ভালবাসার স্পর্শ পর্ব-০৩

0
341

#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ০৩
লেখকঃ আবির খান
মায়ার কথা না ভেবেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু এই সুখের ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব পেল না। ঘুমের মধ্যে শুনছি কে যেন আমার রুমের দরজায় নক করছে। আধখোলা চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখি ঘড়িতে ৩ঃ৩৫ বাজে। দরজার ওপাড়ে কি মায়া নক করছে নাকি অন্য কেউ? অজানা এক ভয় কাজ করছে। আমি আস্তে আস্তে উঠে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– কে?

অন্যপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,

~ আমি মায়া। প্লিজ একটু দরজাটা খুলুন।

আমি ভীতু কণ্ঠে বললাম,

– কেন কেন কি হয়েছে?
~ আমার খুব ভয় করছে। সব অন্ধকার। আমি কান্না করে দিব।

তার কথা শেষ হওয়া মাত্রই আমি দরজার এপাশ থেকে শুনছি সে কান্না করছে। কেন জানি এই মেয়েটাকে কান্না করতে দেখলে বা শুনলে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা। আমি আল্লাহর নাম নিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখি মায়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সমানে কান্না করছে। আমি পুরো হতভম্ব হয়ে আছে। সে আমাকে দেখে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ এত বড়ো বাসায় কেউ একা থাকে কিভাবে! ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এএএএ….

বলেই আবার কান্না শুরু। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। এত রাতে একটা মেয়েকে আমার রুমে ঢুকতে বলবো? না না এটা কেমন করে হয়। কি করবো আমি? আর এই মেয়েও বা কি চায়? আমি মায়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে কষ্ট পাচ্ছিলাম। তাই তাকে শান্ত করার জন্য বললাম,

– আচ্ছা কান্না থামান। বলেন কি করলে আপনি আর ভয় পাবেন না? আরামে চুপচাপ ঘুমাতে পারবেন?

মায়া চুপ হয়ে যায়৷ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলে সে বলে,

~ আসলে আমি খুলনাতে মায়ের সাথে সবসময় ঘুমাতাম। কখনো একা ঘুমাইনি। আমার একা ঘুমাতে খুব ভয় করে। রাতে একা ঘুমাতেই পারিনা আমি।

আমি এই মেয়ের কথা শুনে রীতিমতো বিশাল বড়ো একটা ধাক্কা খেলাম। তারমানে সে কি আমার সাথে ঘুমাতে চায়? হায় হায়! মায়া বলে কি! ওর মতলবটা কি? আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই কিছুক্ষণের জন্য। তাও নিজেকে সামলে তাকে জিজ্ঞেস করি,

– আচ্ছা আপনি কি আমার সাথে একি বেডে ঘুমাতে চাচ্ছেন? (বিষ্মিত কণ্ঠে)

মায়া মুহূর্তেই আমার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে না না করে। ও আমতা আমতা করে বলে,

~ বেডে না আমাকে ফ্লোরে একটা চাঁদর আর বালিশ দিলে আমি ঘুমাতে পারবো। তাহলে আর ভয় পাবো না।

আমি আবার স্তব্ধ হয়ে যাই। মানে সে আমার পাশে না ঘুমালেও আমার রুমে ঘুমাতে চায়। নাহ, এই মেয়ের মাথায় কোন ফন্দি অবশ্যই আছে। আজ রাতটা আমার না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে বুঝছি। কি যে একটা ঝামেলায় পড়লাম। মায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আমি কি বলবো তা শোনার জন্য। আমি তাকে বললাম,

– আমি একটা ছেলে মানুষ। আমার সাথে একি রুমে ঘুমানোটা কি আপনার জন্য ঠিক হবে? কেমন লাগে না বলেন?

মায়া কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে,

~ ভূতের চেয়ে আপনি অনেক ভালো আছেন। ওরা আমাকে একা পেলে নির্ঘাত মেরে ফেলবে। আপনি মারবেন না তা আমি বিশ্বাস করি।

মায়ার কথা শুনে অট্টো হাসতে হাসতে আমি বেডে গিয়ে বসে পড়ি। এই মেয়ের কথাবার্তা পুরো বাচ্চাদের মতো। কি কিউটই না লাগছে তাকে। তার এই কথা শোনার পর তাকে না করার উপায় নেই। তাই বললাম,

– ঠিক আছে ঘুমান।

মায়া অসম্ভব খুশি হয়। সে দ্রুত গেস্ট রুম থেকে তার যা যা দরকার সেগুলো আনতে চলে যায়। আমি বসে বসে হাসছি। এমন অভিজ্ঞতা জীবনেও হয়নি আমার। তবে এখন ভাবছি অন্যকিছু। মায়াকে কি এই ঠান্ডা ফ্লোরে ঘুমাতে দেওয়া ঠিক হবে। তার নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগবে। আমি আরাম করে ঘুমাবো আর সে মেহমান হয়ে নিচে ঘুমাবে! নাহ ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। আমি এসব ভাবতে ভাবতেই মায়া চলে আসে। এসেই ফ্লোরে চাঁদর ফেলে কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে বলি,

– দাঁড়ান।

মায়া আমার দিকে তাকায়। আমি তাকে বলি,

– আপনাকে ফ্লোরে ঘুমাতে হবে না।

সে অসহায় মুখ করে বলে,

~ তাহলে কোথায় ঘুমাবো?
– আমার বেডে ঘুমান।

মায়া দুই কদম পিছু সরে গিয়ে বলে,

~ কি…কি বলছেন? আমি আপনার সাথে একি বিছানায় ঘুমাবো! না না অসম্ভব। আমি পারবো না।
– আরে বাবা কথাটাতো শেষ করতে দিবেন নাকি! আমি বলছি আপনি আমার বেডে ঘুমান। আর আমি এই সোফাতে ঘুমাই।

আমার রুমে দুই সিটের ছোট একটা সোফা ছিল। মায়াকে সেটার কথাই বললাম। ও সোফাটা দেখে আমাকে বলল,

~ না না প্লিজ, আপনি আমার জন্য কষ্ট করবেন না৷ আমি ফ্লোরেই ঘুমাই। সমস্যা হবে না।

আমি রসিকতা করে বললাম,

– ঘুমান সমস্যা নেই। কিন্তু রাতে যে ফ্লোরে তেলাপোকা আর টিকটিকিরা পার্টি করে তাদের থেকে সাবধানে থাইকেন।

আমার কথা শুনেই মায়া রীতিমতো ভয়ে একটা চিৎকার দেয়। আমি হাসতে হাসতে বলি,

– কি ঘুমাবেন না?

মায়া মাথা নাড়িয়ে না না বলে। আমি আরও মজা পেয়ে হাসতে হাসতে বলি,

– তাহলে আজ রাতটা চুপচাপ আমার বেডে ঘুমিয়ে পড়েন। কাল তো বাসায় গিয়ে নিজের বেডেই ঘুমাতে পারবেন।

কথা শেষ করে আমি উঠে একটা মাথার বালিশ আর কাঁথা নিয়ে সোফায় চলে যাই। মায়া আস্তে আস্তে আমার বেডের কাছে গিয়ে একপাশে শুয়ে পড়ে। আমিও সোফায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বানরের মতো শুয়ে পড়ি। ইসস! কি শক্ত সোফা। যাইহোক চোখটা বন্ধ করতেই মায়া আবার ডাক দেয়। আমি চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে বসে আছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– এবার কি হয়েছে?
~ না না তেমন কিছু না। আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।
– হুম বলেন।

মায়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি তার দিকে। আমার রুমে বেডের পাশে সবসময়ই দুইটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমি সেই ল্যাম্পের আলোতে মায়ার চিন্তিত মায়াবী মুখখানা দেখছিলাম। তার মিষ্টি গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁটগুলো কেমন কাঁপছিল। যেন কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বের হচ্ছে না। মায়া হঠাৎই বলে,

~ কাল সকালে বলবো। এখন ঘুমান। আপনাকে অনেক জ্বালাচ্ছি আমি।

বলেই সে ঠাস করে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে। আমি সোফায় শুয়ে সব দেখছি। তার এরকম কান্ডে আমি আবারও অবাক। কি এমন কথা ছিল যে সে বলতেই পারলো না! তার ঠোঁটগুলো পর্যন্ত কাঁপছিল! কি এমন কথা সে বলতে চাচ্ছিল আমাকে? চিন্তা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আমার জানা ছিল না যে কালকের সকালে আমার জন্য বিশাল বড়ো একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। আসলে এটাকে সারপ্রাইজ নাকি বাংলার বড়ো বাঁশ বলবো তা আমি জানিনা।

পরদিন সকালে,

ভোরের ঝলমল আলোতে আমার ঘুম ভাঙে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল ৮ টা ২০ মিনিট বাজে। আজ শুক্রবার। সচারাচর এই দিনে আমি বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠিই না। কিন্তু আজ জানালার পাশে সোফায় ঘুমানোর কারণ ঘুমটা সকাল সকাল ভেঙে যায়। অপূর্ণ ঘুম নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসতেই সবার আগে মায়ার অসম্ভব সুন্দর ঘুমন্ত মুখখানা আমার চোখে পড়ে। লেখক আবিরের গল্পেই পড়েছিলাম যে, একটা মেয়ের সত্যিকারের সৌন্দর্য্য দেখতে হলে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে হবে। আমি আজ তা দেখছি। আহ! কি মায়াবী মলিন নেশাকাতর মুখ তার। আমি বুঝিনা কিভাবে এই মেয়ের প্রেমিক তাকে গ্রহণ করলো না। আমার মাথায়ই ঢুকে না ব্যাপারটা। কি জানি, সত্যিকারের প্রেম ভালবাসা আজকালকার দিনে কোন মূল্য নেই। তাই তো আজও একাই আছি। মা কতবার বিয়ে করতে বলল। কিন্তু আমার কোন মেয়েকেই পছন্দ কিংবা ভালো লাগে না। সত্যিই বলতে তাদের বিশ্বাসই করতে পারিনা। আজকালকার মেয়েরা শুধু মন নিয়ে খেলতে জানে। তারা একটা ছেলের অনুভূতি অনুভব কিংবা মনের গহীন জমে থাকা ভালবাসা আর কষ্টগুলোকে কখনোই বুঝতে চায় না। সবকিছু তাদের কাছে নেহায়েত রঙ তামাশা। হ্যাঁ আমারও একজন ছিল অনেক আগে। তখন আমি কলেজে পড়তাম। কিন্তু সে যে এভাবে আমার মন ভেঙে চলে যাবে আমি তা আর ভাবিনি। যাইহোক অতীত মানেই কষ্টকে স্মরণ করা। যেটা আমি চাইনা। এত সুন্দর সকালটা নষ্ট হোক তাও চাই না। আমি উঠে ফ্রেশ হলাম। কারণ মায়াকে আজ যেভাবেই হোক খুলনা পাঠাতে হবে। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আমার বেড খালি। কি হলো! মায়া কোথায় গেল? আমি রুম থেকে বের হয়ে গেস্ট রুমে নজর দিলাম। দেখি রুম রাতের মতোই আছে। ওয়াশরুমও বাইরে থেকে লাগানো। আর মায়ের রুমতো আমি তালাই মেরে রেখেছি। তাহলে মেয়েটা সকাল সকাল গেল কই। মেইন গেইটের কাছে এসে দেখি সেটাও ভিতর থেকে লাগানো। তাহলে…আমি একটু ভাবতেই আমার মনে পড়ে যে আমি তো আমার রুমের বারান্দাই দেখিনি। আমি দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দেখি, হ্যাঁ মিস মায়া আমার বারান্দায় মনের সুখে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছে। আমার বাসার সামনে অনেক বড়ো ফাঁকা জায়গা। তাই দক্ষিণের মনোরম হাওয়া আসতে কোন বাঁধাই পায় না। আমিও মাঝে মাঝে সকালে আর রাতে বারান্দায় বসে কিছু সময় কাটাই। বেশ শীতল ঠান্ডা বাতাস আসে এই সাত তলায়। ভালোই লাগে। মায়ারও বোধহয় তেমনই লাগছে। আমি হালকা কাশি দিলে মায়া আমার দিকে তাকিয়ে ওড়নাটা ঠিক করে নেয়। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাতের চেয়ে মায়াকে এখন বেশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। ওর গায়ের রঙ দুধের মতো একটা সাদা না হলেও ওর গায়ের রংটা বেশ মনকাড়া। আমাকে দেখে মায়া লজ্জা পেল আর আস্তে করে শুভ সকাল বলল। আমিও হেসে তাকে সকালের শুভেচ্ছা জানালাম। আর বললাম,

– আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি নাস্তা নিয়ে আসি। খেয়েই আমরা রেল স্টেশনে রওনা হবো। আপনাকে খুলনার ট্রেনে উঠিয়ে দিব৷ তারপর আপনি আপনার বাসায় আর আমি আমার।

দেখলাম মায়া চুপচাপ শুধু আমার কথা শুনলো। কিন্তু কোন রকম প্রতিক্রিয়া জানালো না। আমি সেদিকে খেয়াল না দিয়ে মায়াকে বাসায় রেখে বাইরে থেকে লক করে নাস্তা আনতে চলে গেলাম। নাস্তা এনে বাসায় ঢুকে দেখি মায়া চুপচাপ মুখ কালো করে হল রুমে বসে আছে। আমি ডাইনিং রুমে নাস্তা রেখে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম,

– কি হলো আপনি এই সকাল সকাল মুখ কালো করে বসে আছেন কেন? কি হয়েছে? আপনার তো খুশি হবার কথা আপনি আবার আপনার পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। তাহলে এভাবে মন খারাপ করে আছেন কেন?

মায়া হঠাৎই কান্না করতে করতে বলে,

~ আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না।

আমি এই কথা শুনে ঠাস করে সোফার উপর বসে পড়ি। হায়! হায়! এই পাগলি মেয়ে বলল কি! আবার কোন বিপদে পড়লাম! আমি কোন রকম নিজেকে সামলে মায়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

– মানে! কি বলছেন? কেন যাবেন না আপনি? কি হয়েছে?

মায়া কান্না করতে করতে বলে….

চলবে…?