#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৫
কালো মেঘে রাতের আকাশ ঢেকে গিয়েছে।ঝড়ো হাওয়া বইছে সমানতালে।কেমন ঠান্ডা,হিমশীতল হাওয়া।যা শরীরে ছুঁইয়ে দিলেই শিরশিরে অনুভূতি হয়।রাতের আকাশে চাঁদ, তারার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।তারা মেঘেদের আড়ালে নিজের লুকিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ তীব্র গর্জনে মেঘ ডেকে উঠলো তার একটু পরেই আকাশ ভেঙ্গে প্রকৃতিতে নেমে এলো বারিধারা।সারাদিনের প্রখর সূর্যের তাপে উত্তপ্ত পৃথিবীকে সিক্ত করতে নিজেদের অস্থিত্বের জানান দিলো। কখনো টিপটিপ, কখনো ঝিরঝির, কখনো বা ঝমঝম অবিরাম বর্ষণে সিক্ত হচ্ছিল। বকালো মেঘে শুরু হল গুরু গুরু গর্জন, আকাশের বুকে সেইসঙ্গে ঝিলিক দিতে থাকলো বিদ্যুতের নীল শিখা।মুষোলধারে মাটির ওপর যেইমাত্র পড়ল বৃষ্টির ফোঁটা, চারপাশ ভরে গেল ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে। সেই যে বৃষ্টি শুরু হল তার আর থামবার অবকাশ নেই।আরাবী একমনে প্রকৃতির এই সুন্দরতম মুহূর্তগুলো উপভোগ করছে।বারান্দার থাই গ্লাস টেনা দেওয়া।তবে স্বচ্ছ কাচের দ্বারা সবই দেখা যাচ্ছে বেশ ভালোভাবে।প্রায় অনেকক্ষন হলো নূর আরাবীকে জায়ানের রুমে দিয়ে গিয়েছে।রুমে প্রবেশ করতেই বেশ অবাক হলো আরাবী।মাত্র এটুকু সময়েই কিনা ফুল দ্বারা কি সুন্দর রুমটা সাঁজিয়ে ফেলেছে।আরাবী একমনে ঘরটির দিকে তাকিয়ে ছিলো।একসময় এই রুমটায় আসতে কতো ভয় পেতো আরাবী।আর আজ থেকে সে নিজেই এই ঘরের মালিক হয়ে গেলো।আরাবী অবাক হয়ে দেখছিলো জায়ানের রুম।বেশ গোছালো আর শৌখিন লোকটা। ঘরের জিনিসপত্র সবকিছুই বেশ সুন্দর। বিছানার দিকে নজর দিতেই বিষ্মত হয়েছিলো আরাবী।সাদা চাদরে মুড়ানো বিছানা পুরো গোলাপ ফুল দিয়ে লাল বানিয়ে দিয়েছে। কি আশ্চর্য কারবার।এতো সুন্দরভাবে সাজিয়েছে আরাবী যে বিছানায় বসবে তার উপায় নেই।যদি নষ্ট হয়ে যায়? এই কারনেই ও বারান্দার দিকে চলে যায়।বারান্দাটা বেশ বড়।বারান্দার একপাশে একটা ছোট্ট বিছানাও আছে।সেখানে অনায়াসে একজন মানুষ ঘুমোতে পারবে। আরাবী সেই বিছানাটায় উঠে বসেই প্রকৃতি বিলাশে মগ্ন হয়ে রইলো।পেরিয়ে গেলো অনেকসময়।হঠাৎ বাহির থেকে চেচাঁমেচি শুনেই ভড়কে যায় আরাবী।বারান্দার বিছানা থেকে নেমে দ্রুত রুমে আসে ও।রুমের বাহিরে ইফতি,নূর আর জায়ানের কথা শোনা যাচ্ছে।মানে লোকটা এসে পরেছে।বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। প্রবলভাবে গলা উচিঁয়ে কথা বলছে নূর, ‘ ভাই নগত পঞ্চাশ হাজার টাকা দেও।পচিঁশ আমার আর পচিঁশ ইফতি ভাইয়ার।’
ইফতি নূরের কথায় সাথে সাথে তেঁতে উঠলো, ‘ তুই পচিঁশ নিবি মানে?সব করলাম আমি।এতো কষ্ট করে ফুল আনলাম আমি।লোক দিয়ে রুম সাজালাম আমি।তুই ফাও ফাও এতো টাকা নিবি মানে?থাপড়িয়ে তোর গাল লাল করে দিমু।বেয়াদপ।’
‘ তুমি একটা আস্তো শয়তান ভাইয়া। আমি না তোমাদের একমাত্র বোন?আমার সাথে এমন করতে পারবে? আর রইলো ফুল টুল এসব আনার কথা।তুমি কি আমায় কিছু বলেছো?যে আমি তোমাকে হেল্প করবো?কিছুই তো জানাও নি?ভাবিকে রুমে দিতে এসে না দেখলাম যে ফুল দিয়ে রুম সাজানো।’
ইফতি ধমকে উঠলো, ‘ ঘোড়ার ডিম না।বোন হয়েছিস তো কি?টাকার কথা আসলে সেটা অন্য।মাত্র দশ পাবি তুই।আর যদি ঘ্যানঘ্যানানি করোস তাহলে এই টাকাও দিবো না। যা ভাগ এখান থেকে ছকিনার মা।’
নূর রেগেমেগে বলে, ‘ খবরদার আমাকে ছকিনার মা এইসব ফাউল নামে একদম ডাকবে না ভাইয়া।’
ইফতি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে, ‘ একটা টাকাও দিবো না তোকে।দশ বাদ।’
‘ এই নাহ নাহ।আমি আর কিছু বলবো না।’
সাথে সাথে নূর মুখ গোমড়া করে নিলো।ইফতি এইবার হাসি মুখে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ কি ভাই?টাকা বের করো! এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো হবে না!’
জায়ান ভ্রু উচিঁয়ে বলে, ‘ টাকা দিবো কেন?আমার রুমে আমি যাবো টাকা কেন দিবো?’
‘ কারন আজ তোমার রুমে স্পেশাল একজন আছে।আর তার কাছে যেতে হলে এন্ট্রি ফি লাগবে।’
জায়ান তপ্ত শ্বাস ফেললো।অহেতুক এদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।সে এমনিতেও জানতো এমন কিছু হবে।তাই বিনা বাক্যে নিজের কার্ডটা বের করে ইফতিকে দিয়ে দিলো।বললো, ‘ ক্যাশ নেই আমার কাছে।তাই কার্ড দিলাম।কিন্তু সাবধান ফিফটি’র উপরে একটা পয়সা বেশি খরচ করলে আমি তোর থেকে তার ডাবল আদায় করবো।মানে পঞ্চাশ হাজারের ডাবল এক লক্ষ টাকা।বুঝেছিস?সো বি কেয়ারফুল।এখন সর সামনে থেকে দুটোই।’
ইফতি আর নূর মনের সুখে কার্ড নিয়ে চলে গেলো।
______________
আরাবী ঠায় শক্ত হয়ে বসে আছে বারান্দার বিছানায়।ও অনেক আগেই জায়ানের গলার আওয়াজ পেয়ে এখানে এসে বসে রয়েছে।কেমন যেন লাগছে।অন্যরকম একটা অনুভূতি। দমবন্ধকর পরিবেশ। এলোমেলো লাগছে নিজেকে।ভয়,লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে সে।
এদিকে রুমে প্রবেশ করে জায়ান অবাক হলো বেশ।পরক্ষণে ভাই বোনের পাগলামি দেখে হালকা হাসলো। রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে কাঙ্খিত ব্যাক্তিটিকে না দেখতে পেরে কপাল কুচঁকালো।হঠাৎ বারান্দার দরজার দিকে তাকাতেই লাল কাপড়ের কিছু অংশ দৃষ্যমান হলো জায়ানের।সাথে সাথে হাসলো।মেয়েটা লজ্জায় এইভাবে বারান্দায় গিয়ে বসে আছে।নিস্তব্ধে সেদিকে এগিয়ে গেলো জায়ান।
আরাবী হাতদুটো কচলাচ্ছে।দৃষ্টি নত করা।হঠাৎ নিজের সম্মুখে কারো অস্থিত্ব অনুভব করতে পেরে। গলা শুকিয়ে গেলো।এটা যে জায়ান সে খুব ভালো করে জানে আরাবী।তবে সাহস হলো না একবার লোকটাকে দেখার। কেটে গেলো অনেকক্ষণ।আশ্চর্য লোকটা কিছু করছে না কেন?নড়ছেও না কিছু বলছেও নাহ। আরাবী আর অপেক্ষা করলো না।ধীরে ধীরে আঁখিপল্লবজোড়া উপরের দিকে উঠিয়ে তাকালো।তাকাতেই দৃষ্টি নীবদ্ধ হলো জায়ানের পানে।লোকটা কেমন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।অন্যরকম একদৃষ্টিতে একধ্যানে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।সেই দৃষ্টিতে আরাবী দেখতে পারছে একরাশ মুগ্ধতা,কাউকে আকুলভাবে কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা আর সবচেয়ে বড় সেটা হলো একসমুদ্র ভালোবাসা। লজ্জায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরলো আরাবীর মুখশ্রীতে। হালকা আওয়াজে বললো, ‘ আসসালামু আলাইকুম! ‘
জায়ান কেমন যেন চমকে উঠলো আরাবীর কথায়।এতোক্ষন সে তো ছিলো ধ্যানমগ্ন হয়ে পরেছিলো ওর কাঠগোলাপের পানে।লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়িতে তার কাঠগোলাপকে এক অনন্য রূপসী লাগছিলো। সে কি চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য মেয়েটার।রূপ যেন সারা অঙ্গ চুইয়ে চুইয়ে পরছে।
জায়ান দুকদম এগিয়ে গেলো আরাবীর আরো কাছে। বললো, ‘ ওয়া আলাইকুম আসসালাম! এখানে কি করছো?আমি তোমাকে খুঁজেছিলাম।’
আরাবী কিছুই বললো না আমতা আমতা করতে লাগলো। জায়ান কাল বিলম্ব না করে হাত গলিয়ে দিলো আরাবীর কোমড়ে। কাঙ্খিত ব্যাক্তির হিমশীতল হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো আরাবী। শিরশির করে উঠলো পায়ের তলা।নখ ডাবিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালালো ফ্লোরে।চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো। হঠাৎ নিজের চোখের সেই বদ্ধ চোখের পাতায় নরম কিছুর আদুরে স্পর্শ পেলো।আরাবী যে লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে নিজেই আরেকটু গুটিয়ে গেলো জায়ানের কাছে। সরে আসলো জায়ান। পরমুহূর্তেই পিটপিট করে চোখ খুলে আরাবী। জায়ান আরাবীর সেই রক্তিম মুখশ্রীর দিক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো।আড়ষ্ট কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ এ কোন বিধ্বংসী রূপে নিজেকে সাঁজিয়েছো আরাবী।তোমার এই ধ্বংসাত্মক সৌন্দর্য যে আমার সর্বনাষ করে দিচ্ছে।আ..আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আরাবী।নিজেকে সামলানো বড্ড কঠিন হয়ে পরছে।’
আরাবীর জবাব নেই।কিইবা জবাব দিবে ও? লজ্জায় কথাগুলো কন্ঠনালিতে এসে আটকে আছে।জায়ান আরাবীর হাতটা আলতো করে ধরে নিজের বুকের বা-পাশে রাখলো। ঘোর লাগা কন্ঠে বললো, ‘ অনুভব করছো আরাবী?বুঝতে পারছো আমি কতোটা ডেস্পারেট হয়ে আছি?আমার ভীতরে যে অনুভূতির ঝড় হচ্ছে অনুভব করছো?’
আরাবী সাথে সাথে জায়ানের বুকে নিজেকে সপে দিলো। লম্বা,চওড়া পিঠটা নরম হাতের দ্বারা আকঁড়ে ধরলো।জায়ান নিজেও ওর বলিষ্ট হাতজোড়া দিয়ে আগলে নিজের স্ত্রীকে।মুখ নামিয়ে চুমু খেলোআরাবীর কানের পাতায় ।কেঁপে উঠলো আরাবী।খামছে ধরলো প্রিয় মানুষটার পিঠ।জায়ান হাত বাড়িয়ে মাথার ওড়নাটা ফেলে দিলো।একটানে লম্বা,দীঘলকালো কেশের খোপাটা খুলে দিলো।ঝরঝর করে একগোছা চুল ছড়িয়ে পরলো আরাবীর সারা পিঠময়।জায়ান মুখ গুজলো আরাবীর ঘাড়ের মাঝে।চুলের ঘ্রাণ টেনে নিচ্ছে নিজের নাসিকারন্দ্রের মাধ্যমে।জায়ান থেমে থেমে বলে উঠলো, ‘ তুমি অসুস্থ আরাবী।আমি জানি।কিন্তু আমার মনকে আমি দমাতে পারছি না।অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছি না।সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি নিজেকে।আমি কি করবো আরাবী? এ কি করলে তুমি আমার।কেন নিজেকে এমন রূপে সাঁজালে?’
আরাবী বুঝলো লোকটা অনেক ডেস্পারেট হয়ে আছে তার জন্যে।এও বুঝতে পারছে যে লোকটা ওকে চাইছে।এখনি,একমুহূর্তেই নিজের করে চাইছে।আরাবী নিজেও চায়।খুন করে চায়।আজ নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায় লোকটার কাছে। আপন করে নিতে চায় লোকটাকে।আজ দুজন দুজনকে ভালোবাসবে সবটা উজাড় করে তা চায় আরাবী। আরাবী এইবার হাত উচিঁয়ে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো দুহাতে।আরাবীর চোখের কোণে অশ্রুরা ভীড় জমিয়েছে।ধরা গলায় বলে উঠলো আরাবী, ‘ আমি তো আপনারই।তবে দুরুত্ব কিসের? আমরা এখন স্বামি স্ত্রী। আমি চাই আপনি আমায় ভালোবাসুক।আদির স্পর্শ আমাকে যতোটা কষ্ট দিয়েছে।আপনার স্পর্শ দিয়ে আমাকে তার থেকে বেশি ভালোবাসুক।আপনার পবিত্র স্পর্শ দিয়ে আদির পাপিষ্ট স্পর্শগুলো মুছে দিন।ভুলিয়ে দিন আমাকে আজকের এই জঘন্য ঘটনা।’
সাথে সাথে তপ্ত অশ্রুগুলো গাল গড়িয়ে পরলো আরাবীর। আচমকা জায়ান আরাবীকে কোলে তুলে ফেলে।আরাবী দুহাতে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরে জায়ানকে।জায়ান মুখ নামিয়ে ঠোঁট ছাপ বসায় ওই সিক্তচোখে।জায়ান সরে আসতেই আরাবী মাথা ঠেকায় জায়ানের বুকে।জায়ান আরাবীকে নিয়ে রুমে এসে ফুলে ভরা বিছানায় আলতো করে সুইয়ে দেই। মোহময় চোখে আরাবীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাত লাগায় পাঞ্জাবির বোতামে।পাঞ্জাবি খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় অদূরে।গায়ের গেঞ্জিটাও রাখলো না। খানিক বাদেই নিজের বলিষ্ট দেহটার ভড় ছেড়ে দেয় আরাবীর নরম দেহের উপর। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো আরাবী। জায়ান চুমু গেলো আরাবীর কপালে।অত্যন্ত আদরে।আবেশে চোখ বন্ধ করলো আরাবী। জায়ান ঠোঁটের স্পর্শ দিলো রক্তিম গালে, লাল হয়ে নাকে নোসপিনটার উপরে,চিবুকে।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে আরাবী।জায়ানের স্পর্শে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আরাবী।জায়ান আরাবীর কানে কানে বললো, ‘ দোষ তোমার কোন্ট্রোললেস তুমি আমায় করে দিলে।এখন আর চাইলেও আমি নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারবো না।’
একটু থামলো জায়ান ফের আদুরে স্বরে বুলি আওড়ালো, ‘বৃষ্টি যেভাবে কাঠগোলাপকে ছুঁয়ে দেয়। আমিও তোমাকে সেভাবেই কাছে টেনে নেব আরাবী।আজ আদুরে স্পর্শে প্রতিটা অঙ্গ ছুঁইয়ে দিবো আমি।’
আরাবী মুখে কিছু বললো না তবে মনে মনে ভাবলো, আমি নিজেই তো চাইছি আপনাকে।দমিয়ে রাখবো কেন?
আরাবী চোখ মেলে জায়ানের দিকে তাকালো।ওই নিভু নিভু চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে সাথে সাথে আরাবীর অধরে অধর মিলিয়ে দিলো জায়ান।কেঁপে উঠে জায়ানকে খামছে ধরলো আরাবী। উন্মাদ হলো জায়ান।গাঢ় আদরে ভড়িয়ে দিলো আরাবীকে।আরাবীও আজ নিজের সর্বষ বিলিয়ে দিলো স্বামির কাছে।আর ওদের এই উজাড় করা ভালোবাসার সাক্ষি হয়ে রইলো এক বৃষিস্নাত প্রকৃতি।আর সেই বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা কাঠগোপাপ গাছটি সাথে গাছে ফুটে উঠা নিদারুণ সৌন্দর্যের অধিকারি #বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ টি।
#চলবে_________
#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৬
জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের মিষ্টি রোদ রুমে প্রবেশ করছে।আলোকিত করছে পুরো রুম।কাল গোটা রাতটা যেমন বৃষ্টিময় ছিলো।সকালটা তেমনই স্নিগ্ধ। নির্মল বাতাসে রুমের পর্দাগুলো দুলছে।সতেজ ভাব তার মধ্যে।দীর্ঘ রাতের পর এ যেন এক প্রেমময়ী স্নিগ্ধ সকাল।কিচির মিচির পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে।বাগানের ওইপাশটায় একটা বড় আম গাছ আছে সেখান থেকেই ভেসে আসছে এই মিষ্টি পাখিদের গান।সেই গানের ধ্বনিগুলো কানে প্রবেশ করতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় আরাবী। হাত দুটো উপরে উঠিয়ে আড়মোড়া দিয়ে।হা করে হাই তুলে ও।ঘুমের রেশ কাটাতে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখা মিলে হৃদয়ের গহীনে থাকা প্রেমিকপুরুষটির। জায়ান একধ্যানে তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা।জায়ানের ওই চোখের দিকে আরাবী নির্দ্বিধায় তাকিয়ে থাকলে জায়ান দুষ্টু হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরে।জায়ানকে এমন করতে দেখে ভড়কে যায় আরাবী।হঠাৎ কাল রাতের সেই ভালোবাসাময় মুহূর্তগুলো একে একে স্মরনে আসতেই লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে যায় আরাবী।শরীরের লোমকূপ শুদ্ধ দাঁড়িয়ে যায় ওর।দ্রুত লজ্জা থেকে নিজেকে বাচাতে গায়ের কম্বলটা ভালোভাবে টেনে নিয়ে পুরো নিজেকে আপাত মস্তক ঢেকে দেয় আরাবী।সাথে সাথে কানে ভেসে আসলো জায়ানের হালকা হাসির শব্দ।এই প্রথম লোকটাকে এমন হাসির শব্দ পেলো আরাবী।ইচ্ছে করলো একটু দেখতে যে লোকটা এইভাবে হাসলে কেমন লাগে দেখতে।তবে লজ্জায় সেই সাহস আর করলো না।হঠাৎ কম্বলে হেচঁকা টান অনুভব করতেই সেটা শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করলো আরাবী।কিন্তু ব্যর্থ হলো ও।জায়ান সরিয়ে দিয়েছে কম্বল।আরাবী লজ্জায় কি করবে দিশা পাচ্ছে না।জায়ান মুচঁকি হেসে বলে, ‘ এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?আমিই তো! আর এইভাবে নিজেকে আপাত মস্তক ঢেকে রেখে লাভ কি? আমিতো সব দেখেই নিয়েছি। অবশ্য তুমি চাইলে এই দিনের আলোতে আবারও দেখে….’
জায়ানকে আর বলতে না দিয়ে আরাবী জায়ানের মুখ চেপে ধরে। লজ্জায় হাসফাস করতে করতে বললো, ‘ অসভ্য আপনি।চরম অসভ্য!’
জায়ানের মুখে আরাবী যেই হাতটা দিয়েছিলো।সেই হাতটা ধরে জায়ান সেই হাতের তালুতে চুমু দেয়।শিরশির করে উঠে সেই জায়গায়টায় আরাবীর।হাত সরিয়ে নিতে চাইলেও সরালো না আর। থাক না লোকটার হাতে বন্ধি ও।ও চাই লোকটার যেন সারাজীবন ওকে তার বক্ষপিঞ্জিরায় বন্ধি করে রাখে। জায়ানের দৃষ্টি আরাবীর পুরো মুখমন্ডলে বিচড়ণ করছে।জায়ান ঘোর লাগা কন্ঠে বলে, ‘ তুমি অনেক সুন্দর আরাবী।অনেক সুন্দর।তোমাকে ধন্যবাদ আরাবী।কাল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় রাত ছিলো।’
আরাবী লাজুক হাসলো।জায়ান আরাবীর কপালে চুমু খেলো।আরাবী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।
চুমু খেলো আরাবীর গালে।জায়ান সরে আসতেই আরাবী ওর লাজুক রাঙ্গা মুখ লুকায় জায়ানের বক্ষে।জায়ান ও আরাবীর কোমড় জড়িয়ে ধরে।আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয় আরাবীর।এইভাবেই অতিবাহিত হয়ে যায় অনেকক্ষন।একটু পর জায়ান আরাবীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অপরাধী কন্ঠে বলে, ‘ আমি সরি আরাবী। আমি যদি তোমাকে ইগনোর না করতাম। তোমার সাথে সাথে থাকতাম তাহলে কাল এমন কিছু হতো না।’
আরাবী মস্তিষ্কে টনক নড়ে। তার তো এটা জিজ্ঞেস করতে মনে নেই।কেন জায়ান আরাবীর সাথে এমন করছিলো।যেখানে দোষটা জায়ানেরই। মুহূর্তেই আরাবীর মুখশ্রী শক্ত হয়ে উঠে।তেজি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আমার উত্তর চাই।যেখানে রাগ দেখানোর কথা ছিলো আমার।সেখানে আপনি কেন আমার সাথে এমন করলেন?’
জায়ানের মুখ অবয়ব মুহূর্তেই বদলে যায়।গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘ সেদিন আমার হাতে এলকোহলের বোতল দেখেছিলে তুমি।সেই কারনে আমাকে কতোগুলো কথা বললে।তুমি কিভাবে বিশ্বাস করলে আমি মদ খাই? তুমি এইভাবে বলায় আমি তাই ত্যাড়ামি করি তোমার সাথে।কিন্তু তুমি কি অনায়াসে বললে মদ না ছাড়লে তোমাকে ছেড়ে দিতে। সত্য মিথ্যা যাচাই না করে তুমি এই কথা কিভাবে বললে?তাই এই কারনে আমার তোমার প্রতি রাগ হয়।এইজন্যে আমি তোমার সাথে কোন কথা বলিনি।’
আরাবী খানিক নুইয়ে গেলো।তবে দমলো না প্রশ্ন করলো, ‘ তবে ওই মদের বোতল আপনার কাছে কিভাবে এলো? যদি আপনি ড্রিংক না করেন।’
জায়ান থমথমে কন্ঠে বলে, ‘ এই রুমে একদিন ইফতি ওর ফ্রেন্ড্সদের নিয়ে পার্টি করেছিলো।আমি তখন বিডিতে ছিলাম না।বিজন্যাসের কাজে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম। ওই গাধায় তো জানে না আমি কোথাও গেলে আমার রুমে সি সি ক্যামেরা লাগিয়ে রাখি।তার ওর এইসব কির্তীকালাপ আমি অনায়াসে জেনে যাই।দেশে এসে এই কারনে সেদিন ওকে মেরেছিলাম।ওরা মদ পাণ করেছিলো।যদিও সেগুলো ওতোটা নেশালো ছিলো না।৪০% এলকোহল ছিলো।তাও আমি ওকে মেরেছিলাম।এরপর থেকে আর ও এমন করেনি ওর ওই বন্ধুদেরও সঙ্গ ছেড়ে দেয়।সেই থেকে আমি আর কাউকে আমার রুমে আসতে দেইনি। মানে কাউকেই না শুধু মা আসতো।তবুও আমি বাসায় থাকলে।তো সেদিন আমি পুরনো ফাইলগুলো ঘাটাঘাটি করছিলাম।সেই ফাইলগুলো ছিলো বড় কয়েকটা ব্যাগের মাঝে।আলমারির নিচের তাকে।আমি সবগুলো ব্যাগ চেক করছিলাম।সেখানের একটা ব্যাগেই আমি ওই মদের বোতল পাই।ইফতিরা বোধহয় লুকিয়ে রেখেছিলো পরে খাবে বলে।আমি ওটা পেয়ে ওটাকে বারান্দার ডাস্টবিনে রাখার জন্যে গিয়েছিলাম। আর তখনি তুমি বারান্দায় আসো।আর আমার হাতে মদের বোতল দেখে উল্টাপাল্টা ভেবে বসো।’
জায়ানের সম্পূর্ণ কথা শুনে অনুশোচনায় আরাবী মাথা নিচু করে নেয়।আসলেই ও বড্ড ভুল করে ফেলেছে।আগে জায়ানকে একবার ভালোভাবে জিজ্ঞেস করার দরকার ছিলো।আরাবী ধরা গলায় বলে, ‘ আমি দুঃখিত আপনাকে এতোটা হার্ট করার জন্যে।আসলে মদকে আমি প্রচুর ঘৃনা করি।তাই সেদিন আপনার হাতে মদের বোতল দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো না।তাই আপনাকে উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছিলাম।আমি অনেক সরি।’
জায়ান আরাবী চিবুক ধরে ওকে নিজের মুখোমুখি করলো।সাথে সাথে আরাবীর চোখের কোন ঘেসে গড়িয়ে পরলো একফোটা জল।জায়ান বেশ শক্ত হাতেই আরাবীর চোখের জল মুছে দেয়।তারপর একমুহূর্ত ব্যয় না করে আরাবীর অধরজোড়া নিজ আয়ত্বে নিজের অধরের ভাজে নিয়ে নেয়।আরাবীর কেঁপে উঠে একহাতে জায়ানের চুল খামছে ধরে।আরেকহাতে জায়ানের ঘার।দাড়ালো নখগুলো দাবিয়ে দেয় জায়ানের ঘারে।কিছুক্ষন পর সরে আসে জায়ান।আরাবী জোড়েজোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে।আরেকটু হলেই দমটা আটকে যেতো।হঠাৎ জায়ানের তীব্র আক্রোশভরা কন্ঠ শোনা গেলে।সেদিকে তাকায় জায়ান, ‘ শুধু শুধু আর কখনো কাঁদবে না।যদি কাঁদতে দেখি তাহলে ঠিক এইভাবেই দম আটকে মেরে ফেলবো।’
আরাবী জায়ানের এমন কথায় মুখ গুমড়া করে ফেললো।কিন্তু গালগুলো লজ্জায় টুকটুকে হতে ভুললো না।এমন সময় পাশের টি-টেবিলে রাখা এলার্ম ক্লকটা সশব্দে বেজে উঠলো।আরাবীর চমকে গেলো।তাকিয়ে দেখলো ঘড়িতে এখন সকাল নয়টা বাজে।তারই এলার্ম বাজছে।চোখ বড় বড় হয়ে যায় আরাবীর।সাথে হালকা আওয়াজে চেঁচালো, ‘ আল্লাহ! এতো দেরি হলো কিভাবে?কতো সকাল হয়ে গিয়েছে।আর আমি এখনো বিছানায় সুয়ে।সবাই কি ভাব্বে?আজ বিয়ের পরে প্রথম দিন আর আমি কিনা এতো দেরিতে উঠলাম।’
জায়ান আরাবীকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আরাবী তাকাতেই জায়ান ভ্রু-কুচকে বলে, ‘ লিসেন ওতো আদর্শবান হওয়া লাগবে না।তুমি বিয়ের আগে যেমন ছিলে ঠিক তেমনভাবেই থাকবে। বুঝলে?’
‘ কিন্তু!’ আরাবীকে বলতে না দিয়ে জায়ান হালকা ধমকে বললো, ‘ কোন কিন্তু না আমি যা বলবো তাই।’
আরাবী জায়ানের ধমক খেয়ে মিনমিনে গলায় বললো, ‘ আচ্ছা,বুঝলাম।কিন্তু এখন তো উঠতে দিবেন?’
জায়ান আর কথা বাড়ালোনা।ছেড়ে দিলে আরাবীকে।বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো।আরাবীও উঠতে নিলে পেটে হালকা ব্যাথা অনুভব করে মুখ কুচকে ফেললো।তা দেখে জায়ান আবারও দ্রুত পায়ে ওর কাছে এসে বললো, ‘ কি হয়েছে?’
আরাবী ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে, ‘ পেটে হালকা ব্যাথা করছে।’
জায়ানকে চিন্তিত দেখালো।বললো, ‘ আমি এইজন্যেই তোমাকে না করেছিলাম।কিন্তু তুমি নিজেই আমায় অনুমতি…!’
জায়ানকে থামিয়ে দিলো আরাবী, ‘ উফ! চুপ করুন তো।ও কিছু না।আমি ঠিক আছি।’
আরাবী আবারও বিছানা থেকে নামার জন্যে উদ্যত হতেই জায়ান জায়ান আরাবীকে কোলে তুলে নেয়।আরাবী হকচকিয়ে গিয়ে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ আরে কি করছেন?আমি যেতে পারবো তো!’
জায়ান আরাবীর কোন কথার জবাব দিলো না।চুপচাপ আরাবীকে ওয়াশরুমে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো রুমে। একটু পর আবার ফিরে আসে।হাতে আরাবীর জামাকাপড়।ক্লথ হ্যাংগারে সেগুলো রেখে দিয়ে জায়ান গম্ভীর গলায় বলে, ‘ তুমি কি পারো না পারো সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না বুঝলে?এখন জলদি গোসল করে নেও।গরম পানি দিয়ে করিও।আমি বাহিরেই আছি।’
জায়ান চলে যেতেই আরাবী ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিয়ে মুচঁকি হাসলো।এই গম্ভীর, একরোখা,জেদি লোকটা যে এইভাবে ওকে এমন ভালোবেসে ফেলবে ভাবতেই পারিনি। আরাবী হালকা হেসে বলে উঠে, ‘ পাগল একটা!’
#চলবে_________
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।