ভয় পর্ব-০৭

0
209

গল্পঃ #ভয় ( ৭ম পর্ব )

ঘুমের মধ্যে অভ্র আমাকে জড়িয়ে ধরতেই দেখলাম দরজার কাছে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু দৃশ্যমান হয়ে ভয়ঙ্কর একটা ছায়ামূর্তিতে পরিনত হয়ে জ্বলন্ত আগুনের গোলকের মতো দুই চোখ মেলে তাকালো।

মূহুর্তের মধ্যে যেন আমার গলা শুকিয়ে ফেটে যাবার অবস্থা। বিস্ফারিত চোখে তাঁকিয়ে আছি আমি সেই ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তির দিকে। আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে, যতটা সম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।

টের পেয়ে যদি অভ্রর ঘুম ভেঙে যায় এবং আচানক এসব দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায় তখন আর এক বিপদ।

একটা বিষয় ভেবে আমি এখনও মোটামুটি শক্ত আছি যে হুজুরের দেয়া সেই তাবিজটা যতক্ষণ আমার সাথে আছে ততক্ষণে অন্তত ঐ অশরীরী আমাকে স্পর্শ করতে পারবেনা বা কাছে ঘেষতে পারবেনা। এবং এই কারণেই অভ্র যতক্ষণ আমার পাশাপাশি থাকবে ততক্ষণ অভ্ররও কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। অভ্রর ক্ষতি করতে হলে আমার কাছ থেকে আগে অভ্রকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে।

সন্ধ্যা এর জন্যই অভ্রর রূপ ধরে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে আগে মারতে গত রাতে অভ্রর সাথে শারীরিক মেলামেশার কারণে হয়তো। ধীরে ধীরে সবকিছু ক্লিয়ার হচ্ছে আমার কাছে আরও।

ভয়ঙ্কর সেই কালো ছায়ামূর্তি আবার ধীরে ধীরে কালো ধোঁয়ায় পরিনত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমি তাকিয়ে আছি বিস্ফারিত চোখে পলকহীন। চোখের পলক পড়ছেনা আমার।

দীর্ঘসময় এভাবে অতিবাহিত হলো। সবকিছু ঠিকঠাক স্বাভাবিক এখন।

চোখের পাতায় এবার রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে আমার। অভ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখের পাতা এক করলাম।

ঠিক কয়েক মিনিট পরেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। আওয়াজ কানে আসতেই আমার চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেল। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। সেই ঠকঠক আওয়াজ প্রথমে মৃদু ছিল এখন ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে।

এবার দরজার ওপাশ থেকে অভ্রর কণ্ঠে মৃদু স্বরে আমাকে ডাকছে– কেয়া – আবার কিছুক্ষণ পরে – কেয়া।

হুবহু অভ্রর কণ্ঠ। এদিকে অভ্রকে আমি জড়িয়ে ধরে আছি শক্ত করে। অভ্র গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।

এবার পুনরায় নিশ্চুপ।

কিছুক্ষণ পরে শুরু হলো দরজা ধাক্কানো সেই সাথে অভ্রর কণ্ঠে– কেয়া দরজা খোলো কেয়া, তুমি রুমের ভেতর যার সাথে আছো সে অভ্র নয় কেয়া সে তোমায় মেরে ফেলবে। দরজা খোলো কেয়া জলদি।

দরজার বাইরে যে আছে সে কিছুতেই আসল অভ্র নয় সেটা আমি জানি। কারণ আমার সাথে তাবিজটা থাকা অবস্থায় অশুভশক্তি কোন ভাবেই আমার কাছে ঘেষতে পারবেনা। আমি চুপচাপ কান খাড়া করে শুনে যাচ্ছি।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যখন সকল ভয়কে উপেক্ষা করে আবার সামনে এগিয়ে যায়। অভ্রর জীবন রক্ষা করতে আমি তেমন এই ভয়টাকে উপেক্ষা করে এখন এর চিরস্থায়ী সমাধান খুঁজছি। হেরে গিয়ে বেঁচে থাকাটা বেঁচে থাকা নয়, ভয়কে জয় করে একদিন বাঁচলেও সেটাকে বেঁচে থাকা কয়।

দরজায় ধাক্কাধাক্কি এবার বন্ধ হলো। পিনপতন নীরবতা চারপাশে। আমি জানি এত সহজে ঐ অশুভশক্তি হার মানবে না। চোখ কান খোলা রেখে আমি সতর্ক প্রতিটি মুহূর্ত।

বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হবার পরে আপার খেয়াল করলাম রুমের বাইরে থেকে দরজার নিচ দিয়ে সেই কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী রুমের ভেতর ঢুকে আবারও সেই ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তি রূপ ধারণ করে বললো– আমার হাত থেকে তোরা দুজনের কেউ বাঁচতে পারবিনা মনে রাখিস। আমার হাতেই তোদের মৃত্যু হবে।

এরমধ্যেই ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসলো চারিদিক থেকে। সেই ছায়ামূর্তি আবারও ধোঁয়ায় পরিনত হয়ে মূহুর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

আমার শরীরটাও হালকা লাগতে শুরু করেছে এবার। ঐ অশুভশক্তি আশেপাশে থাকলেই সারাক্ষণ শরীরটা ভারী হয়ে থাকে আমার।

অভ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, একেতো ওর শরীর ক্লান্ত তার ওপর হয়তো অশুভ শক্তির উপস্থিত আওয়াজ কোনকিছু ও টের পায়না। হয়তো অশুভ শক্তি শুধু আমার সামনেই দৃশ্যমান হয়।

গত রাতে বাথরুমে অভ্র সাথে কি ঘটেছিল সেটা জিজ্ঞেস করার পরে অভ্র কিছুই মনে করে বলতে পারছিল না। আমিও আর জোর করিনি কারণ কি ঘটতে পারে সেটা তো আমি জানি।

যা-ই হোক এবার আর চোখের পাতা মেলে রাখা দায়। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে দুই চোখে। অভ্রকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙলো সকাল দশটার দিকে অভ্রর ডাকে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি অভ্র হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে।

সকাল সকাল অভ্রর মুখে হাসি দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। প্রিয়জনের মুখের হাসিটাও মারাত্মক আনন্দের একটা প্রভাব ফেলে মনে।

উঠে বসে বললাম– কি ব্যাপার জামাই সাহেব এত আনন্দ ভাসছে আপনার চোখেমুখে, কারণটা কি হুম?

অভ্র মুচকি মুচকি হেসে বললো– বিশাল বড়ো একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য কেয়া।

আমি আগ্রহ নিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে বললাম– কৈ জলদি দাও।

অভ্র আমার চোখ চেপে ধরে বললো– চুপচাপ আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে চলো।

অভ্র আমার চোখ চেপে ধরে আমাকে যে ড্রইং রুমে নিয়ে এসেছে সেটা বুঝতে পারলাম।

এবার অভ্র থ্রি টু ওয়ান বলে আমার চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিতেই সত্যি আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম, এরচেয়ে বড়ো সারপ্রাইজ আমার কাছে আর কিছু হতে পারেনা।

আমার চোখের সামনে সোফায় বসে আছে আমার মা এবং বাবা। আমার চোখে জল টলমল করে উঠলো, আনন্দে উত্তেজনায় কথা বন্ধ।

আম্মুর এবং আব্বুর চোখেও জল টলমল করছে।

হাটু গেঁড়ে আব্বুর পায়ের কাছে বসে পড়ে আব্বুর পা জড়িয়ে ধরে বললাম– আব্বু আমার ভুল হয়ে গেছে পালিয়ে এসে তোমাদের মনে কষ্ট দিয়ে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। সন্তান তো ভুল করবেই তাই বলে তোমরা দূরে সরিয়ে রাখবে? নিজেও কষ্ট পাচ্ছো আমরাও কষ্ট পাচ্ছি।

আব্বুর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আব্বু কোনকিছু বলতে পারলোনা। আমাকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে কান্না করলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো– সন্তানের ওপর একটু রাগ করার অধিকার কি বাবার নেই বল? আমি নাহয় রেগে ছিলাম তুই তো জামাইকে নিয়ে আমার সামনে গিয়ে দাড়াতে পারতি।

এভাবে বেশ সময় অতিবাহিত হবার পরে আমরা সবাই গল্প করছি আর অভ্র চলে গেল বাজার করে আনতে।

কিছুক্ষণ পরে সেই হুজুর আসলো। উনি মা বাবার সাথেই এসেছিল।

সোফায় বসে হুজুর বললো– পুরো বাড়িটা বন্ধ করে এলাম, আপাতত সেই অশুভ শক্তি এ বাড়িতে ঢুকতে পারবেনা। কিন্তু এটা চিরস্থায়ী সমাধান নয়।

আমি বললাম– আমি এর চিরস্থায়ী সমাধান চাই হুজুর।

হুজুর বললো– সেটা আজ রাতেই হবে কিন্তু সবকিছু তোমার হাতে। যদি ব্যর্থ হও তাহলে তোমার জীবন চলে যেতে পারে। আজ রাতে তুমি তোমার বিছানায় বেশ খোলামেলা ভাবে শুয়ে থাকবে। এবং খাটের পাশে লুকিয়ে রাখবে আমার দেয়া পাত্রে পবিত্র পানি ও একটা ছোট চাকু। চাকুটা সেই পানিতে ডোবানো থাকবে। তোমার তাবিজটা খুলে রেখে যাবে। আমি রাতে বাড়ির বন্ধন খুলে দেবার পরেই ঐ অশুভশক্তি বাড়ির ভেতর ঢুকে সোজা তোমার কক্ষে চলে আসবে। আমি বাইরে থেকে ঘরের চারপাস দোয়া কালাম পড়ে বন্ধ করে দেবো। অশুভ শক্তি শারীরিক মেলামেশার জন্য যখন তোমার ওপর চেপে বসবে ঠিক তখন পবিত্র পানির পাত্র থেকে চাকুটা তুলে অশুভ শক্তির শরীরে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই ও যন্ত্রণায় পালাতে চাইবে, কিন্তু সেটা আর পারবেনা। এর পরের ব্যবস্থা আমি করবো।

আমি বললাম– তাহলে অভ্র?

হুজুর বললো– ওকে এসবের ভেতর না টানাই ভালো। খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ওকে অন্য রুমে রাখতে হবে।

অভ্র বাজার থেকে ফিরলো।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে রাত। আজ একটু তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিলাম সবাই। এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী অভ্রকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হলো।

খাওয়া শেষে ড্রইং রুমে বসে গল্পগুজব করতে করতে প্রায় রাত বারোটা। অভ্র ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।

এবার আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তুতি নেবার পালা।

হুজুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি রুমে এসে কেবল একটা টিশার্ট এবং পাজামা পড়ে রুমের লাইট অফ করে শুয়ে রইলাম। বুকের ভেতর ধক ধক করছে, নিজের হৃদপিণ্ডের কম্পনের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পারছি।

হুজুর সম্ভবত বাড়ির বন্ধন খুলে দিয়েছে।

একটু ভুল হলেই আমার জীবন চলে যেতে পারে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছি অবিরত।

হঠাৎ অনুভব করলাম শীতল সাপের মতো কিছু একটা আমার পাজামার ভেতর দিয়ে পায়ে পেচিয়ে বুকের দিকে উঠে আসছে…

চলবে…

লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।