবারে গিয়ে একটু বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আরাবীকে বুকে টেনে নিয়ে জায়ান চোখজোড়া বুজে নেয়। আরাবী ধীর আওয়াজে বলে, ‘ ভালো লাগলো আমার খুব যে আপনিও আমার সাথে নামাজ আদায় করলেন।’

জায়ান চোখ না খুলেই জবাব দিলো, ‘ তুমি প্রতিদিন ডেকে দিও তাহলে একসাথে দুজন নামাজ আদায় করে নিবো।’

আরাবী মুচঁকি হেসে বললো, ‘ এটা তো আমার কর্তব্য জনাব।’

‘ আচ্ছা এখন ঘুমাও একটু।’ বলে জায়ান আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো একদময় আরাবীর চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।

____________
সকাল দশটা………..
বাবার একটা ছবি নিয়ে বসে আছে আরাবী।আজ ওর বাবার মৃত্যুবার্ষিকি।বাবার ছবিতে হাত বুলিয়ে ব্যাথিত নিশ্বাস ফেললো আরাবী।কি একটা জীবন ওর। নামাজ পরে বাবার নামে দোয়া করা ছাড়া ও আর কিছু করতে পারবে নাহ।বাবার কবরটা একটু জিয়ারত করবে তাও পারেনা আরাবী।শুধু বাবার নামে দুজন এতিম শিশুকে একবেলা খাইয়ে দেয়।কিন্তু এছাড়া তো আর কিছুর করার সামর্থ্য ওর নেই। অশ্রুচোখে বাবার ছবিতে হাত বুলিয়ে দিলো আরাবী।বিরবির করে বলে, ‘ বাবা তোমার মেয়ের ভাগ্যটা বড্ড খারাপ।তোমার কবরটা পর্যন্ত আমি কখনো দেখতে পারলাম না বাবা।’

এমন সময় ঘর হতে জায়ানের কন্ঠ ভেসে আসলো।আরাবীকে ডাকছে।আরাবী চোখজোড়া মুছে ঘরের ভীতরে এলো।জায়ান সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা, মাথায় টুপি দেওয়া।বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।আরাবী মুগ্ধ হয়ে দেখলো নিজের স্বামিকে।জায়ান আরাবী এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা হাসলো।তারপর বিছানা হতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে আরাবীর সামনে আসলো।আলতো করে হাত গলিয়ে দিলো আরাবীর গালে।এতে যেন আরাবীর হুশ আসলো।জায়ান হাতের ব্যাগটা এগিয়ে দিলে।আরাবী সেটা হাতে নেয়।জিজ্ঞাসুচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘ এটা কিসের?’

জায়ান অপরহাতে আরাবীর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘ যাও এটার ভীতরে একটা শাড়ি আছে পরে আসো। আমরা একজায়গায় যাবো।’

আরাবী দৃষ্টি নত করে হালকা আওয়াজে বললো, ‘ আমার মনটা ভালো নেই আজ।আমি কোথায় যাবো না।প্লিজ রাগ করবেন না।’

জায়ান নরম কন্ঠে বললো, ‘ আমি জানি তোমার মন ভালো নেই।আর এই কারনেই আমরা বাহিরে যাবো।তুমি একা না।বাবা,মা,নূর,ইফতি,চাচ্চু,ছোটমা,আর আম্মুও যাবে।যাও তৈরি হয়ে আসো।’

জায়ানের অবাক হলো আরাবী।ওর মাও নাকি যাবে।আশ্চর্য আর সবাই হয়তো জানে না যে আর ওর বাবার মৃত্যু বার্ষিকি কিন্তু ওর মা তো জানে।তাহলে সে কিভাবে রাজি হলো?মনের কথা মনে রেখেই আরাবী ওয়াশরুমে চলে গেলো শাড়ি নিয়ে। শাড়ি পরা শেষ হতেই আরাবী বের হয়ে আসে।সাদা একটা শাড়ি।শাড়িটার মাঝে জারি সুতোর কাজ করা।আরাবীকে যেন এই শাড়িতে ভীষন সুন্দর লাগছে।জায়ান আরাবীর কাছে এসে আরাবীর কপালে চুমু খেলো।বললো, ‘ মাশা-আল্লাহ ভীষন সুন্দর দেখাচ্ছে।’

আরাবী মাথা নাড়ালো।তারপর গিয়ে চুল আচড়িয়ে খোপা করে শাড়ির সাথে সাদা একটা হিজাব বেধে নিলো। তারপর জায়ানের সাথে চললো।নিচে আসতেই অবাক হলো আরাবী।সবার আগেই শুভ্র রঙ্গের পোষাক।আরাবী তাও কোন প্রশ্ন করলো না।চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই জায়ান কাঙ্খিত স্থানে রওনা দিলো।আধাঘন্টা পর গাড়ি থামতেই একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো সবাই।আরাবী অবাক হলো।এটা তো একটা এতিমখানা আর বৃদ্ধাশ্রম। জায়ানের দিকে তাকালো আরাবী। জায়ান ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বলে, ‘ আজ জিহাদ বাবার মৃত্যু বার্ষিকি সেটা আমরা জানি।তাই তার নামে এখানে খাবারের ব্যবস্থা করেছি।’

জায়ানের কথা শুনে চোখ ভরে উঠলো আরাবীর।লোকটা এতো ভালো কেন? আরাবীকে কাঁদতে দেখে জায়ান বললো, ‘ কেঁদোনা চলো ভীতরে।সবাই চলে গিয়েছে।’

আরাবী জায়ানের হাত ধরে ভীতর প্রবেশ করলো।অতঃপর খুব সুন্দরভাবে আয়োজনটা সম্পন্ন হয়।আরাবী মা তো একটু পর জায়ানের কাছে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে এরজন্যে।বিকেল হয়ে আসলে সবাই বাসায় যাওয়ার জন্যে রওনা হলো।তবে বাড়ির পথে গাড়ি না যাওয়ায় আরাবী প্রশ্ন করলো, ‘ এটা তো বাড়ির পথ না।কোথায় যাচ্ছেন?’

জায়ান কোন কথা বললো না চুপচাপ থাকলো।তবে যখন গাড়ি থামতেই ওরা সবাই নামলো।আরাবীর মা সামনে তাকাতেই বিষ্মত হয়ে গেলেন। আরাবী একটু সময় লাগলো জায়গাটা চিনতে তবে।ও নিজেও চিনে ফেললো।চোখ বড় বড় হয়ে আসলো আরাবীর।পাশে দাঁড়ানো জায়ানের হাত খামছে ধরলো আরাবী।ওর শরীর যে থরথর করে কাঁপছে তা বেশ বুঝতে পারছে জায়ান।আরাবীর মা’কে মিলি আর সাথি সামলে রেখেছেন।তার অবস্থাও আরাবীর মতো।জায়ান আরাবীর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, ‘ যাবে না নিজের বাড়িতে?’

আরাবী কোনকিছুই বলছে না।কেমন পাথরের মতো জমে গিয়েছে। জায়ান নিজেই আরাবীকে নিয়ে গেট পেরিয়ে ভীতরে প্রবেশ করলো।তবে বাড়ির ভীতরে না গিয়ে।বাগানের ওইপাশে নিয়ে গেলে।সেখানে আরাবীর বাবাদের পারিবারিক কবরস্থান।একটু আগাতেই ইখতিয়ার সাহেব আর সাথে একজন হুজুরকে দেখতে পেলেন তারা। মহিলারা আর আগালেন না তারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আরাবীর মা ছটফট করছেন সেখানে যাওয়ার জন্যে।তাকে সাথি আর মিলি বুঝাচ্ছেন।আরাবী চুপচাপ নূরের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।শুধু ফ্যালফ্যাল করে সবটা দেখছে ও। ছেলেরা সবাই ওজু করে আসলো।তারপর জিহাদ সাহেবের কবর জিয়ারত করলো একসাথে।হুজুর চলে যেতেই।এবার মহিলারা সবাই আগালেন।কবরের গেট পেরিয়ে ভীতরে প্রবেশ করতেই আরাবীর মা স্বামির কবরের উপর নিজেকে লুটিয়ে দিলেন।কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন তিনি।এই প্রথম।এই প্রথম স্বামির কবরটার দর্শন পেলেন তিনি। নিজেকে সামলাতে পারলেন না কিছুতেই।কবরটা আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদছেন।উনার এমন হাহাকার দেখে আজ সবার চোখেই পানি জমেছে।এদিকে আরাবী এখনো পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে।ওর মস্তিষ্ক সবটা ধারন করতে পারছে না।এতো কিছু যে একসাথে পেয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ও। বুকের ভীতরটা কেমন লাগছে ও কাউকে বুঝাতে পারবে না।চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে আরাবী।তবে আসছে না।শুধু নিরবে অশ্রু ঝরছে দুচোখ বেয়ে।এদিকে ওকে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জায়ান আরাবীর মাথায় হাত রাখলো মায়া ভরা কন্ঠে বললো,’ বাবার কবরটা একবার স্পর্শ করবে না আরাবী? তোমার বাবা আরাবী।ওখানে সুয়ে আছেন তিনি।বাবার বুকে মাথা রাখবে না?’

আরাবীর ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে।কিছু বলতে চাইছে আরাবী।কিন্তু কন্ঠ গলিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।চোখজোড়া ঝাপ্সা হয়ে আসছে আরাবীর। অপ্রতাশিত সবকিছু আজ জাদুর মতো একসাথে পেয়ে।মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে পরলো আরাবীর।জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতে নিতেই জায়ান ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত দুহাতে জড়িয়ে নিলো নিজের কাঠগোলাপকে।

#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন