#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৫
একসময় আরাবী সবসময় উদাসিন থাকতো।আনমোনা হয়ে নিজের জীবনের দুঃখগুলো কিভাবে ঘায়েব করে দেওয়া যায় তার উপায় খুঁজতো। কিন্তু যবে থেকে জায়ান এসেছে ওর জীবনে। রঙহীন জীবনটা যেন লোকটা এক
নিমিষেই রংধনুর সাতরঙ দিয়ে ওর জীবটা কানায় কানায় রঙিন করে দিলো। জায়ানকে প্রথম বার দেখে ভাবতেই পারেনি।এই বগরাগি লোকটাই ওর একমাত্র ব্যাক্তিগত সেই মানুষটি হবে।যেই লোকটাকে দেখলেই আরাবী ভয়ে সিটিয়ে যেতো আজ সেই লোকটাই যে ওর সবটা জুড়ে এইভাবে সর্বক্ষন বিচড়ণ করবে কখনো কল্পনাও করেনি আরাবী।আর এখন লোকটাকে দেখলেই লাজুক হাসিতে ঠোঁটটা আরাবীর প্রসারিত হয়ে যায়।সাথে পুরো চেহারায় লালাভ আভার ছেঁয়ে যায়।। জায়ানের বলা প্রতিটা কথা বক্ষস্থলে কাঁপন ধরায় ভয়ংকরভাবে।জায়ানের বলা প্রতিটা বাক্য যেন আরাবীর সারা অঙ্গে অদ্ভূত শিহরণ জাগিয়ে তুলে।গম্ভীর লোকটা মাঝে মাঝে এমন সব ভয়ানক কথা বলে আরাবী পারে না লাঁজে মরে যায়।লোকটা এমন অসভ্য কেন?কেন বুঝে না এসব কথা শুনলে লজ্জায় ওর মরে যেতে ইচ্ছে করে?গুমড়োমুখো লোকটা যে ওকে এতোটা চায়, এতোটা চায় তা ওই লোকের চেহারা দেখলে বুঝা বড্ড মুশকিল।আরাবী তো বুঝতে পেরেছে জায়ানের চোখের ভাষা দেখে।জায়ানের চোখগুলো স্পষ্টভাবে আরাবীকে জানিয়ে দেয় যে এই গুমড়ামুখো লোকটা ওকে কতোটা ভালোবাসে। আরাবী বাগানে সুইপিংপুলটার পাশে বসার চেয়ারগুলো আছে সেখানে বসে পানির দিকে তাকিয়ে জায়ানের ভাবনায় মুশগুল ছিলো। অথচ ও টেরই পেলো না।একজোড়া মুগ্ধ দৃষ্টি ওকেই চেয়ে চেয়ে দেখছে। হঠাৎ হাত টান লাগায় ভড়কে যায় আরাবী।ভয়ে চোখ খিচিয়ে নেয় জোড়েসোড়ে।বুকটা এখনো ধুকপুক করছে।ভয়ে বড় বড় শ্বাস নেওয়ার সময় হঠাৎ সেই তীব্র সুঘ্রানটি সুরসুর করে নাসিকাপথ দ্বারা প্রবেশ করতেই আরাবীর বুঝতে একটুও সময় লাগে না যে লোকটা কে। বুকের কাছে ভয়ে রাখা ছিলো সেই হাতজোড়া।তা এখন আস্তে আস্তে মুঠো পাকিয়ে ফেললো। দুমড়েমুচড়ে হাতের সেই মুঠো টুকোর মাঝে খাবলে ধরলে সেই ব্যাক্তিটির টি-শার্ট। মুখের উপর উষ্ণ নিশ্বাসের খেলা চলছে। সাথে সাথে সেই কাঁপন ধরানো কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
-‘ চোখ খুলো!’
আরাবী বাক্যটি শ্রাবণ করা মাত্র নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে বাজেভাবে।একজন মানুষের কন্ঠে যে এতোটা মাদকতা থাকে তা আগে জানতো না আরাবী।কেমন যেন কন্ঠস্বরটা শুনলে নেশা ধরে যায় আরাবীর।ইচ্ছে করে লোকটাকে সামনে বসিয়ে বলতে আপনি কথা বলতে থাকুন আমি শুধু আপনাকে দেখবো। আচমকা মুখের উপর ফুঁ দেওয়ায় কেঁপে উঠলো আরাবী। মৃদ্যু কম্পনরত চোখের পাতাগুলো ধীরে ধীরে খুললো।ওমনেই চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটির সুদর্শন মুখখানা নজরে এলো আরাবীর।লোকটা বোধহয় কাজ থেকে ফিরেই মাত্রই গোসল নিয়েছে। তাইতো অনেকটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।নজর আটকে রইলো আরাবীর সেই শুভ্র স্নিদ্ধ মুখখানায়।আরাবীর এহেন ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখে বাঁকা হাসলো জায়ান।বললো,
-‘ এতোক্ষন চোখই খুলতে চাইছিলে না।আর এখন কি করছো বলোতো?’
লজ্জা পেলো আরাবী।সাথে সাথে চোখের দৃষ্টি নত হলো ওর।জায়ান ধীরে ধীরে ওই নত করা মুখখানার দিকে নিজের মুখ নামিয়ে আনলো।কানের সাথে ঠোঁটজোড়া ছুঁই ছুঁই করে বললো,
-‘ লাল রঙ আমার পছন্দ না আরাবী জানো?তবে আজ তোমায় এই লাল জামাটায় এতো সুন্দর আর আবেদনময়ী লাগছে যে আজ থেকে এই রঙটাও আমার প্রিয়র তালিকায় লিখে নিলাম।যেমনটা তোমায় দেখার সাথে সাথে আমার বক্ষস্থলে যে হৃদয়টা আছে সেখানে তোমাকে বসিয়ে দিয়েছিলাম তৎক্ষনাৎ।’
এতোক্ষন জায়ানের কথায় লজ্জা পাচ্ছিলো আরাবী।কিন্তু জায়ানের শেষ কথাটুকু শুনে চমকালো।কি বললো জায়ান মাত্র।আরাবীকে প্রথম দেখাতেই জায়ান ওকে পছন্দ করেছিলো?কিন্তু কিভাবে?পছন্দ করে থাকলে লোকটা তাহলে ওর সাথে বাজে বিহেইভ কেন করতো? নানান প্রশ্ন আরাবীর মস্তিষ্কে কিলবিলিয়ে উঠলো।অন্যমনস্ক আরাবীর কানে কানে ফের বললো জায়ান,
-‘ তোমায় বড্ড চুমু খেতে ইচ্ছে করছে আরাবী।’
এতোক্ষনের চিন্তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দিলো আরাবী জায়ানের মাত্র বলা কথাগুলো শুনে।জায়ানকে এতোটা জোড়ে খামছে ধরলো যে।জায়ান ব্যাথা পেয়ে মৃদ্যুভাবে চোখজোড়া বন্ধ করলো।তবে টু শব্দটুকুও করলো না জায়ান।আরাবী আটকে আটকে বলে উঠলো,
-‘ এসব বলা বন্ধ করুন। দোহাই লাগে আপনার।এইসব বলে আমায় লজ্জা দিবেন না।আমি যে মরে যাবো।’
মৃদ্যু হেসে জবাবে জায়ান বলে,
-‘ আমি তো মেরেই ফেলতে চাই।’
আরাবী মৃদ্যু ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
-‘ পাষাণ,নিষ্ঠুর।’
হাসলো জায়ান আরাবীর কথায়।চট করে আরাবীকে ছেড়ে দিয়ে সরে আসলো জায়ান।আরাবীও তাকালো।জায়ান পকেটে দুহাত গুজে ভ্রু উচিঁয়ে বললো,
-‘ এতো রাতে এখানে কি করছো?’
আরাবী মুখটা কাচুমাচু করে উত্তর দিলো,
-‘ ঘুম আসছিলো না।তাই আরকি….!’
জায়ান কথাটা শুনে নির্বিঘ্ন ভঙ্গিতে বললো,
-‘ আমার কথা মনে পরছিলো সেটা সরাসরিই বলতে পারো।’
আরাবী কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।আসলেই জায়ানের কথা বড্ড মনে পরছিলো।আজ সারাদিনে লোকটাকে দেখতে পারেনি।আর এখন গিয়েও যে দেখা করবে সেটা আরাবী করতে পারবে নাহ।গিয়ে আরাবী কিভাবে বলবে যে ও জায়ানকে দেখতে এসেছে?লজ্জায় আরাবী মুখ দিয়ে তো তখন কথাই বের হবে না।আরাবী মৌনতা লক্ষ করেই জায়ান যা বুঝার বুঝে ফেললো।হালকা হাসলো জায়ান।বাতাসের ঝাপটায় আরাবীর খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছিলো। জায়ান শক্তপোক্ত হাতটা এগিয়ে দিয়ে আরাবীর মুখের এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিলো।আরাবী চোখজোড়া আবেশে বটে নিলো।আবারও ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো।জায়ান আরাবীর নরম গালটা পাঁচ আঙ্গুল দ্বারা আবৃত করে ধরলো।আরাবী নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে।লোকটা গালে যেভাবে হাত দিয়ে স্পর্শ করেছে।সেখানটা শিরশির করছে।সেই শিরশিরানী ভাবটা ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরেছে।ভালো লাগার প্রজাপতিগুলো মনের আঙ্গিনায় উড়াউড়ি করে চলেছে নিবীড়ভাবে। আরাবী জায়ানের চোখের দিকে তাকালো।ধরা গলায় বলে,
-‘ আপনি অনেক ভালো।অনেক ভালো।’
জায়ান আরাবীর কথাটায় বেশ অবাক হলো।আরাবীর মতো চাপা স্বভাবের মেয়েটা যে জায়ানকে অকপটে এই কথাটা বলবে ভাবেনি জায়ান। আরো নিবীড়ভাবে আরাবীর গালটা আকঁড়ে ধরলো। দু ধাপ এগিয়ে এসে আরাবীর মুখোমুখি হলো।আরাবী তাকিয়েই আছে জায়ানের দিকে।আজ এতো সাহস কোথা থেকে আসলো আরাবীর মাঝে।কিভাবে যেন নির্দ্বিধায় আজ তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। জায়ান হালকা হাসলো আরাবীর এতোটা সাহস দেখে।আজ কেন যেন বেহায়া হতে ইচ্ছে করছে জায়ানের।ওই মায়াবী মুখশ্রীটা আদরে আদরে ভড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। জায়ান মুখটা নিচু করলো।প্রায় অনেকখানি নিচু করলো।কারন আরাবী অনেকখানি খাটো জায়ান থেকে।আরাবী জায়ানকে ঝুকতে দেখে খানিক ভড়কালো তবে দৃষ্টি সরালো নাহ।নান পিছপা হলো।জায়ান যেন এতো অনেকখানি খুশি হলো। জায়ান আরাবীর কপালে অধর ছুঁইয়ে দিলো।এতোদিন বুকের ভীতর জমিয়ে রাখা সকল ভালোলাগা,ভালোবাসাটুকু ঠেলে দিলো ওই উষ্ণ ছোঁয়াটায়।আরাবীর সারা শরীর অদ্ভুতভাবে থরথর করে কেঁপে উঠলো।এই প্রথম, এই প্রথম জায়ানের অধরের স্পর্শ পেলো আরাবী।উত্তেজনায়,ভালোলাগায় জায়ানের পেটের কাছের টি-শার্টটি দুমড়ে মুচড়ে খামছে ধরলো ওই নরম আঙ্গুলগুলো দ্বারা। উষ্ণ স্পর্শটুকু দিয়ে সরে আসলো জায়ান।আরাবী এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজের ভালোলাগাটুকু জানান দিচ্ছে জায়ানকে।জায়ান আরাবীর বদ্ধ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।আবারো ওই আদুরে স্পর্শটুকু ঢেলে দিলো আরাবীর ওই বন্ধ চোখজোড়ায়। তারপর হুট করে আরাবীর দুকোমড়ে ওই পুরুষালি হাতজোড়া দাম্ভিকতার সাথে স্পর্শ করলো।এরপর হেঁচকা টানে আরাবীর ছোট্ট দেহটা টেনে নিয়ে আসলো জায়ান ওর সেই প্রসস্থ বুকে।
#চলবে____________
#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৬
আজ সকাল থেকেই আরাবী পালাই পালাই করছে জায়ানের কাছ থেকে।কাল রাতে জায়ানের করা কর্মকান্ডে লজ্জায় ও জায়ানের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না একটুও।জায়ানের সাথে প্রতিদিন ভোরে কথা বলে আরাবী।আজ তাও করলো না।চুপচাপ নাস্তা সেরে নূরকে নিয়ে ভার্সিটিতে চলে গিয়েছে।লজ্জায় তার গাল দুটো ফুলোফুলো হয়ে আছে।ক্লাসে বসেও স্যারের পড়ানোতে ধ্যান দিতে পারিনি আরাবী।বারবার কাল রাতের কথা ভেবে গিয়েছে অন্যমনস্কভাবে।আরাবীকে এমন আনমোনা দেখে নূর বার কয়েক জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। কিন্তু আরাবী কিছুই বলেনি।ভার্সিটি মাঠ দিয়ে হাটছে আরাবী আর নূর।আরাবীকে কৃষ্ণচূড়ার গাছটার কাছে বসবে জানালো নূরকে।তাই তারা গিয়ে ওখানে বসলো।আরাবী সেখানে বসে আবারো জায়ানের ভাবনায় মশগুল হয়ে গেলো।বসে বসে লজ্জা ভঙ্গিমায় মিটিমিটি হাসছে।নূর আরাবীকে এমন করতে দেখে এইবার বিরক্ত হয়ে বললো,
-‘ তুমি কি বলবা কি কারনে তুমি আজ এমন করছো?’
আরাবীর নূরের প্রশ্ন শুনে থকমত খেয়ে গেলো।দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলে,
-‘ আরে কিছু হয়নি তো!তাহলে কি বলবো তোমায়?’
নূর এইবার বেশ তেজ নিয়ে বলে,
-‘ কিছু হয়নি তো এমন করছো কেন? ক্লাসের পড়াতেও ভালোভাবে মন দেওনি!’
-‘ আহ! রাগ করছো কেন?আজ এমনিই মনটা অতিরিক্ত ভালো তাই এই অতিরিক্ত ভালোলাগার কারনে আমি ক্লাসেও মনোযোগ দিতে পারিনি।’
আরাবীর এমন যুক্তিছাড়া কথা শুনে নূর কি বলবে ভেবে পেলো না।তাই অগত্যা হার মেনে নিলো আর কথা না বাড়ানোর।প্রায় মিনিট পাঁচেক পরেই গাড়ি আসলো ওদের।আরাবী তা দেখে বলে,
-‘ নূর চলো।গাড়ি এসে পরেছে।’
নূর মাথা দোলালো।তারপর দুজনে বাড়ি যাওয়ার জন্যে রওনা হলো।
______________
ভার্সিটি থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে মায়ের কাছে এসে এক লম্বা ঘুম দিয়েছে আরাবী।এখনো মায়ের কোলে মাথা দিয়ে সুয়ে আছে আরাবী।আর ওর মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আরাবী মায়ের কোলে মাথা দিয়ে নানান কিছু চিন্তা করছে।একটা কথা তাকে বার বার ভাবাচ্ছে।কিছুতেই সাহস পাচ্ছে না মা’কে এই কথাটা বলার।আরাবীর মা হয়তো মেয়ের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন।স্বস্নেহে বললেন,
-‘ কিছু বলবি মা?বলার থাকলে বলে ফেল।’
আরাবী হাসলো।সে জানে তার মা ওর মুখ দেখেই মনের চাওয়া পাওয়াটা বুঝে ফেলে নিমিষেই।আরাবী ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-‘ মা শহরে আসলে।একবার বাবার কবরটা জিয়ারত করবে না?আর আমারতো মনে নেই বাবাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে তাই যেতে পারিনি।এখন তুমি এসেছো। তুমিতো জানো বাবাকে কোথায় রাখা হয়েছে।চলো না মা।একবার বাবাকে দেখে আসি।আর তার কবরটা জিয়ারত করে আসি।’
মেয়ের কথায় বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে উনার।আসলেই তো কতোটা বছর পেরিয়ে গেলো মানুষটা আর নেই আর ওর কাছে।ওর ভালোবাসার মানুষটা উনাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। চোখ ভরে উঠলো জলে।প্রিয় মানুষটাকে দেখতে কেইবা না চায়।কিন্তু আরাবীর মা অসহায়।তার হাতে কিছু নেই।কিছু করার নেই।মেয়ের কথায় যে তার ভীতরটা ফেটে যাচ্ছে।কিভাবে মেয়েকে বুঝাবে যে এই শহরে পা দেওয়া মাত্রই উনি নিজের স্বামির কবরটা দেখার জন্যে দিনরাত ছটফট করে কাটাচ্ছেন।তার অন্তরে যে অসহনীয় দহন হচ্ছে তা কি করে বোঝাবে?তারও তো খুব করে মন চাইছে ছুটে গিয়ে প্রিয় মানুষটার কবরের বুকে লেপ্টে থেকে হাউমাউ করে কাঁদতে।এতো বছরের জমানো সকল কথা ওই নিশ্চিন্তে ঘুমানো মানুষদের কাছে পৌছে দিতে।তার কবরটা জিয়ারত করতে।কিন্তু তিনি পারছেন না।পরিস্থিতি তাকে এতোটা অসহায় বানিয়ে দিয়েছে যে উনি চাইলেও পারছেন না। আরাবী ওর মাকে এমন চুপ থাকতে দেখে আবারও বললো,
-‘ কি হলো মা? নিয়ে যাবে না আমায়?’
আরাবীর মা ধুকরে কেঁদে উঠলেন।হঠাৎ উনাকে এমন কাঁদতে দেখে ভড়কে গেলো আরাবী।তৎক্ষনাৎ মায়ের কোল থেকে উঠে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
-‘ কি হয়েছে মা?কাঁদছো কেন?কেঁদোনা প্লিজ?আমার কোন কথায় কি তুমি কষ্ট পেয়েছো?’
আরাবীর মা মেয়ের কথায় চোখ মুছে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কান্না খানিকটা কমে আসলে তিনি বলেন,
-‘ তুই কি ভাবিস?আমি কি পাষাণ?আমার কি মন চায় না তোর বাবার কবরটা দেখতে?এই শহরে পা রাখার সাথে সাথে মন চাইছিলো তার কাছে ছুটে যাই।এইযে এখনো পারলে আমি চলে যাই।কিন্তু আমি অসহায়।আমার কোন ক্ষমতা নেই তার কবরটা একপলক দেখার।আমি তার স্ত্রী হয়েও তার কবরটা দেখতে যেতে পারবো না।সেই অধিকারটুকুও আমার নেই।’
আরাবী মায়ের এমন কথায় রাগে দুঃখে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠে,
-‘ কেন মা?কেন?কেন পারবে না তুমি?কি কারনে পারবে না? তুমি আজও আমায় আমার বাবার বাড়ির ঠিকানা বললে না।শহর এখন আরো উন্নত হয়েছে আগের মতো কিছু নেই।যদি আগের মতোই সব থাকতো আমি অপেক্ষা করতাম না।সেই ছোট্ট সময়ের কথা মস্তিষ্ক ঠিকঠাক ধারন করে রাখতে পারিনি।নাহলে আমি কি এখানে এসেও বসে থাকতাম? উহু! কোনদিন না।আমি সেই কবেই চলে যেতাম।কিন্তু এখন যখন তুমি এসেছো তাও তুমি আমায় বলছো না কিছু।কেন এমন সবকিছু গোপন করো মা? আমাকে আমার বাবার কবরটা এই ইহজীবনে শুধু একবার দেখতে দেও।আমি একবার তার কবরটা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চাই।তার কবরের মাঝে সুয়ে থাকতে চাই।বাবাকে অনুভব করতে চাই।কিন্তু তুমি এইভাবে চুপ করে থাকলে কিভাবে হবে মা?কেন এমন করছো আমার সাথে?তোমার এই সরলতাই আমার থেকে সব ছিনিয়ে নিয়েছে মা।সেদিন যদি তুমি আইনের ব্যবস্থা নিতে।রুখে দাড়াতে।তাহলে আজ আমাদের এইভাবে ভিখাড়িদের মতো পরে থাকতে হতো না।না মানুষের লাথি উষ্ঠা খেয়ে বড় হতে হতো।তুমি নিজের কারনে আজ নিজেই এমন নিঃস্ব।আমায় মিহান আংকেল বলেছেন বাবা আমাদের নামে তার সব সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন।মিহান আংকেলকে নিয়েই সেই দলিল বানিয়েছেন তিনি।যে তিনি যদি মারা যান তাহলে তার সকল সম্পত্তি আমাদের হবে।কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না।সেদিন নিজেকে সবার সামনে দূর্বল প্রমান করে। নিজের অধিকার নিজের হক ছেড়েছুড়ে চলে গেলে।কেন মা?তুমি কেন করলে এমনটা?কেন করলে?’
আরাবী কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।আর আরাবীর মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন মেয়ের কথা শুনে।তার মেয়ে তো ভুল কিছু বলেনি।সত্যিই তো তিনি কেন পারলেন না সেদিন কিছু করতে।নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েও কেন পারলেন না সেদিন রুখে দাড়াতে।আরাবীর মা আচঁলে মুখ চেপে ধুকরে কেঁদে উঠলেন।
_____________
ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে আরাবী।’দ’ আকৃতিতে বসে ও।হাটুতে মুখ গুজে অনরবত কাঁদছে আরাবী।চিৎকার করে কাঁদতে পারলে বুঝি বুকের এই অসহনীয় পীড়াটা একটু কম হতো।কিন্তু আরাবী পারছে না কাঁদতে।এই ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্নাগুলোও যেন ওর কষ্টগুলো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত।নিজেকে পাগল পাগল লাগছে আরাবীর। কষ্টগুলো কেন কমে না?কেন বুকের মাঝে এতো পীড়া হয়? আরাবী কি করবে ভেবে পেলো না।রাগে,দুঃখে নিজের চুল টেনে ধরলো আরাবী।আকাশের দিক তাকিয়ে রইলো একধ্যানে।অবাধ্য নোনাজলগুলো ক্রমান্বয়ে গাল গড়িয়ে পড়ে গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে আরাবীর।ঠিক তখনি কানের কাছে ভরাট কন্ঠের আওয়াজ শোনা গেলো,
-‘ কাঠগোলাপের যে কাঁদা বারণ আছে।সে কাঁদলে যে অন্যজনের বুকে পীড়া হয় তা কি সে জানে?’
#চলবে____________