ভয় পর্ব-০৬

0
234

গল্পঃ ভয় ( ষষ্ঠ পর্ব )

স্বামী স্ত্রীর এই একান্ত সময় পার হবার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি আমি, শেষ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল অভ্রর ভয়ংকর চিৎকারে।

বিছানায় লাফিয়ে উঠে বসে লক্ষ করলাম অভ্র বিছানায় নেই, বুকের ভেতর কলিজায় একটা মোচড় খেয়ে উল্টে গেল যেন। অভ্র কোথায় গেল এবং কোথা থেকে অভ্রর চিৎকার ভেসে এলো সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কিছু সময় হতবুদ্ধি হয়ে বসে থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।

পুরো ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বাথরুমের সামনে এসে দাড়াতেই অভ্রর গোঙ্গানির আওয়াজ শুনে দরজা ধাক্কা দিয়ে বুঝলাম দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। লাগাতার ধাক্কাতে লাগলাম কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।

কলিং বেল বেজে উঠলো। এত সকালে আবার কে এলো।

দরজা খুলতেই দেখি পাশের বাড়ির সেই ভাবী, তার স্বামী এবং ছোট্ট মেয়েটি দাড়িয়ে আছে।

আমি কোনকিছু না বলে আবার বাথরুমের সামনে এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম।

এতক্ষণে ওরাও এসে আমার পাশে দাড়িয়েছে। প্রতিবেশী ভাই বললো– দেখি, এভাবে ধাক্কালে দরজা খুলবে না।

উনি দরজার লক বরাবর জোরে জোরে কয়েকবার আঘাত করতেই দরজা খুলে গেল।

ভেতরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অভ্র। আমরা সবাই ধরাধরি করে অভ্রকে এনে বিছানায় শোয়ালাম। অভ্রর কপালে অনেকখানি কেটেছে। অভ্রর মাথা আমার কোলের ওপর রেখে ক্ষত স্থান পরিস্কার করতে লাগলাম।

পাশের বাড়ির ভাবী তার স্বামীকে বললো জলদি গাড়ির ব্যবস্থা করতে অভ্রকে হাসপাতালে নেবার জন্য। উনি গাড়ির ব্যবস্থা করতে বেরিয়ে পড়লো।

আমার চোখে জল টলমল করছে দেখে পাশের বাড়ির ভাবী বললো– ভাবী একটা কথা বলবো?

: বলুন।

: আসলে ভাবী এই বাড়িটা আমার মোটেই সুবিধাজনক মনে হয়না।

: কেন?

: বাড়িটার দিকে তাকালেই কেমন রহস্যময় মনে হয়, এর জন্যই সেদিন আপনাকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। এই বাড়িতে কিছু আছে মনে হয়।

: কিছু আছে মানে?

: ভাবী আমি গভীর রাতে আমাদের দ্বিতীয় তলার জ্বানালা থেকে একদিন দেখি আপনাদের পুকুরের শান বাধানো ঘাটে সাদা লম্বা কি একটা বসে আছে। আরেকদিন দেখি সেই সাদা লম্বা মানুষআকৃতির মতো জিনিসটা আপনাদের ঘরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে।

: আর কিছু দেখেছেন?

: জ্বি ভাবী, গভীর রাতে পুকুরের পাশের ঐ রক্তজবার ঝোপটা ঘিরে জোনাকিপোকা জ্বলে নেভে, তখন কিছুক্ষণ পরে পরে ঝোপটা এমন ভাবে দুলে ওঠে যেন ওর ডালে চড়ে কেউ নাচছে।

ওনার কথায় অবিশ্বাস করার কিছু নেই কারণ, কারণ এরকম ভৌতিক কিছু বিষয় আমিও ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছি। তবে বিষয় হলো দোষ কি এই বাড়ির নাকি আমার সঙ্গে আসা দোষ।

আমি জিজ্ঞেস করলাম– ভাবী আপনি এসব ঠিক কবে থেকে লক্ষ্য করেছেন।

উনি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম– তোমরা এ বাড়িতে আসার পরে থেকেই। কারণ এর আগে এ বাড়িতে কেউ ছিলনা বলে তেমন নজর পড়তোনা। এখন তোমাদের ঘরে আলো জ্বলে বসে চোখ পড়ে, আর এ জন্যই বিষয়গুলো হয়তো চোখে পড়েছে।

ভাবীর স্বামী গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে, এবার সবাই ধরাধরি করে অভ্রকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে এলাম।

কাটা যায়গা থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, নার্সরা ক্ষত স্থান পরিস্কার করে ড্রেসিং করে দিয়ে স্যালাইন লাগিয়েছে।

ধীরে ধীরে চোখ খুললো অভ্র, আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি হাত বাড়িয়ে অভ্রর হাতটা ধরতেই অভ্রর শুকনো ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

আমার চোখে জল টলমল করছে দেখে তাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে অভ্র বললো– তুমিই আমার শক্তি তুমি আমার মনোবল, তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে আমার কি হবে বলোতো।

আমি চোখের জল মুছে হেসে বললাম– তুমি সুস্থ হয়ে উঠেছো বলেই আনন্দের অশ্রু এসেছে চোখে।

অভ্র মুখটা সেন্টি ইমোজির মতো করে বললো– অশ্রু আনন্দের হোক বা বিষাদের, তোমার চোখে অশ্রু দেখলেই আমার মনটা হতাশার মেঘে ছেয়ে যায় মিস সাদিয়া ইসলাম কেয়া।

– এবার চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবে একদম, চুপ – আমি বললাম।

অভ্র আমার হাত পর হাত দিয়ে আলতো করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রইলো।

পাশের বাড়ির সেই ভাবী আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল এতক্ষণ, এবার ইশারায় জিজ্ঞেস করলো আমাদের লাভ ম্যারেজ কিনা।

আমি মুচকি হেসে বললাম– হ্যা ভাবী আমাদের লাভ ম্যারেজ।

ভাবী সেরকমই মিষ্টি হেসে বললো– এর জন্যই এত প্রেম। আর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করে আমার কপালে জুটলো একটা বেরসিক কুমড়ো পটাস।

ভাবীর কথা শুনে চোখ বন্ধ রেখে অভ্রও হেসে উঠলো আমার সাথে।

ভাবীর স্বামী অভিযোগের সুরে বললো– এই যে আমি যেরককমই হই তোমাকে কিন্তু কখনও কষ্ট দিয়ে কিছু করিনা, আজ এতবছর হলো কষ্টটা কি বুঝতে দেইনি, এরপরও যদি তোমার মনে হয় আমি অনুপযুক্ত তাহলে বলো পাত্র দেখে আবার বিয়ে দিয়ে দেই।

ভাবী লজ্জা পেয়ে বললো– হইছে এবার থামেন জনাব।

আমি ভাবীকে বললাম– ভাবী কেউ কেউ প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু তারা প্রকাশ করতে পারেনা। এটা নিজেকে বুঝে নিতে হয়। দেখবেন সে ভালোবাসা প্রকাশ করছেনা কিন্তু আপনার প্রতি তার ভীষণ খেয়াল দেখে বুঝে নিবেন সে আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে আপনাকে কখনও কোনকিছুর অভাব বোধ করতে দেবেনা, নিজের জীবন থাকতে আপনাকে ছেড়ে যাবেনা। কিন্তু সমস্যা একটাই ভালোবাসার কথাটা সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারেনা।

ভাবী মুচকি হেসে বললো– সেটা আমি বুঝি বলেই তো সংসারের বয়স আজ এত বছর। দোয়া করবে আমাদের জন্য এভাবে যেন আজীবন পাশাপাশি থাকতে পারি।

ভাবীর স্বামী বললো– ঠিক আছে এবার তাহলে আমরা যাই, আর হ্যা বাসায় ফেরার পরে কোনকিছুর প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাদের বলবা।

কথা শেষে তারা চলে গেল।

স্যালাইন শেষ হবার পরে আরও দুই তিন ঘন্টা পরে অভ্রকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম হাসপাতাল থেকে। বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

অভ্রকে ড্রইং রুমে সোফায় বসিয়ে আমি আমাদের বেডরুমের দরজা খুলতেই হতবাক হয়ে গেলাম। আমাদের বিছানায় ঠিক মাঝ বরাবর একটা রক্তজবা ফুল পড়ে আছে।

রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ তবুও এই ফুল আসলো কীভাবে সেটা ভেবে আমি রীতিমতো অবাক। এগিয়ে গিয়ে ফুলটা হাতে নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে সোজা কিচেনে এসে গ্যাসস্টোভ জ্বালিয়ে আগুনে পুড়লাম ফুলটা।

মানুষের ধৈর্যের একটা সীমা থাকে, সেটা লিমিট ক্রশ করলে তখন আর ডর ভয় কিছু থাকেনা।

কিচেন থেকে ড্রইং রুমে এসে দেখলাম অভ্র নেই, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ঘরের বাইরে দাড়িয়ে আছে অভ্র। এই রাত্রি বেলা আবার বাইরে কি ওর!

অভ্র আমাকে হাতের ইশারায় ডাকছে।

আমি ঘুরে ঘর থেকে বাইরে বের হতেই অভ্র মিষ্টি হেসে বললো– অনেক দিন থেকে তোমায় একটা জিনিস দেখাবো ভেবেও দেখানো হয়না।

– কাল দিনেও দেখা যাবে অভ্র – আমি বললাম।

অভ্রর কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম আচ্ছা বাবা ঠিক আছে কি দেখাবে দেখাও।

– আমার পেছন পেছন আসো – বলে অভ্র বাগানের ভেতর দিকে যেতে লাগলো। আমি অভ্রকে ফলো করতে করতে এগোচ্ছি।

একটা যায়গায় গিয়ে অভ্র আমাকে বললো– তুমি ওখানেই দাড়াও।

আমি দাড়ালাম।

অভ্র কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে আমার চোখে চোখ রেখে রহস্যময় হাসি হাসতেই আমার সন্দেহ হলো।

অভ্র এক পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেই আমার মাথা বরাবর উপরে বিশাল একটা গাছের বড়সড় একটা শুকনো ডাল মড়াৎ করে ভেঙে নিচে পড়তে লাগলো ঠিক এই মুহূর্তে আচানক কেউ একজন খপ করে আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে আমাকে বিদ্যুৎ গতিতে সরিয়ে নিলো আর সেই শুকনো ডালটা আমার সামনে পড়লো ধপাস করে।

আমি ঘুরে দাড়িয়ে দেখলাম যে আমার হাত ধরে টেনে সরিয়ে এনেছে সে আর কেউ নয় সে অভ্র।

আমি হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছি। অভ্র আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো– মাথা ঠিক আছে তোমার, এই রাতের বেলা এখানে কি?

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, তার মানে যে আমাকে ডেকে এনেছিল সে আসল অভ্র নয়।

আমি জিজ্ঞেস করলাম– তুমি কোথায় ছিলে অভ্র?

অভ্র বললো– তুমি বেডরুম থেকে কিচেনে গেলে, আমি তখন ড্রইং রুম থেকে বেডরুমে গিয়ে শুয়েছিলাম কেয়া। তারপর তোমার টের না পেয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম।

এবার সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার।

চুপচাপ অভ্রকে নিয়ে ঘরে চলে এলাম। গতরাতে অভ্রর আর আমার একান্ত মেলামেশার কারণেই সেই অশুভশক্তি ক্ষেপে আছে বুঝলাম।

রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে গল্পগুজব করে আমরা অনেক রাতে শুয়ে পড়লাম লাইট অফ করে। ইচ্ছে করেই এত রাত পর্যন্ত জেগেছি যেন রাতটা কোনমতে কেটে যায়। ভোর হলেই আম্মুর আসার কথা সেই হুজুরকে নিয়ে।

আমার শুয়ে আছি, অভ্রর শরীর ক্লান্ত বলে ওর চোখে ঘুম চলে এসেছে কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।

রাত গভীর, আমি শুয়ে আছি চোখ খুলে সতর্কতার সাথে। অশুভ শক্তির আর কোনো আঁচ আমি অভ্রর গায়ে লাগতে দেবনা।

ঘুমের মধ্যে অভ্র আমাকে জড়িয়ে ধরতেই দেখলাম দরজার কাছে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু দৃশ্যমান হয়ে ভয়ঙ্কর…

চলবে…

লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।