#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি
| পর্ব ১৬ |
রাত্রি হাসি মুখ নিয়ে ঘরে ডুকছিলো কিন্তু সাগরকে দেখেই তার মুখের হাসি উবে গেলো। মনের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করলো।
রাত্রি চোখ টা সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলো।
সাগর তখন বলে উঠে,–” কই গিয়েছিলে?”
রাত্রি স্পষ্ট আওয়াজ করে বলে,–“স্কুলে গিয়েছি।”
কথাটা বলে কোনো কিছু শোনার অপেক্ষা না করেই সে চলে গেলো। কিছু শুনতে চায় না সে । মানুষ টার দিকে তাকালে তার রাগ উঠে, মন টা খারাপ হয়ে যায়। সাগরের সামনে সে পড়তে চায় না, ওর সামনে পড়লেই তার মুখের হাসি চলে গিয়ে ঘনকালো আধাঁর নেমে আসে। কেমন যেনো তীক্ততা কাজ করে সাগরের প্রতি। আগের মতো ভালোবাসা পায় না তার প্রতি।
সাগর হতভম্ভ হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে প্রশ্ন করতে নিচ্ছিলো কেনো গিয়েছে তার আগেই চলে গেলো।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,–“ও স্কুলে কেনো গিয়েছিলো?”
শাহিনুর মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে,–“ও স্কুলে চাকরী করে তাই।”
সাগর ভ্রু দুটি কুচকে গেলো। ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বলে,–“মানে? স্কুলে চাকরী করে মানে?”
শাহিনুর খুশি খুশি ভাব করে বলে,–“শখ করেছিলো তাই আমি রাজি হয়েছি। মেয়েটা সারাদিন বাড়ীতে থেকে থেকে এক ঘুয়ে হয়ে গিয়েছে। তাই আমি আর কিছু বলি নি।”
সাগর আর কিছু বললো না, চুপচাপ সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। রাত্রি তার থেকে দূরে হয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে। কী করা উচিত তার? কী করলে সবাই খুশি থাকবে? সে তো কাউকেই খুশি করতে পারছে না।
***
পরের দিন ভোরেই স্কুলে চলে যায় রাত্রি। সাগর এসেছে জেনে সকালেও প্রাইভেট পড়াবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া ও কি করে না করে সেটাতে তো আর কারো সমস্যা হয় না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে যে বাড়ীতে থাকে তাও বোধ হয় কারো চোখে পড়ে না।
স্কুলে এসেই সে সরাসরি ক্লাস রুমে চলে গেলো। মিনিট দুয়েক লেইট হয়ে গিয়েছে তার। ক্লাসে ডুকতেই দেখতে পেলো কালকের ছেলেটা বসে আছে সাথে তার বাচ্চা একটা ছেলে। ফকফকে সাদা চামড়া ছেলেটা। রাত্রির চোখে ভালোভাবেই বাচ্চা টা পড়লো।
সে মিষ্টি হেসে তার চুলগুলো হালকা নাড়া দিয়ে বলে,–“কেমন আছো বাবু?”
ছেলেটা গম্ভীর মুখ করে রাত্রির হাত সরিয়ে দিলো। রাত্রি অবাক হয়ে তাকালো।
হালকা হেসে বলে,–“ওরে বাবা, চুলের ফ্যাশন নষ্ট করে দিছি ম্যাম তাই না? আচ্ছা আর করবো না। ”
ছেলেটা কোনো কথা বললো না, চোখমুখে চরম বিরক্তি ফুটিয়ে দুই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দাড়িয়ে রইলো।
রাত্রি কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। সে এবার আরেকটু নরম সুরে বলে,–“তোমার নাম কী? ”
ছেলেটা ব্যাগের চেইন খুলে একটা খাতা বের করে দু পেইজ উল্টে রাত্রির সামনে ধরলো। রাত্রি ভ্রু জোড়া কুচকে খাতা টা নিলো। গোটা গোটা অক্ষরে ছেলেটার পুরো বায়ো ডাটা লেখা সেখানে। রাত্রি অবাক হয়ে সব দেখলো। পরক্ষণে ভাবলে ছেলেটা হয়তো কথা বলতে পারে না। তার মনটা ই খারাপ হয়ে গেলো। এত সুন্দর বাচ্চা অথচ কথা বলতে পারে না। রাত্রির মায়া হলো তার প্রতি।
সে শাওনের দিকে তাকিয়ে বলে,–” শাফি কথা বলতে পারে না তাহলে তো ওকে প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করানো উচিত ছিলো আপনার। এখানে ওকে কীভাবে পড়াবো আমি?”
শাওন একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাত্রির মুখের দিকে তাকালো। শাফির দিকে তাকিয়ে বলে,–“বাবা ম্যামকে গ্রিটিংস দাও!”
শাফি গম্ভীর সুরে বলে,–“গুড মর্নিং ম্যাম!”
রাত্রি অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকালো। সে বলে,–“এ্যাহ, ও কথা বলতে পারে? তাহলে আমি যে এত কথা বললাম কই ও তো কোনো কথা বললো না।”
শাওন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,–” ও কথা কম বলে।”
রাত্রি দুজনের দিকে পরপর কয়েকবার তাকালো। কাগজ টা শাফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এটুকু বাচ্চার কী গম্ভীরতা! রাত্রির একবার বলতে ইচ্ছে করলো,–“ও কথা কম নয় কথাই বলে না।” পরে কিছু বললো না এনারা দুজনেই যে তার উপর বিরক্ত সে বুঝলো। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। বাচ্চা টাকে শাওন সবার সাথে বসতে বললো, সে চুপচাপ গিয়ে এক পাশে বসে পড়লো।
শাওন চলে যেতেই রাত্রি এসে ওদের সাথে বসে পড়লো পড়ানোর জন্য। সবাই হই চই লাগিয়ে দিয়েছে রাত্রির কোলে কে বসবে আজ।
রাত্রি আওয়াজ করে বলে–” সবাই চুপ করো।”
বাচ্চাগুলো সবাই শান্ত হয়ে গেলো। শাফি বিরক্তিকর মুখ করে ওদের দিকে তাকালো। সবাই চেঁচামেচি করছে কেনো?
রাত্রি সবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বলে,–” আজ আমাদের সাথে আরেকজন নতুন অতিথী এসেছে। আজ থেকে শাফি ও তোমাদের বন্ধু।”
সবাই মাথা নাড়ালো। সে দম নিয়ে আবারো বলে,–” আজ যেহেতু ও নতুন এসেছে, তাহলে ওকেই কোলে বসাই? ও তোমাদের ছোট নতুন বন্ধু তাই না! ”
রাত্রি সবাইকে সুন্দর করে বুঝাতে তারাও রাজি হয়ে গেলো। সে শাফির দিকে তাকিয়ে তাকে ডাকলো। শাফি উঠে আসতেই সে তাকে তার কোলে বসালো। শাফি চুপ করে বসে রইলো। রাত্রি হেসে ওর গালে কিসি দিলো, শাফি সাথে সাথে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেললো। কপাল দুটো কুচকে বিরক্তিকর মুখে রাত্রির দিকে তাকালো। রাত্রি ওর দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি করে হাসলো। এতে তার মুখের এক্সপ্রেশনের কোনো পরিবর্তন হলো না সে একইভাবে তাকিয়ে রইলো।
রাত্রি কাচুমাচু মুখ করে বলে,–“আচ্ছা, আর দিবো না।”
ছেলেটা আগের মতো মুখ করেই নিচের দিকে তাকালো। রাত্রি ফুশ করে নিশ্বাস ছাড়লো। বিরবির করে বলে, “বাপরে বাপ, এমন ভাবে তাকাচ্ছিলো যেনো খেয়ে ফেলবে!”
ওদের ক্লাস শেষ হতেই রাত্রি বেরিয়ে পড়লো অফিসের দিকে। ওর পিছন পিছন শাফি ও বের হলো। রাত্রি অফিসে ডুকবে এমন সময় দেখলো বাচ্চা ছেলেটা তার পেছনে। সে বলে,–“ক্লাসে গিয়ে বসো বাবু। এখনো অন্য সার যাবে তো।”
শাফি কোনো জবাব না দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। রাত্রি আরো কয়েকবার বলে উপায়ন্তর না পেয়ে ওকে সহ অফিসে ডুকলো।
সে প্রিন্সিপ্যাল কে বলতে নিচ্ছিলো, –” স্যার এ বাচ্চা টা,, ”
পুরো কথা টা শেষ হওয়ার আগেই স্যার বলে উঠে,–” আরে শাফি। আসো আসো। এদিকে আসো!”
শাফি রাত্রির হাত ছেড়ে দিয়ে উনার কাছে চলে গেলো। রাত্রি বলে,–” স্যার ওকে চিনেন আপনি?”
প্রিন্সিপ্যাল বলে,–“হ্যা। ও হলো পরিদর্শকের নাতি। কাল যে ছেলেটা এসেছিলো, মিঃ শাওন উনি হলেন পরিদর্শকের ছেলে। তিনি কাল অসুস্থতার জন্য আসতে পারে নি তাই ছেলেকে পাঠিয়েছিলো। এসব কথা তিনিই আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে ছিলেন রাতে। ”
রাত্রি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকালো। কি বলে?
স্যার আবারো বলে,–” ইউ নো আমাদের স্কুলকে উনারা বেস্ট বলে জানিয়েছে। বিশেষত শিশু ক্লাসের জন্য, উনি সব ভালো করে দেখে রিপোর্ট করেছিলেন। আমিও তোমার কথা বলেছি এরপর উনি বলেন তোমাকে পার্মানেন্ট করার ব্যবস্থা করে দিবেন উনারা।”
রাত্রি শুনে কিছুটা খুশি হলো। এরপর বলে,–“তাহলে স্যার বাচ্চা টাকে কেনো ভর্তি করিয়েছে?”
–” আসলে ও কারো সাথে কথা বলে না,মিশে না। ওকে স্বাভাবিক করার জন্যই এখানে ভর্তি করিয়েছে। ওর বাবা কাল দেখেছিলো সব বাচ্চা নাকি খুব হাসিখুশি ভাবে কথা বলছিলো।”
রাত্রি কৌতুহল নিয়ে বলে,–“কিন্তু ও কেনো এমন? না মানে এমন গম্ভীর গম্ভীর থাকে কেনো?”
প্রিন্সিপ্যাল উদাস মুখ করে শাফির দিকে তাকিয়ে বলেন,–” ওর মা নেই। জন্মের সময় মারা গিয়েছে। এরপর বাবা আর বিয়ে করে নি।একা একা ই বড় হয়েছে তাই ও এমন। ওর মেন্টাল কন্ডিশন ভালো না। স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো নরমাল বিহেভ করে না ও। সবসময় নিজের মতো থাকে। একা একা খেলে, একা একা থাকে।”
রাত্রির বুকটা ধক করে উঠলো। ও জানে মা ছাড়া একটা বাচ্চার জীবন কেমন। কতটা কষ্ট সে খুব ভালো করেই বুঝে। ছেলেটার দিকে তাকাতেই ওর খারাপ লাগা টা বহু গুন বেড়ে গেলো। ও তো কয়েক বছর মা কে পেয়েছে। মা কেমন বুঝেছে। কিন্তুু শাফি? ও তো কখনো মায়ের আদর পায় ই নি।
শাফি ছোট ছোট চোখ করে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে না কী বলছে উনারা! তবে এটুকু বুঝেছে ওর সম্পর্কেই বলছে না হলে দুজনে বারবার ওর দিকে তাকাতো না।
চলবে!