ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
870

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(১৩)

পাঁজাকোলা করে ফাহাদ কে নিয়ে প্রস্থান করে ছেলে পক্ষ রা। ফাহাদ বলে,
‘ বাবা লাবিবাকে আটকে রাখলেই তো হলো। আপনি চলে আসলেন কেনো?’
‘ সে কথা তো আমিও ভাবছি ব্যাটা। একটা কথার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলি না কিভাবে সবগুলো জেঁকে ধরলো ঐ মেয়েকে বিয়ে করিয়ে আনলে জামেলাই হবে শুধু শান্তি পাবি না। ‘
‘ আপনি পঁচিশ লাখে স্বীকার করলেই তো হতো। এতো ঝামেলা এখন আর হতো না। ‘
‘ আমিও তো উঠে আসতে চাইনাই। ভাবছি ইসমাইল চুপসে যাবে কিন্তু এ তো মেয়ের জন্য এক চুল ও ছাড় দিতে রাজী না। তবে যা হয়ছে ভালোই হয়ছে। তোকে কিভাবে বলি বাবা! এতো খোঁজ খবর নেবার পরেও যে ঐ মেয়ের আসল রুপ ধরতে পারবোনা এটা তো বুঝি নাই। ছবি গুলো যদি থাকতো তোকে দেখাতে পারতাম।’
‘ আমি সব জানি বাবা। তবুও আমার লাবিবাকে চাই বাবা। ওকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবোনা। ‘
‘ কোথায় যাস? বাড়ি থেকে এক পাও বের হবিনা।’
‘ লাবিবাকে বিয়ে করেই ফিরবো। এর আগে না। ‘
‘ ঐ সুবোল ওরে আটকা। বাড়ির বাইরে যেনো যেতে পারে না।’
‘ না সুবোল কাকা। আমাকে আটকাবে না। ‘
সুবোল কথা শুনে না। ভাতিজাকে ধরে ফেলে। যে বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে ফিরেছে সেই বাড়িতে বংশের কাউকেই পা রাখতে দিবে না।

ইসমাইল কে হসপিটালাইজড করা হয়েছে। অপ্রত্যাশিত ঘটনা মেনে নিতে পারেনি আর। কত শখ করে বড় বাড়িতে আয়োজন করে বিয়ে টা পরিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলো শেষে কিনা বিয়েটা ভেঙে গেলো। তার ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটার গায়ে কলঙ্ক ছড়িয়ে দিলো! এতো বড় ভুল করতে যাচ্ছিলো। ভালোমানুষীর মুখোশ পড়া লোককে চিনতে পারেনি।
অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাউমাউ করে কাঁদছেন সাবিনা বেগম। জা রা তাকে সামলাচ্ছেন। ইসমাইলের ভাইরা ইসমাইল কে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। ঘটনা শুনে নিতু ইসলাম ও এসেছেন। তামিম ও বাদ যায়নি। নিতু এসেই লাবিবাকে খুঁজছেন। বাপ ভক্ত মেয়ে, ঠিক আছে তো! লাবিবাকে খুঁজে পেয়েও যান। বাবাকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেই কেবিনে ফ্লোরে গুটি শুটি হয়ে ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে আছে লাবিবা। কেবিনে পেশেন্ট ব্যতীত অন্য কেউ নেই সে ছাড়া। হাতের ভাজে মুখ গুঁজে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নিতু ইসলাম পারমিশন নিয়ে কেবিনে ঢুকে। লাবিবার কাছে গিয়ে লাবিবার কাঁধে হাত রাখতেই লাবিবা ফিরে নিতু ইসলাম কে দেখে আর কান্না আটকে রাখতে পারেনা। নিতু ইসলামের বুকে মাথা রেখে চিপে চিপে কাঁদে। একদম শব্দ করে কাঁদে না। যাতে বাবার অসুবিধা না হয়। নিতু ইসলাম শান্তনা দিতে থাকে। কিই বা বোঝাবে মেয়েটাকে? বিয়ে ভাঙা তার উপর বাবা হসপিটালে কম কষ্ট সহ্য করছে মেয়েটা? লাবিবা নাক টানে। বুকে মুখ গুজেই বলে,
‘ আমার জন্য হয়েছে সব। আমিই দোষী। আমার জন্য আব্বু এখানে শুয়ে আছে। ‘
‘ না মা। এসব ভেবো না। আব্বু ঠিক হয়ে যাবে। তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ঐ ছোট লোক গুলোর। ‘
‘ আমি ই আমার আব্বু এখানে এনেছি। আমার জন্য ই হয়েছে এসব। সব এই বিয়ের জন্য। আমি জীবনেও বিয়ে করবো না। ‘

লাবিবাকে নিয়ে বাইরে চলে আসে নিতু ইসলাম। আজ মেয়েটার বিয়ে হবার কথা ছিলো। সাদা লালে কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে চেহারা ভয়ঙ্কর বানিয়ে ফেলেছে। দোপাট্টা টা ফ্লোরের উপর গড়িয়ে যাচ্ছে। সীতা হারের চাক টাও উল্টে গেছে। নিতু সোজা করে দেয়। ‌ওয়েট টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দেয়। ম্যাট লিপস্টিক এর জন্য তুলতে পারেনা। সাদা মাটা একটা সিগ্ধ বউ লাগছে। লাবিবা উঠে দাঁড়ায়।
‘ আমি বাসায় যাচ্ছি। ‘
কলিজা কেঁপে উঠে সাবিনার। ঝাঁপ দিয়ে হাত চেপে ধরে। আতঙ্কিত গলায় বলে,
‘ কোথাও যাবিনা। এখানেই থাক। আমার সামনে। ‘
‘ তুমি থাকো তোমার জামাইয়ের কাছে। আমি থাকছি না আর এখানে। ‘
‘ তোর আব্বু হসপিটালে শুয়ে আছে এখনো জেদ দেখিয়ে যাবি?’
‘ কে জেদ দেখায়? আমি না তোমরা? আমি বলেছিলাম আমাকে বিয়ে দাও? পছন্দ করে এনেছিলাম তোমাদের দ্যা গ্ৰেট ফাহাদ কে? নাকি বলেছিলাম অসুস্থ হয়ে হসপিটালে আসতে? ‘
রাগে লাবিবার শরীর থরথর করে কাঁপছে। সাবিনা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে মেয়েকে।
‘ কোথাও যাবিনা। এখানেই থাক। আমার সামনে থাক। আমার ভয় হয় মা। তোকে ছাড়া যে আমরা বাঁচবো না।’

পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। হাতেও এসেছে সকল রিপোর্ট। তানভীর এতো সময় হসপিটালে ছিলো না। জ্ঞান ফেরার পর পর ই তানভীরকে দেখা যায়। এক পলক লাবিবার দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি গিয়ে ইসমাইলের কেবিনে ঢুকে। পেছন পেছন তামিম ও যায়। তামিমকে জিজ্ঞেস করতেই হালকা ভাবে বলে,
‘ আমি রিপোর্ট চেক করেছি। আঙ্কেলের তেমন কিছুই হয়নি। সামান্য একটা এট্যাক। বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। টেনশন করবেন না।‌’
কিছুক্ষণ পর কেবিন থেকে তামিম মাথা বের করে। নিতু ইসলামকে বলে,
‘ খালামনি। আসো তো। ‘
নিতু ইসলাম সাবিনার মুখ পানে চায়। লাবিবা উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। ব্যাগটা কাঁধে তুলে কেবিনে যায়। পর পর লাবিবার দুই কাকাও গিয়ে ঢুকে। সাবিনার বুক ভার হয়ে আসছে। ছোট জা কে বলে,
‘ আমাকে একটু দেখা করে আসতে দাও তোমার ভাইয়ের সাথে। ছোট কে ডাকো। বলো ভাবী যেতে চায়। ‘
‘ সবাই ভেতরে কি করছে ভাবী? বুঝতে পারছিনা। ‘
কিছুক্ষণ বাদেই ডাক পড়ে তাদের। লাবিবা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। দৃঢ কিন্তু কাপা কন্ঠে জেদ ধরে,
‘ তোমরা যাও। আমি আব্বুর কাছে যাবো না। ‘
‘ জেদ করেনা লাবি মা। আব্বু তোমাকে ডাকছে। আব্বু কাঁদবে তো। আব্বু তোমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। আর কষ্ট দিও না। ‘
‘ এতোক্ষনে কেনো ডাকে? সবার শেষে আমার কথা মনে পড়েছে। ‘
অভিমানে ঠোঁট ভেঙে আসে লাবিবার।

কেবিনের ভেতরে গিয়েই থ হয়ে যায়। সবার দৃষ্টি লাবিবার দিকে। ইসমাইল আধ শোয়া। হাতে স্যালাইন খোলা হয়েছে। ঐ হাতেই ইশারা করে কাছে যেতে। লাবিবা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে কাছে যায়। শিয়রের পাশেই এক পা তুলে বসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হো হো করে কেঁদে উঠে। ইসমাইল ও মেয়েকে দু বাহুতে আগলে নিয়ে বুকে জায়গা করে দেয়। কপালে চুমু দিয়ে মেয়েকে কাঁদতে সাহায্য করে। কাদুক। কাঁদলে হালকা হবে। সবার উদ্দেশ্যে বলে,
‘ আমি আমার অস্বিত্বকে এভাবেই আগলে রাখি। আমি চাই আমার মৃত্যুর পরেও সে এভাবেই আগলে থাকুক। ‘

রাত নয়টায় বাড়ি ফেরা হয় ইসমাইল কে নিয়ে। দশটার আগেই চত্বরে হাজির হয় পর পর তিনটি গাড়ি। ফিরোজ খানের পা পড়ে ইসমাইলের বাড়িতে। ইসমাইল এসে আর নিজ রুমে যায়নি। আগে নিশ্চিন্ত হবে তার পরেই সে রেস্ট নিবে। ড্রয়িংরুমে ই সোফায় বসে আছে। বন্ধু রেজাউল তড়িঘড়ি করে বাসায় ঢুকে। দু হাত দুই দিকে রেখে ইসমাইলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
‘ এতো কিছু ঘটে গেছে আমাকে জানালিও না তুই? শালাদের পশ্চাৎদেশে ডান্ডা ফেললেই সোজা হয়ে যেতো। ‘
‘ হারামজাদা দের কথা বাদ দে। তুইও তো আসলিনা।’
‘ আরে ছুটি পাই নাই। লাবি মা ঠিক আছে?’
‘ মেয়েটাকে তুই বুঝা। ‘
‘ আচ্ছা বোঝাবো। এমনিতেই আমার মা অনেক বুঝদার। এমপি সাহেব আসছে তো?’
‘ কবির গিয়েছে আনতে। ‘

ফিরোজ খানের পেছন পেছন সোহানা ইসলাম উপস্থিত হয় সোহানা ইসলাম। তার পাশেই খবিরুল ইসলাম এবং নিতু ইসলাম। তামিম আর কবির একসাথেই প্রবেশ করে। তারপর তানভীর । তার সাথেই আশিক, রমেশ, নাকিব। ফিরোজ খানকে এই অব্দি আনতে সবাইকে একটু হিমশিম খেতেই হয়েছে। তানভীর বিয়ে করবে শুনে বড্ড খুশি হয়। কিন্তু খোঁজ খবর না নিয়েই যে বিয়ে করবে এটা মেনে নিতে পারেনি। তার ঘরের লক্ষী দেখে শুনে তারপর ঘরে তুলবে এটাই জানায়। বড় ছেলের বেলায় যে ভুল করেছিলো ছোট ছেলের বেলায় সেই ভুলটা একদমি করতে চাইছেনা। বরং বেকে বসে। সোহানা ইসলাম কে বলে,
‘ তোমার ছেলেকে বলো আমি আগে মেয়ের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিবো। তারপর মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হবো। এরকম হুডমুড়ানো কাঁচা বুদ্ধিটা কার? কি ঠেকা পড়েছে যে তানভীরকেই বিয়ে করে সেই মেয়ের সম্মান বাঁচাতে হবে?’
তামিম কাঁচুমাচু করে। ফোনের দিকে চোখ বুলিয়ে সাহস নিয়ে বলে,
‘ আমিই প্রস্তাবটা দিয়েছি পাপা। ‘
‘ কি মনে করে? তুমি চেনো মেয়েটাকে? তোমার পরিচিত? তুমি তার কাছে দায়বদ্ধ?’
‘ খালামনির কথায় প্রস্তাব রেখেছি পাপা। ‘
‘ তোমার খালামনি এ কাজ কিভাবে করতে পারলো?’
সোহানা ইসলাম বোনের পক্ষে সায় জানালো।
‘ মেয়েটাকে আমিও দেখেছি। পছন্দ করেছি তানভীরের জন্য। ‘
‘ ব্যাস এতোদূর! তাহলে তো হয়েই গেলো। ‘
নিতু ইসলাম এসে সামলে নিলো।
‘ দুলাভাই। মেয়েটা আমার স্টুডেন্ট। খুবই ক্লোজ। জেনে বুঝেই আমি এগিয়েছি। ‘
ফিরোজ খান তানভীরের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি তো মা খালা ভাইয়ের কথা শুনার ছেলে নও! তাহলে কেনো আমি সেই বাড়িতে যাবো?’
‘ আমি সেচ্ছাই বিয়ে করছি। সেজন্যই আপনি আপনার পুত্রবধূ কে দেখতে যাবেন। ‘
ফিরোজ খান মনে মনে হাসলো। মনে মনে লাবিবাকে দেখার প্রবল ইচ্ছা পোষন করলো। নিশ্চয় এই মেয়ের মাঝে কিছু একটা আছে। নয়তো তার ছেলে তার সামনে স্বভাবের বিপরীত আচরণ করতো না।

ফিরোজ খানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় ইসমাইল। ফিরোজ খান ও হ্যান্ডসেক করে আমোদ মেজাজে উচ্চস্বরে বলে,
‘ এই শরীরে বসে আছেন ভাই সাব। এখন তো ভালো আছেন। ‘
‘ এখন ভালো আছি। গরীবের বাড়ি আসতে অসুবিধা হয়নি তো আপনাদের? ভালো আছেন ?’
‘ হাফ ভালো আছি। এমন নিউজ এতো তাড়াতাড়ি শুনবো ধারণাও করি নাই। আপনার মেয়েকে আগে দেখি। তারপর ডিপেন্ড করবে বাকিটা ভালো হবো কিনা যতটুকু আছি ততোটুকুও খোয়াবো। ‘
‘ এই ব্যপারে আমি গ্যারান্টি ভাই সাহেব। আমার মেয়ের মাথার উপর থেকে হাত তুলতে পারবেন না। ‘
‘ তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। ‘
উপস্থিত গোল বৈঠকে লাবিবাকে নিয়ে আসা হয়। উর্মিলা ছোট কাকী এক প্রকার টেনেই নিয়ে আসে। লাবিবা বলতে থাকে, ‘ আবার কি করতে চাইছো তোমরা? আবার কোন নাটক?’
‘ আরেকটু ধৈর্য্য ধর মা। তারপরে ই শেষ। বিয়েটা হয়ে গেলেই শান্তি। ‘
‘ আবার কোন গবেটকে ধরে এনেছে তোমাদের ভাই? করবোনা আমি এই বিয়ে। ‘
‘ আল্লাহ লাবি মা চিৎকার করে না। এমপি সাহেব বাড়িতে। ‘
‘ উনি কেনো এখানে? উনার ছেলে দিয়ে কাজ হয়নি এখন বুঝি উনি ঘটক গিরি করতে এসেছে?’
উর্মিলা মুখ চেপে ধরে। এবার চুপ যা মা। আগে চল।

লাবিবাকে বসিয়ে দিয়ে কলম হাতে ধরিয়ে দেয়। রেজিস্ট্রেশন পেপার সামনে। ফিরোজ খান লাবিবার মুখ দেখে ‘ মাশাআল্লাহ ‘ বলে উঠে। পকেট দেখে ওয়ালেট বের করে সেলামী ধরিয়ে দেয়। সোহানা উঠৈ এসে লাবিবাকে একহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দিয়ে দু হাতে মোটা চুর পড়িয়ে দেয়। খবিরুল ইসলামের ওয়েইফ বলে,
‘ এই ওয়ালেট বের করো। ‘
‘ আরে আরে। এতো অস্থির কেনো? ভাগিনা বউকে একদম ভরিয়ে নিয়ে যাবো তো। ‘ ইসমাইল হাত ধরে পেপারের দিকে এগিয়ে বলে,
‘ সাইন করো ‘
লাবিবা টলমল চোখে ইসমাইলের দিকে তাকায়। অভিমানে চোখ থেকে দু ফোটা গড়িয়ে পড়ে। কাঁপা হাতে সাইন করে দেয়। কাজী সাহেব বলেন ,’ এমপি সাহেব দেনমোহর কতো ধরবো? ‘
ফিরোজ খান তানভীরের দিকে তাকায়। ছেলের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসে। তানভীর গা ঝাড়া দিয়ে বসে। স্ট্রং গলায় বলে,
‘ পঁচিশ লাখ লিখেন।’
ফিরোজ খান টিপ্পনি কাটেন।
‘ কম হয়ে গেলো না বাবা?’ তানভীর ও কম যায় না। কাজীকে বলে,
‘ সাথে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট এবং টাউন হলে একটা ফ্ল্যাট এড করে দেন। ‘
ছেলের কথায় কেশে উঠে ফিরোজ। আস্তে আস্তে বলে,
‘ তোমার ফ্ল্যাট তুমি দিতেই পারো। কিন্তু উত্তরার ফ্ল্যাট টা তো তোমার মমকে দিয়েছি বাবা। ‘
‘ প্রব্লেম কি? মমের আর আমার তো একি হলো। মম আমাকে দিবে। আমি আমার বউকে দিবো। ‘
‘ তোমার একটা বড় ভাই আছে বাবা। ‘
‘ ভাইয়ের জন্য আমি খুঁজে নিচ্ছি। পেয়ে গেলে পেমেন্ট টা করে দিবেন। ‘
ফিরোজ খান তানভীরের কথায় আর টু শব্দ করে না। এই ছেলে সব সময় বাপের উপর দিয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

চলবে ___

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(১৪)
ঘরের দরজা দিয়েছে লাবিবা। আর খুলার নাম নেই। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। হৃদপিন্ড অসংখ্য বার অস্বাভাবিক বিট করছে। কি হচ্ছে তার সাথে? একেরপর পর অস্বাভাবিক ঘটনা গুলো ঘটেই যাচ্ছে। সম্মানের চোখে যে স্যারকে এতো দিন মাথায় উচ্চতায় বসিয়ে এসেছে সে স্যার আজ বুকে নেমে আসার পথ ধরেছে। পৌঁছেও গেছে। ঢুকতে পেরেছে কি? কিভাবে দরজা খুলবে? স্যার ই বা এরকম দয়া করতে গেলো কেনো? সমাজ যা ইচ্ছে তাই বলুক। লাবিবার কোন যায় আসতো না। কারো সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন ও সে দেখেনি। তাহলে কেনো তানভীর স্যার ইঙ্গিত পূর্ণ আচরণ করবেন? তানভীর স্যার কি লাবিবাকে পড়ে নিয়েছে? দু মন টাকে শান্ত করতে পারছেনা কিছুতেই। উত্তর চায় লাবিবা। উত্তরের আশায় প্রশ্নটা ও করে বসে সে।
‘ আপনিই কেনো স্যার?’
তানভীর মোটেও বিচলিত নয়। তার জীবনের এতো বড় একটা মোড় ঘুরে গেছে তা নিয়ে তার ভেতর অনুশোচনা ও নেই আবার উচ্ছাস ও নেই। যেনো সব স্বাভাবিক। প্রতিবারের মতো আজো তার লয়্যাল এনসার। তিনি যে একজন স্যার তিনি তার কথা কিংবা ব্যবহারেই প্রকাশ করেন। সোজাসাপ্টা উত্তর,
‘ প্রমিস করেছিলাম তোমাকে গিফট দিবো। দিলাম। তুমি যা চাও সেটাই দিলাম। এবার তুমি স্বাধীন। পড়াশোনা করো। নিজের পায়ে দাড়াও। দায়িত্ব পালন করো। লাইফটাকে ইনজয় করো। দুর্বলতাকে ভালোবাসো। তোমার সব রেসপনসিবিলিটি আমার। ‘
‘ অন্যভাবে ও তো গিফট দেওয়া যেতো। ‘
‘ যেতো কি?’
লাবিবার মুখ বন্ধ। কি উত্তর দিবে? সত্যিই তো যেতো না। কেউ না কেউ তো তার লাইফে আসতো ই। শুধু আসতো না কর্তৃত্ব ও ফলাতো। নিয়মে বেঁধে তবেই ছাড়তো। কিন্তু এমন মানুষ টাই বা কেনো? লাবিবা কি আদৌ কোন দিক থেকে তার যোগ্য? নয়তো। তাঁদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। পরিবারের ফারাক, ফিনান্সিয়াল ফারাক, বয়সের ফারাক, যোগ্যতার ফারাক, সৌন্দর্যের ফারাক। ওতো বড় মানুষ টা সারাজীবন ভীতির ই সৃষ্টি করে গেছে। সামনে গেলেই বুক কেঁপে উঠে। ব্যাক্তিত্ব, ক্রোধ,দাম্ভিকতা,দক্ষতা, বিশালতা, প্রাচুর্যের ভীড়ে হয়ে উঠেছে চুনোপুঁটির মতো শিষ্যত্ব অর্জন করা। সেই সম্মানীয় আজ হয়ে উঠলো স্বামী। কিভাবে নিজেকে শান্ত করবে লাবিবা? তিনি সত্যি সত্যি নিজের কথা রাখলেন। নিরবে জিতে গেলেন।

দরজায় অসংখ্য করাঘাত। লাবিবা সেদিকে মন দিলো না। দুরু দুরু বুকে ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানায়। এতোসব কি না হলেই হতো না? আব্বু কিভাবে পারলো তার সাথে এরকম করতে? এতো গুলো মানুষের সামনে বিয়ে ভাঙ্গা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে সরাসরি বললো সাইন করো। তাও আবার কার জন্য তার কলেজের সম্মানীয় প্রিন্সিপালের জন্য। লোকে জানলে কি বলবে? এতো লোকের ভয় তাহলে এরকম একটা কাজ করার আগে একবার ভাবলো না এর পরিণাম কি হবে? এতোই তাড়া মেয়েকে পরের অধিনস্থ করার জন্যে? অবাধ্য দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
সারা রাত ঘুম হবেনা যে!

বাড়ি সুদ্ধ মানুষ দরজা ধাক্কিয়েও লাবিবাকে বের করতে পারে না। এদিকে তানভীর কে জোর করে রেখে দেওয়া হয়েছে। বিয়ের দিন ই জামাই মেয়েকে রেখে চলে যাবে লোকে শুনলে কি বলবে? জামাই সহ জামাইয়ের বন্ধু বান্ধব রাও আজ এখানেই থাকবে। তাঁদের থাকার জন্য রুম গুছিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু জামাই কোথায় থাকবে? লাবিবা যে দরজাই খুলছে না। তানভীর চলে যেতে চেয়েছিলো। সাবিনা হাতে ধরে রেখে দিয়েছে। একেতো দুপুরে মেয়ের বিয়ে ভাঙলো তারপর এখন রাতে বিয়ে হলো অনাকাঙ্ক্ষিত একজনের সাথে। বিয়ে হতে না হতেই ফুলের মতো মেয়েটাকে রেখে জামাই চলে যাবে? তাঁদের তো একটু আলাদা সময় দেওয়া উচিত। তবে যদি মেয়েটার বুকের ভার একটু কমে। কষ্টে কষ্টে যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জামাইকে তো সেজন্য ই রেখে দিলো যাতে মেয়েটাকে একটু হাত করে নিতে পারে। এখন যদি দরজাই না খুলে জামাইয়ের সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে? কি লজ্জা কি লজ্জা! সোহানা ইসলাম তো ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে যাবার জন্য উঠে পড়ে লাগছিলো। মেয়ে তার এখানে দাম দিচ্ছে না ঐখানে গিয়ে না জানি কি করে! সাবিনা জানে ভিতু মেয়ে তার কিছুই করবেনা। কিন্তু কেটে কেটে অজ্ঞান হবে। এখন তো মনে হচ্ছে জামাইকে যেতে দেওয়াই উচিত ছিলো। এর চেয়ে লজ্জার আর কি থাকতে পারে! ইসমাইল ঘরে রেস্ট নিচ্ছে। মাঝরাত অব্দি যখন ডেকে ডুকে ঘর থেকে টু শব্দ ও করাতে পারলো না তখন তানভীর এসে বাগড়া দিলো।
‘ আন্টি আমি আমার ফ্রেন্ডস দের সাথেই থাকছি। আপনি টেনশন করবেন না। ‘
‘ইয়ে মানে বাবা।’
‘ আপনার মেয়ে অনেক স্ট্রং। আপনি চাপ নিবেন না। আংকেল অসুস্থ প্লিজ গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ‘
‘ কিছু মনে করোনা বাবা। বুঝতেই তো পারছো মেয়েটা আমার এত্তো জেদি_’
‘ আমি বিষয়টা নরমাল ই নিচ্ছি। ওর দিক টাও তো ভেবে দেখতে হবে। একটা অসম বন্ধনে আমরা জড়িয়ে গেছি। সবটা নরমাল হতে সময় লাগবে। আপনি প্লিজ গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ‘
‘ দোয়া করি বাবা। এভাবেই আমার মেয়েটাকে বুঝে শুনে যেনো আগলে রাখতে পারো। সুখী হও তোমরা। ‘

তানভীর গিয়ে বন্ধুদের পাশে শুয়ে পড়ে। দুই বন্ধু তানভীর কে নিয়ে আফসোসের ডালা খুলে বসে। মুখে চুক চুক আওয়াজ করে। আশিক‌ বলে,
‘ বন্ধু রমেশ!’
‘ হ্যা বন্ধু!’
‘ মনে পড়ে তোর তোর বাসর রাতের কথা?’
‘ হ্যা বন্ধু। কি সেই স্মৃতি আর তোর ভাবীর ভালোবাসা এই জীবনে ভুলতে পারবো না। আহ!’
‘ তুই তো শালা ভাগ্যবান। আমিও তোর ভাবীর সাথে প্রথম রাত! কি প্রেম! কি অনুভুতি! সেসব কি আর আমৃত্যু ভোলা যায়?’
‘ তুইও তো শালা ভাগ্যবান। আমার তো আফসোস হচ্ছে সেইসব অভাগার জন্য যারা বাসর রাতে বউয়ের কাছে যেতে পারে না। বউকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমিয়ে বন্ধুদের পাশে ঘুমায়। আহ! আফসোস। ‘
দুজনের ঠোঁট চৌখা করে চুক চুক শব্দ করে।
‘ আহ! কি কষ্ট। আমরা থাকি আকাশে আমাদের বন্ধু থাকে চকিতে। ‘

‘ ঐ তোরা চুপ করবি? ‘
‘ আরে বন্ধু ঘুমাও নাই? ও তোমার তো আজ ঘুম হবো না। নরম গরম জায়গা রেখে কি শক্ত জাজিমে ঘুম আসবো!’
‘ আশিক প্লিজ মজা পরে করিস। মাথাটা ধরেছে আমার। ঘুমোতে দে। ‘
রাগে মাথা ব্যাথা করছে তানভীরের। কত্তবড় বেয়াদব মেয়ে! বাড়ির কারো কথা শুনবিনা মানলাম তানভীরের কথাটাও ভাববি না? বেয়াদব মেয়ে একটা। চরম অবাধ্য। হুস জ্ঞান কিচ্ছু নেই। এর জন্যই বলে যার জন্য করি চুরি সেই বলে চুর। উপকারীর উপকার করবিনাতো কৃতজ্ঞতা ও জানাবে না।

ব্রেকফাস্টে লাবিবা নেই। তানভীর কি যেনো একটা ভাবতে ভাবতে আপেলে কামড় দিচ্ছে। পুরো টেবিল জুড়ে খাবার। জামাই আদরে কোন ফাঁক রাখছেন না শ্বাশুড়ীরা। তানভীর বলে,
‘ আন্টি আংকেল আমরা বেরোবো। ব্রেকফাস্টের পরেই একসাথে বেরোচ্ছি। ‘
সাবিনা লাবিবার রুমের দিকে তাকায়। মেজজা কে ইশারা করতেই বলে,
‘ এখন যাওয়া হচ্ছেনা। দুপুরে খেয়ে তারপর যাবে। বাড়ির প্রথম জামাই তুমি। ব্রেকফাস্ট না করিয়ে ছাড়ছিনা। ‘
‘ আন্টি আমার ফ্রেন্ডসদের যেতে হবে। আমিতো আসছিই পরে। ‘
‘ না না তা হবে না। লাঞ্চের আয়োজন করছি বাবা। থেকে যাওনা। ‘
কাজিন মহলকে ইশারা দিতে তাঁরাও তানভীরের হাত চেপে ধরে,
‘ দুলাভাই পরে যান না। আমাদের তো ঠিক ভাবে আলাপ ই হলো না। আমরা কিন্তু আপনাদের ছাড়ছিনা।’

সাবিনা ছোট জাকে নিয়ে লাবিবার রুমে যায়। জানালা খোলা। উপুড় হয়ে ভুস ভুস করে ঘুমুচ্ছে মেয়েটা। গতকালের শাড়িটাও ছাড়েনি। তানভীর ডাইনি্ং এ এখনো বুঝানোর চেষ্টা করছে। চলে যাবে সে। আর এদিকে মেয়েটা ঘুম থেকেই উঠেনি। দুপুর পর্যন্ত থাকলে যদি দুজনের আলাপ হয় সেজন্য তানভীরকে আটকাতেই হবে। অনেক ডাকাডাকির পর লাবিবাকে ঘুম থেকে উঠানো যায়। বেচারা চোখ মেলতেই পারছেনা। গতদিন এতো কান্নার পর রাতেও কেঁদেছে। ঘুমিয়েছে ঘন্টা তিনেক হলো প্রায়। মা কাকীর ডাকাডাকিতে বাধ্য হয়ে দরজা খুলতে হলো। সাবিনা ছোট জাকে ইশারা করে চলে গেলো। ঘরে নতুন জামাই। অনেক পদ রাঁধতে হবে তাকে।

ছোট কাকী এসে লাবিবাকে মৃদু আওয়াজে বকা ঝকা করে এরকম বোকামোর জন্য। নতুন জামাই তার উপর এতো বড় মাপের লোক! তার সামনে মান ইজ্জত সব শেষ করে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রাত কাটাতে হলো বন্ধুদের সাথে! শ্বশুড় শ্বাশুড়ির এর থেকে বড় লজ্জা কি আর কিছু হতে পারে? লাবিবা যেনো ভূলেই গিয়েছিলো তানভীরের কথা। এখন মনে পড়তেই হাঁসফাঁস করতে লাগলো। কাকী ঠেলে ঠুলে গোছল করতে পাঠালো। গোছল শেষে লাবিবা পড়লো একটা সুতি গাউন। সেটা দেখেই কাকী রেগে গেলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
‘ লাবি মা তুই হলি নতুন বউ! গতকাল বিয়ে হয়েছে। তুই পড়বি শাড়ী। তা না পড়ছিস গাউন! জামাই আছে ঘরে। তাড়াতাড়ি চেঞ্জ কর। ‘
‘ কাকী মনি প্রেশার দিবে না একদম। সব কিছুতেই তোমাদের প্রেশারে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। এখন ড্রেসটাও মন মতো পড়তে পারবোনা?’
‘ মা রে চুপ যা। আস্তে। জামাই শুনতে পাবে যে। তোর কলিজায় ডর ভয় কি নেই? মান সম্মান আর আমাদের রাখবিনা।’
‘ কাকী মনি আমি ঠিক ঠাক শাড়ি সামলাতে পারিনা। ‘
‘ ভেতরেই থাকবি। বাইরে তো যাবিনা। পড়ে নে না মা। ‘ শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে লাবিবাকে খাইয়ে আবার ছুটে রান্নাঘরে।ঘরে নতুন জামাই রান্না দেখতে হবে।

ফাহাদ ছেলেটা ছেড়ে দেওয়ার ছেলে নয়। সে এসে অসভ্যতামো শুরু করেছে। লাবিবাকে বিয়ে করবে বলে আরজি জানাচ্ছে। তানভীর লাবিবাকে বিয়ে করেছে শুনে তার অসভ্যতার মাত্রা বেড়ে গেছে । গলা ফাটিয়ে লাবিবাকে ডাকছে। তানভীর ফাহাদকে নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায় । রাস্তা দেখিয়ে বলে,
‘ চলে যাও। আর ভুলেও এদিকে আসবে না। ‘
‘ স্যার আপনি এটা কি করে করতে পারেন? এতো বড় বেইমানি আমি মেনে নিবো না। লাবিবার সাথে আমার বিয়ে হবার কথা ছিলো । আর কারো না। ‘
‘ চুপ চাপ চলে যাও ফাহাদ। আশেপাশে লোক জড়ো হবে। এমনিতেই কাপুরুষের মতো চলে গেছো বিয়ে করতে এসে। মেয়েটার কথা একবারো চিন্তা করোনি। তোমার জন্য এই পরিবারের প্রধান হসপিটালাইজড হয়েছে। আজকে আমি আনমেরিড জন্য বিয়েটা করে তাঁদের বাঁচাতে পেরেছি। নয়তো কি হতো একবার ভেবে দেখেছো? ‘
‘ লাবিবাকে ছেড়ে দেন না স্যার। আমি আর বাবার কথা শুনবো না। লাবিবাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবো। ‘
‘ এই কথাটা গতকাল তোমার ভাবা উচিত ছিলো। বিয়েটা যে ভাবেই হোক না কেনো হয়েছে। লাবিবা এখন আমার ওয়াইফ। আমার একটা সম্মান আছে। আমার সম্মান হানি কারক কোন কিছুই আমি এলাও করবো না। আমার ওয়াইফের থেকে দূরে থাকবে। ‘
‘ আমি লাবিবাকে ভালোবেসে ফেলেছি স্যার। প্লিজ আপনি ওকে ছেড়ে দেন। ‘
‘ ছেড়ে দিয়েই কি হবে? লাবিবাই তো তোমাকে চায়না। আমাকে বার বার বলেছে সে তোমাকে পছন্দ ই করেনা। তার বাবার জন্য তোমাকে মেনে নিচ্ছে। ফয়দা কি ব্রো?’
‘ আমি ওকে ঠিক আমার করে নিবো । ‘
‘ ইতোমধ্যে সে আমার হয়ে গেছে। সসম্মানে যেতে চাইলে এখনি যাও ব্রো। আমার রাগটা আবার বেশ খারাপ। বেশিক্ষন কন্ট্রোল করতে পারিনা। ‘

চরম অপমান নিয়ে ফাহাদ চলে যায়। লাবিবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটাই খেয়াল করে। সে আর রুম থেকে বের হয়না। লাঞ্চ শেষে তানভীর যখন চলে যাবে তখন শালা শালীরা তানভীরকে লাবিবার সাথে দেখা করানোর জন্য লাবিবার রুমে নিয়ে যায়। কিন্তু কেউ সেখানে থাকেনা। দরজা অব্দি পৌঁছে দিয়েই চলে যায়। রুমে নক না করেই ঢুকতে হয়। দরজা খোলা। ভেতরে পা রাখতেই লাবিবাকে দেখে থেমে যায়। লাল টকটকে সিল্কের শাড়িতে খোলা চুলে লাবিবাকে দেখে তানভীরের চোখ জুড়িয়ে যায়। হিযাপে মেয়েদের ফিফটি পার্সেন্ট সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে এটা তানভীর বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।‌ চোখে ঘোর লেগে যায়। লাবিবা কাঁচুমাচু করে দাঁড়ায়। সত্যি সে অভদ্রতা করছে। এখন কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। বরাবরের মতো ফর্মাল ড্রেসে সামনে দাঁড়ানো শ্যামপুরুষের চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা নেই। বরং চিরপরিচিত ভিতীটাই কাজ করছে। নিরবতা তানভীর ই ভাঙে।
‘ ঠিক আছো? ‘
‘ হু।’
‘ আমি তাহলে যাচ্ছি। ‘
লাবিবা মাথা নাড়ে। ‘ হু। ‘
তানভীর হাতটা লাবিবার দিকে তুলে। গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। হাত পাঁচেক দুরুত্ব বজায় রেখেই আবদার জানায়,
‘ তোমায় একটু ছুই? ‘
‘ হু। ‘
চমকে তাকায় লাবিবা। তানভীরের ঠোঁটে খেলা করে মৃদু হাসি। সেই হাসিতেই খেই হারিয়ে ফেলে লাবিবা। হা করে তাকিয়ে থাকে। তানভীর লাবিবাকে আপাদমস্তক দেখে নেয়। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এই মুহূর্তে সেসব কথা সমিচীন নয়। তবে একটু প্রশংসা না করেও থাকা যাচ্ছে না। তাই আবদারের সহিত বলেই ফেলে,
‘ তুমি সত্যিই অনেক কিউট। তোমায় একটু ছুঁই? ‘
‘ কি_কি_কি কেনো?’
ফের আবার সেই প্রশ্ন। তুতালাতে থাকে লাবিবা। তানভীর সেই মুহূর্তে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। লম্বা তিন পা বাড়িয়ে আচমকা লাবিবার পেটের দুপাশে হাত গলিয়ে পিঠ চেপে বুকের উপর তুলে জড়িয়ে ধরে। লাবিবাকে আচমকাই হটাৎ উপরে উঠাতেই তাল সামলাতে চিৎকার দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তানভীরের গলা। তানভীর চোখ বন্ধ করে লাবিবার কাঁধে মুখ রেখে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। অনুভব করে তার গতকাল বিবাহিত বউটার সান্নিধ্য। নাকে শুষে নেয় অগোছালো শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ। কাঁধ থেকে মাথা তুলে সমান্তরালে চোখে চোখ রাখে। ধীর কন্ঠে বলে,
‘ এভাবে কখনো কান্না কাটি করে মুখ ফুলাবেনা। তোমার বিদ্ধস্ত মুখ আমার একদমি দেখতে ভালো লাগে না। ‘

চলবে ___

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(১৫)
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় গুলো ঝুড়িতে ভরেছে সোহানা। তানভীর পিছনে ছুটছে।
‘ মম! হচ্ছেটা কি এসব? দাও আমার ড্রেস গুলো দাও। মম! ‘
‘ একদম কথা বলবেনা আমার সাথে। তোমরা যদি নিজেদের মতো লাইফ লিড করতে যা ইচ্ছা তাই করতে পারো আমিও পারি। এই বাড়িতে এখন আমার যা ইচ্ছা তাই করবো। ঐ লুকমান ঝাড় বাতি নামা। ‘
লুকমান দৌড়ে আসে এক ডাকেই। সোহানা রাগে ফুস ফুস করছে।এখন তার কথা না শুনলে বাড়িতে একটা কাজের লোক ও আস্ত থাকবে না। ঝাড় বাতি নামানোর জন্য দৌড় দিতেই ফিরোজ খান থামিয়ে দেয়। সোহানা ফিরোজকে দেখে মুখ ঝামটা দিয়ে কিচেনে চলে যায়। জাবেদা কে বলে,
‘ প্লেট,গ্লাস,জগ,মগ সব দুই নম্বর মার্কেটে এক্ষুনি বিক্রি করে আয়।‌ স্টিলের বাসন কোশন কিনে আনবি আসার সময়। সবাই স্টিলের প্লেটে ভাত খাবে। ‘
‘ আহ! সোহানা করছো টাকি? স্টিলের প্লেটে জীবনে কখনো খেয়েছো তুমি? এসব ছেলে মানুষী বন্ধ করো। ‘
‘ আমার বাড়ি তে আমি ছেলে মানুষী করবো নাতো মেয়ে মানুষী করবো সেটা আমার ব্যপার। তুমি আমার কাজে খবরদার নাক গলাবেনা। ‘
‘ আচ্ছা মম আমার ড্রেস গুলো দিয়ে দাও। ওগুলো ওয়াশ করতে হবে ‌। ‘
‘ এই জবেদা! বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুই মিনিট হাটবি। ডান সাইডে দেখবি একটা ডোবা আছে সেখান থেকে এই কাপড় গুলো ধুয়ে আনবি। ‘
‘ ইমপসিবল। মম গিভ মি দ্যা বাস্কেট। গিভ মি। ‘
‘ নো।নেভার। ‘
‘ সোহানা তুমি কি পাগল হলে?’
‘ আমি তো পাগল হবোই। তোমরা তো এটাই চাও তাই না? বাপ ছেলে মিলে আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলছো।’
‘ তানভীর? হোয়াট হেপেন্ড?’
তানভীর বিরক্তিতে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়ায়।সোহানা চেঁচিয়ে উঠে।
‘ কি হয়নি সেটা বলো। দুই ছেলেকে বিয়েতে বসাতে পারি না। যাও একজন বসলো বউ নিয়ে আসার নাম গন্ধ নেই। আরো বলছে সংসার করবে না। আচ্ছা ঠিক আছে। সংসার যেহেতু আমার ই থাকবে। এই সংসার আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চালাবো। ‘
ফিরোজ খান তানভীরকে লক্ষ্য করলো।
‘ তোমার মম যা বলছে তা কি ঠিক? খুব তো আমার মুখের উপর কথা বলে বিয়েটা করলে এখনি শখ মিটে গেলো? আমার কি ফ্ল্যাট বেশি হয়েছিলো বাবা? ‘
দাঁতে দাঁত চেপেই বললো শেষের কথাটা। তানভীর তার কলিজায় টান দিয়েছে কিনা!বউকে দেওয়া গিফট বলে কথা! তানভীর মুখটা অসহায় করে ফেলে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
‘ তুমি এতো বউ পাগলা কিভাবে হলে পাপা? পুরুষ জাতি কে এভাবে ঘোল খেতে সাহায্য করতে তোমার কি একটুও হৃদয় কাপলো না?’
‘ আমাকে বউ পাগলা বলছো? বেয়াদব! পাপা হই তোমার। সোহানা রেড়ি হোও। বেয়াদব টা কিভাবে সংসার না করে থাকে আমিও দেখে নিবো। ‘
‘ লিসেন পাপা।‌আমি কখন বললাম যে আমি সংসার করবো না? ‘
সোহানা লাফিয়ে উঠে,
‘ একটু আগে যখন বললাম বউকে ঘরে এনে কাপড় গুছা তখনি তো বললে যে তুমি বউকে তোমার কাজ করানো র জন্য সংসার করবে না। ‘
‘ উফফ মম! আমি বলেছি আমার বউ কাজ করবেনা জন্য সংসারেই আসবে না। তোমার সাথে কিছুই বলা যায়না। উল্টো মিনিং ধরে রাখো। ‘
‘ তাহলে তুমি সত্যিই সংসার করবে না? ‘
‘ মম! পাপা প্লিজ বোঝাও তোমার বউকে। আমার কলেজের স্টুডেন্ট আমার বউ হয়ে আমার সাথে সংসার করছে এটা জানাজানি হলে আমার মান সম্মান কিছু কি থাকবে? তাও আবার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে! ‘
‘ এতো সমস্যা থাকলে করেছো কেনো বিয়ে? ‘
‘ মমের কথাতে। ‘
‘ কিহ? আমি কখন বললাম?’
‘ সেদিন যে মেয়েটা আসলো, তাকে দেখে আমাকে কি বলতে এসেছিলে? মনে আছে?’
‘ কিন্তু আমি তো বলতেই পারি নি। ‘
‘ তোমার কথা বুঝে নিয়েই তো বিয়েটা করলাম। তোমার কথা রাখতে গিয়ে আমি বিয়েটা করেছি। এবার অপেক্ষা করো বছরের পর বছর ‌ । আমার তাতে কি?’
‘ সর্বনাশ! ‘
‘ সর্বনাশ তো তুমি আমার করলে। বছরের পর বছর বউ ছাড়া থাকবো। তোমার কারণে। ‘
তানভীর আঙুল তুলে মুখ ঝামটা দিয়ে সোহানাকে দেখিয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে পদার্পণ করে তামিম। তানভীরকে দেখে চোখ উপড়ে। অবাক হয়ে বলে,
‘ এসব কি হচ্ছে? তানভীর তুই ও?’
‘ এই ড্রামাবাজদের চাপে আমিও এঁদের মতো হয়ে যাচ্ছি ভাই। প্লিজ তোমার বউকে নিয়ে আসো । অভিনেত্রী দের জায়গা এ বাড়িতেই হবে। ‘
ফ্লোরার কথা বলতেই মুখটা থমথমে হয়ে যায় তামিমের। কিছুক্ষণ আগেই তার সাথে কথা হয়েছে। তীর্যক ভাবে প্রশ্ন ছুড়েছে।
‘ শুনলাম তানভীর নাকি বিয়ে করেছে? ‘
‘ নিউজ পেয়ে গেছো? বাহ! গুড। ‘
‘ এভাবে কথা বলবেনা তামিম। তুমি তানভীর নও যে এভাবে কথা বলবে আমার সাথে। আর আমি মেনে নিবো।’
‘ তানভীর হলে মনে হয় ভালো হত তাইনা? এইযে সব মেনে নিতে। ‘
‘ নিতাম। কারণ আমি তার নিকট অপরাধী। ‘
‘ আমার সাথে তো কোন অপরাধ ই হয়নি। ‘
‘ আমি তুমি কি আলাদা তামিম? যদি আলাদাই ভাবো তাহলে আমি আবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।’
তামিম অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ে। ফ্লোরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আজকাল কথা বলতেই কান্না আসে। সেই ভয়েজেই তামিমকে অনুরোধ করে,
‘ প্লিজ তামিম আমাকে তোমার ভালোবাসার সংসারে জড়িয়ে নাও। আমি আর পারছিনা তোমাকে ছাড়া থাকতে। আমি নয় ভুল করেছি। সেই ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইছি। তোমার কি উচিত নয় আমার ভুল গুলো শুধরে নিয়ে আপন করে নেওয়া?’
‘ সময় গুলো ফিরিয়ে দাও। আমি আমার উচিত কাজটাই করবো। ‘
তারপর আর কথা হয়না। কথা বলার মতো কিছু নেই। নিশ্চুপ হয়ে যায় দুজনেই। দীর্ঘ শ্বাসের সঙ্গে উপস্থিতি জানান দেয় দুজন দুজনার।

চারদিন পর কলেজে পা পড়ে লাবিবার। তার অবস্থান ক্লাস রুমে। নিতু ইসলাম ক্লাস নিচ্ছেন। উর্মিলা গত ক্লাস গুলোর নোট দিয়ে দিয়েছে । সেজন্য কোন প্রব্লেম হচ্ছে না ম্যাথ গুলো বুঝতে। নিতু ইসলাম লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে লাবিবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন। লাবিবার হাতে সোনার রুলি। নিতু ইসলাম ই পড়িয়ে দিয়েছেন। কাঁচা হলুদ রঙা স্কিনে বেশ মানিয়েছে। চিকচিক করছে একদম। সেটাই দেখে নিতু ইসলামের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটেছে।‌ ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাবার সময় লাবিবাও বেরিয়ে নিতু ইসলামের পিছু ছুটে। লাবিবার হাতে একটা ওয়ালেট। ওয়ালেটটি তানভীরের। লাবিবার বাসায় ফেলে আসছে। তার সেটি নিয়ে আসার নাম নেই। অথচ ভেতরে ইমপর্টেন্ট কিছুই আছে। দুটো কার্ড আছে আর হাজার ছয়েক ক্যাশ আছে। আর কিসব কাগজ হাবিজাবি। লাবিবা অনুমতি ব্যতীত ই খুলে দেখেছে। প্রথমে ভেবেছিলো কারো পার্সোনাল ওয়ালেটে অনুমতি না নিয়ে হাত দেওয়া ঠিক হবে না। তারপর মনে হলো এটাতো মাত্র একটা ওয়ালেট! আর তার জীবনে একেরপর এক অনুমতি ব্যতীত যে জলজান্ত মানুষ এন্ট্রি নিয়ে নিচ্ছে তার ক্ষেত্রে? যার ওয়ালেট খুবলে না চাইতেও সেই মানুষটি এখন তার স্বামী। লাবিবা কিভাবে চুপ রইলো? পারতো তো এই বিয়েটাও আটকাতে। তার কি কোনভাবে সায় ছিলো? ছিলো। কিন্তু কতটুকু ছিলো? সুপুরুষ টিকে কি সে পেয়েই গেলো?

‘ মুখটা চিন্তিত দেখাচ্ছে কেনো আমার লাবি মার?’
নিতু ইসলামের কথায় লাবিবা চিন্তা জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। নিতু ইসলাম পেছন ফিরে লাবিবার কাছে এসে দাড়ালো। মাথায় হাত রাখলো,
‘ কি হয়েছে আমার ভাগিনাবধুর ?’
বলেই হাসতে লাগলো। লাবিবা দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। কোথায় যেনো আটকাচ্ছে। হুট করেই আপন করে নেওয়া যায়কি? লাবিবা নিলেই কি সে আপন হবে? এতো সব চিন্তাই বা সে কেনো করছে? তার চিন্তা গুলোর সমাধান কোথায় পাবে?
লাবিবা ওয়ালেটটা নিতু ইসলামের দিকে এগিয়ে দেয়।
‘ ম্যাম এটা প্রিন্সিপাল স্যারের ওয়ালেট। উনাকে দিয়ে দিবেন। ‘
‘ তুমি দিচ্ছো না কেনো?’
‘ স্যার আসেননি আজ। ‘
‘ ফোন দাও। নিয়ে যেতে বলো। ‘
লাবিবা আমতা আমতা করে। নিতু ইসলাম মুচকি হাসে। লাবিবার হাত ধরে নিজ কেবিনে নিয়ে আসে। ব্যাগ থেকে নিজ ফোন বের করে। আড়চোখে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘ কথা হয় তোমার তানভীরের সাথে?’
লাবিবা দু’পাশে মাথা নাড়ে। ‘ না। উনার নাম্বারে ফোন দিয়েছিলাম। ধরেননি। ‘
‘ প্রাইভেট পার্সন হয়ে পাবলিক নাম্বারে কল দিলে তো পাবে না মা। আমার ভাগিনা তো আর একটা ফোন নিয়েই বসে থাকে না। নাও এই নাম্বার ফোনে তুলো। আর কল দাও। ‘
‘ এখনি দিবো?না পরে দেই।
‘ তোমার ইচ্ছা। ‘
লাবিবা নাম্বার নিয়ে চলে যায়। কি যেনো ভেবে আবার চলে আসে। একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করে,
‘ ম্যাম?স্যার আসেননি কেনো? ‘
‘ তোমার স্যারের গতিবিধি জানার কথা এখন কার? আমার নাকি তোমার? অনেক তো সামলালাম ছেলেকে এবার তুমি সামলাও। আমাদের তো এখন রিলাক্স করার বয়স। ‘
‘ এতো বড় মানুষটাকে ও সামলাতে হয়? কেনো কি করেন উনি?’
খুব ভাবুক হয়ে পড়ে লাবিবা। নিতু ইসলাম কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না। অন্য কাউকে এইভাবে বললে লজ্জায় মুখ তুলতো না। এই মেয়ে তো ভাবনায় ঢুবে যাচ্ছে।
দরজার বাইরে থেকে উর্মিলা ইশারায় লাবিবাকে ডেকে যাচ্ছে। লাবিবা চলে আসে উর্মিলার সাথে ‌। তার মাথায় রাজ্যের প্রশ্ন ভর করে। সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তর পেতে হবে। তানভীর ই পারবে উত্তর গুলো দিতে। উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই মন শান্ত হচ্ছে না। উর্মিলা একটা ফাঁকা জায়গা দেখে লাবিবাকে হাত টেনে দাঁড় করায়। মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
‘ এভাবে ম্যামের পিছু পিছু যে ছুটলি সবাই তো বলছে তুই পালিয়ে আসলি। আর এসব কি লাব্বু? বিয়ের পাঁচদিন হয়ে গেছে এখনো স্যারের নাম্বার তোর কাছে নেই? দোস্ত স্যার কি তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে নাই? আই মিন স্বামী স্ত্রী যেমন করে!’
লাবিবা মাথা নাড়ায়। ‘ করেছে’।
‘ তোরা তো একটা নাইট ও পাস করলি না একসাথে। কি করেছে? মানে কত দূর অব্দি?’
সেদিন কার কথা মনে পড়তেই লাবিবার গাল দুটো গরম হয়ে উঠে। চোখ দুটো নুইয়ে আসে। উর্মিলা সাথে সাথেই লাবিবাকে পাঞ্জা দিয়ে ধরে মৃদু চিৎকার করে,
‘ দোস্ত!! হাউ ইট ইজ পসিবল? তুই লজ্জা পাচ্ছিস?তার মানে সব ডান ! ইয়াহু! ট্রিট দে।’
লাবিবা আরেকটু সিটিয়ে যায়। দুপাশে মাথা নাড়ে।
‘ সেদিন চলে আসার সময় হুট করে জড়িয়ে ধরে উপরে তুলে ধরে। আর বলে।’
‘ কি বলে? বলনা। ‘
‘ আমার কান্না ফোলা মুখ উনার একদমি সহ্য হয়না।’
‘ লাব্বু এই যে তোর ড্রীম পার্সন তোর হাজব্যান্ড তোর কেমন ফিল হয়? মানে এই যে সবাই তোকে মিসেস তানভীর খান বলে, তানভীর খান ও তোর কান্না সহ্য করতে পারে না, স্পেশাল ফিল করে অনুভূতি কি তোর?’
লাবিবা উর্মিলা ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। উর্মিলাও ছাড়ার পাত্র না। সেও তাড়া করে।
‘ দোস্ত ফিলিংস টা কেমন বল না!’
‘ আমি বলবো না। ‘
‘ বলনা প্লিজ। ‘
‘ আমার শরম লাগতাছে। খবরদার আমার পিছু আসবিনা।
‘ বলে যা না!’
‘ আমি বলবো না। ‘
পেছনে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে ঝাউ গাছের রাস্তায় দৌড়াতেই ধাক্কা খায় শক্তপোক্ত এক দেহের সাথে। ব্যালেন্স রেখে সরে দাঁড়ায়। চোখ তুলে তাকাতে না তাকাতে ক্রস করে যায় তাঁকে। যাবার আগে একবার চোখে চোখ মেলে। দেখেও না দেখার ভান! পুরোপুরি ইগনোর! অন্যান্য কেউ হলে নিশ্চিত বকে দিতো এতোক্ষনে। অথচ লাবিবাকে কিছুই না বলে ইগনোর করে। উর্মিলা পা থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চটপট মুখে হাসি নিয়ে সালাম দেয়।
‘ আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। ‘
‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম। কলেজ মাঠে গিয়ে খেলো। সাবধানে। ‘
বলেই তানভীর হাঁটা দেয়। উর্মিলা লাবিবা দুজন ভ্যবলার মতো তাকিয়ে থাকে। লাবিবা ঠোঁট কামড়ে ধরে। ছেড়ে দিয়ে বলে,
‘ বাই এনি চান্স স্যার কি আমাদের বাচ্চাদের মতো ট্রিট করলো? ‘
‘ সাবধানে ওয়ার্ড টা কি তোর জন্য ছুঁড়ে দিলো?’
‘ আমার জন্য হবে কেনো? বললো তো তোকে। ‘
‘ আমিও তো এখন স্পেশাল। শালিকা! তাই না?’
‘ তো? ‘
‘ স্যার তো চলে আসছে। কি নাকি দিবি? যা দিয়ে আয়।’
‘ হ্যা। তাই তো। মনেই ছিলো না। ‘

লাবিবা তানভীরের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পিয়ন কে সালাম দিয়ে তানভীরের কথা বলতেই পিয়ন দরজা খুলে দেয়। তানভীর মাত্র এসে বসলো সাথে সাথেই লাবিবার আগমন। হাতে এখন প্রচুর কাজ। বিকালেই কলেজের কাজে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে। এসময় লাবিবাকে দেখেই তার কাজ থেমে গেলো। ল্যাপটপ ছেড়ে টান টান হয়ে বসলো। লাবিবা এগিয়ে গিয়ে ওয়ালেট টা ডেস্কের উপর রেখে সালাম দিয়ে বললো,
‘ আপনি ওয়ালেট টা রেখে এসেছিলেন। তারপর আর নিতে যাননি। আমার চোখে পড়লো তাই ফেরত দিতে এলাম। ‘
‘ ফেরত! ‘
‘ সরি ইই স্যার। আমার বেডের উপর পেলাম তো তাই আপনাকে দিতে এলাম। ‘
‘ কি আছে এতে যে অফিসেই আসতে হলো তোমাকে?’
‘ সররি স্যার। ওয়ালেটটা খুলে দেখার জন্য। আপনার অনেক কিছুই আছে। ‘
‘ তুমি কি ওয়ালেটের ভেতরটা পুরোপুরি দেখেছো?’
‘ জি স্যার। কয়েকটা পেপারস আর কার্ড,ক্যাশ সবই আছে। ‘
‘ আবার খুলো। আমার সামনে। ‘
‘ স্যাররর…’
‘ ঘাবড়ানোর কিছু আছে কি? নাকি তুমি কিছু নিয়েছো?’
যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো। নয়তো সামনে খুলতে বলবে কেনো? লাবিবা কঠিন মুখ করে বললো,
‘ স্যার যেমনটা ছিলো ঠিক তেমনটাই আছে। আমি কিছুই নিই নি। ‘
‘ খুলো। ‘

লাবিবা ওয়ালেটটা খুলে একে একে সবকয়টি জিনিস ই বের করে সামনে রাখে। টাকা, তারপর কার্ড তারপর পেপার্স গুলো ভাজ খুলে একটার পর একটা সাজিয়ে নিতেই একটা চিরকুট পায়। চিরকুট টা আগেও দেখেছিলো কিন্তু খুলা হয়নি। এখন খুলতে গিয়ে ই চোখ ছানাবড়া। উপরের লেখা গুলো পড়তে থাকে
‘ ইটস্ ফর য়্যু মাই ওয়া_
বাকিটুকু আর উচ্চারণ করার সুযোগ পায়না। তানভীর টেনে নেয় চিরকুট টা। বাকি পেপার্স গুলোর দিকে হাত বাড়াতেই লাবিবা হাতের তালুর নিচে আবদ্ধ করে। তার যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে। এটা তানভীর ওর জন্য রেখে আসছিলো। তানভীর দুবার নিজের নাক টেনে হাত বাড়ায় লাবিবার দিকে।
‘ দাও। ‘
লাবিবা ছেড়ে দেয়। তানভীর লাবিবার বোকাসোকা থতমত খাওয়া মুখটা দেখে পেপার্স গুলো নেয়। কার্ড দুটো লাবিবার দিকে এগিয়ে দেয়। ক্যাশ গুলোর সাথে আরো কিছু নোট এড করে লাবিবার হাতে দেয়। ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলে,
‘ তুমি নিলে আমি খুশি হতাম।‌ ভেতরের তেজটা রাইটে টার্ণ দাও লেফ্টে নয়।এবার আসতে পারো। ‘

লাবিবা টাকাগুলো নিয়ে হাতে মুঠো পাকিয়ে ধরে। রাগটা ক্রমশ বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই মানুষটা বরাবরই লাবিবাকে একটা ধাঁধায় ফেলে রাখে। সেই ধাঁধার জালে আটকে লাবিবা হাঁসফাঁস করে। বেঁচে উঠতে চাইলে আরো গভীরে ছুঁড়ে ফেলে। তবে এর উত্তর সে জেনেই ছাড়বে। সরাসরি তানভীরের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে,
‘ এ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি স্যার? ‘
‘ তোমার স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতা, বাঁচার মতো বেঁচে থাকা। ‘
‘ আর বাঁধন গুলো?’
‘ আমি তোমাকে বাঁধি নি লাবিবা।’
‘ সুতো তো ছেড়েছেন। আচমকা গিট্টু লেগে গেছে পায়।’

দরজায় নক পড়ে। একজন প্রফেসর হালকা মাথা বের করে ডাকে।
‘ স্যার। একটু পর ই বের হতে হবে। ডি সি সাহেব একটু পরেই অফিসে থাকবেন। ‘
নিউজ টা জানিয়েই উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রফেসর চলে যান। তানভীর লবিবাকে বলে,
‘ তুমি এসো। ‘
‘ আমার উত্তর পাইনি। ‘
‘ আমি এখন ব্যস্ত। পরে কথা বলবো। ‘
তানভীর নিজের চেয়ার টেনে ফাইল নিয়ে বসে। তিনটি ফাইল খুলে পেপার্স গুলো একের পর এক উল্টে চেক করে। তখন ও লাবিবা দাঁড়িয়ে আছে। মোট কথা সে আবার ধিধান্বিত হয়ে পড়েছে। একের পর এক দ্বিধা তাকে লুফে নিচ্ছে। দ্বিধাগুলো কাটিয়ে শ্বাস নিতে চায়। তানভীর আড়চোখে কয়েকবার তাকায় । লাবিবার মধ্যে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই দেখতে পায়না। শ্বাস ছেড়ে হাত বাড়িয়ে চেয়ারে ইশারা করে বলে,
‘ বসো। নয়তো পা ব্যথা করবে। ‘
লাবিবা বসে না। বরং চেয়ারের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি স্যার। আমি আমার ভবিষ্যৎ জানতে চাই। কোন দিকে মোড় নিবে আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক? বিয়ে হবার কথা ছিলো একজনের সাথে হলো আপনার সাথে। আপনি কেনো আমাকে বিয়ে করলেন ? হুট করেই এই বিয়ে, এতো গুলো টাকা দেনমোহর,ফ্ল্যাট, তারপর এখন ডেবিট কার্ড,ক্রেডিট কার্ড,টাকা! স্যার আপনার সাথে আব্বুর কি কথা হয়েছে? আব্বু কি আপনাকে বলেছে যে আমার ভরনপোষন আর উনি করবেন না তাই আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আর আপনি আমার উপর দয়া করলেন। আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিলেন।
‘ কি বলছো ভেবে বলো লাবিবা। ‘
‘ আমি একটা সমুদ্রে সাঁতার কাটছি। প্লিজ আমাকে ডাঙায় তুলুন। আপনি তো অজানা না। আমার আব্বু আমাকে সমুদ্রে ফেলে দিলো আর আপনি আমাকে সব থেকে গভীরতম স্থানে নিয়ে এলেন। আমার শ্বাস আটকে যাচ্ছে স্যার। অর্থ দ্বারা যদি সাহায্য করার থাকতো তাহলে তো এমনিতেই করা যেতো।‌বিয়েটা কেনো করতে হলো ? ‘
‘ তোমার অবাঞ্চিত প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি দিতে বাধ্য নই। বেরিয়ে যাও এখান থেকে। ‘
‘ আমার প্রশ্ন গুলো অবাঞ্চিত কেনো মনে হচ্ছে? ‘
‘ অবাঞ্চিত মনে হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত বিয়েটা তুমি ভেঙেছো। বিয়ে ভাঙার পর তোমার বাবাকে হসপিটালাইজড করেছো। সুস্থ হবার পর যে কারো সাথে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিতো। অথচ তোমাকে বিয়ে করতে কেউ এগোতো না। ফাহাদের ফ্যামিলি মুহুর্তেই তোমাকে নিয়ে বাজে কথা ছড়িয়ে দিয়েছিলো। তোমার বাবা বাড়ি ফেরার পর এসব শুনে আরো অসুস্থ হয়ে পড়তো। যারা তোমাকে বিয়ে করতে আসতো তারা প্রত্যেকেই লোভে পড়েই দুর্নাম রটানো মেয়েকে বিয়ে করতে আসতো। আর তোমার লাইফের করুন পজিশনটা তুমি সেখানেই দেখতে। আমি যেহেতু তোমাকে সেভ করার দায়িত্ব টা নিয়েছিলাম সেজন্য ই আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। আর আসছে লেন দেনের কথা! খান বাড়ির ছেলে বিয়ে করবে অথচ মোহরানা বেশী হবেনা সেটাতো হতে পারে না। আর এখনকার বিষয়টা পুরোটা আমার রেসপনসিবিলিটি থেকে করার হলেও আমি আমার সম্মান রাখতেই করছি। তোমাকে লালন পালন করতে তোমার বাবার ঠিক কতো খরচ করতে হয় তা আমি এ কয়দিনেই বেশ ভালো ভাবেই জেনে গেছি। আমি নিশ্চয় বেকার ছেলে নয় যে আমার বউকে শ্বশুরের টাকায় খাওয়াবো পড়াবো আর নিজে গা বাঁচিয়ে চলবো। আমি তোমার লাইফে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছিনা। তোমাকে বরং ভরিয়ে দিচ্ছি। তুমি তোমার মতো লাইফ লিড করতে চেয়েছিলে তার ব্যবস্থাই করে দিচ্ছি। তাহলে এসব ভ্যালুলেস প্রশ্ন কেনো মনে পুষে রেখেছো? দয়া করে মানুষ হতদরিদ্রের উপর। তুমি তো তা নও। তোমার বাবার সাথে মনোমালিন্য বিষয়টা তাড়াতাড়ি আলোচনায় গিয়ে শেষ করো। উনি তোমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে ভালো চায় তুমি নিজেও জানো না। ‘
তানভীর থামে। কথা বলতে বলতে বেশি হাইপার হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে দমিয়ে নেয়। চেয়ার ছেড়ে লাবিবার দিকে এগিয়ে যায়। পাংশুটে মুখটা থুতনিতে হাত রেখে উপরে তুলে। কঠিন গলায় হুকুম করে,
‘ বাসায় ফিরে মান অভিমানের পালা দূর করো লাবিবা। আর নেক্সট টাইম আহাম্মকের মতো এসব কথা বলবেনা। ‘
লাবিবা আর কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই। তবুও জোর টেনে বিরবির করলো,
‘ আপনি তো আমার দ্বিধা কাটিয়ে দিলেন না। ‘

চলবে,