ভালবাসার স্পর্শ পর্ব-০৮

0
242

#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ০৮
লেখকঃ আবির খান
আমরা দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমাদের মাঝে সময় যেন থমকে গিয়েছে। আমি ধীরে ধীরে মায়ার ঘোরে পড়ে যাচ্ছিলাম। চাঁদের আলোতে মায়াকে এত্তো বেশি সুন্দরী লাগছিল আমি বলে বুঝাতে পারবো না। আমি আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জানিনা কি হতে যাচ্ছে সামনে। আমি মায়ার কোমড়ে হাত রাখতেই মায়া কেঁপে উঠে। হঠাৎই দমকা একটা হাওয়ার জন্য মায়ার কপালের উপর কিছু চুল এসে পড়ে৷ আমি একটা আঙুল দিয়ে সেই দুষ্টু চুলগুলোকে তার কানের পিছনে গুজে দিলাম। মায়া লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। আমি আবার তার দিকে তাকালাম। তার গোলাপি মিষ্টি ঠোঁটগুলো থরথর করে কাঁপছিল। আমি যেন আরও বেশি মায়ার নেশায় পড়ে যাচ্ছিলাম। মায়াও যেন আমাকে আলিঙ্গন করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু হঠাৎই মনে হলো, এটা ঠিক না। মায়া আমার উপর বিশ্বাস করে এখানে এসেছে। আমি ওর বিশ্বাস ভাঙতে পারিনা। আমি কি করতে যাচ্ছিলাম এটা! না না। এটা কখনোই ঠিক হবে না৷ আমরা দুজনই হয়তো ঘোরের মধ্যে আছি। যখন এই ঘোর কাটবে মায়া আমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করবে যদি আমি এখন ওর সাথে কিছু করি। ও আমার কাছে একটা আমানত। আমি তার খিয়ানত করতে পারিনা। এই শিক্ষা আমি পাইনি। আমি কাপুরুষের খাতায় নাম লিখাতে চাইনা, যে পুরুষ একটা মেয়েকে অসহায় পেয়ে তার সর্বত্র ভোগ করে নিবে৷ নাহ। আমি আস্তে আস্তে মায়াকে ছেড়ে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম। আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললাম,

– দেখুন আজকের চাঁদটা ভীষণ সুন্দর। একদম আপনার মতো।

মায়া আমাকে সরে যেতে দেখে চোখ মেলে তাকায়৷ সে অনেক বেশি অবাক হয়। মায়া ভেবেছিলো আমি তার সাথে কিছু একটা করে ফেলবো। কিন্তু হঠাৎ করে যে থেমে যাবো তা সে ভাবেনি। মায়া ইচ্ছা করেই আমাকে থামায় নি। থামালে হয়তো আমি কষ্ট পাবো তাই। সে ভাবছে আমি তাকে থাকার আশ্রয় দিয়েছি আরও কতকিছু করছি, তাই সে যদি তার শরীর দিয়ে আমাকে খুশি করতে পারে তাহলে সেটাই হোক। কারণ সে আজ জীবিত থেকেও মৃত প্রায়। তার জন্য যদি কেউ খুশি হয় হোক। কিন্তু আমি মায়ার সব ধারণা নিমিষেই শেষ করে দিলাম। মায়া খুব অবাক হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

~ আপনি আমাকে ছেড়ে দিলেন কেন? আমি তো আপনাকে বাঁধাও দেইনি। তাহলে ছাড়লেন কেন?

আমি মায়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম,

– আপনি কি ভেবেছেন, আপনি আমার কাছে খুব সস্তা কেউ? জি না। আপনি আমার কাছে অনেক মূল্যবান একজন মানুষ। কিভাবে আমি আপনার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমার সবকিছু ভোগ করে নিব! আমি এমন না। জীবনে বহু ধরনের সুযোগ আসবে। কিন্তু আমাদের সব সুযোগে সবসময় পা দিতে নেই। আজ আপনাকে আমি আপন করে নিলাম। কাল যদি আপনাকে আর আমার কাছে নাই রাখতে পারি, আপনি তো সারাজীবনের জন্য একটা দাগ নিয়ে বেঁচে থাকবেন। যেটা আমি চাই না। আমি চাইনা আমার কোন প্রিয় মানুষ এভাবে কষ্ট পাক। আর সত্যি বলতে আপনি এত মানুষের ভীড়ে আমাকে বিশ্বাস করেছেন। আমি কিভাবে আপনার বিশ্বাস ভাঙি বলুন। আপনার এই মায়াবী দুচোখে আমি আর দশটা পুরুষ মানুষের মতো হতে চাইনা। যারা মেয়েদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের সবকিছু কেড়ে নেয়। আপনি আমার চোখের সামনে হাসিখুশি থাকলেই আমি খুশি। আমার এর থেকে বেশি আর কিছুই চাইনা৷

মায়ার গাল বেয়ে বেয়ে অশ্রু পড়ছে। সে কল্পনাও করেনি আমি এতটা ভালো হবো। আমার কথাগুলো শুনে আমার প্রতি তার অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে। সাথে আমার প্রতি তার সম্মানও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে৷ পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই এমন মনমানসিকতার ছেলে চায়। মনের গহীনে মায়াও হয়তো এরকম কাউকে চেয়েছিল। কিন্তু আমিই যে সেরকম কেউ হবো তা সে ভাবেনি। মায়া নিঃশব্দে কাঁদছিল। আমি তা দেখে বিচলিত হয়ে তার একটু কাছে গিয়ে চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– একি! কাঁদছেন কেন?
~ ভেবেছিলাম আমার সবকিছু দিয়ে আপনাকে খুশি করবো। কারণ আমার জীবনে আমি অন্যদের জন্য যত যাই করেছি কেউ খুশি হয়নি শুধু মা বাদে। তাই আজ ভাবলাম আপনি এতকিছু করলেন আমার জন্য। আমি যদি আমার সবকিছু দিয়ে আপনাকে খুশি করতে পারি তাহলে তাই হোক। কিন্তু আমি কল্পনাও করি আমি নিজেকে কতটা সস্তা বানিয়ে ফেলছিলাম। তাই নিজের উপর এখন ঘৃণা হচ্ছে।
– আহহা, আপনি শুধু শুধু এসব ভাবছেন। আপনার কোন দোষ নেই। আপনি মেয়ে মানুষ, মাথায় যেটা এসেছে সেটাই করছিলেন৷ কিন্তু আমাদের পুরুষদের দায়িত্ব বেশি। আপনারা ভুল করতে নিলে বা আমরাই ভুল পথে যেতে নিলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমি আপনাকে কোন দোষ দিব না৷ আর লজ্জিত আমি। আমিই অজান্তে আপনার অনেকটা কাছে চলে গিয়েছিলাম। আপনি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন৷ নাহলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।

মায়া অস্থির হয়ে বলে,

~ না না এ কি বলছেন! আপনি কেন ক্ষমা চাচ্ছেন। আপনার মতো ভালো মানুষ আর একটা আছে কিনা আমার জানা নেই৷ আপনার মতো যদি সব পুরুষেরা এমন হতো, তাহলে আর কোন মেয়ের জীবন নষ্ট হতো না। তারা অনেক ভালো থাকতো।
– হুম পরিবর্তন হবে। হয়তো আমার মতো আরও এমন অনেক পুরুষ আছে যারা মেয়েদের অনেক সম্মান করে আর তাদের কোন ক্ষতি হতে দেয় না।
~ হয়তো আছে, হয়তো নেই। তবে আমার চোখে আপনিই সেরা।

আমি মায়ার কথা শুনে হাসলাম। আর বললাম,

– চলুন আজ ঘুমিয়ে পড়ি। কাল সকালে তাড়াতাড়ি উঠে সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরাঘুরি করবো তার একটা প্লান করতে হবে৷
~ আবির সাহেব আপনি কি আজও সোফাতে ঘুমাবেন?
– হ্যাঁ, কেন আপনার সাথে ঘুমাতে বলবেন নাকি? (রসিকতা করে)

মায়া লজ্জা পেয়ে বলে,

~ ধুর আপনিও না। আচ্ছা শুনুন না, আমি বলছি কি আপনার যদি কোন সমস্যা না হয় ডাইনিং রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে রাখলে আমি হয়তো গেস্ট রুমেই ঘুমাতে পারবো। আমি চাইনা এভাবে সোফাতে ঘুমিয়ে আপনি কষ্ট পান৷
– উমম, এক কাজ করুন, আপনি আমার রুমেই ঘুমান, আমি বরং গেস্ট রুমে গিয়ে ঘুমাই। আমার রুমে তো টেবিল ল্যাম্প আছে। সো অন্ধকার হবে না। কিন্তু গেস্ট রুমটা একটু অন্ধকার হয়ে যায়। আপনার হয়তো ভয় লাগতে পারে।
~ আপনি আসলে আপনিই। আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যা বলবেন তাই।

এরপর আমরা দুজন দুইরুমে ঘুমিয়ে পড়ি। একসাথে একি রুমে ঘুমানোটা আপাতত ঠিক না৷ সেটা মায়াও হয়তো বুঝতে পেরেছে। তাই সে তার ভয়টাকে জয় করে আলাদা ঘুমানোটাকেই বেছে নিয়েছে।

পরদিন সকালে নয়টা নাগাদ আমার ঘুম ভাঙে। তাও মায়ের ফোন দেওয়ার জন্য। মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে বসলাম। মাকে জানিয়ে দিলাম যে আমি কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে যাতে অফিসের কাজ গুলো বাসায় বসে ঠান্ডা মাথায় শেষ করতে পারি। যেটা অনেকটাই সত্য। তাই মাকে মিথ্যাও বলা হয়নি আর সত্যটাও সে জানতে পারেনি। আমি আস্তে আস্তে উঠে আগে ফ্রেশ হওয়ার জন্য রুমের বাইরে আসতেই পুরো অবাক। মায়া রান্না ঘরে কি যেন করছে। আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে দেখি সে নাস্তা বানাচ্ছে। চুলাতে আলু ভাজি হচ্ছে আর সে রুটি বানাচ্ছে। রুটিগুলো বেশ সুন্দর গোলাকার হয়েছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– আপনি এত সকালে উঠে নাস্তা বানাচ্ছেন কেন? আমি তো বাইরে গিয়ে আনতামই।
~ বাইরের নাস্তা খেলে আপনার শরীর খারাপ হবে। আপনি তো সবসময় আপনার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে বের হন। আজ না হয় আমার হাতের রান্না খেলেন।
– আপনি না সেদিন বললেন আপনি রান্না পারেন না৷
~ সাথে তো এটাও বলেছিলাম যে একে বারে পারিনা তা না, পারি। তবে মশলা একটু কম বেশি হয়ে যায় এই আরকি। আল্লাহ ভরসা ঠিক হয়ে যাবে রান্না করতে করতে।

আমি মনে মনে খুশিই হলাম যে মায়ার হাতের রান্না খাবো। আমি হেসে বললাম,

– আপনি আসলেই একটা পাগলি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি৷
~ ঠিক আছে৷

আমি এরপর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি মায়া টেবিলে নাস্তা বেড়ে দিচ্ছে। আমি গিয়ে চেয়ারে বসলাম। মায়া আমাকে ভাজি আর রুটি বেড়ে দিল। আমি বললাম,

– আপনি বসবেন না?
~ আপনি খান তারপর আমি খাবোনি।
– না না এটা চলবে না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। একসাথে খাবো। নাহলে আমি খাবোই না৷
~ আপনিও না। আচ্ছা আসছি।

মায়াও দ্রুত গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আমার সাথে খেতে বসে। আজ জীবনে প্রথম মায়ের হাতের পর অন্যকোন প্রিয় মানুষের হাতের রান্না খেতে যাচ্ছি। মায়াও অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটুকরো রুটি ছিড়ে ভাজি নিয়ে মুখে দিলাম। কিছুটা খাবার পরই মায়া খেয়াল করে আমার মুখটা কেমন জানি হয়ে এসেছে। মায়া এই দৃশ্য দেখে খুব কষ্ট পায়। সে অসহায় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

~ ভালো হয়নি তাইনা? আমি জানতাম আমার দ্বারা রান্না হবে না৷ আমি কিছুই পারিনা।

আমি গম্ভীর কণ্ঠে তাকে বললাম….

চলবে…?