নিয়তি পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
585

#নিয়তি
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

শেষ পর্ব

জীবন নিবিড় স্রোতে বয়ে চলা এক বিষাদ সাগরের নাম। আর নিয়তি হচ্ছে সে সাগরের বুকে অবিরাম ধেয়ে চলা পালহীন নৌকা। ছুটে চলা দুর্গতি। ‘জীবন যদি কল্পনার মতো উচ্ছ্বল হতো তবে কত-ই না সুন্দর হতো। চাইলেই যদি একটু পেছন ফিরে অতীতের ভুল গুলো শুধরে নেওয়া যেতো তবে জীবন হতো অর্থবহ,অধিক সুখময়। মানুষ তো কল্পনাতেই সুখী। কল্পনায় ভেসে ভেসে জীবন খুজে পায় রংধনুর সাতরং। অথচ ভাবনার সুতো ছিড়ে কল্পনার ঘুম ভাঙলেই বোঝা যায় জীবন কি? বাস্তবতা কত কঠিন, কত দুর্লোভ।

,ধুলো জমে থাকা বারান্দার রেলিং দু হাতে আঁকড়ে ধরে সাদামাটা আকাশটার দিকে তাকিয়ে জীবনের রং খুজে খুঁজে মরিয়া হয়ে উঠছে মেহরুবা। কোথায় সেই জীবনের রংধনুর সাত রং? কোথায় তার সাজানো সংসার? কোথায় গেলো তার বুকের মানিক? নেই নেই কোথাও কিছু নেই। সব যেনো হঠাৎ ঝড়ে চোখের পলকেই তছনছ হয়ে গেলো। সুখের নীড় ভেঙে গেলো। সুখ গেলো দীর্ঘশ্বাসে ভেসে গিয়ে জায়গা করে নিলো আজন্ম দুঃখের স্রোত।

খোলা আকাশের দিকে তাকিয়েই মেহরুবার চোখ জলে টলমল করে উঠলো। বারান্দার রেলিং ছেড়ে ডান হাতের তালুতে চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলো,

‘এই কপালে বুঝি এতোই দুঃখ লেখা ছিলো খোদা!

দেখতে দেখতে বছর গড়ালো। আগের মতো আর কিচ্ছু ঠিক নেই। ঘরে অসুস্থ স্বামী। একমাত্র সন্তান, কলিজার টুকরা সাফওয়ান তার বুক জুড়ে নেই৷ সব যেনো শেহরীনের দীর্ঘশ্বাস দিনের পর দিন তার কাছে শুষে নিয়েছে।

বছর খানিক আগে

শেহরীনের মৃত্যু তখন ছয় মাস গড়িয়েছে। কালক্রমে সবাই ভুলেও গিয়েছে শেহরীন নামের কেউ দিনের পর দিন অবহেলিত হয়ে এ বাড়ির মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। আবেশ, মেহরুবা, আয়না বেগম সময়ের সাথে সবাই মেতে উঠেছে নিজস্ব আনন্দে। চোখের আড়াল হলেই যে মানুষ মনের আড়াল হয়ে যায় শেহরীন ছিলো তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

‘ছোট্ট সাফওয়ান আধো আধো বুলিতে মা ডাকা শিখেছে। ক্ষনে ক্ষনে বাবাও ডাকতে শোনা যায়। একমাত্র সন্তানের মুখে বাবা,মা ডাকা শুনে খুশীতে আত্মহারা আবেশ- মেহরুবা দম্পত্তি। আবেশের খুশী আর দেখে কে! আনন্দ, খুশী,সুখে তাদের জীবন টইটম্বুর। কোথাও যেনো এক ফোঁটা দুঃখ নেই।

‘কিছু সময় হলো অফিস থেকে ফিরেছে আবেশ। বিছানার উপর সাফওয়ান কে নিয়ে খুনসুটিতে মেতেছে সে। মাগরিবের আজান শেষে জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে মেহরুবা। মাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মা মা বলে খিলখিল করে হেসে উঠে সাফওয়ান। হাসে মেহরুবাও। চায়ের কাপটা আবেশের হাতে তুলে দিয়ে সাফওয়ান কে কোলে তুলে নেয় সে। চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিতেই আবেশের দিকে স্থির হয় মেহরুবা। শান্ত গলায় খুব রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে,

‘একটা কথা বলবো তোমাকে?

মেহরুবার এমন পারমিশন চাওয়াতে একটু অবাক হয় আবেশ। তবুও নিজেকে তটস্থ করে চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিতে দিতে বলে,

‘হুম বলো। কি বলবে।

‘মেহরুবা আর কোনো ভনিতা করেনা। সোজা সাপটা ভাবে বলে উঠলো

‘দীর্ঘ দিন বাড়ির বাইরে যাওয়া হয় না। সামনে তোমার ছুটিও পড়ে গেছে। তাই ভাবছিলাম দু এক দিনের জন্য সাফওয়ান কে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসি। এতে ওর ব্রেইন ডেভলপমেন্টও হবে। কি বলো?

‘ আবেশ ভাবে,’ মেহরুবার কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আসলেই বিয়ের পর থেকে এখনও মেহরুবা নিয়ে কোথাও যাওয়া হয় নি। যাবো যাবো বলে নানা রকম ঝড় ঝামেলার মধ্য দিয়ে আর যাওয়া হয়নি। এখন অফিসে কাজের চাপ কম। পহেলা বৈশাখের সুবাদে কাল থেকে তিন দিনের ছুটিও আছে। এ সুযোগে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসাই যায়। নিজের মনে কথা গুলো ভেবেই মেহরুবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে আবেশ,

‘কথাটা মন্দ বলো নি। কিন্তু যাবো টা কোথায়?

মেহরুবা চুপ থাকে। দুয়েক দন্ড সময় নিয়ে উচ্ছাস নিয়ে বলে উঠে,

‘সিলেট যাওয়া যায়।

‘সিলেট?

‘হুম। প্রথমে সিলেটের খাদিম নগরে এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে যাবো। তারপর হাকালুকি হাওর ঘুরবো। সব শেষে হযরত শাহজালাল রাঃ মাজার জিয়ারত করে বাড়ি ফিরে আসবো। ভালো হবে না বলো?

‘উমমম ভালো হয়। কিন্তু এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে দেখার মতো আর কি আছে তার চেয়ে বিছানা কান্দি গেলে ভালো হয় না?

‘আবেশের কথায় মেহরুবা একটু গাল ফুলিয়ে রইলো। মেকি অভিমান নিয়েই বললো,

‘উহু বিছানা কান্দি গেলে পরে যাবো। এখন আমি এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডেই যাবো। তুমি জানো কত সুন্দর সে জায়গাটা? অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। নয়নাভিরাম বিনোদন পার্ক অ্যাডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ড। বিশাল আয়োজনে পাহাড়-টিলা এবং চা বাগান এলাকায় মনমুগ্ধকর পরিবেশে নির্মিত হয়েছে এ পার্কটি। এখানে সব সময়ই দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। কয়েকজন প্রবাসী সিলেটির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ পার্কে ইতিমধ্যেই প্রায় ২৫টি রাইড স্থাপন করা হয়েছে। আর এসব রাইডের মাঝে সবচেয়ে উপভোগ্য রাইড হচ্ছে জারেন্ট হুইল। এ রাইডে উঠলে পুরো বিমান বন্দর এলাকা ও চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ছোট ছোট টিলা কেটে পরিপাটি করে সাজানো নয়নাভিরাম এই পার্কটি অল্প সময়েই দর্শনার্থীদের মন আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। এ পার্কের আরেকটি উপভোগ্য রাইড হচ্ছে মিউজিকের তালে তালে পানির নৃত্য।

মেহরুবার মুখে এমন বর্ননা শুনে আর দ্বিমত করলো না আবেশ। চোখের সামনেই যেনো এডভেঞ্চর ওয়ার্ল্ডের সৌন্দর্য দেখতে পেলো। দুজন মিলে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্তও নিয়ে নিলো ভোর হলেই তারা রওনা দিবে সিলেটের উদ্দেশ্যে।

পরদিন সোনালি সূর্য্য পৃথিবীতে উঁকি দিতেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে সিলেটের পথে রওনা দিলো মেহরুবা,আবেশ আর ছোট্ট সাফওয়ান। এই প্রথম সে বাড়ির বাইরে অদুরে যাচ্ছে। আয়না বেগম আসার সময় পই পই করে বলে দিয়েছেন সাফওয়ানের যেনো কোনো অযত্ন না হয়। সবাই কে বিদায় জানিয়ে শহরের বুক ফেড়ে ধেয়ে চলছে সৌন্দয্যের লাীলাভুমি সিলেট নগরীতে।

চার পাচ ঘন্টা টানা ড্রাইভ করার পর দুপুরের পর পরই তারা সিলেটে পৌছে গেলো। প্রথমে এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা সেখানে গেলো না। প্রথমে হাকালুকি হাওর ঘুরে, মাজার জিয়ারত করে আসলো। তখন রাত সাড়ে আট টা বাজে। মাজারের কাছেই একটা রিসোর্ট বুকিং করে রাত টুকু সেখানে কাটিয়ে দিলো। পরদিন সকাল বেলা তারা এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে চলে যায়। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকেলের দিকে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সিলিটের খাদিম নগরে উচু নিচু অজস্র টিলা। পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা। গাড়ির ব্রেক হেন্ডেল করতে হিমশিম খাচ্ছে আবেশ। এদিকে সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ডুবুডুবু। বৈশাখ মাস। সন্ধ্যার আকাশ তখন তুলোট মেঘে আচ্ছন্ন। থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে মেঘের গুড়ুম গুড়ম আওয়াজ। হঠাৎ ই বৃষ্টি নেমে এলো। চোখ অন্ধকার করা বৃষ্টি। পথ ঘাট মারাত্মক পিচ্ছিল। গাড়ি নিয়ে সামনে আগানোর জো নেই। পাহাড়ি অঞ্চলে গাড়ি নিয়ে পথে বসে থাকাটাও বিপদজনক। অজানা এক আশংকা চেপে বসলো আবেশের মস্তিষ্কে। পরিস্থিতি দিশেহারা। মেহরুবাও ভীষন ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে। সাফওয়ান তখন বেঘোর ঘুমে। সাফওয়ানকে বুকে জড়িয়ে আল্লাহকে স্মরন করে যাচ্ছে সে।

‘কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর বৃষ্টির বেগ কমে আসলো। আবেশ খুব সতর্ক হাতে গাড়ি স্টার্ট দিলো। পথ ঘাট পিচ্ছিলে ভয়াবহ অবস্থা। সাথে চোখ ধাঁধানো অন্ধকার। খুব সতর্ক, সাবধান হয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলো না আবেশ। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঝড়ে আক্রান্ত খড়কুটোর মতো রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে গেলো পাহাড়ের খাদে। বেগতিক তাল সামলাতে না পেরে সাফওয়ান হাত ছাড়া হয়ে গেলো মেহরুবার। ঘুমন্ত সাফওয়ান কোল থেকে ঝড়ের গতিতে যেনো উড়ে চলে গেলো অদুরে কোথাও। আবেশ ততক্ষণে রক্তাক্ত,বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে গাড়ির কোনায়। চোখের সামনে অন্ধকারে তলিয়ে গেলো মেহরুবার সমস্ত সুখ। চোখ টা বুজে আসার আগে স্পষ্ট দেখতে পেলো দুমড়ে মুচড়ে ধ্বংস হয়ে গেলো তার সাজানো সংসার।

‘চোখ খুললো দুর্ঘটনার তিনদিন পর। ততক্ষণে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। হসপিটালের কেবিনে শুয়ে অসহায় দুটি চোখে স্বামী, সন্তান কে খুজে বেড়াচ্ছে মেহরুবা। আবেশ তখনও আইসিইউ তে ভর্তি। দুটো পা তার ভেঙেচুরে চুরমার। বাধ্য হয়েই কেটে ফেলতে হয়েছে পা দুটো। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা কাটিয়ে উঠতে মাস খানিক চলে গেলো। মেহরুবা পুরোপুরি সুস্থ হলেও অসুস্থ তার মন। এক মাত্র সন্তান কে সে হারিয়েছে। শেহরীনের পাশেই তাকে দাফন করা হয়েছে। ঘরে অসুস্থ স্বামী। আবেশ তখনও সুস্থ হয়নি। বড়সড় মেন্টালি শকড খেয়েছে। দু পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেছে। সহজে কাউকে চিনতে পারে না। কথা বললে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে দিনরাত মুখে আঁচল চেপে কাঁদেন আয়না বেগম। এতো সুন্দর সাজানো সংসার তার কি থেকে কি হয়ে গেলো! সবই যে তাদের পাপের শাস্তি। একটা জীবন অঙ্কুরে শেষ করে দেওয়ার নির্মম পরিনতি।

‘এভাবেই চলে গেলো বছর। ঘরে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ভাবনার সুতো ছিড়ে মেহরুবার। বারান্দার রেলিং ছেড়ে দৌড়ে ছুটে যায় আবেশের কাছে। আবেশ হাতের ইশারায় কিছু একটা বুঝানোর অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মেহরুবা যেনো আবেশের চোখের পানির নিরব ভাষা চট করে বুঝে নিলো। দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির বাইরে। বাইরে তখন মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে পৃথিবী। মেহরুবা এক দৌড়ে গিয়ে থামে সাফওয়ানের কবরের সামনে। কবরের উপর কাগজ বিছিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেননা আবেশ এখনো বিশ্বাস করে বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে সাফওয়ানের ঠান্ডা লেগে যাবে। তার শ্বাসকষ্ট হবে। সে এখনো মানেনা সাফওয়ান এখন শুধুই আল্লাহর মেহমান। তবুও স্বামীর মনের শান্তির জন্য মেহরুবাও তার কথা মেনে চলছে। কাগজে মুড়িয়ে দিচ্ছে। এমন বুক ভাঙা যন্ত্রণা সইতে না পেরে কবরের সামনে বসেই হাউমাউ করে কেদে উঠে মেহরুবা। কাদতে কাদতে বলে

আমাকে এতো বড় শাস্তি কেনো দিলি? কেনো আমাকে ছেড়ে গেলি বাবুই? কি দোষ ছিলো আমার?

পাশেই শেহরীনের কবর। মেহরুবার কান্না যেনো সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। প্রশান্তি নিয়ে খিলখিল করে হাসছে। মেহরুবার কান্নার ব্যঙ্গ করছে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে বলছে,

‘আমারও তো কোনো দোষ ছিলো না মেহরুবা বু। তুমি, তোমরা চাইলেই হয়তো আমি আর কিছু দিন পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে পারতাম। সেটা আর হতে দিলে কই!
দেখো না আমার ছোট্ট সাফওয়ান কত সুন্দর ভাবে আমার পাশে শুয়ে আছে। তার ছোটো মাকে সে ছেড়ে যায় নি। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে আমাকে। অথচ তোমার আজ কিছুই নেই। তুমি আজ শূন্য। নিঃস্ব। বিধ্বস্ত পৃথিবীর এক জীবন্ত লাশ। এটা তো হওয়ার ই ছিলো, তাই না?

_______সমাপ্ত ______