ভালবাসার স্পর্শ পর্ব-১৩

0
286

#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ১০
লেখকঃ আবির খান
আমি আস্তে করে আঙুলটা মায়ার মিষ্টি ঠোঁটের উপর থেকে নামিয়ে ফেলি। আমরা দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। মায়ার মুখে কেমন জানি একটা মুগ্ধকর হাসি ছিল। আমি এবার ভালো করে মায়াকে দেখলাম। আমি দেখি সে নীল কালারের একটা বেশ সুন্দর শাড়ি পরেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছিল তাকে। আমি মুগ্ধ হয়ে বললাম,

– আপনাকে তো একদম নীল পরীর মতো লাগছে। ওয়াও!

মায়া ভীষণ লজ্জা পায় আর বলে,

~ ধুর আপনিও না। কি যে বলেন।
– সত্যিই বলছি। অসম্ভব সুন্দরী লাগছে আপনাকে।
~ হয়েছে ধন্যবাদ। এবার আপনিও রেডি হয়ে আসুন। আমি হল রুমে অপেক্ষা করছি।
– চলে যাবেন? আর একটু দেখি আপনাকে। (মনের কথাটা ভুল করে মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল)

মায়া চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জিহবায় কামড় দিয়ে জামা কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে দৌড় পালালাম। সে আমার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ। মায়া হল রুমে বসে মনে মনে ভাবছে,

~ আবির সাহেবের মতো যদি কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতাম, তাহলে হয়তো অতীতের সব কষ্টগুলো নিমিষেই হাওয়ায় বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু আমার কপালে এত সুখ কই! যে অতীত থেকে পালিয়ে আসলাম, সেই অতীতের কাছেই আবার নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। আবির সাহেব যদি আমার আবদারটা না রাখতেন তাহলে হয়তো আমি একরাশ কষ্ট নিয়েই দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতাম। যাইহোক আবির সাহেব খুব ভালো একটা মানুষ। তিনি এই ক’টাদিনে আমাকে যে আনন্দ আর হাসি উপহার দিয়েছেন আমি তা গত পাঁচ বছরে এক দিনও পাইনি। আমি সত্যিই তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার মন চায় আমার সবকিছু তাকে উজাড় করে দেই। তিনিই যদি আমার জীবনের প্রথম আর শেষ পুরুষ হতেন আমি ধন্য হতাম। কিন্তু আমার পোড়া কপাল।

মায়া এসব ভাবতে ভাবতে তার মনটা খারাপ হয়ে আসে। কিন্তু পরমুহূর্তেই পিছন থেকে আমি এসে তাকে বললাম,

– আমি রেডি চলুন।

মায়া তার বিষন্ন ভাবনা থেকে বের হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যেই আমার দিকে তাকায় সে একদম স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ আমিও তার সাথে ম্যাচ করে লাইট ব্লু কালারের একটা পাঞ্জাবি পরেছি। সে রীতিমতো হা করে তাকিয়ে আছে। আমি তার কাছে গিয়ে তার মুখটা বন্ধ করে দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম,

– এভাবে হা করে থাকলে মাছি ঢুকে যাবে যে। হাহা।

মায়া লজ্জা পেয়ে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ আপনি দেখি সম্পূর্ণ আমার সাথে ম্যাচিং করে পাঞ্জাবি পরেছেন৷ মানুষ কি ভাববে?

আমি মুচকি হেসে তার কাছে গিয়ে গাল দুটো ধরে তাকে বলি,

– ভাববে আপনি আর আমি কাপল। হাহা।

মায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি এটা বললামটা কি! সে এবার অসম্ভব লজ্জা পায় আর বলে,

~ আপনি আমাকে এত লজ্জা দেন কেন? উফফ..
– কারণ আপনি লজ্জা পেলে খুব সুন্দর লাগে তাই।
~ আপনি শুধু আমাকে স্পর্শ করার বাহানা খুঁজেন। সুযোগ পেলেই খালি আমাকে স্পর্শ করেন। আপনার মতলবটা কি বলেন তো আমাকে?

আমি মায়ার প্রশ্ন শুনে একদম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। কারণ আমি মায়ার নরম গাল দুটো এখনো ধরে আছি। আমি দ্রুত ছেড়ে দিয়ে আমতা আমতা করছি। মায়া হেসে দিয়ে বলে,

~ আরে আবির সাহেব একটু মজা করেছি। আমি তো আপনাকে আমার সব দিয়েই দিতে চেয়েছিলাম।

আস্তে করে বলল লাস্টের কথাটা। মায়া ভেবেছে আমি শুনিনি। কিন্তু আমি শুনে ফেলেছি তার কথাটা। কিন্তু তাকে বুঝতে দিলাম না। প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে বললাম,

– এখন মজা করলে হবে? ঘুরতে যাবেন না?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন।

এরপর আমি আর মায়া একসাথে বাসা থেকে বের হই। আমি বাসা ভালো করে লক করে তাকে নিয়ে লিফট দিয়ে নিচে আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্কিং লটে চলে আসি। আমার দুটো হেলমেট। একটা নিয়ে মায়ার কাছে গিয়ে তাকে সুন্দর করে পরিয়ে দিলাম। খুব সুন্দর লাগছিল। আমিও মুচকি হেসে আমার হেলমেটটা পরে তাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে রওনা হলাম আমার ঠিক করা আর তার পছন্দের জায়গায়। বাইক নিয়ে মেইন গেইটের সামনে আসতেই দারোয়ান চাচাকে দেখতে পাই। সে আমাদের সামনে আসলে আমি আমার হেলমেটটা খুলি। আর মায়াকে হেলমেটের গ্লাসটা উঠাতে বলি। চাচা মায়াকে দেখে খুশি হয়ে আমাকে এসে বলেন,

– বাবা সাবধানে যাইও। খুব সুন্দর মাইয়াডা।
– ঠিক চাচা দোয়া করবেন।

তারপর আমি আবার হেলমেট পরে রওনা হলাম আমাদের গন্তব্যে। আসলে আমরা যেখানে যাচ্ছি সে জায়গাটা হলো পূর্বাচল। সেখানে মায়ার পছন্দের জায়গা আছে। অনেক ধরনের রেস্টুরেন্ট ও আছে। আমরা ১১ টা নাগাদ বাসা থেকে রওনা হয়েছি। বাইকে যাচ্ছি বলে দেড় দু’ঘন্টা লাগবে যেতে। মায়া আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি আস্তে আস্তেই চালাচ্ছিলাম যাতে সে ভয় না পায়। কিন্তু বেচারি ভালোই ভয় পাচ্ছিলো। আমি তাকে আমার সাথে ফিল করছি। বেশ মজাই লাগছিল প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে প্রথম কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি। রাস্তায় অনেক মানুষ আমাদের দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল যখনই জ্যামে পড়ছিলাম। তাদের অধিকাংশই আমাদের কাপল ভাবছিল। আমি অবশ্য এতে খুশিই। কারণ আমি এটাই চাচ্ছিলাম৷ দেখতে দেখতে একটা নাগাদ আমরা আমাদের গন্তব্যে এসে পৌঁছাই। তবে সেটা মায়া যেখানে যেতে চেয়েছিল সেখানে না, একটা রেস্টুরেন্টে। কারণ এখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। তাই খাওয়া দাওয়া তো করতেই হবে। আমি বাইক পার্ক করে হেলমেট গুলো রেখে মায়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। মায়া মনের অজান্তেই আমার হাত ধরে আছে। হয়তো নতুন অজানা পরিবেশ তাই তার একটু আনকমফোর্টেবল লাগছিল। আমিও তাকে ভালো করে ধরে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। স্টাফরা আমাদের দেখে সালাম দিল। ম্যানেজার সাহেব নিজে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

– স্যার ওয়েলকাম আমাদের রেস্টুরেন্টে। আপনাদের জন্য কি ভি আই পি টেবিলটা দিব? আপনাদের খুব সুন্দর লাগছে।
– ধন্যবাদ। হ্যাঁ হ্যাঁ দিন।

মায়া পাশ থেকে আস্তে করে বলে,

~ আরে এত টাকা নষ্ট করছেন কেন? নরমাল টেবিলেই বসি আমরা।

আমি ইশারায় মুখে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ থাকতে বললাম। ম্যানেজারসহ বাকিরা মুচকি হেসে দিল আর মায়া লজ্জা পেল। তারপর ম্যানেজার সাহেব আমাদেরকে ভি আই পি টেবিলের দিকে নিয়ে গেলেন। আমরা বসলে ওয়েটার চলে আসে। আমি মায়ার কাছে মেনুটা দিয়ে বললাম,

– আপনার যা যা খেতে…

আমি মায়াকে আপনি বলায় ওয়াটার আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি তা দেখে দ্রুত কথা ঘুরিয়ে মায়াকে এই প্রথমবার তুমি করে বললাম।

– মানে তুমি যা যা খেতে চাও সব অর্ডার করো। কোন সমস্যা নেই।

মায়া আমার মুখে প্রথমবার তুমি বলতে শুনে অবাক হয়ে তাকায়। অবশ্য মায়ার ভালোই লাগছিল। কারণ তুমি ডাকটায় অনেক আপন আপন একটা ভাব আছে। আমি ইশারায় দ্রুত অর্ডার করতে বললাম। মায়া অসহায় হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর মুখ দেখেই বুঝে গেলাম যে, সে বুঝতে পারছে না আসলে কি অর্ডার করবে। আমি আমার মেনু থেকে দেখে দেখে ইউনিক কিছু বিদেশি খাবার অর্ডার করলাম যা আমরা সচারাচর কখনো খাইনা। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে আমাদের জন্য ওয়েলকাম ড্রিংক পরিবেশন করা হয়৷ আমি আর মায়া ড্রিংকসটা নিয়ে এক চুমুক একসাথে খেয়ে নি। মায়া খেয়ে বলে,

~ মজা অনেক।

আমি মুচকি হেসে দিলাম। মায়াকে অনেকটা আনকমফোর্টেবল লাগছিল। তাই জিজ্ঞেস করলাম,

– অস্বস্তি লাগছে?

মায়া আস্তে আস্তে করে আমাকে বলে,

~ আশেপাশে কত চুপচাপ আর নিরিবিলি, মনে হচ্ছে ভূতুড়ে কোন জায়গায় এসে পড়েছি। আমার তো খুব নার্ভাস লাগছে।
– এটা ভি আই পি জায়গা তো তাই আশেপাশে কেউ নেই। আপনি আপনার মনের মতো করেই বসুন।

মায়া আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে বলে,

~ আবির সাহেব একটা অনুরোধ করি রাখবেন?
– একটা কেন হাজারটা করুন।
~ আমি তো আপনার অনেক ছোট। আপনি যদি আমাকে তুমি করেই বলেন আমি খুব খুশি হবো। আপনার মুখে তুমি ডাকটা খুব মানায়৷

আমি মায়ার লজ্জাসিক্ত মুখখানার দেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছি। ওকে এত কিউট লাগে লজ্জা পেলে। আমি হেসে বললাম,

– ঠিক আছে। আমরাও মনে মনে খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে তুমি করেই বলার। যাক ইচ্ছাটা এবার পূরণ হলো।

মায়া লজ্জা পাচ্ছে খুব। এরমধ্যে আমাদের খাবার চলে আসে। সে খাবার দেখে তো পুরাই সকড। এত এত মজার মজার খাবার। ওয়েটার সব খাবার সার্ভ করে দিয়ে গেলে আমি মায়াকে খাবার বেরে দিতে দিতে বলি,

– এগুলো খেয়ে দেখো। অনেক মজা লাগবে।
~ এতগুলো!
– আরে আগে শুরু তো করো।

এরপর আমরা দুজন খাবার খেতে শুরু করলাম। মায়ার খুব মজা লাগছিল। ও নিজে নিজেই নিয়ে মজা করে খাচ্ছিল। আমিও খাচ্ছিলাম। ডেজার্টে খুব মজার একটা আইসক্রিম অর্ডার করেছিলাম। যেটা আমাদের জন্য স্পেশাল করে বানিয়ে আনা হয়েছে। মায়া সেটা খেয়ে খুশিতে একদম আত্নহারা। আমি ওকে খুশি করতে পেরে আলাদা একটা শান্তি পাচ্ছিলাম মনে মনে। আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে অনেকটা সময় ওখানে বসেই দুজন গল্প করি। কারণ বাইরে এখন রোদ। বের হয়ে লাভ নেই। আমি গালে হাত দিয়ে মায়ার ছোট বেলার গল্প গুলো শুনছিলাম। মাঝে মাঝে ওকে কেমন জানি বাচ্চা বাচ্চা লাগে। আবার মাঝে মাঝে একদম কিশোরী। আবার মাঝে মাঝে বউয়ের মতো লাগে। মেয়েদের কত্তো রূপ। আমি মায়াকে যত দেখি আমার মন ভরে না। অথচ অফিসে কত মেয়ে কলিগ আমার। তাদের কাউকেই আমার ভালো লাগে না বা বিশ্বাস হয়না। কিন্তু মায়ার বিষয়টা ভিন্ন। ওর প্রতি অন্যরকম একটা মায়া, টান, অনুভূতি কাজ করে আমার। জানিনা কি নাম দিব এই অনুভূতির৷ মায়ার সাথে গল্প করতে করতে দুকাপ কফিও খেয়ে ফেললাম আমরা৷ ঘড়িতে এখন সাড়ে তিনটা নাগাদ বাজে। আমি মায়াকে বললাম,

– চলো এবার তোমাকে তোমার পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাই। এখন তোমার অনেক ভালো লাগবে জায়গাটা।
~ সত্যি? চলুন চলুন৷ (খুব খুশি হয়ে)

আমি ওয়েটারকে বিল আর টিপস দিয়ে দিলাম। মায়া বিল দেখে অজ্ঞান হয়ে যায় প্রায়৷ আমি ওকে একটা গুতা দিয়ে বললাম, এখানে এরকমই দাম। কিন্তু সে মানবেই না। তার কথা একটাই তার পিছনে এতগুলো টাকা নষ্ট হলো। আমি মায়াকে বুঝাতে বুঝাতে বের হচ্ছিলাম ওমনি হঠাৎ করেই পিছন থেকে,

~ আবির!

আমি আর মায়া দুজনই অবাকও হই আবার ভয়ও পাই। আমার পরিচিত কে আমাকে না না আমাদেরকে দেখে ফেললো! হায় হায়! এখন কি হবে? আমি মায়ার দিকে ভয়ে তাকাই, মায়াও সেইম আমার দিকে ভয়ে তাকায়। তারপর আমরা দুজনই একসাথে পিছনে তাকাই। দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া মেয়েটাকে না চিনলেও আমি ঠিকই তাকে এক নজরেই চিনে ফেলি। সে আর কেউ নয়, সে আমার….

চলবে…?