#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#শেষ_পর্ব
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
বিয়ে শেষ হতেই বর এশারের নামাজ পড়তে চলে গেল। ডক্টর হুমায়রা রিদ্ধিকে তার ঘরে নিয়ে গেল। রিদ্ধি রিহানকে ঘুম পাড়াচ্ছে। এই মুহূর্ত তার অনুভূতিটা অদ্ভুত! কারণ এমন অনুভূতি তার কখনো হয়নি। বলা চলে অসাড় হয়ে আছে ভেতর, বাহির। মাহিদের সাথে বিয়ের দিনটা মনে করতে চাইল সে। কিন্তু কিছুতেই সে দিনটি মনে কোনো সুখের স্মৃতি ভেসে ওঠল না। সে ভাবছে, “আচ্ছা মাহিদ কোথায় এখন? সে যদি জানে রিদ্ধির বিয়ে হয়ে গেছে সে কী করবে? ডিভোর্স পেপার তো সেই অনেক আগে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আইনত তারা স্বামী স্ত্রী না।”
ডক্টর হুমায়রা বললেন, “রিদ্ধিমা আমি নামাজ পড়ব। জায়নামাজ দিতে পারবে?”
রিহানের ঘুম এসে গেছে। রিদ্ধি ছেলের কপালে চুমু খেয়ে উঠে এসে জায়নামাজা বের করে হুমায়রাকে দিল। নিজেও অজু করে এসে নামাজে বসল।
নামাজ শেষ হতেই রিয়ন এসে তাকে খেতে ডাকল। খাওয়া শেষ করে মেহমান যেতে যেতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল। রিয়ন রিদ্ধিমার পছন্দের রজনীগন্ধা ফুলদানিতে রাখতেই পুরো ঘর মিষ্টি সুভাসে ভরে উঠল।
রিদ্ধি বাবা-মায়ের রুমে তাদের সামনে বসে আছে। বাবাকে সালাম করতে গিয়ে পা ধরে কাঁদতে লাগল। অস্ফুটস্বরে বলল, “আমি তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা-মা।”
হায়দার সাহেব মেয়েকে ধরে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “আমি তোকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি মা। তুই যত ভুলই করিস আমি কখনো তোর উপর রাগ করে থাকতে পারি বল? শুধু মনে রাখবি যে ভুল তোকে সঠিক পথে নিয়ে এসেছে। আল্লাহর রাস্তায় নিয়ে এসেছে। এই রাস্তায় যত বিপদই আসুক কখনো ধৈর্য হারাবি না। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সৎ পথে চললে ভালো ফলাফল পাবি।”
হায়দার সাহেব থামলেন মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “কখনো তোর করা ভুলের জন্য কষ্ট পাবি না। আল্লাহ মানুষের বর্তমানকে দেখেন। সে যদি অতীতে সব থেকে খারাপ মানুষও থাকে কিন্তু নিজের ভুল বুঝে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে, তওবা করে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। এবং তার উত্তম প্রতিদান দেন। মনে রাখবি বান্দা এমন পাপ করতে পারে না যার ক্ষমা আল্লাহ সুবানাল্লাহ তা’আলার কাছে নেই। তাই সবসময় সৎ থাকবি। যখন নিয়ত সৎ হয়। তখন রাস্তা আপনা-আপনি খুলে যায়।”
মা বললেন, “স্বামীর হক আদায় করা। তাকে সম্মান করাটাও তোর দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কখনো অতীতের অন্যের কর্মের জন্য বর্তমানে যে আছে তাকে অসম্মান করবি না। জীবন অনেক সুন্দর যদি সাজাতে জানিস।”
রিদ্ধি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের দোয়া আমার শক্তি। তোমরা শুধু আমার জন্য দোয়া করো।”
★★★
ডক্টর হুমায়রা রিদ্ধিকে নিয়ে তার রুমে গেলেন। বিছানায় বসে বললেন, “আমি জানি তুমি সবকিছু সামলে নেবে। তোমার ভেতরের পরিবর্তন তোমাকে সুখি করবে। রিদ্ধি তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। তোমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে আমার ভাই শাহান। সে তোমায় অনেক ভালোবাসে আশাকরি, তোমায় ভালো রাখবে।”
রিদ্ধিমা এক মুহূর্তের জন্য কিছুই বলতে পারল না। নিজেকে সামলে যখনই বলতে যাবে তখনই রিয়ন এসে হুমায়রাকে নিয়ে গেল। তারা চলে যাওয়ায় সে কিছুই বলতে পারেনি।
ভাবতে লাগল, “ডক্টর হুমায়রার ভাই আছে একবার বলেছিলেন। কিন্তু সে আমাকে কীভাবে চেনে! আমি তো কোনোদিন তাকে দেখিনি।”
তার ভাবনায় জল ঢেলে ঘরে তার বর দরজার সামনে এসে দরজার কপাটে আলতো করে টোকা দিয়ে অনুমতি চেয়ে বলল, “ভেতরে আসতে পারি?”
রিদ্ধি হতচকিত হয়ে বলল, “জি আসুন।”
সে বিছানায় দরজার বিপরীত দিকে মুখ করে বসেছে। তাই পেছন থেকে সে এসেছে বুঝতে পারল।
জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ভদ্রলোক এসে ডিভাইনের উপর বসেছে। রিদ্ধি ভাবল এভাবে বসে থাকলে হয়তো খারাপ ভাববে। তাই জড়তা কাটিয়ে সামনের দিকে ফিরে বলল, “আসসালামু আলাইকু-ম।”
শেষেরটা খুব আস্তে শোনাল। ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই তার চোখ কপালে উঠে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল।
ক্ষানিক পর অস্ফুটস্বরে বলল, “আ-আ-আপনি?”
ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি নিয়ে জবাব এলো, “জি, মিসেসঃ রিদ্ধিমা শাহানেওয়াজ শেখ। আপনি ঠিক দেখছেন এটা আমিই শাহানেওয়াজ শেখ।”
“আপনি এখানে কেন? আর আপনিই বা কোথায় ছিলেন এতদিন?”
“আগে আপনি শান্ত হয়ে বসুন।”
শাহানেওয়াজ সাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস এনে তার সেই রহস্যময় হাসিটা হেসে রিদ্ধির দিকে এগিয়ে ধরে বলল, “আগে পানিটুকু শেষ করুন। তারপর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।”
রিদ্ধি পানিটুকু শেষ করতেই। তার মুখোমুখি ডিভাইনে গিয়ে বসল শাহানেওয়াজ।
রিদ্ধির পুরো শরীর অসার মনে হচ্ছে। মন বা মস্তিষ্ক কিছুই কাজ করছে না। পৃথিবীতে কিছু মুহূর্ত আসে যখন চেয়েও অনেক কিছু বলা যায় না। রিদ্ধির মনে হচ্ছে সেটাই তার হয়েছে।
তার সদ্য বিয়ে হওয়া বর তাহলে এই মানুষটা! তবে বাবা কেন তাকে বললেন না। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। তার মুখ দেখে সামনে থাকা মানুষটা যেন সব বুঝে নিয়েছে।
তাই সে বলল, “আমি জানি আপনার মনে অনেক প্রশ্ন আছে। আমি সব বলছি। আপনি শান্ত হয়ে শুনুন।”
রিদ্ধিমা কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইল।
শাহানেওয়াজ বলল, “গল্পের শুরুটা তখন থেকে যখন আপনার বাবা বদলি হয়ে আপনাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের কাছাকাছি বাসায় আসেন। আমরা একসাথে স্কুলে যাই। আপনি আমার থেকে ছোট ছিলেন তাই নিজেকে আমি সবসময় আপনার কাছ থেকে আড়ালে রেখেছি। আপনার সাথে স্কুলে যাওয়া, খেলা সব আমার কাছে বন্ধুত্ব মনে হত। কিন্তু যখন আপনারা চলে আসেন, তখন আমি অনুভব করি আমি আপনার জন্য এমন কিছু আছে যা বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে অনেকটা সময় চলে যায়। আমি জানি এসব আপনি জানেন। কারণ আমার ডায়েরিটা আপনি পড়েছেন। কিন্তু যা জানেন না তা হচ্ছে।
মাহিদ আমার বোন হুমায়রার দেবর। রাহিদকে বিশ্বাস করে যখন আপু ঠকে যায়। তখন আমরা তাকে পুলিশে দেই। আপুর ভালো জায়গায় বিয়ে হয়। এসব কিছুতে আমার ভুমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই তো মাহিদ তার ভাইয়ের জেলে যাওয়ার প্রতিশোধ আমার থেকে নেয়ার জন্য আমার কাছাকাছির বাসায় এসে উঠে। সে-বার ভাগ্য তার সহায়ও ছিল। আমি অসুস্থ হলে তাকে পাঠাই আপনার কাছে চিঠি নিয়ে। সে এতদিন খুঁজেছিল আমার দূর্বলতা কোথায়। চিঠি পড়ে সেই মোক্ষম অস্ত্র সে হাতে পেয়ে গেল।
তাই এক মুহূর্ত দেরি না করে এটাকে কাজে লাগাতে লাগল। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে আমার কাছ থেকে দূরে করে আমাকে কষ্ট দেয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আমি ট্রেনিং থেকে এসে যখন শুনি আপনার বিয়ে হয়ে গেছে। তখন পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গিয়ে ছিল।
অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু যখন জানলাম এসব কিছু মাহিদের নাটক। আপনাকে সে শুধু ব্যবহার করছে তাও আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য। তখন নিজেকে বুঝাতে পারলাম না। আপনার উপর নজর রাখতে গিয়ে আমি সব জেনে যাই। তাই তো সেই রাতে আপনাকে জাহান্নাম থেকে বাসায় নিয়ে আসি। এরপর সবকিছু আপনি জানলেও কিছু বিষয় জানতেন না। তা হচ্ছে আপনার বাবাকে আমি সব জানাই। আপনাকে বাসায় পাঠাতে বলি। কিন্তু তিনি আমায় বললেন আগে আপনাকে জিজ্ঞেস করতে আপনি কি চান।
যখন জানলাম আপনার ইচ্ছে নেই বাসায় যাওয়ার তখন আমরা দুজনে আলোচনা করে ঠিক করলাম আপনার দেখাশোনা আমার বাসায় রেখেই করব। সবকিছু হুমায়রা আপুকে জানাই। তিনি আপনার বিষয়ে সবকিছু হ্যান্ডেল করতে পারবেন বলে আমরা মনে করতাম। কারণ তিনিও এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন। তাছাড়া আপু একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।
আপনার প্রতি আমার নজর সবসময় ছিল। প্রায় নাফিসার কাছে শুনতাম আপনি সবসময় মন খারাপ করে বসে আছেন। ভাবলাম আপনার ভেতরের শান্তি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। তাই তো কুরআন শরীফ উপহার পাঠালাম। যাতে আপনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর এখান থেকেই পেয়ে যান। হলোও তাই। আপনি ধীরে ধীরে আল্লাহর পথে চলে আসছেন দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগত। আপনার প্রতি সম্মান আরও বেড়ে গেল। তারপর আপুর কাছে আপনার জন্য বোরখা পাঠালাম। প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি পরবেন না। তারপর মনে হলো পরবেন। তাই তো আপনাকে পর্দা করতে দেখতে আমি এবং আপনার বাবা দুজনেই বেশ খুশি ছিলাম। আপনাকে প্রায় তিনি দেখে যেতেন। এই পর্যন্ত যতবার আপনি হাসপাতালে গিয়েছেন। আমরা দুজনও গিয়েছি। আড়াল থেকে আপনাকে দেখেছি।
আপনার জন্য বাবা অনেক কেঁদেছেন। তিনি সহ্য করতে পারতেন না আপনার এমন চুপ থাকা, কষ্টে থাকা। আমি বারবার বলেছি আপনার সামনে যেতে কিন্তু তিনি জানালেন তার মেয়ে এখন যে অবস্থায় আছে তার থেকেও খারাপ অবস্থা হয়ে যাবে। যখন সে আমাদের সামনে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। আর এই কষ্ট আমি আমার মেয়েকে দিতে চাই না। যখন সে মেন্টালি স্ট্যাবল হয়ে যাবে। তখনই তার সাথে দেখা হবে।
বাবার কথা আমি মেনে নিলাম। যেদিন আপনার লেবার পেইন উঠে সেদিন বাবা হাসপাতালে ছটফট করেছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলেন, “আমার দুই ছেলে যদি আমার দুই চোখ হয়। আমার মেয়ে আমার হৃদপিণ্ড। দুই চোখ ছাড়া তো আমি বাঁচতে পারব। কিন্তু হৃদপিণ্ড না থাকলে আমি মরে যাব।”
সেদিন এই একটি বাক্য আমার বুকে তীরের বাণের মতো এসে লেগেছিল। আপনাকে আমি হিংসা করতে চাইছিলাম। আপনাকে কেউ এত ভালোবাসে অথচ আপনি নিজেকে অপরাধী ভেবে সবকিছু থেকে দূরে রেখে দিয়েছেন। আমি চাইলেও আপনাকে এসব বলতে পারতাম না। আমার বলতে ইচ্ছে করত আআপনার কোনো দোষ নেই রিদ্ধিমা। আপনার ভুল হলো এটাই আপনি বিশ্বাস করেছিলেন। আর সেই বিশ্বাসই আপনাকে অন্যের শিকার বানিয়ে দিল।
আপনি যতক্ষণ অজ্ঞান ছিলেন বাবা রিহানকে কোলে নিয়ে থেকেছেন। একটু হেসেছেন, আবার কেঁদেছেন। রিহানকে কোলে নিয়ে তিনি পাগলের মতো বলছিলেন, “আমার রিদ্ধির অংশ ও। আমার রিদ্ধির রক্ত।”
তিনি শুধু কেঁদেই গেছেন। এই প্রথম আমি উনাকে এত কাঁদতে দেখেছি। ”
রিদ্ধির দৃষ্টিতে নিচের দিকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। দুই হাত মুষ্টি বদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
শাহানেওয়াজ সেটা খেয়াল করে আবার বলতে লাগল,
“বিশ্বাস করা কোনো ক্রাইম না। কেউ যদি বিশ্বাসকারিকে ঠকায় সেটাই ক্রাইম। কিন্তু আমার চোখের সামনে নিজেকে অপরাধী ভেবে আপনি যেভাবে ভেঙে পড়ছিলেন। আমার সহ্য হচ্ছিল না। তাই তো আমার অপারেশনের যাওয়ার আগের দিন বাবাকে সব জানাই। আমরা যারা আর্মিতে আছি। তারা যখন ঘর থেকে কোনো গুপ্ত অপারেশনের জন্য যাই। তখন এটা ভেবেই যাই যে, হয়তো আমরা আর ফিরব না। তাই তো প্রিয়জনদের সব জানাতে ভয় পাই।
বাবাকে বললাম আমি হয়তো নাও ফিরতে পারি। তাই
এবার আপনার দ্বায়িত্ব আপনাকে বুঝে দিতে চাই। রিহানকে ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। যতদিন আর্মিতে জয়েন হয়েছি তার মধ্যে যতবার কোনো অপারেশনে গিয়েছি কখনো আমার এত কষ্ট হয়নি। কোনো পিছুটান আছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু এবার সেটাই মনে হলো। এই এক বছরে আমার মনে হয়েছিল আপনারা দুজন আমার সংসার হয়ে গেছেন। আমার সংসার ছেড়ে আমি কী করে যাই বলেন। কিন্তু যেতে তো হবেই। গেলামও কিন্তু আমার ভয়টাই সঠিক হলো শেষ মুহূর্তে এসে শত্রুদের একটা বুলেট এসে আমার পায়ে লাগে। ভাগ্য ভালো নাকি আপনার দোয়া জানি না আমার তেমন কোনো ক্ষতি হলো না। হ্যাঁ মাসখানেক হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। কিন্তু বেঁচে তো গেলাম আল্লাহর রহমতে।
রিদ্ধি চমক লাগা চোখে তার দিকে তাকাল। ভাবল, “এই লোক কীভাবে জানেন আমি তার জন্য দোয়া করেছি!”
রিদ্ধির মনের কথা যেন সে বুঝে গেল। হেসে বলল, “আপনি সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিলেন আমি যখন গাড়িতে উঠছিলাম। তখন কেন যেন মনে হলো আপনি আমার কিছু হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন।”
কথাটা বলতেই রিদ্ধি তার দিকে তাকাল। শাহানেওয়াজও রিদ্ধির দিকে তাকাল। এই প্রথম দুজনের চোখাচোখি কিছুটা সময় নিল।
সে দেখল টেবিল ল্যাম্পের মোলায়েম হলুদ আলোর খানিকটা তির্যকভাবে রিদ্ধির চোখে ও মুখের উপর এসে আলোকিত করছে। সেই আলোয় তাকে অন্ধকার আকাশের একমাত্র ধ্রুব তারার মতো দেখাচ্ছে। পবিত্র , নিষ্পাপ, একেবারে নিষ্কলংক। যেন তার ছোয়ায় ধরনীর সমস্ত কলংক এক নিমিষেই ধুয়েমুছে পবিত্র হয়ে যাবে। সে ভাবল মেয়েটাকে কীসের সাথে তুলনা করা যায় চাঁদের সাথে? কিন্তু ও তো চাঁদের থেকেও পবিত্র, স্নিগ্ধ।
রিদ্ধি খেয়াল করল চশমার কাচের ভেতর থেকে দুটো মায়া-মায়া চোখ তাকে দেখছে। সেই চোখে গভীরতা সে জানে না। শুধু জানে এই গভীরতা মাপার কোনো যন্ত্র কোনো বিজ্ঞানী কোনোদিন আবিষ্কার করতে পারবে না। তাহলে তার কী সাধ্যি তা বের করে!
কিছু রহস্য অজানা থাকাই বোধহয় ভালো। সারাজীবন সেই রহস্য খুঁজে বেড়ানোর মধ্যেও আনন্দ আছে। রহস্যের মায়ায় নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়ায় যে সুখ তা বোধকরি আর কিছুতেই নেই। কিছু রহস্যে আজীবন বিচরণ করতে ইচ্ছে করে।
রিদ্ধি বলল, “আমি জানতাম না আমাকে চিঠি দেয়া সেই মানুষটা আপনি। আমার জীবন কী অদ্ভুত দেখেছেন। কাকে ভেবে কাকে ভালোবেসেছি।”
শাহান বলল, “আপনি আমাকেই ভালোবেসেছেন রিদ্ধিমা। আপনি যে চিঠির প্রেমে পড়েছিলেন তা শুধু আমার ছিল। মাঝখানে সবকিছু ভুল বুঝাবুঝি ছিল। একটা পরীক্ষা ছিল। আপনি শুধু আমার ছিলেন বলেই এখনো আমারই আছেন।”
“জানেন আমি আমার জীবনে কোনো পূণ্য করেছি তাই আপনি আমার পথচলার সঙ্গী হলেন।”
শাহান হাসল। উঠে ধীরে ধীরে রিদ্ধির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রিদ্ধিও উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, “কিন্তু মিঃ শাহানেওয়াজ শেখ আপনার নাম কী শাহান?”
“জি। মিসেস আমার ইয়া বড় নামটা আপনি ছাড়া কেউ ডাকে না। তাই সবাই ছোট্ট করে শাহান ডাকে। বন্ধু মহলে পরিবারের বড়রা আমাকে শাহান বলেই ডাকে।” কথা বলে সে হাসল।
রিদ্ধিও হাসল বলল, “আপনি সিক্রেট এজেন্সিতে যোগ না দিয়ে আর্মিতে কেন দিলেন? স্পাই হিসেবে আপনি জবরদস্ত কাজ করতে পারবেন।”
শাহান আবারও হাসল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, “এই বিয়েতে আপনি খুশি তো?”
“আমি আমার ভাগ্য আল্লাহ তা’আলার উপর ছেড়ে দিয়েছি। তিনি আমায় আপনার কাছে এনেছেন মানে এটাই আমার জন্য, আমার সন্তানের জন্য ভালো তাই অখুশি হওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
“কিন্তু, মিসেস রিদ্ধিমা শেখ। আর অল্পের জন্য আমার প্রাণটাই নিয়ে নিতেন আপনি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে কখনো যাবেন না। একবার সহ্য করে নিয়েছি। আর একবার হলে মরেই যাব।”
রিদ্ধি বলল, ” তো মিঃ শাহানেওয়াজ শেখ! এত স্ট্রং পার্সোনালিটির মানুষও কারো জন্য মরতে পারে তাহলে?”
রিদ্ধর কপালের টিকলিটা সোজা করে দিয়ে সে বলল, “একদম ম্যাডাম। আপনি আর আমার ছেলে আমার পাশে থাকলে আমি পৃথিবী জয় করতে পারব।”
‘আমার ছেলে!’ এই শব্দটা রিদ্ধির বুকে গিয়ে লাগল। কেউ এত সহজে কী করে অন্যের সন্তানকে নিজের বলে ভাবতে পারে! আল্লাহ তা’আলা যা নেন তার থেকে হাজার গুণ বুঝি এভাবেই ফিরিয়ে দেন?
তাকে আনমনা দেখে শাহান তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “হ্যালো ম্যাডাম কোথায় হারিয়ে গেলেন। চলুন আজ আপনার সাথে একটা ডিল করি।”
রিদ্ধির কপাল কুঞ্চিত হলো। সে বলল, “ডিল?”
“ইয়েস! ডিল। আপনার অনুমতি থাকলে বসে আলাপ করতে পারি?”
“নিশ্চয়ই।”
দুজনে ডিভাইনের উপর মুখোমুখি পাশাপাশি বসল। দুজনের মাঝখানে দূরত্ব একটুখানি। চুপ করে থাকলে এই নির্জন রাতে নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় এমন।
শাহান বলল, “পৃথিবীর সব সম্পর্কে টানাপোড়েন আসে। একসাথে থাকতে গেলে দুজন আলাদা মানুষের আলাদা-আলাদা মতামত থাকতে পারে। আমাদের মধ্যেও এমনটা হতে পারে। তাই এসব বিষয়ে আমরা আগে থেকে একটা রুলস করে নেব। যাই হয়ে যাক আমরা কেউ কাউকে ভুল বুঝব না। আমি কখনো তোমায় কষ্ট দেব না। প্রতিটি সম্পর্ক একটা গাছের মতো। গাছ থেকে ফলের আশা করলে যেমন সঠিক পরিচর্যা করতে হয়। পরিমাণ মতো পানি দিতে হয়, মাটি দিতে হয়, অতিরিক্ত রোদ, বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে হয়। নয়তো গাছ কখনোই ছায়া দেয় না, ফল দেয় না। সেটা অযত্নে-অবহেলায় নষ্ট হয়ে যায়। সম্পর্কও ঠিক এমন।
এই পৃথিবীতে বাবা-মায়ের পর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। যেখানে তিন কবুল বলার সাথে সাথে একজন অন্যজনকে তার জীবনের সব ভালো-মন্দের ভার দিয়ে দেয়। যেখানে কোনো আলাদা আব্রু থাকে না। কোনো আড়াল থাকে না। দুজন-দুজনের কাছে খোলা বইয়ের মতোন।
ঠিক সেই সম্পর্ককে বেশিরভাগ সময় অবহেলায় ফেলে রাখা হয়। এই সম্পর্ক নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয়। যদি একটা গাছের মতো সম্পর্ককেও যত্ন না করা হয় তবে একটা সময় তা তো শেষ হয়ে যাবেই। মানুষ যার যত্ন করে না তার নিচে ছায়া পাবে এটা কীভাবে ভাবে আমি জানি না। আমি কখনো চাই না আমাদের সম্পর্ক তেমনটা হোক। যদি কোনোদিন চলতে চলতে আমার উপর তোমার ক্ষোভ আসে। আমার কোনো ব্যবহার তোমায় কষ্ট দেয় তবে রাগ করে না থেকে আমায় সরাসরি বলবে। আমি নিজেকে শুধরে নেব। কখনো মনের ভেতর সেটা চেপে রাখবে না। যদি আমরা কেউ কারো উপর নারাজ হয়েও তা আড়াল করি। তা মনের ভেতর ফুলেফেঁপে বড় হতে থাকবে। আর এই বড় হওয়াটাই ঘুন পোকার মতো সম্পর্ককে ভেতর থেকে শেষ করে দেবে। তাই আমাদের সম্পর্কে আমরা কখনো নেগেটিভিটি নিয়ে আসব না।
সম্পর্ক খাওয়া, পরার অভাবে কখনো নষ্ট হয় না। সম্পর্ক নষ্ট হয় মনের ভাব প্রকাশের অভাবে। মনের কথা খুলে না বললেই কেবল সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। মানুষ প্রায় বলে সম্পর্কের বয়স বাড়লে নাকি ভালোবাসা থাকে না। শুধু দায়বদ্ধতা থাকে।
রিদ্ধিমা আমি চাই না আমাদের সম্পর্ক কখনো এমন হোক। কেন একটা সম্পর্কে শুধু দায়বদ্ধতা থাকবে! কী হয় যদি আমরা নিজেদের কাছের মানুষদের প্রতিদিন অন্তত একবার কাঁধে হাত রেখে বলি, “তুমি আমার জীবনে আসায় আমার জীবনটা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে।”
কী হয় যদি বলি, “আমি তোমাকে দায়বদ্ধতায় নয়, ভালোবাসায় আটকে রাখতে চাই।”
কী হয় যদি সপ্তাহে একবার বলি, “চল আজ টংয়ের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি।”
কী হয় যদি বলি, “তুমি পাশে আছো বলে আমি আজও ভালো আছি, সুখে আছি।”
রিদ্ধিমা এই কথাগুলো বলতে কী খুব বেশি সময় লাগে? খুব কষ্ট হয়? খুব ক্ষতি হয়ে যায়? তাহলে মানুষ কেন বলে না।
আজ এত কেজি আটা লাগবে, আলু, তারকারি মাছ লাগবে এসব লিস্টের ভিড়ে কেন ভালোবাসাগুলো হারিয়ে যায়। কেন প্রতি মাসে অন্তত একটা এমন লিস্ট হয় না। যে লিস্টে লিখা থাকবে আজকের দিনটা আমি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, শুধু তোমার সাথেই সময় কাটাতে চাই।”
জীবন কখনো এত কঠিন না। আমরা শুধু শুধু ইগু, অহংকার দিয়ে তাকে কঠিন করে ফেলি। আমরা চাইলে সবকিছু সুন্দর রাখতে পারি। আসলে মানুষ ভুলে যায় যে, শুধু ব্যবসায়ে না। সম্পর্কেও ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন আছে। বরং ব্যবসায়ের চেয়েও অনেক গুণ বেশি ইনভেস্টমেন্ট সম্পর্কে প্রয়োজন। আর এই টুকরো টুকরো অনুভব গুলোই সম্পর্কের ইনভেস্টমেন্ট। আমি সবসময় চেষ্টা করব এমনভাবেই আমাদের সম্পর্ককে সুন্দর রাখতে।
তারপরও যদি কোনোদিন আমার পক্ষ থেকে ভুল হয়ে যায় প্লিজ তুমি আমাকে বকবে, অভিযোগ করবে কিন্তু, চুপ করে থাকবে না। আর বাকি সবকিছুর দায়িত্ব আমার। বুঝলেন ম্যাডাম?”
রিদ্ধি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার সামনে বসা মানুষটির কথা শুনছে। বছর খানেক আগে তার জীবনে এমন একটা রাত এসেছিল। সে রাত নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল কিন্তু, সেসব স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিল। সে মানুষটাকে নিয়ে তার মনে অনেক আশা ছিল তার সব আশায় সে গুড়ে বালি পড়েছিল। লাঞ্চনা, অপমানই কপালে জুটেছিল। কিন্তু, এই মানুষটা! একে সে জানতো না। কাত সাথে বিয়ে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত জানা ছিল না। যার উপর কোনো আশা ছিল না। সে এত সুন্দর করে। এতটা ভালোবেসে, এতটা মায়া দিয়ে সব বলে যাচ্ছে। যেন আকাশ থেকে টুক করে কোনো মহাপুরুষ তার জীবনে প্রবেশ করেছে। কালে কালে কবি-সাহিত্যিকরা কী তবে এনাদের মহাপুরুষ বলে গেছেন। তাদের কাছে মহাপুরুষের সংজ্ঞা কী এমনটাই!
আল্লাহ সুবানাল্লাহ তা’আলা যা নিয়ে যান তার থেকে হাজার গুণ বুঝি এভাবেই ফিরিয়ে দেন? আমার আল্লাহ আমাকে এত ভালোবাসেন। তাই তো আমাকে এমন কারো হাতে তুলে দেননি যে আমার জন্য ক্ষতিকর হবে।
শাহান ভ্রু উঁচিয়ে রিদ্ধির চোখের সামনে তুড়ি মেরে বলল, “কোথায় চলে গেছেন ম্যাডাম?”
“জান্নাতে।” অসচেতন অবস্থায় রিদ্ধির মুখ থেকে শব্দটা বের হয়ে আসল।
শাহানের চোখের গভীরতা, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা আরও গভীর হলো।
তৎক্ষনাৎ হাসিটা চওড়া করে বলল, “জান্নাত কেমন আমি জানি না রিদ্ধিমা। কিন্তু তোমায় কথা দিচ্ছি আমাদের জীবন আমি জান্নাত বানানোর চেষ্টা করব।”
রিদ্ধি হেসে বলল, “চলুন নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই।”
শাহান হেসে উঠে দাঁড়াল। দুজনে অজু করে এসে জানামাজে বসেছে। শাহান একটু আগে, রিদ্ধি একটু পেছনে। পৃথিবীর বুকে এমন দৃশ্যগুলো সব থেকে সুন্দর। আল্লাহর কাছে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মাঝে যে আনন্দ আছে তা আর কোথাও নেই।
রিদ্ধি মোনাজাতের জন্য হাত তুলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কতকিছু বলার ছিল কিন্তু একটা বাক্য বলে আর কিছু বলতে পারল না। সেই একটা বাক্য হলো, “হে! আমার সৃষ্টিকর্তা! আপনি আমাকে মা খাদিজা (রাঃ) এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মধ্যে যেমন ভালোবাসা ছিল, তেমন ভালোবাসা তৈরি করে দিন। আমি যেন সর্বদা, সব অবস্থায় আমার স্বামীর পাশে থাকতে পারি তার তৌফিক দিন।”
শাহান বলল, “ইয়া, রাহমানির রাহিম! আমার এত বছরের অপেক্ষার ফল আপনি আমায় এত বেশি দিয়েছেন যে আমার মতো সামান্য মানুষ তার যোগ্য না। আমি আপনার দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া জানাই। আমি যেন আমার স্ত্রী-সন্তানকে যথাযথ সম্মান দিতে পারি। ভালোবেসে আগলে রাখতে পারি। সবকিছুর জন্য শোকর আলহামদুলিল্লাহ।”
নামাজ শেষে দুজন বিছানার গিয়ে বসল। শাহান রিহানের কপালে চুমু খেল।
রিদ্ধি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি না জেনে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তার জন্য ক্ষমা করে দিন।”
শাহান তার কাছে এসে মুখখানা দু’হাতে আঁজলা ভরে ধরে বলল, “তুমি আমার জীবন পরিপূর্ণ করেছো। আমার এত বছরের অপেক্ষার আসলের সাথে সুদও বুঝিয়ে দেবে তাহলেই হবে।”
রিদ্ধি তার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। ও-ই চোখে কী মায়া সমুদ্রের গভীরতা। স্বামীর বুকে মুখ লুকাল।
★★★
এক মাস পর।
শাহান বাজারে যাচ্ছে। রিদ্ধি বাজারের লিস্ট করে তার হাতে দিয়েছে। ঘণ্টা খানেক পর খালি হাতে ফিরল সে। রিদ্ধি কোমরে আঁচল বেঁধে হাতে খুন্তি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলল, “কী ব্যাপার মিঃ শাহানেওয়াজ শেখ। বাজার কোথায়?”
শাহান তার কাছে এসে। রিদ্ধির মুখের উপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুলগুলোতে ফুঁ দিয়ে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “আপনার সামনেই তো হাজির। আজকের বাজারের লিস্টে আপনি আমাকে চেয়েছেন।”
রিদ্ধি খুন্তি দিয়ে শাহানের পেটে খোঁচা মারল, শাহান পেটে হাত দিয়ে একটু দূরে সরে আসতেই রিদ্ধি হাসতে হাসতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
শাহান রিহানের দোলনার কাছে গিয়ে বলল, “তোমার মা খুব পঁচা বাবাকে মেরেছে। তুমি একটু বকে দিয়ো তো। হঠাৎ শাহানের ফোন বেজে উঠল।
ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে একটা মেয়ে বলল সে রিদ্ধির বান্ধবী কথা বলতে চায়। শাহান রিদ্ধির কাছে ফোন নিয়ে গেল।
রিদ্ধির হাতে মাছ তাই সে বলল, ” লাউডে দিয়ে ধর।”
সালাম দিতেই ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি গলা ভেসে এলো।, “রিদ্ধি আমি মাহিদ। প্লিজ কল কেটো না। শুধু দুই মিনিট কথা বলব।”
রিদ্ধি শাহানের দিকে তাকাতেইন্সে সম্মতি দিল।
মাহিদ বলল, “রিদ্ধি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমার ভাইয়ের অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তাই তো শাস্তি পাচ্ছি। আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। লাস্ট স্টেজে আছি। তুমি আমায় ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাব না। আমার একটা অনুরোধ আমার ছেলেকে শুধু একটিবার আমাকে দেখতে দাও। তাকে কোনোদিন বলো না তার বাবা কে ছিল। সে জানলে আমাকে ঘৃণা করবে। যা আমি কবরে গিয়েও সইতে পারব না।”
রিদ্ধি অনেক কষ্টে বলল, “ক্ষমা করে দিলাম।”
শাহান জানাল তাকে যেন হাসপাতালের ঠিকানা ম্যাসেজ করে দেয়। তারা রিহানকে নিয়ে যাবে।
রিদ্ধি বারণ করল। শাহান বলল, “আল্লাহ ছাড় দেন। ছেড়ে দেন না। তোমার কাছে যখন এত বড় সুযোগ এসেছে তাকে ক্ষমা করে দেয়ার তুমি অবশ্যই তা করো। আমাদের নবী করিম সাঃ সবাইকে ক্ষমা করে দিতেন।
রিদ্ধি বলল, ” ঠিক আছে।”
শীতের রাতে ঘুম আসছিল না। তাই সে বারান্দায় এসে বসল। শাহান তার পেছনে কম্বল নিয়ে এসে রিদ্ধির পাশে বসে দুজনের গায়ে কম্বল দিয়ে মুড়ে দিল। রিদ্ধি হেসে বলল, “পাগল।”
শাহান বলল, “হু, পাগল। সেটা শুধু তোমার জন্য।”
রিদ্ধি বলল, “আচ্ছা, ভালোবাসার দুটো পিঠের একটিতে যদি ভালোবাসা থাকে, অপরটিতে কী থাকে?”
শাহান বলল, “ক্ষমা।”
রিদ্ধি অবাক হয়ে বলল, “ঘৃণা নয় কেন?”
“কারণ যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো ঘৃণা করা যায় না।”
রিদ্ধি বলল, “আমি আপনাকে আগে কখনো বলিনি। কিন্তু আজ একটা কথা বলতে চাই।”
“কী?”
“আমি আপনাকে আপনার চাইতেও বেশি ভালোবাসি মিঃ শাহানেওয়াজ শেখ।”
“আমি তোমাকে আমার নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি মিসেসঃ শেখ।”
দুজনেই হাসল। মৃদু নীলাভ আলোয় বারান্দাটা স্বপ্নাতুর হয়ে আছে। সেই স্বপ্নের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে দুটো প্রাণ। যারা জানে তাদের ভালোবাসা আজীবন এমন অমর থাকবে। ভালোবাসায় একে অপরকে বেঁধে রাখবে সারাজীবন।
সমাপ্ত।