#বেলির_কথা (২৪)
সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ও বেলিকে কত মায়াবি দেখাচ্ছে।নাওয়াখাওয়া অনিয়মিত করে শরীর শুকিয়ে গেছে বটে।এক সপ্তাহ গ্রামে থেকেই বেলি হাসনাতের ঘরে চলে আসে।তার স্বামীর ঘর থাকা সত্ত্বেও বেলি কেন ভাইয়ের ঘরে থাকবে?বেলি চায় শেষজীবন পর্যন্ত হাসনাতের গোছানো ঘরেই জীবন কাটিয়ে দিবে।
.
চুপচাপ বেলি,অতিরিক্ত কথা এখন আর বলেনা।তেমন হাসে ও না।হাবিবা বেলির সাথে গল্প করতে এসে আবার নিজের বাসায় চলে যায়।দেখতে দেখতে এক মাসের ও বেশি সময় পার হয়ে যায়।কিন্তু বেলির চোখের জল ফুরায় না।একটা মাস হয়ে গেলো মানুষটাকে বেলি দেখেনি।জীবনে এই চোখ দিয়ে পৃথিবী নামক জায়গায় আর তাদের দেখা হবে ও না।
বেলি হেনাকে রেডি করিয়ে বোরকা পড়ে নেয়।হেনাকে স্কুলে দিয়ে কলেজ যেতে হবে।কলেজে যতক্ষণ স্টুডেন্ট এর সাথে থাকে ততক্ষন বেলি হাল্কা হাসিখুশি তে থাকে।
হেনাকে স্কুলে দিয়ে বেলি কলেজ যায়।নতুন টিচার জয়েন করেছে।সবার সাথে পরিচিত হলেও বেলির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি।
বেলি কলেজে ডুকতেই নতুন স্যারের(রিহান) সাথে দেখা হয় বেলি চিনতে পেরে সালাম দেয়।
‘ম্যাডাম যে কেমন আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভাল।’
‘আমার কথা জানতে চাইবেন না?’
‘জ্বি কেমন আছেন?’
‘ভালো।আপনার কথাগুলো আপনার মতো ই সুন্দর।’
বেলি কথাটায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না।স্টুডেন্ট এর সাথে কথা বলতে অসুবিধা হওয়ায় বেলি কলেজে এসে নিকাব খুলে ফেলে।বেলিকে দেখেয় স্যার এ মন্তব্য টা করলো।বেলি তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে হাটা ধরলো।
.
কলেজে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বেশি টাইম দিতে হচ্ছে বেলির।কলেজ শেষ করে হেনাকে নিয়ে বাসায় ফিরে।
.
বাসায় এসে রান্না বসাতে হয়।রান্না করে নামাজ পড়ে বেলি হেনাকে ডাক দেয়।
খাবার টেবিলে হেনা চুপ করে বসে থাকে।তখন বেলি বলে,
‘খাবার খাচ্ছো না কেন?’
হেনা টেবিলের খাবারের দিকে তাকায়।আলুভাজি,ডাল,মুরগির মাংস আর ডিমভাজি।
বেলি আবারো বলে,
‘মাম্মাম খাইয়ে দিবো?’
‘নাহ।’
‘তাহলে এভাবে না খেয়ে বসে রয়েছো যে?’
‘তোমার রান্না আমার মজা লাগেনা।’
‘কারণ?’
‘আমার ফ্রেন্ডদের আম্মুরা ফ্রেন্ডদেরকে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে দেয়।তাদের খাবার থেকে আমাকে ভাগ দেয়।এ খাবারগুলা অনেক মজা।তুমি এরকম রাঁধতেই জানোনা।’
মেয়ের এমন চাহিদায় বেলি আহত হয়।জীবনে এই প্রথম কেউ তার রান্নার ব্যপারে এভাবে বলল।অথচ এইতো সেদিন মানুষটা তার রান্না খেয়ে প্রশংসা করতো।
বেলি হেনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘আমি ও তোমাকে প্রতিদিন নিয়ম করে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়ে দিতে পারব কিন্তু তাতে তুমি শুধু সেখানে খাবার ই পাবে।মায়ের ভালবাসা পাবে না।এ খাবার গুলা সাধারণ হলেও দেখো কত যত্ন আর ভালবাসা দিয়ে আমি মেয়ের জন্য রান্না করেছি, যে ভালবাসা তুমি অই খাবারে পাবেই না।’
হেনা প্লেট নিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করে।মা কে বলে এসব লাভ নেই।সে বড় হলে এসব মায়ের খাবার বাদ দিয়ে দিবে।যখন তার হেব্বি টাকা হবে খালি রেস্টুরেন্ট এর খাবার বসে বসে খাবে।আহ কি স্বাদ এগুলাতে।
বেলি হেনার দিকে তাকিয়ে হাসে।
___
ইদানীং রিহান স্যার যেকোনো অযুহাতে বেলির সাথে গল্প করতে আসে।পরপুরুষের সাথে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা বেলির পছন্দ না।ইগনোর করছে বেলি,রিহান ও তাই বুঝছে তবুও যেন বেলির সাথে কথা বলতে আসে।বেলির সেটা বিরক্ত লেগেও ভদ্রতার খাতিরে কিছুই বলেনা।
যখন ই কলেজে যায় বেলির সাথে এটা সেটা নিয়ে গল্প করতে চলে আসে।
আজ ও তার ব্যতীক্রম নয়।
বেলি ক্লাস অফ টাইমে চেয়ার নিয়ে বসে বই পড়ছিল।
রিহান স্যার বেলির থেকে দুরুত্ব রেখে চেয়ারে বসে।বেলি রিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কিছু বলবেন?’
‘আমি আপনার ব্যপারে সব শুনেছি ম্যাডাম।ভেরি সেড।’
বেলি কিছু না বলে চুপ হয়ে থাকে।
‘আমি আসলে একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম।কি মনে করেন তাই?’
‘বলুন?’
‘আপনি জীবনে আবার কাউকে সুযোগ দিবেন?’
বেলি কথাটা বুঝতে না পেরে বলে,
‘কিসের সুযোগ? ‘
‘প্রিয়তমা বানানোর সুযোগ।’
বেলি স্যারের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়।এমন একটা কথা স্যার বলে কেমনে তার বুঝা আসলো না।
রিহান বলে,
‘ভণিতা না করেই বলি?আপনাকে প্রথম দেখাতেই আমার অনেক ভালো লেগেছিল।আমার কথা ভেবে দেখুন।আপনার কিছুই অপূর্ণ রাখব না।আপনাকে ভালবাসব অনেক।আর এভাবে একা থাকা ঠিক না।
আপনার মেয়েকে আমি আমার পরিচয়ে….’
বেলি হাত দিয়ে থামিয়ে বলে,
‘এসব কেমন ধরনের কথা?আপনার কোনো ধারণা আছে আপনি কি বলছেন?’
‘জানি।কিন্তু অনেকেই এমন দ্বিতীয় কাউকে সুযোগ দেয়।তাছাড়া একা জীবন চলে না।’
বেলি বলে,
‘একা?আমি একা আপনাকে কে বললো?আমার জীবন জুড়ে আমার ভালবাসা জুড়ে আমার স্বামী যে রয়ে গেছে।আমি যে একা নই।ভাববেন না আমি একার নাম করে আমি অসহায়।আমি তা ও নই।আমি মেয়েকে নিয়ে বেশ আছি।’
‘কিন্তু আমার দিকটা দেখুন।আমি ও আপনাকে অনেক ভাল বেসেফেলেছি।বাচা সম্ভব নয়।
আপনার চোখের চাহনি..’
বেলি তখন দাঁড়িয়ে যায়।
‘এনাফ মি: রিহান।আপনার ভালবাসা সত্য কিন্তু ভুল মানুষকে ভালবেসেছেন হয়তো।আমি বাকি জীবনটুকু আমার উনার বউ হয়েই থেকে যেতে চাই।তাছাড়া আপনি যেটাতে ভালবাসা বলছেন এটা মোটেও ভালবাসা নয় এটাকে মোহ বলে।আপনি আমার রূপে মুগ্ধ হয়েই এমন টা বলছেন।মোহ কেটে গেলে আমি ও কেটে যাব।’
রিহান চুপ করে বসে থাকে।
বেলি আবারো বলে,
‘দুনিয়াতে আপনার যোগ্য মেয়ের অভাব পড়বে না।এমন মেয়ে দেখেয় বিয়ে করুন।ভালবাসতে হলে বিয়ের পর কাউকে ভালবাসুন।তার আগে নয়।’
রিহান তখন উঠে চলে যায়।বেলি সস্থি পায়।
_______
বেলি এখন কলেজে পৌছে ও নিকাব খুলে না।বেলি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় বুঝেছে যে,
কালোদের একটা জ্বালা সে কালো কেউ তারে পছন্দ করেনা।কিন্তু সুন্দরী মেয়েমানুষদের দশ জ্বালা।প্রায় বেশিরভাগ মানুষ এর নজর তাদের দিকে থাকে।যে কেউ চাই তাদের সাথে মিশতে।
যেসব বেলির পছন্দ না।
কয়েকদিন পর রিহান স্যার কলেজের মেয়ের প্রেমে পড়ে।বেলি এসব এ আর মাথা ঘামায় না।
___
গ্রামে আরেকটা কথা রটে যায়।প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে রামিমের বউ পরপুরুষের সাথে পালিয়েছে।সারা গ্রাম ছি ছি করছে।
কয়েকদিন ধরে গ্রামের মানুষ এর অনেক কানাঘুষা ছিল রামিমকে নিয়ে।আস্তে আস্তে সেসব থেমে যায়।
.
মাসের পর মাস চলে যায়।সময় যে থেমে থাকে না কারো জন্য।বেলি অফ ডে তে হেনাকে নিয়ে আবারো গ্রামে আসে। পথে চেয়ারম্যান চাচার সাথে দেখা হয়।বেলি গাড়ি থেকে নেমে চাচাকে সালাম করে।চেয়ারম্যান চাচা বেলিকে দেখে খুব খুশি হয়।
আজ মিরা ফুফিকে পেয়ে খুব খুশি।সাথে হেনা ও খুশি।শহিদ বেলির সাথে কথা বলে।কিন্তু হেনার সাথে কথা বলেনা, হেনাকে কেমন যেন লাগে।কেমন যেন হিংসুটে মেয়েটা।তাই শহিদ হেনার দিকে তাকিয়ে চলে যায়।
মিতু বেলিকে আগের চেয়ে স্বাভাবিক দেখে অনেক খুশি।শাহেদ বাজারে যায় বেলির পছন্দের সব খাবার নিয়ে ফেরার পথে প্রাক্তন চেয়ারম্যান চাচার সাথে দেখা হয়।
চেয়ারম্যান মুখ কাচুমাচু করে শাহেদ কে দেখে বলে,
‘বাজার করেছিস?’
‘হ্যা চাচা বেলি এসেছে।তাই পছন্দের সব খাবার নিছি।’
‘হ্যা আমার সাথে দেখা হয়েছে।’
‘একটা কথা বলি?’
‘বলেন?’
‘তোর বোন বেলি এখন একা।ওর একটা সঙ্গি দরকার।একা জীবন চলতে পারেনা।একা চললে মন মানসিকতা ঠিক থাকেনা।’
‘কি বলতে চান চাচা?’
‘আমি বলতে চাই ওর আবার বিয়ে দাও।’
শাহেদ চমকে বলে,
‘বিয়ে?’
‘হ্যা।আমি আসলে এতদিন বাহ্যিক রূপের মেয়েদের বেশি পছন্দ করতাম।কিন্তু ভাল মনের মেয়েরা যে আসল রুপবতী সেটা বুঝিনি।বন্ধুর মেয়েকে শখ করে নিয়ে আসলাম।ভেবেছিলাম অনেক ভাল হবে।কিন্তু হলো কি দেখ?
যাইহোক রামিমকে একটা ভাল মেয়ে দেখে আবার বিয়ে দিব ভাবছি।সে যতই রূপ না থাকুক ভাল মেয়ে হওয়া চাই।ওদের বয়স ত আর চলে যায়নি একা থাকবে নাকি?
বেলির ও একজন সঙ্গী প্রয়োজন এমন হাসিখুশি মেয়েটা কেমন যেন মুখ শুকনা।সঙ্গী পেলে ঠিক হয়ে যাবে।চাচা হয়ে বলছি কিছু মনে নিস না।মেয়েটা যে ভালো ই।তুই ভেবে দেখিস কথাটা।’
‘আমার বোন যা বলবে তাই হবে।তবুও আমি আগে ওকে বলে দেখবো।’
.
বেলির মন একদম ভাল নেই।মানুষ এর জীবন পাল্টাতে সময় নেয় না।কার কপালে কি থাকে কেউ বলতে পারেনা।ভাগ্য মানুষ কে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলে কেউ জানেনা।উনি এভাবে হারিয়ে যাবেন কল্পণা করেনি বেলি।তবুও আল্লাহ মানুষ টাকে ভাল রাখুক।জায়নামাজ এ প্রতিদিন এ দোয়াটায় বেলি করে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে বিকেলের দিকে সবাই একটু ঘুমায়। বেলির ঘুম আসেনা।বেলি নদীর পাড়ে বসতে যায়।
শাহেদ ও ঘুমায় না।বেলির পিছনে পিছনে যায়।গিয়ে বেলির পাশে বসে।
বেলি ভাইকে বলে,
‘ঘুমাবে না?’
‘নাহ।’
‘মন খারাপ তোর?’
‘কই না তো?’
‘এভাবে একা মনমরা থাকিস দেখতে ভাল লাগছেনা?’
‘কেন?আমি যে বেশ সুখে আছি।আমার মেয়ে হেনা আছে।’
‘তবুও।’
‘তবুও কি?আমার সাথে আমার রব আছে।’
‘কিছু মনে না করলে তোকে একটা কথা বলি বেলি?’
বেলি ভাইয়ের দিকে তাকায়,
‘তুই অন্যকাউকে সুযোগ দে?’
ভাইয়ের এমন কথায় বেলি চমকায়।আবার কি যেন মনে করে হু হু করে হাসে।থেমে বলে,
‘ভালবাসা একবার ই সুন্দর।বারবার নয়।’
চলবে……
#তাহরীমা
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)