ভালোবাসার সন্ধিক্ষণ পর্ব-১২

0
183

#ভালোবাসার_সন্ধিক্ষণ
#গল্পছোঁয়া Jannatul Ferdous Mahi
#পর্ব_১২

–কংগ্রাচুলেশনস মিঃইয়ামিন চৌধুরী,আপনি বাবা হতে চলেছেন।

–(নিশ্চুপ)

–কি হলো,আপনি খুশী নন

–প্রতিভা,আর ইউ সিরিয়াস

–হুম,রিপোর্ট টা দেখুন।
আমি কনসিভ করেছি,২মাস চলছে

–তুমি কি ইচ্ছে করে কনসিভ করেছো

–অবশ্যই,কনসিভ করার জন্য আমি পিল খাওয়া বাদ দিয়েছিলাম।
এতদিনে আমার আপনার অংশ,আমাদের সন্তানও পৃথিবীতে আসবে বলুন।

–প্রতিভা,আমি বলিনি আমার বাচ্চা প্রয়োজন।আজ তোমার এই সিদ্ধান্তে যদি তোমার কিছু হয়ে যায় তখন

–ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না,আল্লাহর ওপর ভরষা রাখুন।

ইয়ামিন কিছু না বলে প্রতিভাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো,বাবা হতে চলেছে এটা শোনার পর যতটা না খুশি হয়েছে তার থেকে বেশি প্রতিভাকে হারানোর ভয় জেকে ধরেছে ইয়ামিনের মনে,যদি কোনো কিছু হয়ে যায় তখন।


২মাস পর..
সিএনজি করে বাসার দিকে যাচ্ছে লামিয়া আর প্রতিভা,হসপিটালে চেকআপে জন্য গিয়েছিল তারা।গত ২সপ্তাহ যাবৎ ইয়ামিনের টাইফয়েড জ্বর হওয়ায় সে বেডরেস্টে রয়েছে।
প্রতিভা পুরো পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে আছে,লামিয়াও চুপচাপ।টেস্ট রিপোর্টে ধরা পড়েছে প্রতিভার অনাগত সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত, এটা জানার পর থেকেই প্রতিভা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে,লামিয়া অনেক চেষ্টা করেছে কথা বলার কিন্তু প্রতিভার কোনো সাড়া নেই।

*বাসায় এসে দেখে ইয়ামিন কুশন কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছে,মিসেসঃফাতেমা বেগম লামিয়া আর প্রতিভা কে দেখে দ্রুত পানি আনতে গেলেন।
ইয়ামিন ওদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুরে দিলো,

–টেস্ট করিয়েছো?

প্রতিভা কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ নিজেদের রুমে চলে গেলো।

–কি হয়েছে লামিয়া,সব ঠিক আছে তো?
প্রতিভা এমন চুপচাপ কেন,কিছু না বলে এভাবে চলে গেলো,টেস্ট করিয়েছিস,রিপোর্টে কি এসেছে? (চিন্তিত হয়ে)

–কিছু ঠিক নেই ইয়ামিন স্যার? (কাঁদো কাঁদো গলায়)

–কি হয়েছে

লামিয়া রিপোর্ট ফাইলটা ইয়ামিনের দিকে এগিয়ে দিলো,ইয়ামিন রিপোর্ট টা পড়ে পুরো স্তব্ধ হয়ে গেছে।

–স্যার,প্রতিভা একদম ঠিক নেই,ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে,ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করুন স্যার,তানাহলে প্রবলেম হয়ে যাবে।

ইয়ামিন কিছু না বলে ফাইলটা সোফার ওপর রেখে দ্রুত রুমে চলে গেলো,রুমে ঢুকে দেখে প্রতিভা এলোমেলো ভাবে বিছানায় বসে আছে,গায়ের বোরকা টাও খুলেনি,কেমন একটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে।
ইয়ামিন এগিয়ে গিয়ে প্রতিভার পাশে বসে প্রতিভাকে বুকে জড়িয়ে নিলো,ইয়ামিনের সংস্পর্শে এসে ডুকরে কেঁদে উঠলো প্রতিভা।

–কাদছো কেন তুমি,পাগলি মেয়ে এভাবে কান্না করতে আছে নাকি,সব ঠিক হয়ে যাবে

–কিছু ঠিক হবেনা কিচ্ছু ঠিক হওয়ার নেই।আমাদের সন্তান যদি জীবিত অবস্থায় জন্ম নেয়,আল্লাহ যদি ওকে হায়াত দান করে তাহলে সারাজীবন আমার মতো এতো যন্ত্রণা সহ্য করে বাঁচতে হবে।
আমি তো এমন চাইনি,আল্লাহর কাছে রাতদিন প্রার্থনা করেছি,আমার সাথে যেটা হয়েছে হয়েছে,যা হবার হবে,কিন্তু আমার সন্তানকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে এনে দাও,সে যেন একদম সুস্থ থাকে,তাহলে কেন এমন হলো বলুন।

প্রতিভা নানান প্রলাপ বকছে আর ডুকরেডুকরে কাঁদছে,ইয়ামিন কিইবা বলবে,সবই আল্লাহর ইচ্ছে,এর ওপর তো কারোর হাত নেই।

–প্রতিভা শান্ত হও,আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসার পর থেকেই আমরা ওর ট্রিটমেন্ট করাবো।তুমিতো জানো এখনকার চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা উন্নত,আশা করি রোগের উপসর্গ তীব্র হবে না।
আমি রিসেন্টলি পড়েছি,থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা সম্পর্কে।

*নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন,রক্তের আয়রন কমানোর ওষুধ প্রয়োগ,জটিলতা নির্ণয় ও নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

*প্লীহা বড় হলে সার্জারী করে ফেলে দেওয়া,ক্ষেত্রবিশেষে এই চিকিৎসার শরণাপন্ন হতে হবে।

*অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন পদ্ধতির মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীর শরীর থেকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়।

*আপন ভাইবোন বা বাবা-মা যদি সুস্থ/বাহক হয় আর তার সঙ্গে যদি ১০০% এইচএলএ ম্যাচ হয়,তবে তার শরীরের স্টেম সেল নিয়ে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়,এতে ৯০শতাংশ ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে রোগমুক্ত করা যায়।

এই এইচএলএ এর পূর্ণরূপ হলোঃ- হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন।এটি মানুষের মধ্যে উপস্থিত এমএইচসি জিন কমপ্লেক্সের একটি রূপ।

আমরা আমাদের সন্তানকে প্রোপার ট্রিটমেন্ট করাবো বুঝেছো।এখন কান্না বন্ধ করো,এরওপর তো আমাদের কোনো হাত নেই,সব আল্লাহর ইচ্ছা।
তুমি এভাবে যদি ভেঙে পরো তাহলে কিভাবে সব ঠিক থাকবে বলো,শক্ত হও তুমি,তুমি একজন মা,মায়েদের সবসময় শক্ত থাকতে হবে নিজের সন্তানের জন্য।ফ্রেশ হওতো,কি অবস্থা করেছো নিজের,পুরো পাগলি দেখাচ্ছে।এরকম করলে কিন্তু আমাদের সন্তান তোমাকে পাগলি বলবে,পেত্নী বলবে,তখন কেমন লাগবে বলোতো।
হায়হায়,আমার এতসুন্দরী কিউট মিষ্টি একটা বউ কিনা শেষে পাগলি আর পেত্নী হয়ে যাবে,ভাবতেই কেমন লাগছে আমার,জাস্ট ইমাজিন করো কে…

–থামুনতো,সবসময় বাজে কথা (কপোট রাগ দেখিয়ে)


কেটে গেলো কয়েকটা দিন,প্রতিভার ব্লাড নেওয়ার ডেট ওভার হয়ে গেছে,এতো চেষ্টা করেও O- group এর কোনো ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না,গতমাসে ইয়ামিনের সেই কলিগ ব্লাড দিয়েছিলো,৩মাস নাহলে তো সে আর ব্লাড দিতে পারবেনা,এছাড়াও তিনি বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে গেছেন।
ইয়ামিনের টাইফয়েড জ্বর বেশ অনেকটাই কম,কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়নি সে,যার কারণে তার পক্ষে ব্লাড দেওয়া ইম্পসিবল।এদিকে প্রতিভার অবস্থাও খারাপ,ইমিডিয়েটলি ব্লাড না পেলে গর্ভে থাকা বাচ্চা আর প্রতিভা দুজনেরই মৃত্যুঝুকি রয়েছে।ইয়ামিনের ইতিমধ্যে সোসাল মিডিয়ায় ইমার্জেন্সি রক্ত চেয়ে পোস্ট করেছে,এখন অবধি ডোনার পাওয়া যায়নি।O- রেয়ার গ্রুপ হলেও এতোটা রেয়ার না যে একজন ডোনারও পাওয়া যাবে না,কিন্তু এখন এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছেনা ইয়ামিন।


বিকেলে ইয়ামিন ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে যদি কোনো ডোনারের সন্ধান মিলে সেই আশায়,প্রতিভা শরীরের যন্ত্রণায় একপ্রকার কাতরাচ্ছে,প্রতিভা ওর মায়ের ঘরে আছে,মিসেসঃফাতেমা বেগম মেয়ের সেবা করছেন।
হঠাৎ ইয়ামিনের ফোনে কল আসলো,আননৌন নম্বর থেকে।কল রিসিভ করে কথা বলেই ইয়ামিন জানতে পারলো এটা এক ডোনারের ফোন কল,পোস্টে নম্বর দেওয়া ছিল সেটা দেখেই কল করেছেন তিনি।ইয়ামিন লোকটিকে রাজশাহী মেডিকেলে আসতে বললো দ্রুত।ইয়ামিন পাশের রুমে গিয়ে দেখে প্রতিভা ওর মায়ের কোলে মাথা রেখে সুয়ে আছে।

–মা,আপনি প্রতিভাকে তাড়াতাড়ি রেডি করান,ডোনার পাওয়া গেছে,আমরা এক্ষুনি মেডিকেলে যাব।
প্রতিভা ওঠো,চিন্তা করোনা তুমি।

প্রতিভা সোয়া থেকে উঠে বসলো,প্রতিভার মা মিসেসঃফাতেমা বেগম মেয়েকে ধরে ধরে ওয়াসরুমে নিয়ে গেলেন,ওয়াসরুমে ঢুকিয়ে বাইরে চলে আসলেন তিনি,কারণ প্রতিভার প্রস্রাব বেগ এসেছে।
প্রায় ৫মিনিট পর ওয়াসরুমের ভেতর থেকে প্রতিভার চিৎকার শোনা গেলো,ইয়ামিন আর মিসেসঃফাতেমা বেগম তাড়াতাড়ি ওয়াসরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে পুরো ফ্লোর রক্তে মাখামাখি প্রতিভা এককোনায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে পেটে হাত রেখে চেচাচ্ছে।
মিসেস ফাতেমা বেগম দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে চেপে ধরলেন..

–কি হয়েছে মা তোর,এত রক্ত কোই থেকে আসলো,কিরে

–আম্মু,আমি জানিনা
আমি প্রস্রাব করার জন্য বসতে যাব তখনই কি যেন আমার জড়ায়ু নালির ওখান থেকে ধপ করে টয়লেটে পরে গেলো,বুঝতে পারিনি,তারপর থেকেই এরকম ব্লেডিং হচ্ছে,পেটে ভীষণ ব্যথা করছে আম্মু,মরে যাচ্ছি আমি,আআহ্
আমার বাচ্চা,আ… (সেন্সলেস হয়ে গেলো প্রতিভা)

ইয়ামিন দ্রুত প্রতিভাকে কোলে তুলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো ওই অবস্থাতেই,লিফটে করে নিচে নেমে একটা ট্যাক্সি ডেকে প্রতিভাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ইয়ামিন ও মিসেসঃফাতেমা বেগম।ভয় আর চিন্তায় ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে ইয়ামিন,মিসেসঃফাতেমা বেগমতো আয়তাল কুরসি পড়ছে আর কান্নাকাটি করছে।


হসপিটালের কেবিনে সেন্সলেস অবস্থায় সুয়ে আছে প্রতিভা,পাশের বেডে ডোনার লোকটি শুয়ে আছে,প্রতিভাকে রক্ত দিচ্ছেন তিনি।
বাইরে বসার জায়গায় চিন্তা আর ভয় নিয়ে বসে আছে ইয়ামিন,ইয়ামিনকে ভরসা দিচ্ছে রিয়াজ।মিসেসঃফাতেমা বেগমের কান্নাকাটি বন্ধ হওয়ার নামই নেই,রিয়াজের স্ত্রী মিসেসঃরাজিয়া তাকে সামলাচ্ছেন।
ডক্টর প্রতিভার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলে ইয়ামিন তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুরে দিলো..

–ডক্টর,আমার ওয়াইফ আর বাচ্চা ঠিক আছেতো?

–আপনার ওয়াইফ এখন আউট অফ ডেঞ্জার,ওনাকে ব্লাড দেওয়া হচ্ছে।
বাট আই এম সরি টু সেয়,আপনার বাচ্চাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি…….

To be continue….