বেটারহাফ পর্ব-০৫

0
2055

#বেটারহাফ
writer:#Nishat_Tasnim_Nishi
পর্ব_৫

জীবনের তেইশ বসন্ত পেরিয়ে রাত্রি এসেছিলো তার জীবনে। বসন্তের রঙ্গিন ফুল আর তাজা হাওয়ার মতো আসেনি তার জীবন রঙ্গিন করত! এসেছিলো কালবৈশাখী ঝড়ের মতো,তার জীবন এলোমেলো করতে।

ব্যালকনিতে বসে অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে সে ইতোমধ্যে এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। আজ আর তার ঘুম হবে না, কাটিয়ে দিলো সিগারেটের সাথে রাত।

৮.
জ্বরের ঘোরে কাঁপছে রাত্রি। তার পাশেই শুয়ে আছেন শাহিনুর বেগম। না চাইতে উঠে রাত্রিকে জলপট্টি দিতে লাগলেন। রাত্রি ঘুমের ঘোরে মা বলে কেঁদে উঠলো। শাহিনুর বেগম স্পষ্ট শুনলেন সে কন্ঠ। তবুও তিনি কোনো রিয়েক্ট করলেন না। রাত্রিকে শুইয়ে দিয়ে অপরপাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। রাত্রির চেহারা ও তিনি দেখেন না। এই চেহারা দেখলেই তার পুরানো ক্ষত তাজা হয়ে উঠে।

কি মাসুম চেহারা। দেখলেই মায়া চলে আসে। শাহিনুর বেগমের একফোঁটাও মায়া আসে না। তিনি এ চেহারার মায়ায় একবার পড়েছিলেন। যার শাস্তি আজীবন পেয়ে যাচ্ছেন। মেয়েটা দেখতে হুবহু তার বাবার মতো। চরিত্র রাও কি তেমন? কই এত দিনেও তো তার মনে হয় নি। তবুও কেনো তিনি মানতে পারেন না? কেনো রাত্রিকে কষ্ট দিলে তিনি আনন্দিত হন?

রাত্রির গায়ে কাঁথা টা টেনে দিয়ে উঠলেন তিনি। সিন্দুক খুলে সব জামাকাপড়ের নিচ থেকে পুরানো আলব্যাম বের করলেন। ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি উচ্চ সুরে হাসলেন,হেসে বললেন–” আমার সামান্য ত্রুটির জন্য কত অপমান করেছিলে? আর আজ দেখো তোমার মেয়ে সবার কাছে বারবার অপমানিত হচ্ছে। ”

এক হাতে আয়না নিয়ে মুখের সামনে এনে বাম চোখে হাত বুলালেন। তার এই টেরা চোখের জন্য সে একদিন কত অপমানিত হয়েছিলো। আজ আবার মনে পড়তেই চোখ দুটো জ্বলে ভিজে উঠলো। তিনি চোখের জল মুছে ফেললেন আজ আর কাঁদবেন না। আজ তার খুশির দিন, তিনি প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন।
গুন গুন করে গেয়ে উঠলেন,

ভেজা ভেজা স্বপ্ন গুলো আধো ঘুমোঘোর
দক্ষিণ হাওয়া ঢাকছে গায়ে মেঘের চাদর ।
বৃষ্টি ফোঁটা মিষ্টি সুরে ঝরলে অবিরাম
স্বপ্ন চোখে তোমায় ঘিরে ভিজবো অবিশ্রাম ।
ভেজা ঘাসে বাজিয়ো নুপুর রিনিঝিনি ঝুম
জুড়িয়ে আসুক বৃষ্টি ভেজা স্বপ্নমাখা ঘুম ।।
(চন্দ্রগুপ্ত)

৯.
সেদিনের পর দিন দুয়েক কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে বহু জিনিস পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। সাগর শব্দবিহীন ভাবে বৃষ্টিকে সাহায্য করেছে। ওর ঔষধ,খাওয়া দাওয়া সবকিছুই নিজ হাতে করেছে। বিনিময়ে বৃষ্টির চোখে একরাশ ঘৃণা আর ভয় দেখেছে। এ নিয়ে সে কোনো অভিযোগ করে নি, চুপচাপ নিজের মতো কাজ করেছে। সে বারবার চেষ্টা করছে বৃষ্টির সাথে মিশতে। কিন্তু বৃষ্টি ততই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। সে ভেবে পাচ্ছে না কীভাবে বৃষ্টির সাথে সম্পর্কটা এগুবে সে?

অন্যদিকে রাত্রিকে দেখতে না পেয়ে তার অবস্থা খারাপ হয়ে আছে। চোখ দুটো ভীষণ ছটফট করছে রাত্রিকে দেখার জন্য। বহু চেষ্টা করেও দু দন্ডের জন্যেও তাকে দেখতে পায় নি। তার সবসময় চিন্তা হয় রাত্রির জন্য, মেয়েটার খুব বড় একটা সমস্যা। কিছু হলেই সুইসাইডের চেষ্টা করবে। মাঝে মাঝে এজন্য তার প্রচুর রাগ হয় রাত্রির প্রতি।

রাত্রি বিহীন খাবার টেবিলে বসে আছে পুরো পরিবার। সবাই নিজের মতো খাচ্ছে। কারো কোনে মাথা ব্যাথা নেই এ নিয়ে। কিন্তু একজনের এ নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে। সে হলো সাগর। সে রাত্রির কথা জিজ্ঞেস করতেই ফিহা ফট করে বলে উঠলো,–” ছোট আম্মু কিচেনে বসে খাচ্ছে।”

ব্যাস! সাগরের আর খাওয়া হলো না, সে চুপচাপ না খেয়ে উঠে গেলো। বাকিরা একপলক তাকিয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এ বাড়ীর কেউ সাগর আর শাহিনুর বেগমের বিষয়ে কথা বলেন না। এটাই নিয়ম। সাগরের বিষয় শাহিনুর বেগম ছাড়া কারো অধিকার নেই কথা বলার। যে যার মতো খেয়ে কাজে চলে যেতে লাগলো।
শফিক সাহেব বেঁচে থাকতে তিনিও কখনো সাগরের ব্যাপারে কথা বলে নি। সাগরের সবকিছুতে শাহিনুর বেগমের অধিকার সবচেয়ে বেশি। সব ছেলে মেয়ে এমনকি ছোট মেয়ে শিফার থেকেও সাগরের উপর আলাদা টান শাহিনুর বেগমের। এর পিছনেও কারণ রয়েছে।

১০.
তিক্ত মেজাজ নিয়ে ইজি চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে সাগর। ইদানীং সিগারেট ছাড়া তার আর কিছুই ভালো লাগে না। নারী নামক বস্তু টি তার জীবনে প্রবেশ করার পরেই আগমন ঘটে এই নেশার। জীবন টা ছারখার হয়ে গিয়েছে তার। না পারছে মরতে আর না পারছে শান্তিতে বাস করতে। সবকিছু গলায় ঝট পাকিয়ে আটকে আছে। সে গিলতেও পারছে না ফেলতেও পারছে না। মায়ের জেদের জন্য তার জীবনে দু দুটো নারী আটকে আছে। কাকে ছাড়বে আর কাকে ধরবে সে ভেবে কূল পায় না! তার লাইফ ই কেনো এমন? কোন জন্মের পাপের শাস্তি পাচ্ছে সে?

এমন সময় চা নিয়ে আসে বৃষ্টি। থরথর করে কাঁপছে তার হাত। সাগর বুঝলো বৃষ্টি নিজ থেকে নিয়ে আসে নি তার মা পাঠিয়েছে। সে পাশের চেয়ার টা পা দিয়ে ঠেলে বৃষ্টির সামনে দিয়ে বললো,–“বসো।”

বৃষ্টি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,–“চ্ চা চা টা নিন।”

সাগর মাথা নাড়িয়ে বললো,–“রাখো টেবিলে। আর বসো এখানে।”

বৃষ্টি ভয়ে ভয়ে বসলো। সে প্রচন্ড ভয় পায় সাগরকে। ভাবীদের কাছে সাগরের রাগের ব্যাপারে শুনেছে। কিন্তু সেদিন সে নিজে সাক্ষী হয়ে গিয়েছে। একদিনের মার খেয়েই তার জ্বর উঠে গিয়েছে। সে খুব ভয় সাগরকে,তার মুখের উপর কোনো কথাই বলে না সে। সে ভাবে যত কম কথা তত তার জন্যই মঙ্গল।

সে ভয়ে চোখ মেলেও তাকাচ্ছে না সাগরের দিকে। বসে বসে দুই হাত কচলাচ্ছে। সাগর বুঝলো বৃষ্টি কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না।

সাগর ভাবছে, কী এমন বলবে যার জন্য বৃষ্টি এত ভয় পাচ্ছে? মা কী বলতে বলেছে ওকে?

সে নরম গলায় ডাক দিলো, –“বৃষ্টি।”

বৃষ্টি অন্য মনষ্ক হয়ে ভাবতেছিলো, সাগরের ডাকে তার হুশ ফিরে। সে সাথে সাথে হু হু করতে লাগলো।

–“তুমি কি কিছু বলবে?”

বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বললো যে হ্যা সে বলবে।

সাগর অভয় দিয়ে বললো,–“তোমাকে বলতে হবে না আমি বুঝেছি কী বলবে।”

বৃষ্টি অবাকের সুরে বললো,–“কী বুঝেছেন?”

–“মা, তোমাকে বাচ্চা বিষয় বলতে বলেছে তাই তো?”

বৃষ্টি দ্রুত গাড় হেলিয়ে বললো,–” না,না।”

সাগর ভ্রু কুচকে তাকালো বৃস্টির দিকে। সোজা হয়ে বসে ওর দিকে তাকালো। ইশারায় তাকে জিজ্ঞেস করলো তাহলে কী?

.
চলবে?