বেটারহাফ পর্ব-১৫

0
2092

#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি
| পর্ব ১৫ |

শাহিনুর বেগম চেয়ে আছেন তার যাওয়ার দিকে। মেয়েটা এত ভালো কেনো? তিনি কত খারাপ বিহেভ করেছেন তার পরেও সে এতটা স্বাভাবিক ব্যবহার কীভাবে করে! বিশেষ করে উনার সাথে, যেনো তিনি তার সত্যিকার অর্থে মা। ইদানীং রাত্রির সাথে উনার ব্যবহার একদম স্বাভাবিক। আগে যেমন বিদ্বেষ কাজ করতো তার প্রতি এখন আর তেমন করে না। শিফাকে রাতদিন মানসিক-শারীরিক উভয় ভাবে সাহায্য করে সে। উনার মনে হয় রাত্রি পরিবর্তন হয়ে গেছে,অনেক পরিবর্তন। যার জন্য হয়তো তাকে পঁচতাতে হবে।

স্কুলে পৌঁছেই রাত্রি হাঁপাতে লাগলো।
দশটায় আসবেন পরিদর্শক। আর এখন বাজে নয় টা আট। সে দ্রুত যেতে লাগলো টিউবওয়েল এর দিকে। টিউবওয়েলের দুকদম দূরে থাকতেই তার সামনে ক্লাস ফাইভের দুজন বাচ্চা চলে আসে পানি নিয়ে। সে একটু হাসি দিয়ে পানি টা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। বাচ্চা দুটোর মাথাভর্তি চুলগুলো আলতে হাতে স্পর্শ করে হাসিমুখে তাদের বিদায় দিয়ে অফিসের দিকে চলে গেলো।
আজ পুরো স্কুল একদম পরিষ্কার। কোথাও কোনো আবর্জনা নেই। রাত্রি হাঁটছে আর চারপাশ পরিক্ষা করছে। অফিসে গিয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো সে। সে ছাড়া আরো চার জন মহিলা শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন ওর বয়সী, শিমলা আর চৈতী। বাকি দুজন একটু বয়স্ক, উনাদের বাচ্চা রা কলেজে পড়ে।
শিমলা ম্যাম বিবাহিত, উনার বিয়ের ছমাস চলছে। আর চৈতী, এখনও বিয়ে করে নি। হেডস্যার বাদে পুরুষ টিচার তিনজন। তিনজনের তিনজনই বিবাহিত। উনাদের বয়স চল্লিশের কৌটা পেরিয়ে গিয়েছে।
রাত্রি স্কুলে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন করেছে, এখনও ও পার্মানেন্ট হয় নি। তাই সে সব টিচার কে অনেক সম্মান করে। টিচার রা প্রায় সবাই ওর প্রতি মুগ্ধ। তবে তার সফলতা দু-তিন জনের হিংসার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তার দুটো কারণ।
এক. সব স্টুডেন্টের কাছে সে প্রিয় টিচার এবং প্রায় চারপাশে ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
দুই. টিউশনি। সব স্যার থেকে বাচ্চারা আস্তে আস্তে সরে ওর কাছে পড়তে চাইছে।
এজন্য কারো সফলতা শুনতে নেই। মনের মধ্যে আপনাআপনি ইর্ষা আর কূট বুদ্ধি চলে আসে।

সবাই আলাপ-আলোচনা করছিলো এমন সময় দরজায় টোকা নাড়ে অল্প বয়সী এক যুবক। ধবধবে সাদা গায়ের রং। বাদামী রং এর ঈগলের মতো চোখ দুটো। গায়ের কালো শার্ট টা যেনো তার শরীরের রং টা আরো ফুটিয়ে তুলেছে। হাতের কুৎসিত ব্ল্যাক ওয়াচ টার সৌন্দর্য ও ফুটে ওঠলো সাদা চামড়ার ফলে।
হাসলে হয়তো তার সৌন্দর্য আরো তিনগুন হবে, কিন্তু সে গম্ভীর মুখ করে দাড়িয়ে আছে। ফর্মাল গেট আপ, দেখে মনে হচ্ছে অফিসে যাচ্ছে না হয় অফিস থেকে আসছে।
রাত্রি ছাড়া সবাই তার দিকে তাকালো। প্রিন্সিপ্যাল বললেন,–“জ্বি, আসতে পারেন।”

সে ডুকেই হালকা কেশে উঠলো কারণ সবাই এখনো ওর দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। কাশির শব্দে চৈতী আর শিমলা ম্যামের হুশ ফিরে আসলো। উনারা মাথা নিচু করে কাজ করতে লাগলেন।

প্রিন্সিপ্যাল সহজ ভাষায় বলেন,–” জ্বি, কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”

ছেলেটা বলে উঠে,–“আসলে আব্বু আমাকে,,”

বলেই থেমে যায় ছেলেটা। এরপর কথা টা ঘুরিয়ে বলে,—” আসলে এই স্কুলে আমি একজন স্টুডেন্ট এডমিট করাতে চাই।”

অতি চমৎকার কন্ঠ শুনে রাত্রি চোখ তুলে তাকায়। সে কাগজে সিগনেচার করছিলো কিন্তু এত মধুর কন্ঠ শুনে না তাকিয়ে থাকতে পারলো না। এতকাল শুনেছে মেয়েদের কন্ঠ কোকিলের মতো হয়, কিন্তু আজ প্রথম কোনো ছেলের কন্ঠ এতটা নেশা ধরানো লাগছিলো।
এক পলক তাকাতেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় ছেলেটার।রাত্রি চোখ নামিয়ে ফেলে।

প্রিন্সিপ্যাল বলে,—“জ্বি। কোন ক্লাসে ভর্তি করাবেন? বয়স কত বাচ্চার?”

–“সাড়ে চার বছর। শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করাবো।”

প্রিন্সিপ্যাল বলে এত ছোট বাচ্চাকে ভর্তি করাবেন না। পাঁচ বছর হলে নিয়ে আসতে। ছেলেটা বলে,–“তাহলে এখন এমনি কয়দিন যাওয়া আসা করুক।”
প্রিন্সিপ্যাল শায় দিলেন। তিনি বলেন কাল থেকেই যেনো দিয়ে যায়। ছেলেটা গম্ভীর গলায় বলে,–” স্যার আমি কি একবার ক্লাস গুলো দেখতে পারি?না মানে সবকিছু কেমন সেটা দেখতে আর কি। ”

তিনি মাথা দুলিয়ে অনুমতি দিয়ে বলেন,–“শিউর। আপনি বরং শিশু শ্রেণির ক্লাস টিচারের সাথে যান। উনি আপনাকে সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিবে। ”

কথা বলেই তিনি রাত্রিকে ইশারা করলেন। রাত্রিও ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে উঠে দাড়ালো। ছেলেটা আড় চোখে ওর দিকে একবার তাকালো, তারপর চুপচাপ ওর সাথে বের হয়ে গেলো।
রাত্রি আগে আগে হাঁটছে আর ছেলেটা পিঁছন পিঁছন। রাত্রি দূর থেকেই ক্লাস টা দেখিয়ে বললো,–“ওটা শিশু ক্লাস!”
ছেলেটা তাকায় বামদিকে। দুজনে সমান তালে হেটে যাচ্ছিলো। রাত্রি রুমে ডুকতে নিচ্ছিলো তখন ছোট বাচ্চা তানহা এগিয়ে এসে রাত্রির শাড়ী ধরে দাড়ায়। দুজনেই তাকায় ওর দিকে। রাত্রি কিছু টা ঝুঁকে বলে,–“কী হয়েছে,তানহা?কিছু লাগবে আম্মু?”
তানহা মাথা নাড়ায়। রাত্রি ওকে কোলে তুলে বলে,–“কী লাগবে তানহা বাবুর?”
তানহা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,–“আমি হিসু করবো। ও আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না।”
রাত্রি সিরিয়াস হয়ে গেলো। এখানের কিছু বাচ্চা এখনো অনেক অবুঝ, তারা পানিটুকুও খেতে পারে না, ধরে খাইয়ে দেওয়া লাগে।
রাত্রি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে,–” এটা শিশু ক্লাস। আপনি দেখুন, আমি একটু ওকে নিয়ে আসছি।”
কথা টা বলে কোনো কিছু শুনার অপেক্ষা না করে রাত্রি তানহাকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে লাগলো।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রাত্রি ফিরে আসে তানহাকে নিয়ে। এসেই ছেলেটাকে বলে,–“সরি, আসলে ওরা এখনো অনেক কিছুই জানে না। কিছু কিছু বাচ্চা মেন্টালি একটু উইক। ”
ছেলেটা কিছু বললো না,গম্ভীর মুখেই দাড়িয়ে রইলো। রাত্রির মনে হলো উনি হয়তো রাগ করেছেন,তাই সে আবারো মিস্টার বলে সম্বোধন করছিলো তখন ছেলেটা গম্ভীর কন্ঠে বলে,–” শাওন। শাওন আমার নাম।”
রাত্রি হালকা হেসে বলে,–“জ্বি। মিস্টার শাওন আপনি এখন সব দেখতে পারেন। এই যে ওরা সবাই নিচের মাদুরে বসে আর আমি,,, ”
পুরো কথা শেষ করার আগেই শাওন বলে,–“আপনি ওই চেয়ারে বসেন।”
রাত্রি কিছু বলতে নিচ্ছিলো তার আগে বাচ্চারা হই হই করে বলে,–“না, না, আম্মু আমাদের সাথে বসে। প্রতিদিন আমাদের কোলে নিয়ে পড়ায়!”
শিশু ক্লাসের সবাই রাত্রিকে আম্মু ডাকে। আর রাত্রি নিজেই ওদের ডাকতে বলেছে।
বাচ্চাদের কথা শুনে ওরা দুজনেই কথা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকায়।
শাওন ভ্রু কুচকে বলে,–“ওরা সবাই আম্মু ডাকছে কেনো?”
বাচ্চা রা বলে,–“কারণ উনি আমাদের আম্মু।”

রাত্রি আর কিছু বললো না। শাওন ঘুরাঘুরি করে সব দেখলো,দু একটা বাচ্চাকে ছড়া আর বর্ণমালা জিজ্ঞেস করলো,সবাই ঠিকঠাক বলতে পারছিলো। রাত্রির মুখে কিছুটা হাসি ফুটে ওঠলো।

শাওন রাত্রিকে বলে বাকি ক্লাসগুলোও দেখে নিলো। বাচ্চারা সবাই খুব চুপচাপ বসে ছিলো। রাত্রিকে দেখেই তাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠলো। সব ক্লাসের স্টুডেন্ট একবার একবার বললো যে ম্যাম আজকে আমাদের ক্লাস নিতে আসবেন প্লিজ।
শাওনের বিষয়টা কেমন যেনো লাগলো। একজন টিচারের সব ক্লাসেই একটা একটা সাবজেক্ট আছে?বাট হোয়াই? গেস্ট টিচারকে সব ক্লাস নিতে কেনো দেওয়া হচ্ছে? তাহলে তো সারাদিনে মাত্র একটা ক্লাস তিনি সময় পান।
শাওন নিজের মনের কথা মনে রেখে প্রিন্সিপ্যালের সাথে আরেকবার দেখা করে চলে গেলো।

★★★
পুরো পথ জার্নি করে মাত্রই বাসায় এসে পৌঁছায় সাগর আর বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে বিকাল নেমেছে। তিনটা-সাড়ে তিনটা বাজে হয়তো। সাগরকে দেখে শাহিনুর সহ সবাই এগিয়ে আসে। মিনিট বিশেকের মতো চলে ফ্যামিলি ফর্মালিটি। শিফার চোখমুখ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে সাগরের কাছে। রাত্রিকে আশেপাশে চোখে পড়লো না, ভাবলো সে হয়তো তার আশার খবর শুনে লুকিয়ে আছে।
সাগর খুব ক্লান্ত, তাই সে ভাবলো পরে রাত্রির সাথে দেখা করবে আগে ফ্রেশ হয়ে আসা যাক।
সাগর আর বৃষ্টি ফ্রেশ হয়ে আসতেই শাহিনুর ওদের গরম ভাত আর গরম তরকারী দিয়ে খাবার দিলেন।
সাগর খাবার টা মুখে দিতেই অন্যরকম স্বাদ পেলো, বুঝলো যে এটা রাত্রি রান্না করে নি। তার মা রান্না করেছে। মনে মনে ভাবলো আজ হঠাৎ মা রান্না করলো কেনো? পরক্ষণেই ভেবে উঠলো হয়তো তার জন্য রেঁধেছে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সাগর সোফায় এসে বসলো, শাহিনুর তো ছেলেকে পেয়ে খুশিতে আটখানা। তাকে এটা সেটা প্রশ্ন করতে লাগলো।

সাগর সব প্রশ্ন এড়িয়ে মাকে বলে,–” মা,শিফাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? মনে হচ্ছে ও খুব অসুস্থ! চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে আছে।”

শাহিনুর চুপ করে গেলেন। কী বলবেন তিনি? এতদিন তিনি ছেলেকে বাড়ীতে ঘটে যাওয়া কোনো কিছুই জানায় নি। ছেলে চলে আসতে চাইবে তাই।
এখন আর কিছু লুকালো না, শিফার সব বলে দিলো। কি কি ওর শশুড়-শাশুড়ি বলেছে সেসব!

সাগরের চোয়াল রাগে লাল হয়ে গেলো। সে রেগে গিয়ে কিছু বলতে নিচ্ছিলো তখন ই দেখে রাত্রি কাঁধে ব্যাগ ঝুঁলিয়ে বাসায় ডুকছে।
সাগর ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালো, এত পরিপাটি হয়ে কই গিয়েছে সে?

রাত্রি হাসি মুখ নিয়ে ঘরে ডুকছিলো কিন্তু সাগরকে দেখেই তার মুখের হাসি উবে গেলো। মনের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করলো।
রাত্রি চোখ টা সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলো।
সাগর তখন বলে উঠে,–” কই গিয়েছিলে?”

চলবে!