#বেলির_কথা (২৩)
চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিড়ে,
কাঁদিস কেন মন?
ভাঙ্গাগড়া এ জীবনে আছে সর্বক্ষণ।
হাসির পরে কান্না আসে,
দুঃখের পরে সুখ,
আধার রাতের শেষে আসে,
দিনের আলোর মুখ।
জন্ম নিলে ম*রতেই হবে,
কাঁদিস কেন মন?
ভাঙ্গাগড়া এ জীবনে আছে সর্বক্ষণ।
‘মৃ**ত্যু’ কত ছোট একটা শব্দ।কিন্তু এ শব্দকে ঘীরে নিখুঁতভাবে যে বিচ্ছেদ টা হয় সে বিচ্ছেদ যে সহ্য হওয়ার নয়।তবুও এই নিদারুণ বাস্তবতা মানুষকে মানতে হয়।প্রথম প্রথম এটা মানতে না পারলে ও সময়ের সাথে সাথে একটা সময় আসে মানুষ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
হাসনাতের কথা শুনে শাহেদ মিতু ছুটে আসে গ্রাম থেকে।এ কি থেকে কি হয়ে গেলো?পুলিশ অনেক খুঁজে ও লাশ পেলো না।ধারণা করা হলো গাড়িতে সবাই আটকে ছিল।আগুন ধরার পর তারা আর বের হতে পারেনি।এত নদীর পানি ও আগুন নিভাতে পারেনি যখন, তখন ধরে নেয়ায় যায় মৃ*ত্যুটা তাদের কপালে এভাবেই লিখা ছিল।
বেলি এখন হুট করেই আগের মতো চিল্লিয়ে কেদে উঠেনা।বেলির বেলায় হয়েছে এমন,
‘মানুষ অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর’
তবে আকাশে যেমন মেঘ জমে গেলে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ে।বেলির ক্ষেত্রে ও তাই হয়েছে।নিঃশব্দে চোখ থেকে বৃষ্টি গড়াতে ভুল হচ্ছেনা।
মিরা বেলির কোলে বসে চোখের পানি মুছে মুছে দিচ্ছে।আর বলছে,
‘আমার ফুফি ভাল যে না?’
পাশে হেনা মাকে জড়িয়ে ধরে আছে।ঘুম থেকে উঠেই সে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি।তখন হাসিব জানায় তার বাবা নামক ভালবাসাটা আর নেই।হেনা তখন বাবাইয়ের জন্য কেঁদে উঠলেই হাবিবা জড়িয়ে রাখে।তারপর থেকে বেলিকে জড়িয়ে বসে ছিল।
শাহেদ এর চোখে জল।জল নিয়ে মিতুকে বলে,
‘আমার বোন এত ভালো।তার ভাগ্য এত দুঃখ কেন?’
‘আল্লাহ পরীক্ষা নেয়ার জন্য মানুষকে দুঃখ দেন।তবে এটা ভেবো না যে পাপি বলেই দুঃখ পাচ্ছে।বেলিকে আল্লাহ ধর্য্য দিক।’
শাহেদ হাবিবার কাছে গিয়ে বলে,
‘বেলিকে কয়েকদিন আমাদের এখানে নিয়ে যাই?’
‘হুম।নিয়ে যান।এই শোক কাটানো টা যে দরকার।হেনার জন্য হলেও ওকে শক্ত হতে হবে।’
হাবিবা ও ফুফিয়ে কাদে।ভাইয়ের কথা মনে পড়ে।এই সেই ভাই বাবা মা চলে যাওয়ার পর কখনো ভালবাসার অভাব বুঝতে দেয়নি।এই সেই ভাই কখনো ইচ্ছের অপূর্ণ রাখেনি।এই ভাই একজন যোগ্য ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছে।হাবিবা কিভাবে ভাইকে ভুলবে?কি ভাগ্য তাদের।শেষবিদায়ে তার লা*শ টাও দেখা হলো না।আফসোস।
শাহেদ বেলির মাথায় হাত বুলিয়ে পাশে বসে,
‘বেলিই।’
বেলি শাহেদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘উনি আমাকে শিঘ্রই ফিরবেন বলেছিলেন।উনি কথা দিয়ে কথা রাখলেন না।উনি ও আম্মার মতো চলে গেলেন।আমার ভালবাসায় যত সমস্যা।আমি কাউকে ভালবাসলে সে ই হারিয়ে যায়।আমি তোমাদের কে আর ভাল ও বাসব না।কখনো আর কাউকে ভালবাসব না।’
‘তুই শান্ত হ।হেনার দিকে তাকা?মেয়েটা কেমন ভয়ে ভয়ে আছে।এ বয়সে ও ভয় পেলে ওর মানসিক চাপ পড়বে।’
‘আমি কিভাবে শান্ত হবো?আমার কলিজায় আগুন ধরে গেলো ভাইয়া।পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।উনার স্মৃতি আমি কিভাবে ভুলবো?তুমি বরং এমন একটা ঔষধ এনে দাও।যে ঔষধ খেয়ে আমি সব ভুলে যাব ভাই।তোমার পায়ে পড়ি।’
শাহেদ বেলিকে জড়িয়ে নেয়।দুই পাশে বেলির দুই মা কান্নারত চোখে তাকিয়ে থাকে।
.
শাহেদ বেলিকে জোর করে গ্রামে নিয়ে আসে।
বেলি একদম চুপচাপ হয়ে আছে।খাওয়াদাওয়া করেনা।
বারান্দায় টুলে বেলি আনমনে বসে ছিল।
হ্যা তার মনে আছে।বহু আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিল সে।একটা বাগান অনেক সুন্দর বাগান।রাজপ্রাসাদ আছে।সেই প্রাসাদে বেলি একা ছিল।বাবার হাত ধরে বাগান পর্যন্ত গেলে ও পরবর্তীতে সে বাবা মা ভাই কাউকে খুঁজে না পেয়ে একা হয়ে গেলো।হ্যা আজ তেমন টায় মনে হচ্ছে। আজ বেলির প্রাসাদ আছে,বাগান আছে নেই শুধু আব্বা আম্মা উনি।বেলি আবারো চোখের জল ছেড়ে দেয়।
মিতু এসে পাশে বসে,
‘এভাবে ভেঙ্গে পড়লে হেনার কি হবে আমায় বল?তুই ও ওকে একা করে দিয়ে চলে যেতে চাস?’
বেলি বলে,
‘ভাবি আমাকে ঔষধ এনে দাও।প্রিয়জন ভুলে যাওয়ার ঔষধ।’
‘ধর্য্য ধর বোন।আমি তোর ভাইকে বলেছি এখন থেকে তুই এখানেই থাকবি।হেনাকে এখানের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দে?শহরে আর তোকে পাঠাবো না।হাসনাতের স্মৃতি তোকে কুড়ে কুড়ে খাবে।’
‘উনি আমার মনে আজীবন বসবাস করে যাবে।’
‘থাকুক মনে।কিন্তু তুই এখানেই থাকবি এটা আমার শেষ কথা।’
বেলি মিতুকে জড়িয়ে ধরে রাখে।
.
হেনা আর মিরা খেলা করছে।হেনা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।সবার বাবা আছে তার নেই।তাকে কেউ আর আদর দিবে না।
মিরা হেনার চুপচাপ খেয়াল করে হেনা কে বলে,
‘আপু খেলবে না?’
‘হুম খেলবো।’
‘তোমাকে হাসিখুশি দেখতে আমার কত্ত ভাল লাগে।’
‘তাই?’
‘হ্যা।তুমি আমার ফুফির মতো ই সুন্দর।’
হেনা হঠাৎ করেই কেঁদে উঠে মিরা ভয় পেয়ে যায়।
‘কি হলো আপু কেদোনা?’
‘আমার বাবাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে।কেন আল্লাহর কাছে নিয়ে গেলো?’
মিরা তখন বলে,
‘আমার আম্মু বলে আল্লাহর কাছে নাকি যা চাই তাই মানুষ পাই।শুধু আল্লাহকে ভালবাসতে জানতে হয় তুমিও আল্লাহকে ভালবেসে তোমার বাবাইকে চাও আল্লাহ দিয়ে দিবে।’
‘সত্যি?’
‘চেয়ে দেখো?’
মিরা হেনা দুজনে হাত তুলে দোয়া করে।তারপর হেনা খুব খুশি হয়।সে মিরাকে বলে,
‘তুই ও খুব সুন্দর।’
.
বেলি গ্রামে আসার পর থেকেই মুহুর্তে পুরো গ্রাম কথাটা ছড়িয়ে যায়।অকালে বেলি স্বামী হা*রিয়েছে।
কেউ কেউ বেলিকে সান্তনা দিতে ও চলে আসে।আবার কেউ কেউ বেলির আড়ালে গিয়ে হাজারটা গিবত করছে।
শাহেদ বাজারে যেতে না যেতেই কয়েকজন এসে শাহেদ কে ঘীরে ধরলো।
একজন বলে,
‘শুনলাম বেলির জামাই নাকি..?’
শাহেদ হাত দিয়ে থামিয়ে বলে,
‘হ্যা যা শুনেছো তাই।’
‘বেলির থেকে মনে হয় কোনো বাতাস আছে।’
‘কিসের বাতাস?’
‘জ্বিনের বাতাস।প্রথমে বিয়ে দিতে কত কষ্ট করলে এখন আবার জামাইটা অকালে চলে গেলো।আমি বলি কি তাড়াতাড়ি বেলিকে তোমাদের ঘর থেকে আলাদা করো নইলে তোমার ঘরে ও সে বাতাস আসবে।নয়তো চিকিৎসা করাও হুজুর দিয়ে।’
শাহেদ হু হু করে হাসে।শাহেদের এমন হাসি লোকটি সন্তুষ্ট হতে পারলো না।এখানে কি এমন হাসির কথা বলল?তখন চাচা বয়সী একজন বলে উঠলো।
‘মিয়াভাই ঠিকই বলেছে।বেলির যদি সমস্যা নাই ই হয় ওর এত কষ্ট ক্যান?’
শাহেদ তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আল্লাহ বান্দাদের পরীক্ষার জন্য কষ্ট দেন।’
লোকগুলো সেসব বুঝতে নারাজ।তখন শাহেদ না পেরে বলে,
‘আপনার মেয়েটাকে দুইবার বিয়ে দিলেন।একজনের সাথে দিলেন ছেড়ে দিলো।এখন আরেকজনের সাথে দিলেন কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছে।তাহলে আপনার মেয়ের ও বাতাস আছে নিশ্চয়?’
‘কি বলছো কি?’
‘হ্যা আমার বোনের বেলায় যদি তাই ই মনে হয় আগে নিজের ঘরের আর নিজের মনের চিকিৎসা করুন আগে।তারপর অন্যজনকে বলতে আসবেন।’
শাহেদ চলে আসে।যতসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা এদের।বাসায় এসে মিতুকে এসব জানায়।শাহেদের এমন উচিৎ জবাবে মিতু খুব খুশি হয়। তারপর মিতু জানায় বেলি একফোটা পানি ও খাচ্ছেনা।তখন শাহেদ হেনাকে ডাকে।তারপর ভাতের প্লেট হেনার হাতে দিয়ে বলে মা কে খাইয়ে দিতে।
হেনা প্লেট নিয়ে বেলির সামনে যায়।
‘মাম্মাম নাও খেয়ে নাও?’
বেলি হেনার দিকে তাকায়।আর বলে,
‘তুমি খেয়েছো?মাম্মাম পরে খাবো।’
‘খেয়ে নাও।আমি কি খাইয়ে দিবো?বাবাই খায়নি তুমি ও খাচ্ছ না।’
বেলি হেনার দিকে তাকায়।মেয়েটা হুট করে কেমন যেন হয়ে গেলো।তবে কি বাবার শোকে এমন হয়ে গেছে।আমার মেয়েটা কত শুকিয়ে গেলো।
বেলি প্লেট হাতে নিয়ে হেনাকে খাইয়ে দেয়।হেনা কেঁদে কেঁদে বলে,
‘আল্লাহকে বলেছি বাবাইকে এনে দিতে।তুমি ও খেয়ে নাও?’
বেলি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়।তারপর বলে,
কলিজা তুই আমার,
তুই আমার আলো।
তোকে ছাড়া শূন্য আমি,
লাগেনা যে ভালো।
রাজকন্যা তুই আমারি,
জীবনের চেয়ে দামি।
তুই থেকে যাস আমারি বুকে,
কুড়িয়ে নিবো সুখ আমি,
চেয়ে থেকে তোর মুখে।
শাহেদ এসে বেলির মাথায় হাত রেখে বলে,
‘তোর ভাবিকে এ বাড়িতে নিয়ে আনার পর বলেছিলাম যে,তোকে যেন বোনের মতো দেখে।কিন্তু ও আমাকে অবাক করে দিয়ে তোকে মায়ের মতো আগলে রেখেছিল।সেই মায়ের মতো মানুষ এর নীড়ে তুই নিঃসন্দেহে যতদিন ভাল লাগে ইচ্ছে হয় থাকবি।আমার আদেশ বাইরের লোকজনের কারো মন্দ কথায় কখনো কষ্ট পাবিনা।কখনো বাইরের কাউকে দূর্বলতা দেখাবি না।তুই কষ্ট পাবি মানে ওরা দূর্বলতা বুঝে যাবে। সুযোগ পেয়ে যাবে আঘাত করার।তাদের সেই সুযোগ দিস না রে বোন।
চলবে…
#তাহরীমা
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)