ভালোবাসার রঙে রাঙাবো পর্ব-২৬

0
624

#ভালোবাসার_রঙে_রাঙাবো💜
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি💜
#পার্টঃ২৬
সময়ের সাথে সাথে মানুষ আস্তে আস্তে নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখে যায়।পরিস্থিতি যতোই খারাপ হোক না কেন?নানান রকম কথা দিয়ে নিজের মনকে বুঝায়।সাদুর পরিস্থিতিও ঠিক সেরকমই সে মানিয়ে নিয়েছে।কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা সেইদিনের ঘটনার রেশ রয়ে গেছে।নিজের মস্তিষ্ককে এটা ওটা বলে বুজিয়ে শান্ত করলেও মনটাকে শান্ত করতে পারে না।মেহমাদের জন্যে একটু হলেও তার বুকটা পুড়ে।একটা মানুষ কিভাবে এতোটা ভালোবাসতে পারে যে সে মরার পরেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ না করে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে গেছে।আর শেষ পরিনতি কি হলো?পূর্ণতা পেলো না তার ভালোবাসা।সাদু কেন যেন নিজেকে দোষী ভাবছে।কোথায় একটা অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।বাগদানের আজ ২ দিন হয়ে গিয়েছে।সবাই হাসি ঠাট্টা হই হুল্লোড়ে থাকলেও সাদু সেদিনের পর থেকে একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।যখনি সময় পায় ছাদে এসে বসে থাকে।আর আকাশের দিক তাকিয়ে আছে।এমনও আছে কোন সময় প্রচন্ড কান্না করে কিন্তু কেউ সেই কান্নার আওয়াজ কেউ পায় না।এদিকে প্রিয়তমাকে দুদিন যাবত এমন মন মরা দেখতে ভালো লাগছে না মনিরের।কি হলো মেয়েটার বাগদানের দিন তো কতো খুশি ছিলো। কিন্তু হঠাৎ কি হলো কিছু বুজতে পারছে না।সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায় সাদু সারা বাড়ি খুজেও না পেয়ে মনির অবশেষে ছাদে আসে।ছাদের গেট আলগোছে খুলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মনির।মেয়েটা যে কেন এমন হয়ে গেলো ভেবে পায়না সে।কি এতো দেখে আকাশের দিক তাকিয়ে মেয়েটা।মনির খেয়াল করলো সাদুর শরীর হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে।মনির দ্রুত পায়ে সাদুর কাছে গিয়ে দাড়ালো।এবং ওর কাঁধে হাত রাখলো।এদিকে সাদু বুজেছে যে মনির এসেছে তাই সে চেষ্টা চালাচ্ছে কান্না থামানোর কিন্তু এই বেহায়া চোখের পানি থামছেই না।সাদু পারছে না নিজেকে থামাতে। মনির বুজলো বড় কিছু হয়েছে।তাই সে আদুড়েভাবে ডাকলো,

–” উম্মিপাখি!”

এই ডাকটা! এই ডাকটা ইসস! এই ডাকটা সাদুর ভীতরটা শুদ্ধ কাঁপিয়ে দেয়।বাজেভাবে কাঁপন ধরে একেবারে।এই ডাকটা তার সব কিছু এলোমেলো করে দেয়।ভীতর থেকে কান্নারা বাঁধ সাধতে দেয়না।সাদু পারলো না আর নিজেকে ধরে রাখতে পিছনে ঘুরেই মনিরকে ঝাপ্টে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো।মনিরের বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে প্রিয়তমার এমন বেদনাদায়ক কান্নায়।কেন কাঁদছে ও? মনির দুহাতে সাদুকে বুকের সাথে চেপে ধরলো।কিন্তু ওর কান্না থামালো না।কাঁদুক একটু কাঁদলে মন হালকা হয়।মনিরের বুকের কাছের শার্ট খামছে ধরে অনেকক্ষন কাঁদলো সাদু।এইবার মনির বাধ সাধলো।অতি আদড়ের সহিত সাদুর চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,

–” কি হয়েছে আমার আদুড়িনির? কেন সে এতো কান্না করছে?সে কি বলবে তার এতো মন খারাপ কেন হয়েছে?”

সাদুর হিচঁকি উঠে গেছে।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সাদু আধো আধো স্বরে বলে,

–” আপনি তো আমায় বিশ্বাস করেন তাইনা?”

মনির চকিত তাকালো।বললো,

–” হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

সাদু ভেজাগলায় আবারো জিজ্ঞেস করে,

–” বলুন না বিশ্বাস করেন?”

মনির অবাক হয়েই বললো,

–” তোমাকে বিশ্বাস করবো না কেন?যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসা নেই বুজলে।”

–” আমি যা বলবো আজ তা কি আপনি বিশ্বাস করবেন?”

মনির দুহাতের আজলে সাদুর মুখটা নিয়ে পরম যত্নে প্রিয়তমা স্ত্রীর কপালে চুমু খেলো।বললো,

–” আমার উম্মিপাখি আমাকে যা বলবে আমি সব বিশ্বাস করি।”

সাদুর চোখের জল মুছলো।সাদু ছাদের দোলনাটা ইশারা করে বলে,

–” ওখানে গিয়ে বসে বলি।”

সাদু যেতে নিলে মনির ধপ করে সাদুকে কোলে তুলে নেয়।সাদু হালকা হাসলো,

–” কি করছেন?আমি তো এতোটুকু যেতে পারতাম।”

মনির মিথ্যে রাগ দেখিয়ে হলে,

–” আমার বউকে আমি কোলে নিয়েছি তাতে তোমার কি?”

সাদু আর কিছু বললো না দুহাতে মনিরের গলা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ লুকালো।মনির সাদুকে সেইভাবেই কোলে নিয়ে দোলনায় গিয়ে বসলো।তবুও সাদুকে কোল থেকে নামালো না।দুজনেই চুপ করে আছে।মনির ও কিছু বলছে না সে জানে সাদু এমনিতেই সব বলবে।অনেক্ষন নিরবতা কাটার পর সাদু মুখ খুললো।একে একে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা সে মনিরকে বললো।মেহমাদের সকল রহস্য বললো।মেহমাদের ভালোবাসা,তার অপেক্ষা, তার এতোটা কষ্টময় পরিস্থিতির ঘটনা সব বললো।মনির অবাক হয়ে সব শুনছে।আদৌ কি এসব সম্ভব?কিন্তু সাদু যেভাবে বলছে এতে তো সব সত্য মনে হচ্ছে তার কাছে।মনির যতো শুনছে ততো অবাক হচ্ছে।মনির সব কিছু ধ্যান দিয়ে শুনলো।বলা শেষে সাদু মনিরের কাধ থেকে মুখ উঠিয়ে কান্নামাখা চেহারা নিয়ে মনিরের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বলে,

–” আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না তাই না?আমি জানি কেউ বিশ্বাস করবে না।”

মনির সাদুর চোখের জল মুছে দিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো সাদুর ঠোঁটে তার পর বলে,

–” আমার উম্মিপাখিকে আমি কখনো অবিশ্বাস করতে পারি বলো?”

সাদু আবার ঠোঁট ফুলিয়ে ফোফাতে লাগলো।দুহাতে মনিরকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো।বললো,

–” আমি কি খুব বেশি অপরাধ করেছি।আমি কি তাকে ঠকিয়েছি বলুন।আমি কি করে তার সাথে যেতাম?আমি তাকে ভালোবাসি না।আমি ভালোবাসি আপনাকে। আপনি আমার স্বামি। আপনার ভালোবাসার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছি আমি।সেখানে কিভাবে আবার অন্যের ভালোবাসার রঙে রাঙাতাম নিজেকে আপনি বলুন?তবুও কষ্ট হচ্ছে।তার এতো বছরের অপেক্ষা, ভালোবাসা পাওয়ার তৃষ্ণা সবটা অপূর্ণতার চাঁদরে মুরিয়ে গেলে।আমি কিভাবে ক্ষমা করবো নিজেকে? আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না।”

মনির কিছুক্ষন চুপ থাকলো।সাদুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ বলতে শুরু করে,

–” ভালোবাসা অপরাধ না।না তুমি অপরাধ করেছো আর না মেহমাদ অপরাধ করেছে।কেউই দোশি না তাই নিজেকে দোষারোপ করা বন্ধ করো।
আর সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়না।যেখানে মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়না সেখানে মেহমাদের তো অসম্ভব।আর তোমার সাথে তো একেবারেই অসম্ভব।সে মারা গেছে।আর তুমি জীবিত।
আর তুমি আমাকে ভালোবাসো।ভালোবাসা জোড় করে হয়না সেটা তুমিও জানো আমিও।আল্লাহ্ যদি তোমাকে মেহমাদের জন্যে বানাতো তবে তুমি মেহমাদেরই থাকতে।আমার সাথে আল্লাহ্ তোমাকে পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতেন না।এখন বিয়ে আমাদের যেভাবেই হোক।হয়েছে তো।আমরা স্বামি স্ত্রী।ভালোবাসা যদি আমাদের মাজে নাও থাকতো তবুও আমরা এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ।তাই চাইলেও আমাদের বিচ্ছেদ সম্ভব না।তার ভাগ্য এমনটাই ছিলো বলে এটাই হয়েছে ভাগ্যকে কেউ বদলাতে পারে না।তাই এইভাবে নিজেকে তিলে তিলে কষ্ট দিও না। নামাজ পড়ো কুরআন তিলাওয়াত করো মেহমাদের জন্যে দোয়া চাও।যেন সে পরকালে ভালো থাকে।শান্তিতে থাকে।”

সাদু শুনলো প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো।আশ্চর্য তার মন খারাপ ভাবতা আর নেই।মনটা ভীষন হালকা লাগছে তার।এটাই বুজি স্বামির ভালোবাসার শক্তি।স্বামির ছোঁয়ায়, তার প্রতিটি কথায় বুজি এতোটাই শান্তি।এইযে যার বুকে সে পরম শান্তিতে মাথা দিয়ে আছে ব্যাক্তিটি তার স্বামি।এই লোকটা কি জাদু জানে?সাদুর এতো এতো মন খারাপ কি সুন্দর এক নিমিষেই শেষ করে দিলো।মনির সাদুকে চুপ থাকতে দেখে হালকা হাসলো।বললো,

–” আর যতো যাই হয়ে যাক না কেন?আমি তোমাকে ভালোবাসি।আর তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করবে এটা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো হাতে নেই।আমার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়েছি তোমাকে।সেই রঙ কি এতোটাই ফিকে যে তা হালকা পানির ছোঁয়া পেয়েই মুছে যাবে?উমহু! কিছুতেই না। তুমি আমি এই ভালোবাসাময় রঙে একে অপরকে রাঙিয়ে যাবো আজীবন।
ভালোবাসি আদুড়িনী।”

সাদুর ঠোঁটের কোণে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো প্রশান্তিময় সেই হাসি।এই মানুষটা তার সাথে থাকলে তার কি চায় সে?এই দুনিয়াতে আর কিছুই চায়না।শুধু এইভাবেই যেন এই লোকটার বুকে তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারে।এইটাই সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল আবেদন তার।

—————-
আলিশার পিছনে ঘুরঘুর করছে নিবিড়।তার একটাই কথা।তারা রিলেশনে গিয়েছে আজ দুদিন এখনি অব্দি সে আলিশার সান্নিদ্ধ ঠিকভাবে পেলো না।আরে ভাই প্রেম করছে তারা।নতুন নতুন প্রেম কোথায় একটু একান্ত রোমান্টিক টাইম স্পেন্ড করবে তা না এই মেয়ে সারাদিন এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে।এটা ঠিক না একদমি ঠিক না কিন্তু এই মেয়েকে তা কে বুজাবে?আলিশা কথা বলছিলো বাকিদের সাথে।এরই মাজে ওর পিছনে এসে দাড়ালো নিবিড়।নিবিড়কে দেখে নূর দাঁত ভেটকানি দিয়ে বলে,

–” হাই দুলাভাই!”

নিবিড় ঘুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

–” এই কি ডাকলে দুলাভাই! হ্যা এইটাই ডাকবে শুনতে ভালো লাগে।”

আলিফা ভাব নিয়ে বলে,

–” দুলাভাই ডাকা এতো সহজ না। কিছু দিলেই তো কিছু পাবেন না-কি?”

নিবিড় বিরবির করে বলে,

–” কি আর দেবো তোমাদের,?তোমার বান্ধবী তো আমাকে এখনো কিছুই দিলো না।”

আলিশা চোখ রাঙিয়ে বলে,

–” কি বললেন?”

নিবিড় দাঁত কেলিয়ে বলে,

–” কিছুনা বলছিলাম যে আমার সালিকাদের কি ট্রিট চাই।”

নূর কিছু বলবে এরই মাজে হাজির হয় আফরান,আরিফ আর মেরাজ।আরিফ গিয়েই আলিফার সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,

–” এইযে আলু সাহেবা। তোমার কি খেয়াল আছে যে তোমার একটা অসহায় প্রেমিক সবসময় তোমার জন্যে কাতর হয়ে থাকে।”

আলিফা চোখ ছোট ছোট করে বলে,

–” ওমা তাই না-কি?”

–” হ্যা! এখন চিপায় আসো।”

আরিফের কথায় কথায় আলিফা মুখ ভেংচি দিলো।আরিফ এইবার চেঁচিয়ে উঠে,

–” এই তোমরা সবাই চোখ বন্ধ করো।”

কথাটা শুনে আলিফা ধমকে উঠে,

–” কেন চোখ বন্ধ কেন করবে?”

আরিফ পাত্তা দিলো না।

–” আরে করো সবাই চোখ বন্ধ। ”

আফরান নিবিড়ের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,

–“করবো না বন্ধ কি করবি তুই।”

আরিফ হাসলো।হঠাৎ চট করে আলিফাকে কোলে নিয়ে বলে,

–” কিছু না জাস্ট নিজের বউকে কোলে নিয়ে ভেগে যেতাম।”

আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে আলিফাকে নিয়েই হাটা দিলো আরিফ।এদিকে আলিফা সমানে কিলঘুশি দিয়েই যাচ্ছে তাতে কোন হেলদোল নেই আরিফের।নূর সেদিকে তাকিয়েই বলে,

–” কি কিউট দুজনেই।আহা! ”

আফরান আস্তে করে নূরের কানে বলে,

–” আমাদের জোড়িও এমন কিউট। ”

নূর ভ্রু-কুচকে তাকালো।তা দেখে আফরান বলে,

–“বিশ্বাস হচ্ছে না?আসো আমি কোলে নেই তারপর ওদের জিজ্ঞেস করো আমাদের একসাথে কিউট লাগে কি-না।”

নূর রেগে বোম হয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো।সিড়ির কাছে গিয়ে আবারো ফিরে তাকালেই আফরান তাকে চোখ মেরে দেয়।নূর দ্রুত নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো।কিন্তু ঠোঁটে লেগে আছে তার অমায়িক মিষ্টি হাসি।

#চলবে_______

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।